দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ১৩

তেরো

বনবিহারী থমকে গেলেন। না, তিনি ভুল দেখেননি। কিন্তু এই বন্ধ বাড়িতে মানুষ ঢুকল কী করে? ওপাশে উঠোনের শেষে পাঁচিলে একটা দরজা অবশ্য আছে কিন্তু সেটা তো সবসময় ভেতর থেকে বন্ধ রাখা হয়! তিনি এগিয়ে গিয়ে উঠোনে পা দিলেন। পাঁচিলটার কাছে গিয়ে সন্দেহ দৃঢ হল। দরজাটা ভালো করে ভেজানো। ছিটকিনি এবং খিল দেওয়া নেই।

বনবিহারী বুঝলেন যাকে সরে যেতে দেখেছেন সে নিঃসন্দেহে কালীচরণ। তাঁকে আসতে দেখে লজ্জায় সরে দাঁড়িয়েছে। এমন হতে পারে ব্যাটা কোথাও যায়নি। উঠোনের দরজা খুলে রেখে তাঁকে চাবি পৌঁছে দিয়ে চলে যাওয়ার ভান করে বাড়ি ফিরে এসেছে। তিনি ভেতরের বারান্দায় উঠে এসে চেঁচিয়ে ডাকলেন, ‘কালীচরণ!’

কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। মেজাজ আরও গরম হয়ে গেল তাঁর। আরও গলা তুলে বললেন, ‘কালীচরণ, আমি এসব বরদাস্ত করব না!’

তারও জবাব না পেয়ে তিনি ঘরের দিকে এগোতেই চমকে গেলেন। দরজার পাশে জড়সড়ো হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে মামণি। চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে। রোগা, কালচে। পরনের শার্ট-প্যান্ট যে বহুকাল কাচা হয়নি তা বুঝতে অসুবিধে হল না। স্নানও বোধহয় ইদানীং করেনি।

‘একি! তুমি? এখানে কী করে এলে?’

মামণি মুখ তুলল। তোলামাত্র চোখ উপচে জল গড়িয়ে এল দুই গালে। তারপর মুখ নামিয়ে নিল। যে মেয়ে কথা বলতে পারে না তার কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যাবে না। এখন হাতে কলম-কাগজ ধরিয়ে দিলেও যে ও লেখার মানসিকতায় নেই তা বুঝতে পারলেন বনবিহারী। আর কোনও প্রশ্ন না করে সোজা নিজের ঘরে চলে এসে সশব্দে চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। হঠাৎই যেন খুব কাহিল লাগছিল নিজেকে। পেছনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন তিনি। এই মেয়ে বাড়িতে কী করে এল? কেন এল?

দরজায় শব্দ হলেও চোখ খুললেন না বনবিহারী। বুঝতে পারলেন তাঁর পায়ের পাশে মেঝের ওপর এসে বসল মামণি। বসে তাঁর হাঁটুতে গাল রাখল। তারপর কিছুক্ষণ নড়াচড়া নেই। বনবিহারী বুঝতে পারছিলেন না এখন তিনি কী করবেন। মেয়েটার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, এতগুলো বছরের ব্যবধান কিছুই নয়, ও যে চোরের মতো পালিয়ে গিয়েছিল সেই ছেলেটার সঙ্গে, যাওয়ার আগে তাঁর কথা দূরে থাক, নিজের সন্তানের কথাও ভাবেনি, সেসব যেন কোনও অপরাধ নয়!

কিন্তু এভাবে কতক্ষণ বসে থাকা যায়? উত্তেজিত হওয়ায় খিদের বোধটাই চলে গিয়েছিল, এখন সেটা ফিরে আসছে। বনবিহারী বললেন, ‘দয়া করে সরে বসো।’

মামণি যেন শুনতেই পেল না। একটু অপেক্ষা করে বনবিহারী ওর মাথাটা সরিয়ে উঠে পড়লেন। সোজা রান্নাঘরে ঢুকে ফ্রিজ খুললেন। কয়েকটা পাত্রে তরকারি, মাছের ঝোল রেখে গেছে কালীচরণ। সকালে ওগুলো খাওয়ার ইচ্ছে হল না। প্যাকেট খুলে পাঁউরুটি বের করে ভাবলেন টোস্ট করে নেবেন। তখন ফ্রিজের নীচে ডিম দেখতে পেলেন। ডিম সেদ্ধ আর টোস্ট খেলেই আপাতত চলে যাবে। গ্যাস জ্বেলে বড় বাটিতে জল ঢেলে বসিয়ে দিলেন তিনি। তখনই মনে পড়ল, মেয়েটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে না খেয়ে আছে। এসেই যখন পড়েছে তখন ওকে না দিয়ে তিনি একা খাবেন কী করে। এই সময় মামণি রান্নাঘরের দরজায় এল। তাঁকে যা বলতে চাইল তা গোঙানি ছাড়া অন্য মানে তৈরি করল না। তিনি বুঝতে পারছেন না বুঝে মামণি ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে। তারপর তাঁর হাত ধরে টেনে বাইরে বের করে দিয়ে ফিরে গেল। বনবিহারী বুঝলেন ও নিজে খাবার তৈরি করতে চায়। সমস্যা বাড়িয়ে লাভ নেই ভেবে তিনি বললেন, ‘টোস্ট আর ডিম সেদ্ধ, তোমার জন্যেও করবে।’ মামণি তাঁর দিকে পেছন ফিরে ছিল, কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না।

এখন স্নান করে নিলে ভালো লাগবে। জামাকাপড় নিয়ে বনবিহারী বাথরুমে ঢুকলেন। আজ সকালে চেম্বারে যাওয়া হল না। অনেক পেশেন্ট এসে ফিরে যাবে। কিন্তু তাঁর কিছু করার নেই। এত ক্লান্তি নিয়ে তিনি মন দিয়ে পেশেন্টদের দেখতে পারবেন না। বরং বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি গিয়ে কাজ শুরু করবেন।

কিন্তু যখন এই বাড়ি থেকে বেরুবেন তখন মামণিকে একা রেখে যেতে হবে। সেটা কি ঠিক হবে? এখন আর ওকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে সে তার সঙ্গীসাথিদের ডেকে এনে খাওয়াতে পারে। রাত্রে যদি ভেতরের কোনও জায়গায় আশ্রয় দেয় তাহলে তিনি জানতেও পারবেন না। পুলিশ যদি তাদের তাঁর বাড়ি থেকে আটক করে তাহলে আর দেখতে হবে না। বাকি জীবনটা জেলে পচতে হবে তাঁকে। ওর সঙ্গীসাথিরা জঙ্গলে অভুক্ত অবস্থায় লুকিয়ে আছে। এরকম আশ্রয়ের সুযোগ পেলে বর্তে যাবে। কী করা যায়!

মেয়েটার যে চেহারা হয়েছে তাতে স্পষ্ট খুব কষ্টে ছিল। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর ওর শরীর বেশ সুন্দর হয়ে গিয়েছিল। কী লাভ হল ওর চলে গিয়ে! আচ্ছা, ওর মা এখন কোথায়? নাঃ, এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না তিনি। খাওয়াদাওয়ার পর ওকে বলবেন চলে যেতে। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ঢের ভালো।

স্নান সেরে বেরিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াবার সময় মনে হল শরীর একটু স্বাভাবিক হয়েছে। দরজায় মামণি এসে কিছু বলার চেষ্টা করল। তাকালে ইশারা করল খাওয়ার জন্যে। খাওয়ার টেবিলে চারটে স্যাঁকা পাঁউরুটি আর একটা ডিম সেদ্ধ প্লেটের ওপর রেখেছে মামণি। রুটির কিছু জায়গা কালচে হয়ে গেছে পুড়ে যাওয়ায়। সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াবার সময় সাদা অংশের কিছুটা উড়ে গেছে। দেখলেই বোঝা যায়, যে রান্নাঘরে নিয়মিত যায় না বা রান্না সম্পর্কে কোনও আগ্রহ নেই এগুলো তার তৈরি। আর একটা প্লেট টেনে নিয়ে দু-পিস পাঁউরুটি তুলে নিলেন বনবিহারী। কিছু না মাখিয়ে স্যাঁকা রুটি খেতে অসুবিধে হয় না কিন্তু একটু নুন ছাড়া ডিম সেদ্ধ যে সুস্বাদু হয় না তা বোধহয় এই মেয়ে জানে না। টেবিলে নুন-গোলমরিচ রাখা ছিল। কালীচরণ সেগুলো কোথায় সরিয়েছে কে জানে। বনবিহারী রান্নাঘর থেকে এক চামচ নুন এনে প্লেটে ঢেলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে, খেয়ে নাও।’

রান্নাঘর থেকে আরও চারটে পাঁউরুটির সঙ্গে বনবিহারীর তুলে দেওয়া দু-পিস প্লেটে নিয়ে বসল মামণি। বনবিহারী লক্ষ করলেন ও ডিম নেয়নি। তিনি জিজ্ঞাসা করলে মামণি মাথা নাড়ল, অর্থাৎ খাবে না। বনবিহারী রান্নাঘর থেকে একটা চামচ আর জেলির শিশি এনে সামনে রাখলেন, এটা মাখিয়ে খাও। শুকনো রুটি খাওয়া যায় না।’ মামণির ঠোঁটে হাসি ফুটল। শিশি খুলল সে।

বনবিহারী এবার নিজে চা বানালেন। দু-কাপ। একটা কাপ মামণির সামনে রাখতেই সে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ‘উঃ’ বলল।

চা খেতে খেতে মেয়েটাকে ভালো করে দেখলেন। গলায়, হাতে গুড়ি গুড়ি ঘামাচির মতো র‍্যাশ বেরিয়েছে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কতদিন স্নান করোনি?’

মামণি দুটো আঙুল তুলে দেখাল। ওটা দু-মাস হবে, দুদিন অস্নাত থাকলে এরকম চেহারা হয় না, চামড়াতেই তা বোঝা যাচ্ছে।

চা খেতে খেতে ওর খাওয়া দেখলেন। গোগ্রাসে খেয়ে বোতল থেকে অনেকটা জল গলায় ঢেলে চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ল মামণি। তারপর চায়ে চুমুক দিল।

এবার বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই কয়বছর কীরকম কাটালে?’

‘কাঁধ ঝাঁকাল মামণি। চায়ে চুমুক দিল আবার।

‘আমরা যে এখানে আছি তা জানলে কী করে?’

সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাসি ফুটল, মাথা দোলাতে লাগল সে। যেন, গোপন তথ্য ফাঁস করব না।

একটি বোবা মানুষকে জেরা করার কোনও মানে হয় না। যে কথা বলতে পারে না সে জবাব দেবে কী করে! অবশ্য কাগজে লিখে সেটা দিতে পারে কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে সেই ইচ্ছেটাই নেই।

বনবিহারী সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কখন যাবে?’

এবার মুখ তুলল মামণি। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল যার অর্থ, যাবে না।

‘না। তোমার এখানে থাকা চলবে না। আমাকে না বলে, খুব অপমান করে যার সঙ্গে চলে গিয়েছিলে তার সঙ্গে তো এতদিন দিব্যি ছিলে। হঠাৎ ভূতের মতন উদয় হয়ে যদি বলো এখানে থাকবে তা মেনে নিতে পারছি না। একটু পরে বাথরুমে গিয়ে ভালো করে স্নান করো। আমি নতুন সাবান বের করে দিচ্ছি। ভরদুপুরে এই এলাকা একদম ফাঁকা হয়ে যায়। তখন বেরিয়ে গেলে কেউ দেখতে পাবে না।’ গম্ভীর গলায় বললেন বনবিহারী।

দ্রুত মাথা নেড়ে ‘না’ বলতে লাগল মামণি।

হঠাৎ মাথায় ভাবনাটা আসতেই বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাকে কি কালীচরণ এ বাড়ির খবর দিয়েছে?’

কয়েক মুর্হূত ভাবল মামণি, তারপর মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।

‘বাঃ। তার সঙ্গে কোথায় দেখা হল?’

উত্তর দিল না সে। বনবিহারী চেয়ার ছেড়ে উঠে একটা সাদা কাগজ আর ডটপেন এনে ওর সামনে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী করে দেখা হল?’

অত্যন্ত অনিচ্ছায় মামণি লিখল, ‘বাজারে।’

‘তুমি বাজারে এসেছিলে? পুলিশ ধরতে পারে জেনেও এসেছিলে?’

মাথা নাড়ল মামণি। তারপর লিখল, ‘কালীচরণ আমাকে বাঁচায়। লুকিয়ে নিয়ে আসে এখানে। ও পালিয়ে যায় জঙ্গলে।’

‘ও মানে, সেই ছেলেটা যে তোমাকে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল?’

মামণি লিখল, ‘আমি নিজেই গিয়েছিলাম।’

‘এখন দয়া করে নিজে এখান থেকে চলে যাও। আমি চেম্বারে যাওয়ার আগেই এখান থেকে যাবে। তোমার জন্যে পুলিশের হাতে আমি পড়তে চাই না।’

হঠাৎ মামণি লিখল, ‘আমার ছেলে কোথায়?’

লেখাটা দেখে একটু থিতিয়ে গেলেন বনবিহারী। তারপর বেশ জোরে বললেন, ‘যে মা ওইটুকুনি শিশুকে অবহেলায় ফেলে যায় তার কোনও অধিকার নেই এতদিন পরে এসে ওই প্রশ্ন করার। ও জানে ওর মা মরে গেছে।’

মামণি লিখল, ‘মিথ্যে কথা। মা না, বাবা মরে গেছে।’

‘মা-ও। তুমি তাকে দেখলে চিনতে পারবে? পারবে না? তাকে আমি যেভাবে মানুষ করছি তা তোমার খামখেয়ালিতে নষ্ট হতে দেব না।’ নিজের ঘরের দিকে এগোলেন বনবিহারী, ‘আমার বাড়িতে তোমার জায়গা নেই।’

নিজের ঘরে ঢুকে মনে পড়ল সাবান দেওয়ার কথা। ওর শরীরে যদি খারাপ ধরনের চর্মরোগ হয়ে থাকে তাহলে—! কিন্তু মত বদলালেন তিনি। তাঁর ব্যবহার করা সাবান যদি ও ব্যবহার করে তো করুক। ওটা ফেলে দিলেই হবে। নতুন সাবান ওকে দেওয়ার কোনও দরকার নেই। শুয়ে পড়লেন তিনি।

এখন বুঝতে পারছেন কালীচরণ কেন ছুটি নিয়ে পালিয়েছে। সে বুঝতে পেরেছিল মামণিকে বেশিদিন এই বাড়িতে তাঁর চোখের আড়ালে রাখতে পারবে না। তাই ধরা পড়ে গেলে তিনি তার কী দুরবস্থা করবেন তা আন্দাজ করে আগেভাগে চলে গেছে। কিন্তু মেয়েটাকে এত স্নেহ দেখাল কেন সে? সন্তানকে কালীচরণ খুব ভালোবাসে। যে মা সন্তানকে এক কথায় ছেড়ে গিয়েছিল তাকে আশ্রয় দেওয়াটা কি স্বাভাবিক? আর বাজার থেকে মামণিকে এখানে নিয়ে আসার পথে পুলিশ তো মামণির সঙ্গে ওকেও ধরতে পারত? এত বড় ঝুঁকি নিল? হঠাৎ বনবিহারীর মনে হল কালীচরণ কাছেপিঠে কোথাও আছে যেখানে থাকলে এখানকার খবর সে পাবে। ওর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না, যাবে কোথায়?

গতরাত জাগার ক্লান্তি, উত্তেজনা যে অবসাদ তৈরি করছিল তাতে চোখ বুজে গেল বনবিহারীর। যখন ঘুম ভাঙল তখন বেলা দুটো। ঘুম ভাঙতেই খিদে পেল। দুপুরের খাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে? সেই সময় বাইরের দরজায় শব্দ হল। তিনি উঠে ভেতরের ঘরে এসে বুঝলেন মামণি বাথরুমে স্নান করছে। তাড়াতাড়ি বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘আমি না বলা পর্যন্ত জলের শব্দ করবে না। বাথরুম থেকে বের হবে না। বাইরের লোক এসেছে।’

তারপর দুটো ঘর পেরিয়ে দরজা খুললেন। তিনি অবাক। সদানন্দর বউ দাঁড়িয়ে আছে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে। পেছনে রিকশা। তিনি বললেন, ‘একী!’

‘দোকানে খুব ভিড় বলে সে আসতে পারল না। তার জন্যে অপেক্ষা করে করে বেশ দেরি হয়ে গেল। অনেকক্ষণ না খেয়ে আছেন, আমাকে ক্ষমা করবেন।’

সদানন্দর বউ বাইরের ঘরের টেবিলের ওপর টিফিন ক্যারিয়ার রাখল।

‘এভাবে আমাকে লজ্জায় ফেলার কোনও কারণ আছে? ছি ছি ছি। এই দুপুরবেলায় এতটা পথ এসেছ আমাকে খাবার দিতে!’

সদানন্দর বউ হাসল, ‘আমি চললাম।’ তারপর হন হন করে বাইরে বেরিয়ে রিকশায় উঠল। রিকশাটা চলে গেল। দরজা বন্ধ করে ওটা খাবারের টেবিলে রেখে বাথরুমের কাছে গিয়ে স্নান শেষ করতে বললেন তিনি।

সদানন্দর স্ত্রী হয়তো মন থেকে করছে কিন্তু তাঁর পক্ষে খুব অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। এটা ঠিক, এখন খাবারটা আসায় দারুণ উপকার হল কিন্তু রিকশা ভাড়া দিয়ে এতসব করা কি সদানন্দর পছন্দ হবে? এ বিষয়ে পরে কথা বলতে হবে।

স্নান করে ওই ময়লা শার্ট-প্যান্ট পরে থাকা সত্ত্বেও মেয়েটাকে আগের থেকে অনেক তাজা দেখাচ্ছিল। বনবিহারী বললেন, ‘বসে পড়ো। খুব খিদে পেয়েছে।’

তিনটে বাটি। একটাতে ভাত এবং অনেকগুলো পটল ভাজা। দ্বিতীয়টিতে সবজি দিয়ে রান্না ডাল, তৃতীয়টিতে অনেকটা মুরগির মাংসের সঙ্গে ঝোল। চমৎকার গন্ধ বের হচ্ছিল। যা আছে তা দুজনের পক্ষে যথেষ্ট। সদানন্দর বউ কি ভেবেছে দুপুরবেলায় তিনি দুজনের খাবার খান!

মামণি ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, কোত্থেকে এসব এল?

বনবিহারী আঙুল তুলে ওপর দিকটা দেখালেন।

খাবার শেষ করার পর বনবিহারী বুঝলেন তাঁর পেট ভরে গেলেও মামণির আরও দরকার ছিল। বেশিদিন না খাওয়ার পর খেতে বসলে বেশি খাওয়া যায় না। কিন্তু এই মেয়েটার ক্ষেত্রে তা উলটো দেখছেন।

হাতমুখ ধুয়ে আসার পর তিনি বললেন, ‘মিনিট পনেরো বিশ্রাম করো। খেয়েই বেরুতে হবে না। তারপরে চলে যাও। আমি দরজা বন্ধ করে বিশ্রাম নেব।’

নিজের ঘরে চলে এলেন তিনি। লোকে বলে, কোকিল নাকি কাকের বাসায় ডিম পেড়ে যায়। কাক তা দিয়ে সেটা থেকে বাচ্চা বের করে। ব্যাপারটা এখনও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না তাঁর। প্রথমত, কাক বাসা তৈরি করে ডিম পেড়েছে জেনে কোকিল গর্ভবতী হবে এবং ডিম পাড়বে এটা কী করে সম্ভব! দ্বিতীয়ত, ডিমের ওপর থেকে মা-কাক কখনই সরে যায় না। তিনি দেখেছেন অন্য কাক এসে মা-কাককে খাওয়ায়। যদি বা মা-কাক বাসা ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্যে অন্যত্র যায় তাহলে অন্য কাকরা বাসার কাছে থাকে। কোকিলের পক্ষে তাদের নজর এড়িয়ে আসা সম্ভব নয়। যদি তাও হয় তাহলে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পরে মা কাক পার্থক্য বুঝতে পারবে এবং কোকিলছানাকে মেরে ফেলবে। সেক্ষেত্রে পৃথিবীতে কোনও কোকিলই থাকবে না। ফাল্গুন-চৈত্র তো বটেই অন্য শুকনো ঋতুতেও এখানে এত কোকিল ডাকে যে এই থিওরি সত্যি বলে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু মামণি কোকিলের মতো বাচ্চা হওয়ার পরে উধাও হয়ে গিয়েছিল। কাকের বাসায় কোকিলছানা যদি বেঁচেও থাকে তাহলে তার সঙ্গে কোকিল মায়ের কোনও সম্পর্ক থাকে না। গুজব বিশ্বাস করলে বুঝতে হবে কোকিল মায়ের মনে সন্তানস্নেহ নেই। নাঃ, তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না মামণিকে। দরকার হলে কিছু টাকা দিতে পারেন যাতে কোথাও চলে যেতে পারে।

আধঘণ্টা পরে তিনি ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখলেন মামণি একমনে কিছু লিখে যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘কী হল, পনেরো মিনিট বলেছিলাম, আধঘণ্টা হয়ে গেছে।’

মামণির সামনে অনেকগুলো কাগজের টুকরো। তার একটা এগিয়ে দিল সে। বনবিহারী পড়লেন, ‘আমি এখানে থাকতে এসেছি।’

সঙ্গে সঙ্গে বনবিহারী চেঁচিয়ে বললেন, ‘অসম্ভব।’

এবার দ্বিতীয় কাগজ এগিয়ে দিল মামণি, ‘আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না।’

‘যখন চলে গিয়েছিলে, তখন মনে ছিল না? আমি যতই করি, কখনও ছেলেটাকে মায়ের স্নেহ দিতে পারিনি। সারাজীবন ওকে বঞ্চিত করলে তুমি!’

তৃতীয় কাগজ এগিয়ে দিল মামণি, ‘আমি ভুল করেছিলাম। ক্ষমা চাইছি।’

‘কবে ভুল বুঝলে? এতদিন লাগল? না, তুমি চলে যাও।’

চতুর্থ কাগজ, ‘কেন যাব?’

‘কারণ তুমি ওই ছোকরার জন্যে ছেলেটাকে বঞ্চিত করেছ।’

‘পঞ্চম কাগজ, ‘কিছু মনে করবেন না, তার জন্যে আপনি দায়ী।’

‘আমি? তোমার পালিয়ে যাওয়ার জন্যে আমি দায়ী?’ বেশ হকচকিয়ে গেলেন বনবিহারী। এবার ছয় নম্বর কাগজ এগিয়ে দিল মামণি, ‘আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঠিক কী ছিল বুঝতে পারিনি। আপনি অবিবাহিত, যথেষ্ট বয়স হলেও বৃদ্ধ হননি। আমি বাচ্চার মা হলেও শরীরের চাহিদা হত। আপনি সাধু-সন্ন্যাসীর মতো ব্যবহার করতেন। না করলে আমি কোথাও যেতাম না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *