দুই
পাথরটা একটু উঁচু। উঠতে কষ্ট হয় কিন্তু ওপরে উঠে এলে মনে হয় পৃথিবীটা আমার। পাথরের ওপরটা মসৃণ, দুটো মানুষ পাশাপাশি শুয়ে থাকতে পারে। আর একবার চিত হয়ে শুয়ে পড়লে আকাশটা নেমে আসে অনেক নীচে। তার নীলে ডানা মেলা চিলগুলোর পেট পরিষ্কার দেখা যায়। পাখিগুলোর কোনও ব্যস্ততা নেই। অলসভঙ্গিতে সাঁতার কেটে যাচ্ছে অথৈ নীলে। একটু পাশ ফিরলেই টিমলিং পাহাড়টাকে স্পষ্ট দেখা যাবে। সন্তান পাশ ফিরল। ঘন জঙ্গলে মোড়া পাহাড়ের শরীর। মাথাটা খাপছাড়া ভাবে শূন্যে উঠে গেছে। ওই পাহাড় নিয়ে কত গল্প ছড়িয়ে আছে। কালীচরণ বিশ্বাস করে গল্পগুলো।
নতুন স্কুলে গিয়ে তার রেজাল্ট ভালো হয়েছে। ফাস্ট টার্মের রেজাল্ট দেখে বনবিহারী পর্যন্ত বলেছেন, ‘গুড। কিন্তু পরের বার বেটার করতে হবে।’
সে হেসে বলেছিল, ‘তার পরের বার বেস্ট?’
‘সেটাই তো লক্ষ্য হওয়া উচিত।’
‘আমার একটা কথা খুব মনে হয়!’
‘বলে ফ্যালো।’
‘একই ইতিহাস, ভূগোল বই থেকে মুখস্থ করে আমরা সবাই পরীক্ষার খাতায় লিখছি। যার ভালো মনে থাকছে সে বেশি নম্বর পাচ্ছে, যার সেরকম থাকছে না সে কম পাচ্ছে। তাহলে পরীক্ষাটা হল স্মরণশক্তির ক্ষমতার, ওই বিষয়ের নয়!’
ছেলেটির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন বনবিহারী। ওর বয়সে এমন চিন্তা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তবু উত্তর দিতে হয় বলেই বলেছিলেন, ‘এটাই যখন সিস্টেম তখন তোমাদের মেনে চলতে হবে। নিয়মটা তো একদিনে চালু হয়নি। তোমার আগেও বছরের পর বছর ধরে ছাত্রছাত্রীরা এই পদ্ধতিতেই পড়াশুনা করেছে।’
টিমলিং পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটু ঘুম ঘুম ভাব চলে আসছিল। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। হঠাৎ চিৎকার কানে এল, ‘খোকন! খোকন!’
ধড়মড়িয়ে উঠে বসল সে। কালীচরণ খুঁজতে এসেছে। কোনও দরকার নেই তবু একটু চোখের আড়াল হলেই এই টিলার কাছে চলে এসে হাঁকাহাঁকি করবেই। সে পাথরের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল, ‘কী হয়েছে?’
‘আরে ব্বাপ! তুমি এই অত উঁচুতে উঠে গিয়েছ? বাবু জানলে খুব রেগে যাবে। নীচে নেমে এসো।’ কালীচরণ ভয়ার্ত গলায় বলল।
‘নামতে পারছি না!’
‘নামতে পারছি না মানে? উঠলে কী করে?’
‘ওঠার সময় বুঝতে পারিনি। তুমি এসে নামিয়ে নিয়ে যাও।’
‘সর্বনাশ! এখন কী হবে? লম্বা মই ছাড়া নামানো যাবে না যে।’
‘বেশ তো। একটা লম্বা মই নিয়ে এসো।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি যতক্ষণ না ফিরছি ততক্ষণ তুমি ওখানেই বসে থাকো। নামার চেষ্টা কোরো না।’ বলেই কালীচরণ দৌড়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। খুব মজা পেল সে। তারপর পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে নীচে নেমে এল স্বচ্ছন্দে। কালীচরণ তাকে খুব ভালোবাসে। খোকন নামটা ওরই দেওয়া। বনবিহারী ভুলেও তাকে খোকন বলে ডাকেন না। প্রয়োজন হলে গলা তুলে বলেন, সন্তান!
এখানকার স্কুলে পড়ার সময় তার নাম নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। সহপাঠীরা ডাকত সনু বলে, শিক্ষকরাও কেউ সন্তু কেউ বা সনু। কিন্তু বোর্ডিং স্কুলে গিয়ে প্রথম দিনেই ক্লাসটিচার প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নাম সন্তান?’
সে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়েছিল, ‘হ্যাঁ।’
‘কে রেখেছেন নামটা?’
‘আমার দাদু।’
‘আশ্চর্য! তিনি আর কোনও নাম খুঁজে পেলেন না!’ তারপর অন্য ছেলেদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোমরা কেউ কখনও কারও ভালো নাম মা অথবা বাবা, শুনেছ?’
সঙ্গে সঙ্গে হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে গেল ক্লাসঘরে।
ক্লাসটিচার বললেন, ‘ভাই বা বোন কারও ডাকনাম হতে পারে, আদর করে কেউ কেউ ডাকতেই পারে কিন্তু তোমরা ভাবো, কেউ যদি কোনও পাবলিক ফাংশনে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলে আমার নাম জ্যেঠা চক্রবর্তী তখন কী প্রতিক্রিয়া হবে?’
আবার হাসি, টেবিলে তবলার আওয়াজ কিছুক্ষণ ধরে চলল।
ক্লাসটিচার বললেন, ‘বসো।’
‘আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ বইতে যে দেশপ্রেমিক দলের কথা তিনি বলেছেন তার নাম ‘সন্তানদল’। নামটা তো বঙ্কিমচন্দ্র রেখেছিলেন। তাঁকে তো ‘সাহিত্যসম্রাট’ বলা হয়ে থাকে।’ সে মানুষটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল।
ক্লাসটিচারের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল তিনি এরকম কথা আশা করেননি। তাঁর মুখে নীরবে অনেকরকম ভাব ফুটে উঠছিল। ক্লাসের ছেলেরা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। শেষ পর্যন্ত ক্লাসটিচার মুখ খুললেন, ‘তুমি আনন্দমঠ পড়েছ?
মাথা নেড়েছিল সন্তান, ‘হ্যাঁ। দাদু পড়তে বলেছিলেন।’
ক্লাসটিচার আর কিছু বলেননি। কিন্তু পরের ক্লাসগুলোয় যেসব টিচার এসেছেন তাঁরা প্রথমেই জানতে চেয়েছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সন্তান কার নাম?’
সে উঠে দাঁড়িয়েছিল। ভালো করে দেখে নিয়ে টিচার বলেছিলেন, ‘বসো।’
দূর থেকেই দেখতে পেল সে। কালীচরণ এবং আর একজন লোক একটা লম্বা কাঠের মই বয়ে নিয়ে দ্রুত আসার চেষ্টা করছে। একবার ভাবল সে, আড়ালে চলে যাবে। টিলাতে তাকে না পেয়ে খুব ঘাবড়ে যাবে কালীচরণ। কিন্তু ভাবনাটা কাজ করার আগেই কালীচরণ তাকে দেখতে পেয়ে গেল। মইটাকে রাস্তার ওপর রেখে প্রায় দৌড়ে এল কাছে, ‘তুমি একা একা নেমে এসেছ?’
‘দেখতেই তো পাচ্ছ!’ সে হাসল।
‘কী ডাকাত ছেলে রে বাবা! যদি পড়ে গিয়ে মাথা ভাঙত?’
‘তাহলে দাদুর কাছে নিয়ে যেতে।’
‘আমি, আমি এই কথাটা তাঁকে বলব। একা মই নিয়ে আসতে পারব না বলে ওই লোকটাকে পাঁচ টাকা দিয়ে ভাড়া করেছি। কে দেবে টাকা?’
‘যে ভাড়া করেছে সে দেবে। আমি কি বলেছিলাম লোক ভাড়া করতে?’
কালীচরণ আর দাঁড়াল না। গম্ভীর মুখে মই নিয়ে লোকটার সঙ্গে ফিরে গেল।
বাঁ-দিকের জঙ্গুলে পথটা ধরে খানিকটা হাঁটলেই পিচের রাস্তা পাওয়া যায়। নীচ থেকে ওই রাস্তা ধরেই বাস বা টাক যাতায়াত করে। সে পিচের রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াল। মাঝে মাঝেই হুসহাস শব্দে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে।
‘অ্যাই সনু!’
চিৎকারটা কানে আসতেই মুখ ফিরিয়ে সাইকেল দুটোকে দেখতে পেল সে। বছরদুয়েক আগে ওরা তার সহপাঠী ছিল। সে বোর্ডিং স্কুলে চলে গেলেও ওরা এখানকার স্কুলেই পড়ছে। দুটো সাইকেলে চারজন ওর সামনে এসে থামল।
মৃণাল বলল, ‘তোর ব্যাপার কী বল তো? নামি স্কুলে পড়ছিস বলে আমাদের ত্যাগ করেছিস?’
‘ভ্যাট। বাজে কথা বলিস না।’
‘বাজে কথা? তুই যে এসেছিস তা আমরা জানিই না। চৌমাথার দিকে একবারও গিয়েছিস? তুই তো আগে এরকম ছিলি না।’ নিতাই বলল।
‘ঠিক আছে, মানছি অন্যায় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তোরা কোথায় যাচ্ছিস?’
ভোম্বল বলল, ‘সিগারেট খেতে।’
‘অ্যাঁ?’ অবাক হয়ে গেল সে।
‘চমকাবার কিছু নেই। আমরা রোজ একটা সিগারেট চারজনে খাই।’
‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।’
‘তাহলে বিক্রি হয় কেন?’ মৃণাল জিজ্ঞাসা করল।
‘যে কোম্পানিগুলো সিগারেট তৈরি করে তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে কেন?’ চঞ্চল বলল, ‘কোটি কোটি টাকা সরকার তাদের কাছ থেকে ট্যাক্স নেয় কেন?’
নিতাই বলল, ‘প্যাকেটে লেখা হচ্ছে টোবাকো কজেস ক্যানসার। সিগারেটের দোকানগুলো বন্ধ করে দিলে পাবলিক আর সিগারেট কিনে খেতে পারবে না, ক্যানসারও হবে না। ওসব জ্ঞান দিস না।’
‘এদিকে কেন এলি?’ সে জিজ্ঞাসা করল।
‘চেনা পাবলিক এদিকে আসবে না। জঙ্গল-টঙ্গল আছে। আড়াল পাওয়া যাবে। তুই শেয়ার করবি?’ নিতাই জিজ্ঞাসা করল।
‘নো।’
‘গুড বয়।’
সাইকেল দুটো পিচের রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের পথে ঢুকে গেল।
তার মনে হল ওদের কথায় যুক্তি আছে। সিগারেট খাওয়া যদি এত ভয়ংকর হয় তাহলে সরকার দোকানদারদের বিক্রি করা আটকাচ্ছে না কেন? এটা তো খুব অন্যায় কথা।
এই সময় বাসটা নীচের পথ ধরে ওপরে উঠে এল। বেশ ভিড় বাসে। কনডাক্টার চেঁচাচ্ছে জায়গায় নাম ধরে। বাস চলে গেলে সে দেখতে পেল
কয়েকজন দেহাতি মানুষের সঙ্গে এক মধ্যবয়সি মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। মানুষটির পরনে পাজামা এবং হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি, দুটোই বেশ ময়লাটে। এক হাতে ব্যাগ অন্যহাতে সতরঞ্চিতে জড়ানো বেডিং গোছের কিছু। মানুষটি এপাশ-ওপাশে তাকাচ্ছিলেন। তারপর দেহাতি মানুষদের কিছু জিজ্ঞাসা করলে তাদের একজন হাত তুলে বাসটা যেদিকে চলে গেল সেদিকটা দেখিয়ে দিয়ে পেছনের জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে পড়ল।
সে দেখল মানুষটি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একা একাই হাসছেন। তার মনে হল মানুষটি যদি পাগল না হয় তাহলে নিশ্চয়ই বেশ মজার লোক হবে। সে আর একটু এগিয়ে যেতেই মানুষটির নজরে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হাত নেড়ে তিনি ডাকলেন।
কাছে এগিয়ে যেতেই মানুষটি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই জায়গা তোমার সাম্রাজ্য?’
অর্থ বুঝতে না পেরে তার চোখ ছোট হল।
হেসে ফেললেন তিনি, ‘বোঝাতে পারিনি, এ আমারই অক্ষমতা। তুমি কি এখানেই থাকো? এই জঙ্গুলে এলাকায়?’
‘আর একটু ওপাশে। কেন?’
‘বাসের কনডাক্টার এমন গলায় চেঁচাল যে ঝটপট নেমে পড়েছি, ভাবলাম এসেই গিয়েছি। আসলে আমার নামা উচিত ছিল শহরের মাঝখানে।’
হেসে ফেলল সে। জিজ্ঞাসা করল, ‘ঘুমাচ্ছিলেন?’
‘একদম ঠিক। ঘুমের ঘোরে ওর চিৎকার শুনে দুদ্দাড় করে নেমে পড়েছি। আচ্ছা, শহর এখান থেকে খুব দূর কি?’
মাথা নাড়ল সে, ‘হেঁটে গেলে কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে পৌঁছে যাবেন।’
‘বাব্বা। পরের বাসেই না হয় যাব।’
‘খুব দেরি করে বাস আসে। দুই-আড়াই ঘণ্টা পরপর।’
‘তাহলে তো সমস্যায় পড়লাম। তুমি কি এখানকার স্কুলে পড়ো?’
‘পড়তাম, এখন পড়ি না।’
‘সেকী! পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছ?’
হেসে ফেলল সে, ‘না। নীচের বড় স্কুলে ভরতি হয়েছি। বোর্ডিং স্কুল। এখন ছুটি বলে বাড়িতে এসেছি।’
‘তাই বলো। তোমার বাড়ি এদিকে?’
‘হ্যাঁ। চলুন, ওখান থেকে রিকশা পেয়ে যাবেন।’
‘গুড। চলো।’
হাঁটা শুরু করেই মানুষটি বলল, ‘জায়গাটা বেশ ভালো।’
‘গরমকাল আর শীতকালে এলে এ কথা বলতেন না।’
‘কেন?’
‘এত গরম আর এত ঠান্ডা যে কেউ ঘরের বাইরে যায় না।’ সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি এখানে কার কাছে এসেছেন?’
‘ঠিক কারও কাছে আসিনি। এখানকার স্কুলের হেডমাস্টারমশাই আর সেক্রেটারির সঙ্গে প্রথমে দেখা করব। অনেক অপেক্ষা করার পরে শেষ পর্যন্ত আমি যে চাকরিটা পেয়েছি তা করতে হবে এখানকার স্কুলে।’
‘ও, আপনি টিচার?’ সে ভালো করে তাকাল। নিশ্চয়ই অনেক দূর থেকে আসছেন তাই পোশাক ময়লা হয়ে গেছে। তার মনে পড়ল এখানকার স্কুলের সেক্রেটারি নোংরা বা ময়লা পোশাক একদম পছন্দ করেন না। মাঝে মাঝেই স্কুলের প্রেয়ারে গিয়ে হাজির হয়ে দেখেন, ছেলেমেয়েরা তো বটেই টিচাররা পরিষ্কার জামাকাপড় পরে এসেছেন কিনা। মানুষটাকে কথাটা বলা দরকার।
‘তোমার নাম জানা হয়নি। আমার নাম সুজয় সেনগুপ্ত।’
নিজের নাম বলল সে। শুনেই দাঁড়িয়ে গেল মানুষটা, ‘এই নাম কে রেখেছে?’
‘আমার দাদু।’
‘আচ্ছা! তিনি জীবিত আছেন?’
‘হ্যাঁ। এখনও ডাক্তারি করেন।’
‘ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে হচ্ছে।’
‘আপনি চৌমাথায় গিয়ে যাকে বলবেন সেই ডাক্তার বনবিহারীর চেম্বার দেখিয়ে দেবে।’ বলেই সে হাত বাড়াল, ‘আপনার ব্যাগটা আমাকে দেবেন?’
‘কোন দুঃখে?’
‘মানে?’
‘তোমাকে আমি চিনি না জানি না। অচেনা জায়গা। ব্যাগটা নিয়ে যদি তুমি সটকে পড়ো তাহলে তো আমি বিপদে পড়ব।’
‘আমি সেরকম ছেলে নই।’
‘তা হবে। কিন্তু এই দুটো বোঝা বইতে আমার কষ্ট হচ্ছে না।’
এই সময় পেছনে সাইকেলের ঘণ্টা বাজল। সে দেখল ওরা ফিরে আসছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভোম্বল বলে গেল, ‘গুডি বয়।’
ওরা চলে গেলে সুজয় জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার বন্ধু?’
‘আমরা একসঙ্গে পড়তাম।’
‘মনে হচ্ছে ওরা ঠাট্টা করে তোমায় গুডি বয় বলল।’
‘হুঁ। ওরা সিগারেট খেতে গিয়েছিল। আমি রাজি হইনি, তাই।’
‘তাহলে তুমি ওই জঙ্গলে একা একা কী করছিলে?’
‘একা পাথরের ওপর শুয়ে আকাশ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।’
‘ভয় পাও না?’
‘কীসের ভয়! ভয় করলেই ভয়, নইলে কিছুই নয়।’
‘শুধু আকাশ দ্যাখো?’
‘না। ওই টিমলিং পাহাড়টাকেও দেখি।’
‘ওই পাহাড়ের নাম টিমলিং?’
‘খোকন!’ চিৎকারটা ভেসে এল। সে দেখল বাড়ির সামনে কোমরে হাত রেখে কালীচরণ দাঁড়িয়ে আছে।
সে জানতে চাইল, ‘কী বলছ?’
‘এবার দয়া করে বাড়িতে চলে এসো।’
‘তোমার ডাকনাম খোকন?’ সুজয় জিজ্ঞাসা করল।
‘শুধু কালীচরণদা ওই নামে ডাকে। একটা কথা বলব?’
সুজয় তাকাল। সে বলল, ‘আপনি আমাদের বাড়িতে গিয়ে পোশাক পালটে নিন।’
নিজের পাজামা-পাঞ্জাবিটির দিকে তাকাল সুজয়। একটু বিব্রত হয়ে বলল, ‘খুব ময়লা হয়ে গেছে, তাই তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিছু হবে না। ওদের সঙ্গে দেখা করে থাকার জায়গা পেয়ে গেলে স্নান করার সময় বদলে নেব। আমার তো আর একজোড়া পাঞ্জাবি-পাজামা আছে। এ দুটো কেচে শুকোতে না দিলে সমস্যা হয়ে যাবে।’ সুজয় হাসল।
‘স্কুলের সেক্রেটারি ময়লা জামা একদম পছন্দ করেন না। খুব রেগে যান।’
‘বলছ?’
‘হ্যাঁ। আসুন।’
কালীচরণ অবাক হয়ে দেখল ছেলেটা একজন অচেনা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আসছে। পাজামা-পাঞ্জাবির হাল দেখে তার মনে হল লোকটা এক ধরনের ভবঘুরে। অবশ্য ভবঘুরেদের সঙ্গে ব্যাগ-বেডিং থাকে না।
সামনে এসে সে বলল, ‘ইনি এখানকার স্কুলে মাস্টারমশাইয়ের চাকরি পেয়ে এসেছেন। দূর থেকে আসতে হয়েছে বলে জামাকাপড় ময়লা হয়ে গেছে। ওগুলো ছেড়ে ভালো জামাকাপড় পরে না নিলে সেক্রেটারি হয়তো চাকরি করতে দেবেনই না। আসুন আপনি!’
‘ইনি?’ সুজয় কালীচরণের দিকে তাকাল। কালীচরণ তখন গভীর সংশয়ে।
কালীচরণদাদা এ-বাড়ির সব। দাদুও ওঁকে কিছু বলেন না।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। বাইরের ঘরে গিয়ে যা করবার করে নিন।’ বেশ বিরক্ত হয়ে কথাগুলো বলল কালীচরণ।
সুজয় মাথা নেড়ে বাইরের ঘরে ঢুকে গেলে সে চাপা গলায় বলল, ‘তুমি ওভাবে বললে কেন?’
‘কেন বলব না? চিনি না জানি না একটা উটকো লোককে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এলে। কতরকম বদমতলব থাকতে পারে লোকটার।’ কালীচরণ বলল।
‘তোমার মন ভালো না বলে সবাইকে খারাপ ভাবো।’
‘অ। এখন যদি আমি ওকে চা-বিস্কুট দিই তাহলে খুশি হবে?’
‘নিশ্চয়ই। অতিথিদের তো তাই দেওয়া উচিত।’
‘বেশ দিচ্ছি।’
আধঘণ্টা বাদে সুজয় যখন পরিপাটি হয়ে বের হল তখন তার চেহারা বদলে গিয়েছে। ইতিমধ্যে তার ময়লা পাজামা-পাঞ্জাবি কেচে নিয়েছে। কালীচরণ শুধু চা-বিস্কুট দেয়নি, ভেজা পোশাক নেওয়ার জন্যে একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগও দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাস্তা থেকে রিকশা ডেকে আনল নিজে থেকেই। রিকশায় বসে সুজয় বলল, ‘সন্তান, খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে।’
রিকশা চলে গেলে সে কালীচরণের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ‘তুমি আর খোকন বলবে না।’
কালীচরণ অবাক, ‘কেন?’
‘লক্ষ লক্ষ ছেলের নাম খোকন, কিন্তু সন্তান শুধু আমারই নাম। তাই।’ বলে ভেতরে চলে গেল সে।