তেইশ
সময় বেশি নেই। জিনিসপত্র সমেত নীচের শহরে নেমে স্টেশনে যেতে হবে। সেখান থেকে রাত আটটার ট্রেন ধরতে হবে। বনবিহারী কালীচরণকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নাও, আমরা চারটের মধ্যে বেরিয়ে পড়ব।’
কালীচরণ জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছেন, ঠিক করেছেন?’
বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘হু!’
কিন্তু নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না তিনি। কোনও তীর্থক্ষেত্রে গিয়ে বসে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না। সেখানে নিত্য মানুষের যাতায়াত, পরিচিত মুখের সামনে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তাহলেই প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে, ‘আপনি এখানে?’ তারচেয়ে বাঙালিরা যেখানে সচরাচর যায় না সেখানেই যাওয়া উচিত। বেশ কয়েকটা শহরের কথা মনে আসছে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না বনবিহারী। তা ছাড়া যাব বললেই কি যাওয়া যাবে? নীচের স্টেশনে গিয়ে কোন ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাবে তার ওপর নির্ভর করছে সব।
বনবিহারী এটাও বুঝতে পারছিলেন না যেখানে যাচ্ছেন সেখানে কতদিনের জন্যে যাবেন! এর জন্যে পর্যাপ্ত টাকা সঙ্গে রাখা দরকার। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া পাগলামো হবে। দিনকালের যা অবস্থা সেই টাকা একটা ছুরি দেখালেই হাতছাড়া হয়ে যাবে।
বনবিহারী আবার কালীচরণকে তাড়া দিয়ে বাড়ি থেকে বের হলেন। বাজারের প্রান্তে পাশাপাশি দুটো ব্যাঙ্ক। অনুরোধে তাকে দুই ব্যাঙ্কেই টাকা রাখতে হয়েছে। প্রথমটির ম্যানেজারের ঘরে সরাসরি ঢুকে পড়লেন তিনি। টেলিফোনে কথা বলছিলেন ভদ্রলোক, ইশারায় বসতে বললেন। তারপর ওপাশের কিছু কথা চুপচাপ শোনার পর বললো, ‘না স্যার, এখানে ডাকাতির কোনও সম্ভাবনাই নেই। যদি কেউ ডাকাতি করতে আসে, এমন ব্যবস্থা করে রেখেছি, আর ফিরে যাবে না, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, ঠিক আছে।’ রিসিভার নামিয়ে ম্যানেজার বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন।’
‘বলছি। তার আগে বলুন, ডাকাতির কথা কী বলছিলেন?’
ম্যানেজার হাসলেন, ‘হেড অফিস থেকে ফোন করেছিল। তাঁদের কাছে পুলিশ জানিয়েছে যে উগ্রপন্থীরা নাকি মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা ব্যাঙ্কে ডাকাতি করে টাকা নিয়ে যাবে। আর কোথাও কী হবে জানি না এই ব্যাঙ্কে সেটা সম্ভব নয়। দরজায় পাঁচটি ট্যাপ পাতা আছে, ধরা পড়ে যাবেই। বলুন।’
বনবিহারী বললেন, ‘আমি বেশ কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি, যা সব ঘটছে। পকেটে টাকা নিয়ে ঘুরতে চাই না। আমাকে কিছু টাভেলার্স চেক তৈরি করে দিন।’
‘কোথায় যাবেন?’
‘পুরো ভারতবর্ষই ঘুরব।’
‘কতদিনের জন্যে?’
বনবিহারী হাসলেন, ‘তেমন কোনও হিসেব করে যাচ্ছি না।’
‘সেকী! তাহলে আমাদের কী হবে? আপনি না থাকলে সবাইকে নীচের শহরের ডাক্তারের কাছে ছুটতে হবে!’ হাসলেন ম্যানেজার। ‘তবে অনেকদিন তো বের হননি, যান, ঘুরে আসুন। কিন্তু তার জন্যে ট্যাভেলার্স চেক নিয়ে যেতে হবে না।’
‘তাহলে—?’ বনবিহারী বুঝতে পারলেন না।
‘আপনার চেক বইটা সঙ্গে থাকলেই হবে।’ আমাদের ব্যাঙ্কগুলোর মধ্যে কম্পিউটারের মাধ্যমে যোগাযোগ তৈরি হয়ে যাওয়ায় আপনি আমার এই ব্যাঙ্কের চেকবইয়ের পাতা জমা দিয়ে ভারতবর্ষের যে-কোনও ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে পারেন। আমাদের পাশের বাড়ির ব্যাঙ্ক কিন্তু এখনও অত আধুনিক নয়।’ ম্যানেজার বেশ গর্বিত হাসি হাসলেন।
কিছু টাকা তুলে বাড়ি ফেরার পথে শশী ড্রাইভারকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন বনবিহারী। সেটা দেখে শশী ড্রাইভার এগিয়ে এসে বলল, ‘নমস্কার ডাক্তারবাবু, আপনাকে খবরটা দেওয়া হয়নি, ছেলেটা এখন একদম ভালো হয়ে গিয়েছে। স্কুলে যাচ্ছে।’
‘এটা সবাই করে। অসুখ হলে ছুটে আসে, সেরে গেলে খবরটা দেওয়ার কথা ভুলে যায়! কিন্তু সেরে যাওয়ার পরেও যে ক’দিন ওষুধপত্র খেতে হয় তার খবর রাখো না।’ বিরক্ত গলায় বললেন তিনি।
‘ভুল হয়ে গিয়েছে ডাক্তারবাবু।’ মাথা নীচু করল শশী ড্রাইভার।
‘যাক গে, আমার একটা গাড়ি দরকার। চারটের সময় নীচে যাব।’
‘চারটের সময়! ঠিক আছে। যান আপনি।’
‘একটু খোঁজ নিয়ে দ্যাখো না কে যেতে পারবে?’
‘আপনি চাইলে সবাই গাড়ি দেবে।’ শশী হাসল, ‘আমি যাব।’
‘কত নেবে?’
‘আঃ। এ নিয়ে ভাববেন না। আমি কি আপনার কাছ থেকে বেশি নেব?’
‘সময়টা খেয়াল রেখো।’ বনবিহারী বাড়ির পথ ধরলেন।
দরজা খুলল কালীচরণ। বসার ঘরে ঢুকে বনবিহারীর চোখ কপালে, ‘একী! এ কী করেছ তুমি?’
বনবিহারীর সামনে চারটে সুটকেস এবং দুটো ট্যাংক জিনিসপত্রে ভরতি। কালীচরণ বলল, ‘এতে হচ্ছে না। ভাবছি বাকিগুলো পোঁটলা করে নেব।’
‘কেন?’
‘কতদিনের জন্যে যাচ্ছি তা তো জানি না। বেশিদিন থাকলে এসব দিয়ে হবে না। কম পড়ে যাবে।’ কালীচরণ বলল।
‘আঃ। তিনটের বেশি সুটকেস করবে না।’
‘সেকী! বাকি সব এখানে থেকে যাবে?’
‘হ্যাঁ।’ বেশ জোর দিয়ে বলল বনবিহারী।
‘নির্ঘাত চুরি হয়ে যাবে।’
‘হোক। তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। তোমার যা নেওয়ার তা নিয়ে নাও। তার জামাকাপড় তো বেশি নেই, যা আছে তার সবগুলোই নেবে, ফেলে রেখে যাবে না।’ কথাগুলো বলামাত্র হাসির শব্দ কানে এল। মুখ ঘুরিয়ে বনবিহারী দেখলেন ওপাশের দরজায় দাঁড়িয়ে মামণি হাসছে।
চোখাচোখি হতেই দুটো হাত মাথায় একবার তুলে উচ্চতা দেখিয়ে বাক্সগুলোর দিকে আঙুল নামাল। কালীচরণ রেগে গিয়ে ধমক দিল, ‘অ্যাই চুপ! আমার সঙ্গে ঠাট্টা হচ্ছে? কথা বলতে না পারলে মজা করে কীভাবে!’
বনবিহারী নিজের ঘরে চলে এলেন। চেয়ারে বসে মনে হল এই যে যাচ্ছেন এটা বেড়াতে যাওয়া নয়। স্রেফ ভয়ে পালিয়ে যাওয়া। অনেক বছর আগে মামণির জন্যে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। আবার এই বাড়ি ছেড়ে গিয়ে কবে ফিরে আসতে পারবেন তা তাঁর নিজেরই জানা নেই। অথচ মামণি অথবা সন্তান তাঁর কোনও নিকট আত্মীয় নয়। তাহলে কেন ওদের দায় তাঁকে বহন করতে হবে?
প্রশ্নটির উত্তর তাঁর নিজেরও জানা নেই। কিন্তু যেতে হবে। কোথায় যাবেন?
গোড়ার দিকে মনে হয়েছিল হরিদ্বার-ঋষিকেশ অঞ্চলে গেলে ভালো থাকবেন। বেশি খরচ নয়, অল্প পয়সায় থাকার জায়গাও পাওয়া যাবে। কিন্তু ওসব জায়গায় বাঙালিদের ভিড় লেগেই রয়েছে। কোনও পাহাড়ি অঞ্চলে গেলেও তো একই কথা। হঠাৎ মনে হল, বাঙালিরা এককালে যেসব জায়গায় যেত, এখন আর যায় না, সেদিকে গেলে কেমন হয়। ছেলেবেলায় শুনেছেন পুজো বা শীতের ছুটি কাটাতে লোকে বলত, পশ্চিমে যাচ্ছি হাওয়া বদল করতে। সেই পশ্চিম ছিল দেওঘর, মধুপুর, শিমুলতলা, গিরিডি এবং ঘাটশিলা। কৈশোরে একবার বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘাটশিলাতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানকার জলে নাকি শরীর ভালো হয়ে যায়। একটা মিষ্টির দোকানের কথা মনে আছে। যেমন সাইজে বড় তেমন সুস্বাদু। বাবা বলতেন, দামও খুব সস্তা। এখন কাউকে ঘাটশিলায় যাচ্ছি বলতে শোনেন না। অনেক পেশেন্টকে সুস্থ হওয়ার পর বাইরে কিছুদিন হাওয়া বদলে আসতে বললে শুনেছেন, ‘তাহলে সিমলা বা মুসৌরি থেকে ঘুরে আসি ডাক্তারবাবু।’ আজ বনবিহারী স্থির করলেন, রাতের ট্রেন ধরে শিয়ালদায় নেমে ঘাটশিলায় যাবেন। সেখানকার হোটেলে দুদিন থাকলে নিশ্চয়ই দিন পনেরো-কুড়ির মধ্যে একটা বাড়ি ভাড়া পেয়ে যাবেন। এইরকম ভাবনার পর তাঁর মনে স্বস্তি এল।
খাওয়াদাওয়ার পর কালীচরণ যখন সব গোছগাছ করে নিচ্ছে তখন মামণির সামনে গিয়ে দাঁড়লেন বনবিহারী! সে তখন টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার ভরে নিচ্ছে। বনবিহারী জিজ্ঞসা করলেন, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছ, কিন্তু আবার বলছি, তোমার মা কোথায় আছেন জানি না, জানা থাকলে তুমি তাঁর কাছে চলে যাও।’
শক্ত হয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর মামণি মাথা নেড়ে না বলল।
‘কোথায় আছেন তা জানো?’
মাথা নাড়ল দ্রুত, না।
‘আশ্চর্য! তিনি যদি হঠাৎ চলে আসেন তাহলে—!’
মাথা দুলল দুপাশে যার অর্থ আসবে না।
‘তোমার ওই জগতে এখনও কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে?’