কাঠকয়লার আগুন – ২১

একুশ

রোদ উঠলে বনবিহারী সন্তানকে দেখতে গেলেন। শুয়েছিল সন্তান, চোখ খোলা। কপালে আঙুল রাখলেন, নাড়ি দেখলেন। উঠে দাঁড়াতেই দেখলেন কালীচরণ দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার এপাশে। তাকে বললেন, ‘এসো।’

নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে ওষুধের বাক্স খুলে তিনটে ট্যাবলেট বের করে টেবিলে রাখলেন, ‘ওকে বাথরুমে যাওয়া ছাড়া উঠতে একদম নিষেধ করবে। আট ঘণ্টা পর পর এই ওষুধগুলো খাওয়াবে। খালি পেটে নয়। খাবার খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়াবে। আর হ্যাঁ, কড়া নজর রাখবে ওর ওপর, যেন পালাতে না পারে।’

কালীচরণ এগিয়ে এসে ওষুধগুলো নিয়ে বলল, ‘ওর সঙ্গে একটাও কথা বললেন না–!’

‘যা বললাম, তাই করো।’ বনবিহারী বললেন, ‘আমাকে চা দাও, বেরুব।’

এখন সকাল। ফিনফিনে রোদ উঠেছে পৃথিবীতে। বড় মায়াময় লাগে চারধার। রাস্তায় অল্পস্বল্প মানুষ, হাতে বাজারের ব্যাগ, যাদের রোদ দেখার সময় নেই। বনবিহারী হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত একটা রিকশা পেয়ে গেলেন।

রিকশায় উঠতেই রিকশাওয়ালা বলল, ‘মেয়েটার ভালো জায়গায় বিয়ে হয়ে গেল ডাক্তারবাবু।’

‘মেয়ে?’

‘আমার মেয়ে। আপনার মনে নেই। মুখে কালো কালো দাগ ছিল বলে বিয়ে হচ্ছিল না, আপনি সারিয়ে দিয়েছিলেন।’

ঝাপসা মনে পড়ল। হাসলেন বনবিহারী, ‘বাঃ, ভালো খবর।’

‘জামাইয়ের মা-বাবা খুব ভালো মানুষ।’ প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে রিকশাওয়ালা বলল, ‘জমিজমা প্রচুর। কোনওদিন ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না মেয়ের।’

মানুষ তৃপ্ত হলে উদার হয়। থানার সামনে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে গেলে সে বলল, ‘আমি আপনার জন্যে দাঁড়াচ্ছি, এখান থেকে ফিরে গিয়ে ভাড়া দেবেন।’

সকালবেলার থানার ভেতরটা বিকেলবেলায় বাজারের চেহারা নেয়। টেবিলগুলো ফাঁকা, একজন সেপাই কুম্ভ হয়ে পাহারা দিচ্ছে। বনবিহারীকে চিনতে পেরে বলল, ‘আপনি এই অসময়ে?’

বনবিহারী বললেন, ‘এখন অসময় নাকি!’

‘আজ্ঞে, সাতসকালে তো থানার কাজ শুরু হয় না। কাল সাহেবরা অনেক রাত্রে ফিরেছেন। সার্চে গিয়েছেন কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। বসুন, বসুন আপনি।’ একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে সেপাইটি বলল, ‘আমার ওয়াইফকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছি ডাক্তারবাবু।’

বনবিহারী তাকালেন। এরকম কথায় তিনি অভ্যস্ত। ডাক্তারকে নিজের জায়গায় দেখলেই মানুষের অসুখের কথা মনে পড়ে যায়।

‘পেটে বাতাস হচ্ছে খুব। সেই সঙ্গে অম্বল। বুক জ্বালা।’ সেপাইটি বলল।

‘কত বয়স?’

‘এই ধরুন, বত্রিশ।’

লোকটির দিকে তাকালেন বনবিহারী। মাথায় টাক, সাদা গোঁফ। পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে অনেকদিন। কুড়ি থেকে পঁচিশের ব্যবধান। সঙ্গে-সঙ্গে মামণির মুখ মনে পড়ল। মাথা নাড়লেন তিনি, ‘দুপুরের ভাত খায় কখন?’

‘তা কাজ শেষ করে খেতে তিনটে বেজে যায়। ছুঁই-ছুঁই বাতিক আছে তো।’

‘তাহলে ওষুধে কাজ দেবে না। অবস্থা আরও খারাপ হবে।’

‘খারাপ হবে?’ সেপাইটি বিড়বিড় করল।

‘সাড়ে বারোটার মধ্যে খেতে হবে। সকাল ন’টায় এক বাটি মুড়ি চিনি জলে ভিজিয়ে খেতে বলবেন। দুপুরে লঙ্কা এবং মশলা যতটা না হয় ততটা। একটা কাগজ চাই—।’

সেপাই কাগজ এনে দিলে তাতে ওষুধের নাম লিখে বনবিহারী বললেন, ‘দারোগাবাবুর সঙ্গে কথা বলা দরকার।’

‘দাঁড়ান, আমি খবর দিচ্ছি। একটু রাগারাগি করবেন। কিন্তু আপনি যখন বলছেন—।’ সেপাইটি চোখের আড়ালে চলে গেল। বনবিহারীর মনে হল এখন এই মুহূর্তে যদি উগ্রপন্থীরা থানা দখল করতে চাইত তখন স্বচ্ছন্দে করতে পারত। অবশ্য করেও কী লাভ হত তাদের? মরণ তো সঙ্গে সঙ্গে থাবা বাড়াত।

মিনিট পনেরো পরে দারোগাবাবু এলেন। বুঝতে অসুবিধে হল না, বিছানা থেকে উঠে লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি চাপিয়ে এসেছেন।

বনবিহারী বললেন, ‘অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।’

‘তা তো বুঝলাম। বলুন!’

‘সন্তান ফিরে এসেছে।’

‘অ্যাঁ?’ চমকে উঠলেন দারোগাবাবু।

‘আপনি বলেছিলেন সে সারেন্ডার করলে তাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেবেন। থানা থেকে পালানো ছাড়া ওর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই।’ বনবিহারী মনে করিয়ে দিলেন।

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। ফিরল কী করে?’

‘খুব অসুস্থ হয়ে। জ্বরে প্রায় বেহুঁশ ছিল।’

‘সে কোথায়?’

‘বাড়িতে। ওষুধ দিয়েছি। ওঠার ক্ষমতা নেই।’

‘থানা থেকে পালিয়ে কোথায় গিয়েছিল?’

‘ওর অবস্থা যা তাতে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যাবে না বলে এখনই কিছু জানতে চাইনি। মনে হয় জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল।’

‘আপনি ওই আনন্দে থাকুন। প্রচণ্ড ধড়িবাজ ছেলে। আপনি কি জানেন সে নীচের থানা থেকে পালিয়ে বাসে চেপে ওপরে এসেছিল। কিছুক্ষণের জন্যে স্কুলের নতুন মাস্টারের ঘরে গিয়েছিল। নতুন মাস্টারের কাছে তেমন পাত্তা না পাওয়ায় জঙ্গল পেরিয়ে নদীর ওপারে চলে যায়। আপনি বলছেন এসব আপনি জানেন না?’ দারোগাবাবুর মুখের চেহারা এবার বদলে গেল।

‘কিছুটা জানি। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি।’

image19.jpg

‘মশাই, কাল রাত্রে খবর পেয়ে আমরা ছুটে যাই জঙ্গল পেরিয়ে নদীর ওপারে। আপনার নাতি হারু নামের একটা লোকের বাড়িতে ছিল। কিন্তু এমন ঘোড়েল ছেলে, আমরা পৌঁছানোর আগেই সে হাওয়া হয়ে যায়। হারু বলেছে সে জ্বরে বেহুঁশ ছিল, তাহলে হাওয়া হল কী করে? রাত্রে তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার দেখা পাইনি। উলটে আর একটু হলে বাইসনের পায়ের তলায় আমার ডেডবডি পড়ে থাকত। অতগুলো বাইসনকে আমি একসঙ্গে কখনও দেখিনি।’ দারোগাবাবু তাকালেন, ‘আপনি কী জেনেছিলেন?’

বনবিহারী সত্যি কথাই বলছেন। নতুন মাস্টারের সঙ্গে তাঁর আচমকা দেখা হয়ে গিয়েছিল। সন্তান যে নদীর ওপারে ওই হারু নামক লোকটির আশ্রয়ে আছে তা ওঁর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন।

দারোগাবাবু সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, ‘খবরটা সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানালেন না কেন?’

‘ওই যে বললাম, বিশ্বাস করিনি। সন্তানের স্বভাবই নয়, অচেনা মানুষের বাড়িতে যেচে গিয়ে থাকা। এতদিন এটাই জানতাম।’ বনবিহারী স্বীকার করলেন।

‘ভুল জানতেন। তখনই যদি আমাকে জানিয়ে দিতেন তাহলে ওদের হাতেনাতে ধরতে পারতাম। মাঝখানে রাত জেগে শরীর খারাপ করলাম।’ আপশোশ দারোগাবাবুর গলায়।

‘ওদের মানে? হারুকে পাননি?’

‘হারুর কথা কে বলেছে? সে তো গঞ্জে এসে গাবিয়ে বেরিয়েছিল বলেই কথাটা আমার কানে এসেছিল। সে আসার পথে মাস্টারকে দ্যাখে, তাকে সন্তানের কথা বলে। এটা আপনি সত্যিকথা বলেছেন, মাস্টার আপনাকে খবরটা জানায়। জানিয়ে তার যা জিনিসপত্র নিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। সন্ধের পরে যে বাসটা নীচের দিকে যায় তাতেই উঠে পালিয়েছে হারামজাদা। যখন খবর পেলাম তখন বাস নীচে গ্যারেজ হয়ে গিয়েছে। উঃ! নাকের ডগায় একটা উগ্রপন্থী ঘুরে বেড়াত অথচ আমি কী বোকা, টের পাইনি। হারুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে যখন মাস্টারের খোঁজে গেলাম তখন সে হাওয়া। ওর বাড়িওয়ালি তো ঘুম থেকে উঠে খবর শুনে হাউমাউ করে উঠল। পুরো ভাড়া না দিয়ে নাকি মাস্টার পালিয়ে গেছে। ইস, কী ভুল করলেন আপনি!’ দারোগাবাবু আপশোশে মাথা নাড়লেন।’

‘তাহলে এখন—।’ কথা শেষ করলেন না বনবিহারী।

‘গাড়ি পাঠাচ্ছি। ওকে তুলে নিয়ে আসব।’

‘কিন্তু ও যে খুব অসুস্থ!’

‘তার জন্যে হাসপাতাল আছে। সেখানে ভরতি করে দেব।’

‘কিন্তু ওর বিরুদ্ধে তো কোনও কেস নেই—!’

দারোগাবাবু উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু থানার সামনে রিকশাটা থামতে চুপ করে গেলেন। রিকশা থেকে নামছেন স্কুলের প্রেসিডেন্ট সাহেব। হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে এসে তিনি বললেন, ‘এসব কী শুনছি?’

‘সত্যি কথাই শুনেছেন।’ দারোগাবাবু বললেন।

‘নতুন মাস্টার উগ্রপন্থী?’ প্রেসিডেন্ট এখনও অবাক।

‘না হলে পালাবে কেন?’ দারোগাবাবু নির্লিপ্ত।

‘আমি ভাবতেই পারছি না। লোকটার সঙ্গে কালই কথা বললাম। আপনার সেকেন্ড অফিসার আমাকে বলেছিল ওর ওপর আপনাদের নজর আছে। কিন্তু কথা বলে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।’ প্রেসিডেন্ট বললেন।

‘কী? সেকেন্ড আপনাকে একথা বলেছিল? কী আশ্চর্য ব্যাপার! এভাবে সরকার চলে? আমি তার বস, আমাকে সে কিছু বলেনি, বলল আপনাকে। আমাকে টপকে কাজ দেখালে প্রমোশন পাবে এই ধান্দায় খবরটা আমার কাছে চেপে গিয়েছে।’ দারোগাবাবু ভেতরের দিকে তাকালেন, ‘অ্যাই, ড্রাইভারকে বল এখনই গাড়ি বের করতে। অ্যাকশনে যেতে হবে।’

প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’

‘ডাক্তারবাবুর বাড়ি থেকে বালক উগ্রপন্থীকে তুলে আনতে হবে। অবশ্য ইতিমধ্যে তিনি যদি বাড়ি থেকে হাওয়া না হয়ে যান।’ দারোগাবাবু বললেন।

‘আপনি কি ওকে নীচের থানায় পাঠিয়ে দেবেন?’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘অবশ্যই। ও ওদের আসামি।’

‘আসামি?’

‘পালিয়ে যাওয়াও তো একটা অপরাধ।’

‘তাহলে আপনারা নিশ্চয়ই ওকে কোর্টে তুলবেন। এখন পর্যন্ত ওই পালিয়ে যাওয়া ছাড়া সে কোনও অপরাধ করেনি। কোর্টকে সেকথা বলব আমরা।’ বনবিহারী বললেন।

‘ডাক্তারবাবু, একটা কথা বলি আপনাকে। আপনারা ভালো উকিল দিয়ে কোর্ট থেকে বেল করিয়ে আনলেন। দুদিন পরেই ও যে আবার পালিয়ে যাবে না তার কোনও গ্যারান্টি আছে? ওই দলের লোকেরাই ওকে হাতছানি দেবে। তখন কোর্ট চাইলে কাকে হাজির করাবেন? আমার কথা শুনুন। ওকে আমরা নিশ্চয়ই জেলে ঢোকাব না। কিন্তু সংশোধন স্কুলে ভরতি করিয়ে দেব। ওখানে কিছুদিন থাকলে ওর মাথা থেকে উগ্রপন্থী হওয়ার ভূতটা চলে যাবে।’ দারোগাবাবু বললেন।

প্রেসিডেন্ট সাহেব মাথা নাড়লেন, ‘উনি খুব ভালো কথা বলেছেন ডাক্তারবাবু। রিফর্মারি স্কুলে গেলে ওর পরিবর্তন আসতে বাধ্য।’

পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে। দারোগাবাবু বললেন, ‘আমি তো আপনাকে বলেছি, যান, কিছুদিন বাইরে থেকে ঘুরে আসুন। জলহাওয়ার পরিবর্তন হলে মনও হালকা হবে। কি বলেন প্রেসিডেন্ট সাহেব?’

‘উত্তম প্রস্তাব। পণ্ডিচেরী চলে যান। খুব ভালো লাগবে।’ প্রেসিডেন্ট বললেন।

‘আচ্ছা, চলি। আপনার বাড়িতে যাচ্ছি কিন্তু আপনাকে সঙ্গে নিতে চাই না। দেখলে লোকে বলবে ডাক্তারবাবু নাতিকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে। কটু কথা বলতে তো কিছু মানুষের মুখ সবসময় কুটকুট করে।’ দারোগাবাবু গাড়িতে উঠলেন দুজন সেপাইকে নিয়ে। গাড়ি বেরিয়ে গেল।

প্রেসিডেন্ট সাহেব বললেন, ‘আমি আপনার মনের কথা বুঝতে পারছি। মায়া, বুঝলেন, মায়া বড় যন্ত্রণা দেয়। দিন কুড়ি চেম্বার বন্ধ রেখে পণ্ডিচেরী ঘুরে আসুন।’

‘আপনারা যখন বলছেন, তখন—।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই যান।’

প্রেসিডেন্ট সাহেব রিকশায় বেরিয়ে গেলে বনবিহারী তাঁর রিকশার দিকে এগোলেন। রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, ‘বড়বাবু কোথায় গেলেন ডাক্তারবাবু?’

‘কেন জিজ্ঞাসা করছ?’

‘লুঙ্গি পরে ওঁকে বাইরে বেরুতে কখনও দেখিনি, তাই—।’

বনবিহারী কোনও কথা বললেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল এই পথ দিয়েই সন্তানকে নিয়ে দারোগাবাবু ফিরবেন। দৃশ্যটা তাঁর মোটেই ভালো লাগবে না। মোড়ের মাথায় এসে রিকশা থামিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিলেন তিনি। কোথায় যাওয়া যায়? দূর থেকে সদানন্দের হোটেল দেখতে পেয়ে সেদিকে পা বাড়ালেন।

হোটেলে এখনও আলস্যের ছাপ। একজন কর্মচারী তাঁকে দেখে দৌড়ে এল, ‘আপনি এখানে? বাবু আপনাকে খুঁজতে বাড়িতে গিয়েছিল!’

‘কেন? কী হয়েছে?’

‘বাবুর বউ খুব অসুস্থ। পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে বললেন।’ লোকটি জানাল।

‘ঠিক আছে, আমি ওর বাড়ি যাচ্ছি।’

আবার রিকশা নিলেন বনবিহারী। সদানন্দর বাড়িতে পৌঁছে দেখলেন বাগানের গেট খোলা। পেছনের দরজায় যেতে কাতরানির আওয়াজ কানে এল। দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখলেন সদানন্দর বউ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে। পাশে দাঁড়িয়ে একজন স্ত্রীলোক তাকে শান্ত হতে বলছিল। সদানন্দ এখানে নেই।

‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা করলেন বনবিহারী।

‘সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকটি মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে নীচু গলায় বলল, ‘আর চিন্তা নেই। ডাক্তারবাবু এসে গেছেন।’

সদানন্দর বউ মুখ ফিরিয়ে দেখল। মুখের রং প্রায় রক্তশূন্য।

বিছানায় বসে নাড়ি পরীক্ষা করলেন বনবিহারী। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সদানন্দবাবু কোথায়?’

‘আপনাকে খুঁজতে তো গেলেন!’

‘সঙ্গে-সঙ্গে বাইরে সদানন্দর গলা শোনা গেল, ‘ডাক্তারবাবু এসেছেন?’

ঘরে ঢুকে সে মাথা নাড়ল, ‘ওঃ, আপনাকে কত জায়গায় খুঁজলাম।’

‘আপনি এখনই আমার বাড়িতে গিয়ে কালীচরণকে বলুন চেম্বারে যে ব্যাগটা নিয়ে যাই সেটা দিতে। তাড়াতাড়ি যাবেন আসবেন।’

‘আমি সাইকেলে যাচ্ছি।’

সদানন্দ বেরিয়ে যাওয়ার পর বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী কষ্ট হচ্ছে?’

‘পেটে যন্ত্রণা।’ স্ত্রীলোকটি বলল;

‘ওকে বলতে দিন। বলুন।’

তলপেটে হাত দিল সদানন্দর বউ, ‘খুব ব্যথা, ছিঁড়ে যাচ্ছে।’

‘কী খেয়েছিলেন?’

‘কিছু না। ওঃ, মাগো!’

‘কখন থেকে হচ্ছে?’

‘ভোররাত থেকে।’

বনবিহারী স্ত্রীলোকটিকে বললেন, ‘একটা গেলাসে নুনচিনি মেশানো জল নিয়ে আসুন তো!’

স্ত্রীলোকটি বেরিয়ে গেলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সত্যি কথা বলুন। কিছু নিশ্চয়ই খেয়েছিলেন। কী সেটা?’

চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে এল, সদানন্দর বউ বলল, ‘শেকড়।’

‘শেকড়! কীসের শেকড়?’

‘জানি না। একজন দিয়েছিল। বলেছিল, শেকড়টা খেলে মা হওয়া যায়।’ চমকে উঠলেন বনবিহারী। এই মুহূর্তে তাঁর মাথা থেকে অন্য সব সমস্যার কথা উধাও হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *