দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ১২

বারো

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বড়বাবু, ‘আসুন আসুন ডাক্তারবাবু! এই রাত্রে দুর্যোগের মধ্যে আপনাকে থানায় আসতে বলা অবশ্যই ঠিক নয় কিন্তু না এনে উপায় ছিল না। বসুন, বসুন।’

ছেলেটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ারে বসলেন বনবিহারী। বেশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন!’

‘ওই যে ছেলেটি বেঞ্চিতে শুয়ে আছে, ওকে একটু পরীক্ষা করে বলুন তো কতটা আহত হয়েছে। বেশ রক্ত বেরিয়েছিল, চাপাচুপো দিয়ে বন্ধ করেছি।’ বড়বাবু হাসলেন।

‘কী হয়েছিল?’

‘যা হয়। গুলি করার অভ্যেস নেই অথচ সামনাসামনি এনকাউন্টারে গুলি চালিয়েছিল। পুলিশ আত্মরক্ষার জন্যে পালটা গুলি করে। মেরে ফেলার ইচ্ছে থাকলে মাথা বা বুকে গুলি করতে পারত। তা না করে পায়ে করেছে। থাইতে লেগেছে।’

‘এখন এরকম ঘটনা এখানে ঘটছে বলে শুনতে পাই না।’

‘সব খবর কি পাবলিকের কাছে পৌঁছায়? যাক গে, আপনি পরীক্ষা করে বলুন ওকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে রেইডে গেলে টেঁসে যাবে কিনা! আমরা ওকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। আবার ওর দলের লোকদের হদিস পেতে ওকে নিয়ে যাওয়াও খুব জরুরি। সেটা করতে গিয়ে যদি ফ্যাটাল কিছু হয় তাহলে—।’ মাথা নাড়লেন বড়বাবু, ‘আফটার অল আমি তো ইনহিউম্যান নই।’

অতএব বনবিহারীকে উঠতে হল। ছেলেটা চিত হয়ে শুয়েছিল। মাথা একপাশে হেলানো। ওর পাশে গিয়ে সন্দেহ দৃঢ হল। হ্যাঁ, একে তিনি দেখেছেন কিন্তু কোথায় তা মনে পড়ছে না। ছেলেটার জ্ঞান আছে কিন্তু সম্ভবত অতিরিক্ত রক্তপাতের জন্যে নিস্তেজ হয়ে গেছে। ওর ফুলপ্যান্টের একটা দিক থাই থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। একেবারে কুঁচকির কাছাকাছি লালচে মোটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। ব্যান্ডেজ যে রক্তের জন্যে লালচে হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সতর্ক হাতে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগলেন। পা একটু নড়াতেই তারস্বরে চিৎকার করে উঠল ছেলেটা। ওপাশে দাঁড়ানো এএসআই প্রায় বুলডগের মতো ধমক দিয়ে বললেন, ‘চোপ! গুলি ছোঁড়ার সময় মনে ছিল না?’

ছেলেটা তখন গোঙাচ্ছে, ‘ও মা, মাগো!’

বড়বাবু তাঁর চেয়ারে বসে হাসলেন, ‘যত বড় উগ্রপন্থী হোক না কেন কষ্ট হলে মাকে স্মরণ না করে উপায় নেই।’

বনবিহারী ক্ষত দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গুলি কখন লেগেছিল?’

‘বিকেলে। এই পাঁচটা নাগাদ।’

‘গুলিটা তো ভেতরেই রয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।’

‘থাকতেই পারে। বের করার কায়দা তো জানি না।’ বড়বাবু উঠে এলেন, ‘আপনি যদি বের করে দেন তাহলে কি ও আউট অফ ডেঞ্জার হবে?’

‘ওকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।’

‘আপনি পারবেন না?’

‘গুলি বের করার যন্ত্রপাতি আমার সঙ্গে নেই।’

এএসআই বললেন, ‘ভোরবেলায় নিয়ে গেলে চলবে না?’

‘আপনারা যদি ভালো বোঝেন তাই করবেন।’ বনবিহারী আবার ব্যান্ডেজটা বেঁধে দিলেন। এখনও রক্ত বন্ধ হয়নি।

‘তাহলে আপনাকে নিয়ে এসে কী লাভ হল?’ এএসআই বললেন।

শুনে মাথা গরম হয়ে গেল বনবিহারীর, ‘দেখুন ভাই, আমি একজন ডাক্তার। পেশেন্টের চিকিৎসা করাই আমার কাজ। তাকে টোপ হিসেবে কেউ ব্যবহার করতে চাইলে আমি সাহায্য করতে পারি না।’

গলার স্বর উঁচুতে উঠেছিল। বড়বাবু বললেন, ‘সরি, এভাবে ওর কথা বলা উচিত হয়নি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। আমি ওকে এখনই হাসপাতালে পাঠাচ্ছি।’

এ এস আই মাথা নাড়লেন, ‘অদ্ভুত ব্যাপার। এইসব দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ নিজের প্রাণ দিচ্ছে। আর পাবলিক দূর থেকে সমালোচনা করে যাবে। কিন্তু স্যার, এই বৃষ্টির মধ্যে ওকে হাসপাতালে পাঠাবেন কী করে? নীচের শহরে যেতে তো অসুবিধে হবে। নদীতে জল বাড়বেই।’

‘ট্রাই করো। ওর কাছ থেকে পরে অনেক খবর পাওয়া যাবে।’

বনবিহারী আবার ছেলেটিকে পরীক্ষা করলেন, ‘অজ্ঞান হয়ে গেছে।’

ঠিক তখনই ফোন বাজল। বড়বাবু রিসিভার তুলে একটু কথা বলেই বেশ উত্তেজিত হলেন, ‘দত্ত, তুমি ফোর্স নিয়ে জঙ্গলে চলে যাও। দুটো ছেলেকে এই বৃষ্টিতে জঙ্গলের পথে দেখা গেছে।’

‘গুলি করব?’

‘আঃ! অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবে। ওরা যে উগ্রপন্থী তা আগেই জানছ কী করে?’ বড়বাবু বিরক্ত হলেন, ‘ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে যাও।’

এএসআই বেরিয়ে গেলে ঘড়ি দেখলেন বড়বাবু, ‘বহুত রাত হয়ে গেছে। আমার আর একজন সাব ইন্সপেক্টরের পেট খারাপ, জ্বর। দুটো কনস্টেবলের ওপর দায়িত্ব দিয়ে ওকে হাসপাতালে পাঠাব? রিস্ক হয়ে যাবে।’

নিজের মনেই যেন কথা বলছিলেন বড়বাবু। বনবিহারী ছেলেটির মুখের দিকে তাকলেন আবার। যদি খুব ভুল না হয়—! তা কী করে হয়? সেই ছেলে তো সুন্দরবনে মামণিকে নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এখানে এসে গুলি খাবে কেন? কিন্তু বেশিক্ষণ গুলি শরীরে থাকলে পচন শুরু হয়ে যেতে পারে। একটু ইতস্তত করে বনবিহারী বললেন, ‘আমার রাতের ঘুমের তো দফারফা হয়ে গেছে। আপনি যদি চান তাহলে কনস্টেবলদের সঙ্গে আমি হাসপাতালে যেতে পারি।’

‘সত্যি? আপনার অসুবিধে হবে না তো?’

মিনিট পাঁচেক পরে বৃষ্টি ভেঙে জিপ চলছিল। ড্রাইভারের পাশে বসেছিলেন বনবিহারী। পেছনে দুই বন্ধুকধারীর সামনে ছেলেটিকে শোওয়ানো হয়েছিল। জিপ একটু লাফালেই যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল সে। বনবিহারী বুঝছিলেন, বৃষ্টি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। সাদা হয়ে গেছে পৃথিবী যা ভেদ করে জিপের হেডলাইট বেশি দূর স্পষ্ট করতে পারছিল না। সে কারণেই গতিও বাড়াতে পারছিল না ড্রাইভার। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট যাওয়ার পর জিপ যখন নীচের দিকে নামছে তখন রাস্তায় জল দেখা গেল। জিপ থামিয়ে ড্রাইভার বলল, ‘কী করব? এগোব?’

বনবিহারী বললেন, ‘নদী কত দূরে?’

‘বেশি দূরে না। কিন্তু তার আগেই রাস্তা ডুবে গেছে স্যার। ব্রিজটা পর্যন্ত আন্দাজে যেতে হবে। কিন্তু ওটার যা অবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে গেলে বোধহয় মরে যাবে।’ ড্রাইভারের গলায় সহানুভূতি স্পষ্ট হল।

image16.jpg

বনবিহারী কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। ভুল করে জিপ যদি নদীর বুকে নেমে যায় তাহলে আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই।

ড্রাইভার মুখ ফিরিয়ে বন্দুকধারীদের একজনকে বলল, ‘তুমি নামো ভাই। খুব ধীরে জিপের সামনে হেঁটে চলো। জল কোমরের কাছে চলে গেলে আর হাঁটবে না।

দুজন যেন শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে বসে থাকল।

ড্রাইভার চিৎকার করল, ‘কী হল? কানে যাচ্ছে না?’

একজন জবাব দিল, ‘আমি সাঁতার জানি না।’

‘কেউ তো সাঁতার কাটতে বলেনি। হাঁটতে বলেছি। নামো।’

অনেক ইতস্তত করে একজন নামল বন্দুক রেখে। জিপ থেকে দু-হাত এগিয়ে সে হাঁটছিল। বৃষ্টিতে চুপসে গেছে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। জল কখনও হাঁটু, কখনও গোড়ালির ওপর ওঠানামা করছে।

প্রায় দশ মিনিট ওইভাবে চলার পর ব্রিজের দেখা পাওয়া গেল। সেটা তখনও অটুট এবং জলের অনেকটা ওপরেই রয়েছে। ড্রাইভার বলল, ‘বাঁচা গেল।’

ওঁরা যখন হাসপাতালে পৌঁছলেন তখন রাত সাড়ে তিনটে। ইমার্জেন্সি খোলা থাকলেও বৃষ্টির কারণে ডাক্তারকে তুলতে সময় লাগল। তখনই অপারেশন করে গুলি বের করা হল। ছেলেটির পা অবশ করে কাটাছেঁড়া করা হয়েছিল তবু তার চিৎকার থামেনি। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে আলাদা বেডে ওকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর লোকাল থানার পুলিশ এসে দায়িত্ব নিল। এসব শেষ হতে না হতেই পৃথিবী ফরসা হল কিন্তু রোদ উঠল না, বৃষ্টিও চলছিল সমানে।

ড্রাইভার এসে বনবিহারীকে বলল, ‘স্যার, এখন ফেরা যাবে না। যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে ব্রিজের ওপাশে এক বুক জল জমে গিয়েছে। আমি বড়বাবুকে ফোন করে দিয়েছি। তিনি বললেন, আপনি যদি চান তাহলে এখানকার কোনও হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন। টাকাপয়সা দিতে হবে না।’

বনবিহারী বললেন, ‘তার দরকার হবে না। আমি এই ওয়েটিং রুমেই আছি। তুমি ফেরার আগে আমাকে খবর দিও।’

বনবিহারী যে ডাক্তারি করেন তা ড্রাইভারের সৌজন্যে হাসপাতালের চিকিৎসকরা জেনে যাওয়ায় একটু খাতিরযত্ন পাওয়া গেল। ডাক্তারদের বিশ্রাম করার ঘরে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালের সুপার তাঁকে চা খাওয়ালেন। একটা সময় বৃষ্টি ধরলেও জানা গেল ওপরে সমানে বৃষ্টি চলছে।

সকাল আটটা নাগাদ ছেলেটির কাছে গেলেন বনবিহারী। দুজন লোকাল থানার পুলিশ তাকে পাহারা দিচ্ছে। ওরা রাত্রেই বনবিহারীর পরিচয় জানায় কাছে যেতে আপত্তি জানাল না। বনবিহারী টুল টেনে নিয়ে ছেলেটির বিছানার পাশে বসলেন। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ছেলেটি। ওর হাত তুলে নিয়ে ঈষৎ চাপ দিতেই চোখ সামান্য খুলে গেল। বনবিহারী ওর কপালে হাত রেখে নীচু গলায় ডাকলেন, ‘এই যে! শুনতে পাচ্ছ?’

দুবার ডাকার পর চোখ খুলল ছেলেটি। ঘোলাটে চোখ। বনবিহারী বুঝলেন এখনও কথা বলার মতো অবস্থায় সে আসেনি। তিনি উঠে পড়লেন।

কিন্তু এখন বনবিহারী প্রায় সত্তরভাগ নিশ্চিত যে এই ছেলেটিই পাথরপ্রতিমাতে মামণির সন্ধানে গিয়েছিল। এত জায়গা থাকতে সে কী করে ভেবেছিল মামণিকে ওই পাথরপ্রতিমায় পাওয়া যাবে তা তাঁকে বিস্মিত করেছিল অনেক আগে। তিনি যে ওদের নিয়ে সেখানে চাকরি করতে গিয়েছেন তা কালীচরণ ছাড়া কারও জানার কথা নয়। আর এখনও তিনি বিশ্বাস করেন কালীচরণ মুখ খোলেনি।

হাসপাতালের বিশ্রাম ঘরে পৌঁছে বনবিহারী দেখলেন বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। হালকা রোদ উঠেছে। তিনি চেয়ারে বসে মাথা নাড়লেন।

তাঁর যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে এই ছেলেটি এতদিন কোথায় ছিল? আর মামণি বা এখন কোথায়? সন্তানের বয়স মাথায় রাখলে ওরা উধাও হয়ে গিয়েছিল দীর্ঘদিন আগে। এতকাল কোথায় ছিল? ছেলেটি যে তার দলের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে ছিল না তা গতকালের ঘটনা থেকে প্রমাণিত। মামণি কি ওর সঙ্গে ছিল? নাকি তাকে ত্যাগ করেছে এই ছেলেটি?

বিস্ময়ের ব্যাপার, তাঁর নতুন শহর, পাহাড়ি-জঙ্গল এলাকায় হলেও কখনও উগ্রপন্থীদের আনাগোনার কথা কেউ শোনেনি। কিন্তু ওরা জঙ্গলে ঘাঁটি তৈরি করেছিল, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে, এসব কিছুদিন আগেও ভাবা যেত না। মামণি কি ওই জঙ্গলে লুকিয়ে আছে? বনবিহারীর মনে তীব্র অস্বস্তি, কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল কালীচরণের কথা। বলা কওয়া নেই কালীচরণ আচমকা দেশে যাবে বলে ছুটি চাইল কেন? আর যেদিন সে ছুটি নিয়ে চলে গেল সেই বিকেলেই পুলিশের সঙ্গে উগ্রপন্থীদের সংঘর্ষ হয়েছে এবং ওই ছেলেটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। কালীচরণ কি কোনওভাবে ওদের কথা জানতে পেরেছিল? ছেলেটিকে ওর চেনার কথা নয়। তাহলে মামণি যে ওই জঙ্গলে এসেছে তা টের পেয়ে ছুটি নিয়ে চলে গেল? এতক্ষণে স্পষ্ট হল বনবিহারীর কাছে। কালীচরণের আচরণের একটা ব্যাখ্যা আবিষ্কার করে তিনি আরও বিরক্ত হলেন। বেশি পাকামি। মামণি যে ওই জঙ্গলে এসেছে তা তাঁকে যদি কালীচরণ জানাত তাহলে—! থমকে গেলেন বনবিহারী। আচ্ছা, কালীচরণ জানল কী করে? সে তো বাড়ি আর বাজার ছাড়া কোথাও যায় না। উগ্রপন্থী যারা তারা নিশ্চয়ই নিজেদের অস্তিত্বের কথা জনসাধারণকে জানাবে না। তা ছাড়া বনবিহারী যে ওই শহরে আছেন তা মামণির জানার কথা নয়। তাহলে কালীচরণ কী করে ওদের খবর পাবে? এই ধন্দটা কিছুতেই যাচ্ছিল না বনবিহারীর। কিন্তু এখন তিনি নিঃসন্দেহ, ও জেনেছিল। ডাক্তার হিসেবে বনবিহারীর সুনাম আছে। সবাই তাঁর কথা জানে। যতই ওরা জঙ্গলে থাকুক, তাঁর খবর মামণিরা নিশ্চয়ই পেয়েছিল। তারপর তিনি যখন চেম্বারে থেকেছেন তখন সন্ধের অন্ধকারে বাড়িতে আসতেই পারে। তাঁর বাড়ি কোথায় তা যে কেউ ওদের বলে দেবে। কালীচরণ মামণিকে যথেষ্ট স্নেহ করত। এতকাল পরে তাকে দেখতে পেয়ে সেই স্নেহ উথলে পড়েছিল। ওরা চলে যাওয়ার পর বোধহয় ভয় পেয়েছিল। তাঁকে বলতে সাহস পায়নি। এমন হতে পারে সন্তানের কথা জানতে চেয়েছিল মামণি। তাতেই ভয় পেয়েছে কালীচরণ। মামণি যদি নিজের ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় তাহলে সে বাধা দিতে পারবে না। অথচ একটু একটু করে যাকে সে বড় করেছে তাকে কিছুতেই অনিশ্চিতের মধ্যে ছেড়ে দিতে পারে না কালীচরণ। এমনও হতে পারে মামণিকে এড়াতেই সে দেশে যাওয়ার নাম করে পালিয়েছে। মামণির কথা তাঁকে বললে তিনি দুশ্চিন্তায় পড়বেন বলে জানায়নি।

বনবিহারীর মনে হল কোনও প্রমাণ না থাকলেও তাঁর এই ধারণাটাই সত্যি। কিন্তু কালীচরণ যদি তাঁকে সময়মতো জানাত তাহলে হয়তো পুলিশের সঙ্গে ওদের কোনও সংষর্ঘ হত না। তিনি যেমন করেই হোক যোগাযোগ করে ওদের বলতেন এই এলাকা থেকে চলে যেতে। এই ছেলেটিও গুলিবিদ্ধ হত না।

‘স্যার!’ ড্রাইভার এসে দাঁড়াল সামনে, ‘চলুন, এখন এখানে বৃষ্টি নেই, হয়তো নদীর জল কমে গেছে।’

‘চলো।’ বনবিহারী উঠলেন।

জিপের ইঞ্জিন চালু করে ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল, ‘ছেলেটা বেঁচে যাবে তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘আচ্ছা, ওরা পুলিশ মারে কেন বলুন তো? ওরা কী চায়?’

অবাক হলেন বনবিহারী। পুলিশের জিপের ড্রাইভার তাঁকে এই প্রশ্ন করছে? উত্তরটা তো ওর অজানা নয়। তিনি মাথা নাড়লেন, ‘জানি না। ওই ছেলেদের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই।’

‘আপনার মতো মানুষের থাকবে না কিন্তু দেশের অনেক বড়লোক নাকি ওদের পেছনে আছে। কী যে লাভ হয়! আর আপনি যদি ভাবেন শুধু ছেলেরা ওই দলে আছে তাহলে ভুল করবেন। কাল আমাদের ভ্যানের ড্রাইভার বলছিল ওই দলে মেয়েও আছে।’ ড্রাইভার নীচু গলায় খবরটা দিল।

সোজা হয়ে বসলেন বনবিহারী। তাঁর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সেই ভ্যান ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে। মামণির চেহারার বর্ণনা দিলে সে কি বলতে পারবে তাকে সংঘর্ষের সময় দেখেছে কিনা? নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। এই যে কিছুক্ষণ আগে তিনি ভাবছিলেন, কালীচরণ খবর দিলে ছেলেটির পায়ে গুলি লাগত না, সেটা কি ঠিক কাজ হত? পুলিশ জানলে তাঁকেই অপরাধীকে সাহায্য করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করত! না, তিনি কখনওই উগ্রপন্থীদের সমর্থন করেন না। কিন্তু মামণির কথা শোনার পর মনটা কীরকম নরম হয়ে যাচ্ছে তাঁর।

পাহাড়ি নদীর চরিত্র বিচিত্র। বৃষ্টির সময় জল যেমন দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল, বৃষ্টি ধরলে সেটা কমে যেতে সময় লাগেনি। জিপ ব্রিজ পেরিয়ে এল স্বচ্ছন্দে। কিন্তু ওপরে এসে দেখা গেল এদিকটায় বৃষ্টি হয়েই চলেছে। প্রবাদটার কথা মনে পড়ল। এখানে বৃষ্টি নামলে সহজে থামতে চায় না।

বাড়ির সামনে জিপ থেকে নেমে পড়লেন বনবিহারী। তাঁর শরীর আর পারছিল না। সারারাত জেগে মাথা ঘুরছিল। দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকে মনে হল বেশ খিদে পেয়েছে। উঠোনের দিকের দরজাটা খুলে রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। মনে হল, কেউ যেন তাঁকে দেখতে পেয়ে দ্রুত সরে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *