দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ১৫

পনেরো

ছেলেটি দ্রুত মাথা নেড়ে অন্যদিকে দৌড়ে চলে গেল। সুজয় মুখ ফিরিয়ে আর কালীচরণকে দেখতে পেল না। বটগাছের পাশ দিয়ে বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। একতলা বাড়ি। দরজার ওপর লেখা বিউটি পার্লার। দরজা খোলা, পর্দা ঝুলছে।

সে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘বলাইচাঁদবাবু আছে কি?’

ভেতর থেকে একটি মেয়ের গলা ভেসে এল, ‘উনি যে শয্যাশায়ী তা সবাই জানে, আপনি জানেন না? আশ্চর্য!’

‘আমি এখানে নতুন এসেছি। আর কেউ আছেন যাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি!’

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার হল, ‘বউদি, ও বউদি, কে এসেছে দ্যাখো।’

তারপরেই পাশের টিনের দরজা খুলে গেল। একটি বৃদ্ধ কাজের লোক জিজ্ঞাসা করল, ‘কোত্থেকে এসেছেন? মা জিজ্ঞাসা করলেন।’

‘আমি স্কুলের চাকরি নিয়ে এসেছি।’

লোকটা চেঁচিয়ে জানাল, ‘স্কুলের মাস্টার এসেছে।’

‘ও পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসা।’ মহিলার গলার স্বর প্রায় পুরুষদের মতন।

লোকটা উঠোনের পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল সুজয়কে। তারপর চলে গেল। প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষার পর গৃহকর্ত্রীর দর্শন পেল সুজয়। মহিলা খুবই স্বাস্থ্যবতী, গায়ের রং শ্যামলা, পরনে গোড়ালি ঢাকা ম্যাক্সি, চুল চুড়ো করে ওপরে তোলা।

দরজায় দাঁড়িয়ে যেভাবে চোখ ঘুরিয়ে তিনি সুজয়কে দেখলেন তাতে মনে হল কিছুই আর অজানা থাকল না তাঁর কাছে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বললেন মহিলা, ‘আপনি স্কুলে মাস্টারি করেন?’

‘করব। এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম বলে জয়েন করতে দেরি হয়ে গেল।’

‘কী জন্যে এসেছেন বলুন, আমার তাড়াহুড়ো আছে, দুজন বড় কাস্টমার আসবে।’

‘কাস্টমার?’

‘আমার যে বিউটি পার্লার আছে তা দ্যাখেননি?’

‘ও হ্যাঁ। দেখুন, আমি একটা থাকার জায়গা খুঁজছি। ঘর, রান্নাঘর আর বাথরুম ল্যাটিন হলেই চলে যাবে।’

‘ম্যারেড?’

‘না।’

‘হু। এখানে এসে অসুস্থ হয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোথায় ছিলেন? সেখানে থাকতে পারা যাচ্ছে না কেন?’

‘আমি সদানন্দবাবুর বাড়িতে ছিলাম, ওই যে, যাঁর হোটেল আছে।’

‘চিনি, চিনি। এখানকার সব মিঞার নাড়িনক্ষত্র জানি। কিন্তু সদানন্দবাবু ব্যাচেলারকে থাকতে দেওয়ার লোক নয়। বউটাকে অসূর্যম্পশ্যা করে রেখেছে এতদিন। কোনও গোলমাল হয়েছিল নাকি?’ মহিলা চোখ ছোট করলেন।

‘না, না। উনি আর বাড়ি ভাড়া দেবেন না।’

‘শুনুন, আমার এখানে ঘর খালি আছে। আমার আবার উলটো। আমি ম্যারেড লোকদের ঘর ভাড়া দিই না। মেয়েমানুষকে ভাড়াটে হিসেবে রাখা মানেই রোজ একটা না একটা সমস্যা তৈরি করা। কিন্তু আমার এখানে ভাড়াটে হয়ে থাকতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।’ ভদ্রমহিলা মোটা গলায় বললেন।

‘বলুন।’

‘আমার বিউটি পার্লারের দিকে একদম ঘেঁষবেন না। ওই টিনের দরজা দিয়ে মাথা নীচু করে যাতায়াত করবেন। পার্লারে যে মেয়েটা কাজ করে তার আবার একটু ছোঁক ছোঁক বাতিক আছে। একদম কথা বলবেন না।’

‘ঠিক আছে।’

‘নেশা করা চলবে না। সিগারেট ঘরে বসে খেতে পারেন। অন্য নেশা একদম নয়। রাত দশটার মধ্যে ফিরতে হবে, তারপর টিনের দরজায় তালা দেওয়া হয়।’

‘বেশ, তাই হবে।’

‘আর হ্যাঁ, বাড়িতে ব্যাটাছেলে এক-আধজন আসতে পারে কিন্তু কোনও মেয়েছেলেকে নিয়ে আসবেন না।’ মহিলা চোখ ঘুরিয়ে বললেন।

‘এখানে তেমন পরিচিত কেউ নেই।’

‘বাঃ। ভালো কথা। এখন বাড়ি ভাড়ার কথা। আপনি যখন স্কুলের মাস্টার তখন বেশি চাইব না। মাসে দুশো টাকা দিলেই হবে, একমাসের টাকা আগাম।’

‘একটা অনুরোধ করছি। আমি জয়েন করার পর স্কুল থেকে আগাম নিয়ে আপনাকে দিতে পারি, যদি এটুকু মেনে নেন—!’

‘দেখুন, লোকে আমার ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে অনেক ঠকিয়েছে। বাড়ির কর্তা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। অবলা মেয়ে বলে যে পারে সে-ই ঠকাতে চায়।’

হাতজোড় করল সুজয়, ‘বিশ্বাস করুন, আমি সেরকম মানুষ নই।’

‘রান্নাবান্না করবে কে?’

‘আমাকেই করতে হবে। বাসন, উনুন কিনতে হবে।’

‘তার দরকার নেই। আগের ভাড়াটে ভাড়া দিতে পারেনি বলে রান্নাঘরের জিনিসপত্র রেখে গেছে। যা যা দরকার, সব। ওতেই হয়ে যাবে। ওহো, নামটা জানা হল না!’

‘সুজয়।’

‘ইচ্ছে হলে আজ বিকেলেই চলে আসবেন। এখন আসুন আমার সঙ্গে।’ উঠে দাঁড়ালেন মহিলা। তারপর উঠোন পেরিয়ে সামনের দিকের একটা ঘরে সুজয়কে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘বাড়ি ভাড়া নিচ্ছেন, বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা করে যান।’

একটা ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘শুনছ?’

সুজয় দেখল এক প্রৌঢ়, মুখে দাড়ির জঙ্গল, বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে শুয়ে রয়েছেন। চোখ কোটরে। মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন, সঙ্গে সঙ্গে শব্দগুলো ছিটকে বের হল, ‘মর, মর মাগি। মর না।’

মহিলা হাসলেন, ‘ওই এক কথা হয়েছে। যখন যা মনে আসে বলে ফেলে। রোগে ভুগে মাথাটা গেছে। এই যে, দ্যাখো, এঁর নাম সুজয়বাবু, স্কুলের মাস্টার, তোমার বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে আসছে।’

সুজয় দেখল প্রৌঢ়ের চোখ তার দিকে ঘুরল। সে হাতজোড় করে নমস্কার জানাল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ হয়ে গেল প্রৌঢ়ের।

মহিলা বললেন, ‘চলুন, পরিচয় হয়ে গেল আপনাদের। কখন আসবেন?’

‘চেষ্টা করব আজ বিকেলেই চলে আসতে।’

‘বেশ। ও হো, একটা কথা বলা হয়নি। আলোর জন্যে প্রতিটি পয়েন্ট পিছু দশ টাকা দিতে হবে। আপনি একা মানুষ, দুটোর বেশি জ্বালার কী দরকার!’

সুজয় মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছে তখন তার চোখ বিউটি পার্লারের দিকে গেল। জানলায় অ্যাপ্রন পরা এক যুবতী তার দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে। সেটা গ্রাহ্য না করে রিকশায় উঠল সে।

‘ঘুরিয়ে নেব বাবু?’ রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করলে হ্যাঁ বলতে গিয়েও কালীচরণের কথা মনে পড়ায় সুজয় বলল, ‘না। এখান থেকে ফরেস্ট কতদূরে?’

‘বেশি নয়। পাঁচ মিনিট লাগবে।’

‘চলো, একবার ঘুরে আসি।’

রিকশাওয়ালার আপত্তি করল না। একটু বাদেই জায়গাটা শুনসান হয়ে গেল। বাঁক ঘুরতেই আচমকা জঙ্গল ভেসে উঠল। বিশাল জঙ্গল, এখান থেকে অন্ধকার অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে। একটা সাঁকোর ওপর রিকশা উঠতেই থামতে বলল সুজয়। নীচে এক কোমর জলের নদী গম্ভীরভাবে বয়ে যাচ্ছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে লোকজন কোথায় থাকে?’

‘আপনাকে নদীর ধার দিয়ে ওই যে পায়ে চলা রাস্তা, ওটা ধরে হেঁটে যেতে হবে। ফরেস্টের বাইরে খাস জমির ওপর ওখানে একটা বসতি হয়েছে।’

‘তোমাকে ছেড়ে দিলে তো হেঁটে ফিরতে হবে।’

‘আর আটকাবেন না বাবু।’

কালীচরণের বাসস্থান দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল সুজয়ের। ওখানে নিশ্চয়ই দুশো টাকার অনেক কমে ঘর ভাড়া পাওয়া যাবে। কিন্তু দুবেলা রিকশা ভাড়া দিতে হলে সেটা আর কম থাকবে না। এই সময় সুজয় ছেলেটাকে দেখতে পেল। একটি যুবক ওপাশের জঙ্গল থেকে অন্যমনস্কভাবে বেরিয়ে এসেই তাদের দেখতে পেয়ে দ্রুত জঙ্গলে ঢুকে গেল। ও যে সামনে আসতে চায় না এটা পরিষ্কার। যুবকের পরনের প্যান্ট খানিকটা গোটানো, এটুকুই চোখে পড়েছিল। সে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘নতুন বসতিতে কারা থাকে?’

‘গরিব মানুষেরা। যারা মাল বয়, কুলির কাজ করে। কেউ কেউ রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে।’

‘কিন্তু একটা ছেলেকে এই মাত্র দেখলাম, ওরকম কাজ করে বলে মনে হল না।’

‘আপনি কি আমাকে ছেড়ে দেবেন?’

‘নাঃ। চলো, ফিরেই যাই।’

অনেকটা দূরে ফিরে এসে রিকশাওয়ালা বলল, ‘আপনি যাকে দেখলেন তাকে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না বাবু। ওরকম বেশ কিছু পালিয়ে বেড়ানোছেলে জঙ্গলে আছে। শুধু ছেলে নয়, আমি নিজের চোখে দেখেছি একটা মেয়েমানুষ শার্টপ্যান্ট পরে ওদের সঙ্গে থাকে।’

ওরা কারা?’

‘জানি না। তবে পুলিশ প্রায়ই ধরপাকড় করে।’

‘তুমি যে দেখেছ তা পুলিশকে বলেছ?’

‘মাথা খারাপ নাকি! বললে তারা হাজারটা প্রশ্ন করবে। আমাকে বলবে, চল, কোথায় তুমি দেখেছ তা আমাদের দেখাও। ব্যস, হয়ে যাবে!’

‘কী হয়ে যাবে?’

‘তারপর থেকে এদিকে ভাড়া খাটা বন্ধ হয়ে যাবে আমার। পুলিশের কাছে চুকলি কেটেছি তা ওরা ঠিক জানতে পারবে। সেজন্যে শাস্তি দেবে না? কী দরকার এসবের সঙ্গে জড়াবার? আমাকে পুলিশ জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি বলেছি কিছুই দেখিনি।’

কথাগুলো শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সুজয়। এদের কথা সে এখানে আসার আগে শোনেনি।

আজ চেম্বারে ভিড় নেই। শেষ রুগিকে দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দক্ষিণা নেওয়ার পর বনবিহারী ভাবলেন আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা যাক। ঠিক তখন তিনি সুজয়কে দেখতে পেলেন। চেম্বারে ঢুকে সুজয় নমস্কার করে সামনের খালি চেয়ারে বসে পড়ল।

‘শরীর কেমন আছে?’

‘ভালো। আপনাকে একটা উপকার করতে হবে।’

‘কীরকম?’

‘দুটো লাইনে লিখে দেবেন আমার কী অসুখ হয়েছিল এবং এখন কাজে যোগ দেওয়ার মতো সুস্থ হয়েছি।’ সুজয় বলল।

‘নিশ্চয়ই। এটা তো আমার কর্তব্য।’

নিজের প্যাড টেনে নিয়ে লেখা শুরু করেই থামলেন বনবিহারী, ‘এখনও সদানন্দর বাড়িতেই থাকা হয় তো?’

‘অ্যাদ্দিন ছিলাম। কাল রবিবার নতুন ঠিকানায় যাব।’

‘এখানে কী অসুবিধে হল?’

‘ওঁদের বোধহয় অসুবিধে হচ্ছে। আজ একটা ঘর দেখে ফাইনাল করেছি। কাল রবিবার সকালে ওখানে চলে যাব।’ সুজয় যতটা সম্ভব সংক্ষেপে জানাল।

‘বেশ। নতুন ঠিকানাটা কী?’

‘বাড়িটা বলাইচাঁদবাবুর। ওঁর স্ত্রী বিউটি পার্লার চালান।’

‘ও! বলাইচাঁদবাবু কেমন আছেন? দেখা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। মনে হল খুবই অসুস্থ।’

‘প্রথমদিকে ওঁর স্ত্রী চেয়েছিলেন আমি চিকিৎসা করি। তারপর সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে যোগাযোগ বন্ধ করলেন। জানি না এখন কীরকম চিকিৎসা হচ্ছে।’

বনবিহারী সার্টিফিকেট লিখে দিলেন। সেটা পকেটে ভরে সুজয় জিজ্ঞাসা করল, ‘কত দিতে হবে?’

বনবিহারী হাসলেন, ‘আমি প্রেসক্রিপশন লেখার জন্যে দক্ষিণা নিই, রোগমুক্তির সার্টিফিকেট লেখার জন্যে নয়।’

উঠতে গিয়ে মনে পড়ল সুজয়ের, ‘আচ্ছা, কালীচরণ কি আপনার কাছে থাকে না?’

‘এই প্রশ্নের কারণ?’

‘তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল!’

‘আচ্ছা, কোথায়?’

‘আমি রিকশা নিয়ে বলাইচাঁদবাবুর বাড়ি খুঁজতে যাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম কালীচরণ থলে হাতে জঙ্গলের দিকে হাঁটছে। ওর কাছেই শুনলাম জঙ্গলের গায়ে যে নতুন বসতি হয়েছে সেখানেই সে থাকে। আমি অবাক হয়ে ওকে প্রশ্ন করার আগেই ও হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল।’ সুজয় বলল।

গম্ভীর হলেন বনবিহারী, ‘সে আমার কাছে ছুটি চেয়েছিল দেশে যাবে বলে। জঙ্গলের পাশেই যে ওর দেশ তা আমার জানা ছিল না।’

‘কালীচরণ আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিল কেন কে জানে। আচ্ছা! চলি।’

সুজয় চলে যাওয়ার পর চেম্বার বন্ধ করলেন বনবিহারী। বাইরে পা রাখতেই বুঝতে পারলেন আকাশে মেঘ জমছে। বেশ কালচে দেখাচ্ছে ওপরটা। দ্রুত বাড়ির পথ ধরলেন তিনি। কিন্তু কালীচরণের কথাটা কাঁটার মতো বিঁধছিল মনে। এতদিনের বিশ্বাসী লোকটা এরকম মিথ্যাচরণ করতে পারে তা তিনি ভাবতেও পারছেন না।

বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাতাসে জলের স্পর্শ। যে-কোনও মুহূর্তেই বৃষ্টি নামতে পারে। আর এখানে বৃষ্টি নামলে আর দেখতে হবে না। বাড়ির সামনে পৌঁছতেই ঘটনাটা ঘটল। হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে ছিটকে এল শরীরটা, এসে তাঁর পায়ের ওপর পড়ে হাউমাউ শব্দে কাঁদতে লাগল। বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন বনবিহারী, চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে? কে?’

কান্না জড়ানো গলায় জবাব এল, ‘আজ্ঞে, আমি কালীচরণ।’

বাড়ির সামনে আলো জ্বলছে না। অন্ধকারে আবছা দেখা যাচ্ছিল। বনবিহারী কোনওরকমে উচ্চারণ করলেন, ‘কী ব্যাপার?’

কান্না গলায় জড়িয়ে ছিল, কালীচরণ বলল, ‘আমায় মাপ করে দিন বাবু, আমি খুব অন্যায় করেছি, আপনার কাছে মিথ্যে কথা বলেছি!’

‘ওঠো! উঠে দাঁড়াও।’ বনবিহারী এবার নিজেকে ফিরে পেলেন।

উঠে দাঁড়াল কালীচরণ, ‘আমাকে মাপ করুন বাবু।’

‘জেনেশুনে তুমি মিথ্যে বলে এখানেই থেকে গেছ, হঠাৎ আসার দরকার হল কেন?’

‘আমি আর পারছিলাম না।’

‘এই রাত্রে আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। তোমার যদি কিছু বলার থাকে তাহলে কাল সকালে এসে বোলো। সরে যাও।’

‘তাই আসব।’

‘সরে যাও।’

কালীচরণ সরে দাঁড়ালে বনবিহারী পা বাড়ালেন।

বারান্দায় উঠতে না উঠতেই বিদ্যুৎ চমকাল বেশ জোরে। বনবিহারী মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেলেন, কালীচরণ চলে যাচ্ছে। কিন্তু একটা সাইকেল বেশ জোরে এগিয়ে আসছে।

‘কে?’

‘আমি ভোলা। বউদিদি পাঠিয়ে দিলেন।’

‘কে বউদিদি?’

‘সদানন্দবাবুর বউ।’ সাইকেল দাঁড় করিয়ে একটা টিফিন ক্যারিয়ার হাতে এগিয়ে এল লোকটি। বারান্দায় সেটাকে রেখে ভোলা বলল, ‘আগের বাটিগুলো যদি দেন—।’

ফেরত দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু পারলেন না বনবিহারী। ক্যারিয়ার ভেতরে নিয়ে গিয়ে খাবারগুলো বাড়ির পাত্রগুলোতে রেখে জলে ধুয়ে আগেরটার সঙ্গে রাত্রে আনাটিকেও ফেরত দিলেন ভোলাকে, ‘দুটোই নিয়ে যাও। ওদের বলে দিও কাল থেকে যেন আর না পাঠায়। পাঠালে আমি ফেরত দিতে বাধ্য হব।’ ভোলা চলে গেল।

দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে দেখলেন আলো জ্বলছে কিন্তু বাড়িতে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র বৃষ্টি নামল হুড়মড়িয়ে। মাঝখানের ঘরে আসা মাত্র কাছাকাছি বাজ পড়ল। তখনই তীব্র চিৎকার করে পাশের ঘর থেকে ছুটে এল মামণি। এসে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল বনবিহারীকে। মেয়েটার শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। বনবিহারী হেসে ফেললেন, ‘এই সাহস নিয়ে বিপ্লব করতে গিয়েছিলে?’ মামণি তাঁকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বনবিহারী বিহ্বল হয়ে পড়লেন। কোনও নারী সমস্ত শরীর দিয়ে তাঁকে কখনও এভাবে জড়িয়ে ধরেনি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *