এক
এ |
খানে আকাশ মাঝে মাঝেই মাটিতে মুখ ঘষে। সে সময় গাছেরা ঝুম হয়ে দাঁড়ায় কারণ তাদের শরীর মেঘেদের দখলে। মাটির বুক থেকে উঠে আসা পৃথিবীর শ্বাস সেই মেঘের রং গায়ে মেখে ছুটে যায় টাট্টু ঘোড়ার মতন। দিনরাত একাকার হয়ে যাওয়া সেই সময়টায় বাধ্য না হলে কেউ ঘরের বাইরে পা বাড়ায় না।
কিন্তু এই দৃশ্যগুলোর আয়ু বড়জোর মাসদেড়েক। তারও মাসখানেক আগে নামে শীত। শিশুর মাড়ি ফুঁড়ে গজানো দাঁত যেমন একটু একটু করে ধারালো হয় তেমনি ওই একমাসেই শীত ছোবল মারতে শুরু করে। তাকে সওয়ার করে নেমে আসে মেঘেরা। প্রাচীন মানুষেরা বলেন, কয়েক মাইল দূরের ভুটান পাহাড়, যার একটা নাম টিমলিং, এসব তারই অবদান। বছরের পর বছর, এই আড়াই মাস ধরে, সমতলের মানুষকে জব্দ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাহাড়টা। প্রাচীনেরা বলেন, ওই পাহাড়ের মাথায় চুম্বক আছে যা টেনে নিয়ে আসে মেঘদের। এনে চাপিয়ে দেয় এই জনপদের ওপর। আজ থেকে বহু বহু বছর আগে একজন বিদেশি এখানে এসেছিলেন। তিনি এখানকার মানুষের ভালো চেয়েছিলেন। তারা ভালো কাজ করুক, ভালোভাবে জীবনযাপন করুক তিনি চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন সবাই যেন একসঙ্গে চাষবাস করে, একই রকম আনন্দের সঙ্গে দিন কাটাবে। কিন্তু তখন যাঁরা মাতব্বর ছিলেন তাঁরা ভাবলেন বিদেশি তাঁদের বিরুদ্ধে লোকগুলোকে উত্তেজিত করছে। এক অন্ধকার রাতে তারা বিদেশিকে লুকিয়ে নিয়ে গেল টিমলিং পাহাড়ের ওপর। ভোরের আগে ফিরে এল বিদেশিকে ছাড়াই। আর তারপর থেকে টিমলিং পাহাড়ের চুড়োয় চুম্বক জন্ম নিল। ক্রমশ মানুষ বিশ্বাস করতে লাগল বিদেশিকে হত্যা করেছিল মাতব্বররা। সেই পাপের কারণে প্রতিবছর এই আড়াই মাস ধরে শাস্তি দেওয়া হয় সমতলের মানুষদের।
এখন এখানে পঞ্চায়েতের শাসনব্যবস্থা চলছে। নির্বাচন হয়। সেই অতীতের মাতব্বরদের বংশধররা সংখ্যায় বেড়ে তিন-চারটে দল করে ফেলেছে। তারাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সাধারণ মানুষ একবার এদের অন্যবার ওদের ভোট দেয়। কিন্তু জেতার পর পঞ্চায়েতের সদস্যরা টিমলিং পাহাড়ের নীচে গিয়ে পুজো দেয় যাতে এবছর শীতটা একটু কম পড়ে আবার গরমও যেন না বাড়ে।
হ্যাঁ, যেমন শীত তেমন গরম। শীত যদি আড়াই মাস তো গরম ছয় মাস। মেঘগুলোকে টিমলিং পাহাড় যখন এক চুম্বকে টেনে নেয় তখন পাখিরা আসে। পাতা গজায় গাছে গাছে। কিন্তু তার আয়ু অতি অল্পদিন। সূর্যের তাপ যত বাড়তে লাগল তত উলটোদিক থেকে গরম বাতাস বইতে লাগল এই জনপদে। তখন পড়ি কি মরি করে মাঠে মাঠে ফসল বোনা শেষ। সেই সব ফসল যা মাসদুয়েকেই খাবার হতে পারবে। তারপর মাঠে থাকলে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে সব। সকাল না ফুরোতেই বাড়িগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ হয়ে যায়। নদীর জল শুকিয়ে কাঠ, পুকুর খাঁখাঁ। সূর্য ডোবার বেশ কিছুটা পরে জীবন চালু হয়। তখন সহনীয় উত্তাপ বলে গরিব মেয়েরা কলসি নিয়ে জল আনতে ছোটে। কখনও তিন কখনও পাঁচ কিলোমিটার। শুক্লপক্ষে চাঁদ সুবিধে করে দেয়। সে সময় আলো জ্বালিয়ে স্কুল খোলে, পঞ্চায়েতের কাজকর্ম থেকে অন্যান্য কাজকর্ম সহজভাবে করা যায়। তা এই সময়টা শীতের চেয়ে কম কষ্টকর। শীত রাতদিনকে আলাদা করতে দেয় না। তার সবটাই সহ্যসীমার বাইরে।
একসময় ভোরের দিকে মেঘ উঁকি দেয় আকাশে, দিয়েই মিলিয়ে যায়। এই লুকোচুরি চলে কয়েকদিন। তারপরে এক সন্ধ্যার মুখে সশব্দে ঝড় আসে। ছয় মাসের শুকনো পাতা, ধুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়, গাছের মাথাগুলোকে মুঠোয় চেপে নাড়াতে তার খুব আনন্দ হয়। কিছু ঘর ভাঙে, কিছু ওড়ে। ঝড়ের লেজ ধরে আসে বৃষ্টি। হইহই করে সিক্ত করে দেয় পৃথিবী। মাটি সোঁদা গন্ধ ছাড়ে। জনপদের বেশির ভাগ সুস্থ মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে শরীর জুড়োয়।
সেই শুরু। পৃথিবীর সব আকাশ থেকে ভালোবাসা বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে এখানে। মাঠের মাটি তখন তুলতুলে। বাৎসরিক ফসল বোনার উদ্যম তখন মানুষের পেশিতে। ক্রমশ ভরাট হয়ে যায় পুকুরগুলো। নদীর যৌবন হয় উদ্ধত। পাতাবিহীন গাছের কঙ্কাল ডালগুলোয় সবুজের আভা ছড়ায়। প্রথম প্রথম রাতে বৃষ্টি, দিন শুকনো। তারপর দিনরাত জল ঝরেই যাবে যতদিন না আকাশের ভাণ্ডারে টান ধরবে। আর তখন শালিকের মতো পা ফেলে চুপিচুপি আসবে শীত।
সবে গরম শেষ হয়েছে। এখন বৃষ্টি নামে রাত দশটার পরে। সকালটা বেশ ভালোভাবে শুরু হয়। কিন্তু কালীচরণের মনে সুখ নেই। সে ভেবেই পায় না পৃথিবীতে এত জায়গা থাকা সত্ত্বেও ডাক্তারবাবু কেন এমন একটা হতচ্ছাড়া আধা পাহাড়ে বাস করতে এলেন! এত গরম, এত ঠান্ডা, এত বৃষ্টি বয়স্ক মানুষদের জন্যে নয়। কিন্তু সে অবাক হয় ডাক্তারবাবুকে দেখে। কে বলবে ওঁর বয়স সত্তর পার হচ্ছে। নিজের বয়সটা ভাবতে বসলেই শরীর শিরশির করে। ডাক্তারবাবু তো তার থেকেও বড়। অথচ এখনও দিব্যি হেঁটে শহরে যান। সকাল দশটার মধ্যে স্নান-খাওয়া সেরে নিয়ে রুগি দেখতে বসেন। বিকেল পাঁচটার পর আর রুগি দেখেন না। যেতে আসতে অন্তত দু-কিলোমিটার হাঁটতে হয়। দেখে তো মনেই হয় না একটু কষ্ট হচ্ছে।
শীত ওঁকে জব্দ করতে পারে না। মাথা থেকে পা পর্যন্ত উলচাপা দিয়ে লাঠি হাতে চলে যান। এমনকি যখন মেঘেরা নেমে এসে রাস্তা দখল করে নেয় তখনও লাঠির আন্দাজ তাঁকে ঠিক পৌঁছে দেয়। আটকে যান গরম বাড়লে। রাস্তা তখন সুনসান, দশটার রোদ চামড়ায় ফোসকা তোলে। ছাতার আড়াল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু গিয়ে যে লাভ হয় না। যত শরীর খারাপ হোক রুগিদের অত কষ্ট করতে বয়ে গেছে। সারাদিন গরমে ঝলসাতে হয়। রুগিরা আসতে শুরু করে সূর্য ডুবলে। তখন তাঁর ফেরার সময় কিন্তু রুগিরা ছাড়বে কেন! শেষ পর্যন্ত সময়টা বদলালেন। দিনভর বাড়িতে কাটিয়ে সূর্য ডোবার পর বের হন। রুগি দেখে ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে যায়।
বৃষ্টির সময়, শোঁ-শোঁ হাওয়ার সময়ে রুটিন বদলায় না ডাক্তারবাবুর। বর্ষাতি আর গামবুট পরে দিব্যি যাওয়া আসা করেন। সে সময় রুগির সংখ্যাও কমে যায়।
একদিকে ডাক্তারবাবু অন্যদিকে খোকন, এদের নিয়ে কালীচরণের দিন কাটে। যত বয়স হচ্ছে তত ডাক্তারবাবুর মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে। আর যত বড় হচ্ছে তত খোকনের স্বভাব শান্ত হয়ে যাচ্ছে। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত এখানে পড়েছিল খোকন। তারপর ডাক্তারবাবু তাকে নিয়ে যান নব্বুই কিলোমিটার দূরে বড় শহরের স্কুলে। কালীচরণ খুব আপত্তি করেছিল ছেলেটাকে বাড়িছাড়া করার জন্যে। ডাক্তারবাবু কোনও কথা শোনেননি। তাঁর কথা, ‘ওকে মানুষ হতে হবে। যা শিখবে তা ঠিকঠাক শেখার জন্যে ওর যাওয়া উচিত।’ হোস্টেলে ঢোকার কয়েক মাসের মধ্যে পরিবর্তন চোখে পড়ছে সবার।
দুই ছুটিতে বাড়িতে আসতে হয় ওকে। সে সময় হোস্টেল বন্ধ থাকে। দশ বছর বয়সেও স্কুল না থাকলেই ওকে বাড়িতে আটকে রাখা মুশকিল হত। ডাক্তারবাবু বাড়ি ভাড়া করেছিলেন জনবসতির একটু বাইরে। তাতে ভাড়া কম দিতে হয় আবার নির্জনতাও উপভোগ করা যায়। কালীচরণকে প্রায়ই দেখা যেত খোকনকে খুঁজতে টিলার দিকে যাচ্ছে। কোনও চওড়া পাথরের ওপর শুয়ে থাকা খোকনকে দেখে তার রাগ বেড়ে যেত, ‘বাড়িতে বিছানা নেই?’
‘আঃ। দিলে নষ্ট করে।’ আকাশের দিক থেকে মুখ না সরিয়ে বলেছিল খোকন।
‘আমি নষ্ট করে দিলাম? কী স্বপ্ন দেখছিলে?’
‘স্বপ্ন নয়। সত্যি। চেখে মেলে দেখছিলাম আর তুমি দিলে বারোটা বাজিয়ে।’
কালীচরণ মুখ তুলে আকাশ দেখল। শুধু নীল আর নীল। এই সময়ের আকাশ এরকমই থাকে। দূরে ছেঁড়া ছেঁড়া তুলোর মতো সাদা মেঘ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মুখ নামিয়ে কালীচরণ হেসেছিল, ‘তা কী দেখা হল?’
খোকন উঠে বসল, ‘চলো।’
‘আমি তো কিছুই দেখতে পেলাম না।’ কালীচরণ যেন হতাশ এমন ভান করেছিল।
‘কী করে দেখবে? তোমার মনের তো একটাও চোখ নেই।’
টিলা থেকে নামতে নামতে ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকাল সে। মনের যে চোখ থাকে তা এই বয়স পর্যন্ত সে জানত না।
আজকাল প্রায়ই মনে হয় ওইটুকুনি ছেলে যা জানে তা তার অজানা। মুখ খুললে তো বটেই, যখন গম্ভীর হয়ে থাকে তখন ওকে আলাদা বলে মনে হয়। অথচ ওই পুচকে শরীর কোলে নিয়ে ডাক্তারবাবু যখন ফিরে এলেন তখন থেকে তার দুটো হাত ওকে ধরে রেখেছে।
সময়টা মনে আছে স্পষ্ট। বৃষ্টি পড়ছিল। দিন ফুরোবার আগেই সন্ধে নেমে এসেছিল কারণ কালো মেঘের ভিড় হয়েছিল সূর্যের মুখে। সেই সময় ট্যাক্সিটা এসে থামল প্রায় বারান্দার সামনে। জানলা দিয়ে অলস চোখে দেখেছিল কালীচরণ। শহরের ট্যাক্সি। ড্রাইভার ছাতি নিয়ে এপাশে এসে দরজা খুলতেই চমকে গিয়েছিল কালীচরণ। পড়ি কি মরি করে বাইরের দরজা খুলতে না খুলতেই ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ‘একে ধরো।’
কালীচরণ দু-হাত বাড়িয়ে কাপড়ে মোড়া ঘুমন্ত শিশুকে বুকের কাছে নিয়ে এসে কীরকম বিহ্বল হয়ে গেল। জিনিসপত্র নামিয়ে ভাড়া নিয়ে ট্যাক্সিওয়ালা চলে গেলে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ওকে ভেতরে নিয়ে যাও। জলো হাওয়া বইছে।’
সেই শিশু, যে টলমল করে হাঁটে এবং পড়ে যায়, আর মুখে শব্দের ফুলঝুরি কিন্তু বেশিরভাগই অর্থবহ নয়, কালীচরণের সব পরিকল্পনা ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। ওই বাড়ি যক্ষের মতো পাহারা দিতে দিতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। প্রথম প্রথম সাধারণ মানুষের কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে সে জেরবার হয়ে গিয়েছিল। দু-দুবার পুলিশ এসে ডাক্তারবাবুর খোঁজখবর করেছিল। একটা গল্প বানিয়ে নিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছিল কালীচরণ। ডাক্তারবাবুর ভাগ্নীজামাই বিদেশ থেকে ফিরে বউবাচ্চা নিয়ে ফিরে যাবে বলে ওদের উনি পৌঁছে দিতে গিয়েছেন। তারপরে প্রশ্ন উঠল, উনি ফিরছেন না কেন? এর উত্তর বানাতে পারেনি কালীচরণ। বলেছে সে কিছুই জানে না। প্রথমবার থানার বড়বাবু এসে সাধারণ কয়েকটা প্রশ্ন করে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল, ‘তোমার খাওয়াদাওয়ার খরচ কে যোগাচ্ছে?’
কালীচরণ জবাব দিয়েছিল, ‘বাবু কিছু টাকা দিয়ে গেছেন। বলেছেন টাকা শেষ হয়ে গেলে মুদির দোকান থেকে ধার নিতে।’
‘মুদির দোকানে চাল ডাল আলু পেঁয়াজ পাবে, শাকসবজি, মাছ?’
‘আমার খাওয়া ভাতেভাত-এই হয়ে যায়।’
‘তা ধরো, তোমার বাবু আর ফিরলেন না, তখন ধার শোধ করবে কী করে?’
‘আমি, আমি জানি না!’
বড়বাবু আর প্রশ্ন করেননি। দ্বিতীয়বার বড়বাবু নিজে আসেননি। মেজবাবু দলবল নিয়ে এসে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেন। তারপর ভেতরের বাগানের মাটি পরীক্ষা করেছিলেন। একটা জায়গা দেখে সন্দেহ হতে সেপাইদের বললেন, ‘এখানকার মাটি খোঁড়ো।’
বেশ বড় গর্ত হয়ে গেল কিন্তু কিছুই যখন পাওয়া গেল না তখন মেজবাবু খুব হতাশ হলেন। কালীচরণ বেশ সাহস নিয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘কী খুঁজছেন মেজবাবু?’
‘একটা উড়ো খবর এসেছিল। তোমার বাবুকে খুন করে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে। তাই দেখে গেলাম বাগানটা।’
‘সর্বনাশ! এসব কী কথা! তা ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে বাবুকে কে খুন করবে?’
‘সবসময় কি বাইরের লোক এসে খুন করে? এই তুমি, তুমিও তো খুন করতে পারো। এতবড় বাড়ি, বাগান। ডাক্তারবাবুর ছেলেমেয়ে ভাইবোন কেউ আছে বলে শুনিনি। সবই তুমি ভোগ করবে। লোভ বড় ভয়ংকর ব্যাপার হে, আর মানুষ লোভী হলে পশুদের ছাড়িয়ে যায়।’
পুলিশ চলে গেলে বুকের ওপরে একটা বড় পাথর চেপে বসল কালীচরণের। সে বাবুকে খুন করে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে বলে পুলিশ সন্দেহ করেছিল? বাবু যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে তাই সবক’টা মন্দিরে মানত করল সে।
এসব করার সময় মনে হল ওই মামণিই হল যত কাণ্ডের জন্যে দায়ী। ও না আসা পর্যন্ত তাদের জীবনে অশান্তি ছিল না। কুমারী মেয়ে মা হল, সেই বাচ্চা নিয়ে এই বাড়িতে এল। তখন থেকে কুসঙ্গ ধরল। কী দরকার ছিল ডাক্তারবাবুর ওকে বাড়ি তুলে আনার? কেউ কি কখনও দেখেছে দুধের বাচ্চা কেঁদে গলা শুকোচ্ছে খিদের জ্বালায় আর তার মা দিব্যি পাশে শুয়ে আছে। কোনও হেলদোল নেই। তখন কালীচরণকেই গরুর দুধ পাতলা করে খাওয়াতে হয়েছে শিশুকে। দেখলে মনে হত মেয়েটা ওকে নিজের বাচ্চা বলে মনেই করে না। ডাক্তারবাবু যখন ওদের এ-বাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে নিয়ে গেলেন তখন মনটা খারাপ হয়েছিল বাচ্চাটার জন্যে। খেতে না পেয়ে নির্ঘাত মরে যাবে ও। কিন্তু যাওয়ার পরে মনে হয়েছিল একটা কালো ছায়া সরে গেল বাড়ির ওপর থেকে।
পুলিশ ছাড়ল তো কী হবে, আশেপাশের লোকজন তো মুখ বন্ধ করবে না। পাশের বাড়ির বউয়ের মা এখনও নিজেকে যুবতী ভাবে। বিকেলে সেজে-গুজে বারান্দায় বসে থাকে মোড়া পেতে। একদিন তাকে ধরল, ‘এই যে, ও কালীচরণ, হ্যাঁ গো, একটু এদিকে এসো!’
মেয়েমানুষটাকে মোটেই পছন্দ করে না কালীচরণ। কিন্তু ডাকলে না গিয়েও পারা যায় না। কাছে গিয়ে বলল, ‘ডাকছেন কেন?’
‘ও-মা! তুমি মিলিটারিতে কাজ করো নাকি? মুদির দোকান থেকে এলে বুঝি?’
‘হ্যাঁ।’
‘বাঃ। ভালো। তা তোমার বাবুর খবর কী?’
‘জানি না!’ মাথা নেড়েছিল কালীচরণ। তাকে ডাকার উদ্দেশ্য যে এই কারণে তা জানা ছিল।
‘কী লোক! ছিঃ! মেয়ের বয়সি, এক বাচ্চার মা, এসব গ্রাহ্যই করল না?’
‘আমি যাই?’
‘আহা! দাঁড়াও না! তোমার সঙ্গে কথা আছে।’
‘বলুন!’
‘মেয়েছেলেটা তোমার বাবুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কামাখ্যায় নিয়ে যায়নি তো?’
‘মানে?’
‘শুনেছি সেখানে নিয়ে গেলে জবরদস্ত ব্যাটাছেলেকেও ভেড়া বানিয়ে ফেলার মন্ত্র কিনতে পাওয়া যায়! কোনদিকে গিয়েছে জানো কিছু?’
‘আমি কী করে জানব! কামাখ্যা কোথায়?’
‘আসামে।’
‘আসাম? ওরকম একটা নাম মেয়েটা বাবুকে বলছিল বটে।’
‘তাহলে হয়ে গেল! তিনি আর ফিরবেন না। ফিরলেও তুমি চিনতে পারবে না।’
‘কেন?’
‘বাড়ির সামনে যে ভেড়া ব্যা-ব্যা করবে তাকেই কি তুমি তোমার বাবু বলে ভাববে? আর তিনি যখন ফিরবেনই না তখন তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার তো বাড়ির কাজকর্ম করা অভ্যেস। না করতে পেরে শরীরে জল জমছে। তুমি এ-বাড়ির কাজে লেগে যাও। জামাই-মেয়ে গুজরাত যাবে। জামাইয়ের খুড়তুতো বোনের বিয়ে। আমাকেও যেতে বলেছিল। কিন্তু অতদূরের কুটুমবাড়িতে আমি যাব কেন? তুমি যদি কাজে লেগে যাও, এই দুবেলা রান্নাটুকু করা, আর ঘরদোর পরিষ্কার করা ছাড়া কিছু করতে হবে না। বাসনটাসন ঠিকে-ঝি মেজে দিয়ে যাবে। তোমার বাবু যা মাইনে দিত তার থেকে দশটাকা বেশি না হয় দেব।’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে মিষ্টি হাসলেন মহিলা।
‘দেখি, আর কিছুদিন দেখি। বাবু যদি ফিরে আসেন—! আচ্ছা—!’
চলে এসেছিল কালীচরণ। এই এক জ্বালা শুরু হয়ে গেল। তাকে চাকরি দেওয়ার জন্যে গঞ্জের মানুষ এত আগ্রহী হল যে সন্ধের আগে বাড়ির বাইরে পা বাড়াত না সে। শেষতক কালীচরণ ঠিক করল এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। যার বাড়ি সে যদি কোনও কথা না বলে দিনের পর দিন উধাও হয়ে থাকতে পারে তাহলে তার কীসের দায়? কিন্তু কোথায় যাবে সে? মথুরা বৃন্দাবন কাশীর নামই সে শুনেছে। কোনওদিন চোখে দেখেনি। বাবুর মা বেঁচে থাকতে বলতেন, ‘এ ছেলে যখন বিয়ে করবে না তখন আমি কাশীবাসী হব।’ কালীচরণ হেসে জিজ্ঞাসা করত, ‘কে খেতে দেবে সেখানে?’ মা বলতেন, ‘কেন? বাবার প্রসাদ খাব। বাবার প্রসাদ খেয়ে কত বিধবা সেখানে বেঁচে আছে।’ এই মা-ই মারা যাওয়ার আগে তাকে বলেছিলেন, ‘কালীরে, তোর বাবুকে দেখিস।’ কথাটা মনে পড়তেই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার বাসনা উধাও হয়ে গেল।
শিশুকে কোলে নিয়ে কালীচরণ ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এর মা কোথায়?’
বনবিহারী এক মুহূর্ত ভাবলেন, ‘যে জিজ্ঞাসা করবে তাকে বলবে ওর মা মারা গিয়েছে। সেই শোকে বাবা ওকে নেয়নি!’
‘কিন্তু—!’
‘তোমারও এর বেশি জানার দরকার নেই।’ বনবিহারী এমনভাবে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন যে মনে হচ্ছিল তিনি গতরাতেও এখানে ছিলেন।