দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ১০

দশ

সদানন্দর বউ আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল এই খবর গঞ্জের সবাই জেনে গিয়েছে কিন্তু কেন করতে চেয়েছিল তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গেল। পরের দিন দোকানে গিয়ে বসতে না বসতেই সদানন্দ অস্বস্তিতে পড়ল। গায়ে পড়ে তাকে এসে জিজ্ঞাসা করছে, ‘কী হয়েছিল ভাই? ঝগড়া হয়েছিল খুব? মারধোর করোনি তো? এখন কেমন আছে? হাঁটা-চলা করছে?’

‘কী হয়েছিল জানি না, মারধোর দূরের কথা, ঝগড়াটগড়া হয়নি। এখন ভালো আছে।’ এই কথাগুলো বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেল সদানন্দ। সে লক্ষ করছিল উত্তর শোনার পরেও প্রশ্নকর্তার ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই থাকে। তারা বোধহয় অন্য কোনও রহস্যের গন্ধ খোঁজে।

বেলা এগারোটা নাগাদ থানার মেজবাবু এলেন জিপে চড়ে। তখন জনাচারেক লোক ডাল-ভাত-তরকারি খাচ্ছে। দোকানে ঢুকেই মেজবাবু সদানন্দের সামনে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে দেখে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সদানন্দ নমস্কার জানাল।

‘সদানন্দবাবু, আপনার দেখছি অনেক হিতৈষী আছে!’

বুঝতে না পেরে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল সদানন্দ।

‘তারাই খবরটা পাঠিয়েছে বলে আমাকে আসতে হল।’

‘আজ্ঞে, বসুন।’ নিজেই চেয়ার এগিয়ে দিল সদানন্দ।

‘না। বসব না। প্রথমে বলুন, আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন?’

গলা শুকিয়ে গেল সদানন্দর। দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, ‘না, ঠিক আত্মহত্যা নয়, ভুল করে কিছু খেয়ে ফেলেছিল। দশ মিনিটের মধ্যে ঠিক হয়ে গেছে।’

হাসলেন মেজবাবু, ‘ভুল করে কি কেউ বিষ খায়?’

‘না, ভয়ানক বিষ নয়, ওই আরশোলা মারার ওষুধকে কি বিষ বলা যায়?’

‘বলা হয়েছে ডাক্তারবাবু তখনই ছুটে না গেলে ভদ্রমহিলা বাঁচতেন না। মরে গেলে ল্যাটা চুকে যায়। স্বামীর অত্যাচারে বউ বিষ খেয়েছে কিনা তা প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু মরতে গিয়েও যদি না মরে তাহলেই হয় সমস্যা।’ মেজবাবু যখন কথাগুলো বলছেন তখন একে একে অনেক মানুষ ঢুকে গেছে দোকানে, কৌতূহলে। তাদের দিকে তাকিয়ে আচমকা ধমকে উঠলেন মেজবাবু, ‘একী! আপনারা এখানে ভিড় করেছেন কেন? যান, বেরিয়ে যান।’

মেজবাবুর সঙ্গে আসা সেপাই সবাইকে বাইরে বের করে দিল। যে চারজন খাচ্ছিল তারাও পায়ে-পায়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। সদানন্দ সেটা লক্ষ করেও মুখ খুলল না। মেজবাবু বললেন, ‘আমার কাছে খোলাখুলি বলুন মশাই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়ই। আমার স্ত্রী সেটা হলেই বাপের বাড়িতে চলে যান। আপনি কী এমন করেছিলেন যার জন্যে তিনি বিষ খেলেন?’

‘আমি জানি না, বিশ্বাস করুন।’

‘মারতেন নাকি?’

‘না, না, কক্ষনো না।’

‘সন্দেহ করতেন?’

‘সন্দেহ?’

‘হ্যাঁ। ওর চরিত্র নিয়ে সন্দেহ ছিল?’

‘কী যে বলেন!’

‘বাড়িতে আর কে কে থাকেন?’

‘আমরা দুজনই থাকি।’

‘আপনি যখন এই হোটেলে আসেন তখন তিনি একাই থাকেন?’

মাথা নাড়ল সদানন্দ, ‘হ্যাঁ, কেন?’

‘সেই সময় তিনি কী করছেন, কাদের সঙ্গে কথা বলছেন তা নিশ্চয়ই জানতে পারেন?’

‘না, না, সে ওই ধরনের মেয়েই নয়।’

‘তার মানে আপনি ওঁকে সন্দেহ করেন না?’

‘সন্দেহজনক কোনও কাজ তো করেনি।’

‘গুড। আপনার দিকটা জানা হয়ে গেল। কিন্তু এবার যে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে!’

‘ওর সঙ্গে? কেন?’

‘দেখুন আত্মহত্যা করা একটা অপরাধের মধ্যে পড়ে। আত্মহত্যার চেষ্টা করে সফল না হলে অপরাধটা আরও বেড়ে যায়। আপনি কোনও দুঃখ-কষ্ট না দেওয়া সত্ত্বেও উনি কেন আত্মহত্যা করতে গেলেন তা জানাটা জরুরি।’ মেজবাবু বললেন।

‘স্যার, ও ঘরের বউ, একটা ভুল না জেনে করে ফেলেছে–, আপনার সঙ্গে কথা বলতেই লজ্জা পাবে। ওকে ছেড়ে দিন স্যার।’

‘সেটা ওঁর সঙ্গে কথা না বলে তো হতে পারে না। চলুন।’

অগত্যা মেজবাবুর সঙ্গে জিপে উঠল সদানন্দ। সঙ্গে সঙ্গে মুখে মুখে রটে গেল সদানন্দকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।

গাড়িতে উঠেই মেজবাবু বললেন, ‘আমরা ডাক্তারবাবুর চেম্বার হয়ে যাব।’

সকালবেলায় বনবিহারী সুজয়কে নিয়ে যখন সদানন্দর বাড়িতে পৌঁছেছিলেন তখন সে দোকানে চলে গেছে। সদানন্দের বউ দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে খবরটা দিয়েছিল। বনবিহারী বলেছিলেন, ‘সুজয়বাবু এখন বেশ সুস্থ। ওঁকে নিয়ে এলাম। ওঁর ঘরের দরজা কি খোলা আছে?’

‘হ্যাঁ। আজ সকালে ঝাঁট দেওয়া হয়েছে।’

বনবিহারী সুজয়কে বললেন, ‘যান, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন। ক’টা দিন এখানে থাকুন। সদানন্দকে বলব হোটেল থেকে দু-তিনদিন খাবার পাঠিয়ে দিতে। আর ওর যদি আপনাকে ঘরভাড়া দিতে আপত্তি থাকে তাহলে এই মাসের ভাড়া দিয়ে সামনের মাসে অন্যত্র বাড়ি খুঁজে নেবেন। যান।’ সুজয় টিনের দরজা দিয়ে নিঃশব্দে ভেতরে চলে গেলে বনবিহারী সদানন্দর বউকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শরীর এখন কেমন?’

‘ভালো।’ গম্ভীর মুখে বলল সদানন্দর বউ।

আর কথা না বাড়িয়ে রিকশায় চেম্বারে চলে এসে একজন রুগি দেখতে না দেখতেই মেজবাবুর জিপ এসে দাঁড়াল। মেজবাবু সদানন্দকে বললেন, ‘আপনাকে নামতে হবে না। আমি কয়েকটা কথা বলেই ফিরে আসছি।’

মেজবাবুকে দেখে বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার?’

‘আর বলবেন না। এখানকার লোক কমপ্লেন করেছে বলে আসতে হল। আপনি তো কাল সদানন্দর বউকে বাঁচালেন। কী খেয়েছিলেন ভদ্রমহিলা?’

হেসে ফেললেন বনবিহারী, ‘পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাজকর্ম দেখছি খুব কমে গেছে। এই একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে তদন্ত করতে ছুটে এসেছেন?’

‘না, আত্মহত্যার চেষ্টা—!’

মেজবাবুকে থামিয়ে দিলেন বনবিহারী, ‘কে বলেছে আত্মহত্যা?’

‘তাই তো খবর পেলাম।’

হাসলেন বনবিহারী। জিপের পেছনে বসা সদানন্দর মুখটা এইসময় দেখতে পেলেন। বোঝাই যাচ্ছে বেশ ভয় পেয়ে গেছে। মেজবাবু একটা চেয়ার নিয়ে পেশেন্টের পাশে বসলেন। ঘরের অন্য রুগিরা পুলিশ দেখে মুখ বন্ধ করে বসে আছে।

বনবিহারী আবার কথা বললেন, ‘বলুন, কী করতে পারি?’

‘আপনি সব ব্যাপারটা গুলিয়ে দিচ্ছেন কেন? আপনি তো ওদের বাড়িতে গিয়েছিলেন!’

‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।’

‘গিয়ে কী দেখলেন?’

‘মেয়েটি খুব নার্ভাস হয়ে ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করছে।’

‘কান্নাকাটি করছে? অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল না?’

‘আধ চা-চামচ পুরোনো আরশোলা মারার ওষুধ জিভে ঠেকালে কেউ অজ্ঞান হয়ে যায় না। সেটা ব্যবহার করা সত্ত্বেও আরশুলা মরছিল না বলে বোকার মতো জিভে ঠেকিয়ে দেখতে চেয়েছিল ওটা নষ্ট হয়ে গেছে কিনা। তারপর খেয়াল হয়েছিল, ওটা বিষ ভেবে এত নার্ভাস হয়ে গেল যে মনে করেছিল মরে যাবে। আমার যাওয়ার দরকার ছিল না। এক গ্লাস জলে মুখ ধুয়ে নিলেই চলত।’ বনবিহারী বললেন।

image15.jpg

‘তাহলে আপনি কোনও চিকিৎসা করেননি?’

‘করেছিলাম। সে আধচামচ জিভে দিয়েছে না দু-হাতা খেয়েছে তা জানা না থাকায় ব্যবস্থা নিতেই হয়েছিল। জল খাইয়ে বমি করিয়ে দেখলাম পেটে কিছুই যায়নি। ব্যস। কিন্তু অফিসার, আমার এইসব পেশেন্টদের দেখে প্রেসক্রিপশন লেখা অনেক জরুরি কাজ। এরা তো এখানে বেড়াতে আসেনি, ওষুধের জন্যে এসেছে।’

‘হুম। ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন! আমাদের বড়বাবুও আপনাকে খুব রেসপেক্ট করেন। আপনি নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছেন না। আচ্ছা, চলি।’

মেজবাবু বাইরে বেরিয়ে ইশারায় সদানন্দকে নামতে বললেন জিপ থেকে। সদানন্দ নেমে এলে বললেন, ‘এ যাত্রায় এই ডাক্তারবাবুর কল্যাণে বেঁচে গেলেন। উনি যখন বলছেন ওটা আত্মহত্যার ঘটনা নয়, তখন আমি মেনেই নিলাম।’

মেজবাবু জিপে উঠে বসতেই সেটা দ্রুত বেরিয়ে গেল। সদানন্দ কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দ্রুত চেম্বারের সিঁড়িতে উঠে আবেগে বলে উঠল, ‘ডাক্তারবাবু।’

একজনের নাড়ি দেখতে-দেখতে বনবিহারী ধমক দিলেন, ‘খবরদার! এখানে কোনও নাটক নয়। আমি রুগি দেখছি।’

মাথা নাড়ল সদানন্দ। তারপর নিজের হোটেলের দিকে হাঁটতে লাগল। সেখানে পৌঁছাতে রাজ্যের লোক তাকে ঘিরে ধরল! মেজবাবু তাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়েও ছেড়ে দিলেন কেন? বদলে ওর স্ত্রীকে ধরেছেন কিনা ইত্যাদি প্রশ্নে তাকে জেরবার করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত দু-হাত ওপরে তুলে সদানন্দ চ্যাঁচাল, ‘সেসব কিস্যু হয়নি। আমাকে ধরেনি আর আমার স্ত্রীকে জেরাও করেনি। যাও তোমরা।’

সদানন্দ দোকানের ভেতরে ঢুকে গেলে লোকজন সিদ্ধান্তে আসল সদানন্দ নিশ্চয়ই টাকা খাইয়ে মেজবাবুকে ম্যানেজ করে ফেলেছে। এরকম কেস হাতে পেয়েও পুলিশ কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? টাকায় কী না হয়?

ভিড় হালকা হয়ে গেলে কর্মচারীদের দায়িত্ব বুঝিয়ে সদানন্দ রিকশায় চেপে বাড়িতে চলে এল। বন্ধ দরজার কড়ায় শব্দ করতে বউয়ের গলা ভেসে এল, ‘কে? এখন বাড়িতে নেই, দোকানে আছে, সেখানে যান।’

সদানন্দ হাসল। বউটা ভালোই। সে মিছিমিছি মাথা গরম করত। গলা তুলে বলল, ‘আমি, সদানন্দ।’

দরজা খুলে দিয়ে চলে যাচ্ছিল বউ, সদানন্দ ডাকল, ‘আরে শোনো! অল্পের জন্যে তোমার আমার জেলের ভাত খাওয়া হল না!’

বউ অবাক হয়ে ফিরে তাকাল। ‘তার মানে?’

‘পুলিশ এসেছিল। থানার মেজবাবু। এসেছিল আমাকে অ্যারেস্ট করতে। আমি নাকি তোমার ওপর এত অত্যাচার করেছি যে তুমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে। যত বলি আমি কিছু করিনি তো বিশ্বাস করে না। তোমাকে জেরা করতে আসতে চাইছিল। বলল, আত্মহত্যা করতে চাওয়াও আইনের চোখে অপরাধ। তার জন্যে জেলে যেতে হয়।’

‘তারপর?’

‘তারপর কী হবে? আমি ম্যানেজ করে ফেললাম।’ সদানন্দ হাসল, ‘কী কাণ্ড হত যদি তুমি মরে যেতে! বাকি জীবনটা জেলে কাটাতে হত। এই বাড়ি, দোকান তখন লুঠ হয়ে যেত। উলটোটাও ভাবো, আমাকে ছেড়ে দিয়ে যদি তোমাকে ধরে নিয়ে যেত, যেতই, তুমি জেলে থাকতে কী করে?’

‘কেন? সেখানে খেতে দেয় না?’

‘দেয়। ভালো খাবার নিশ্চয়ই দেয় না।’

‘যাই দিক তা আমাকে শাস্তি দিচ্ছে বলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। আমাকে তো কারও দয়ায় খেতে হচ্ছে না।’ বউ জিজ্ঞাসা করল, ‘কীভাবে ম্যানেজ করলে?’

‘ওসব কথা ছেড়ে দাও। দয়া করে আর আত্মহত্যার চেষ্টা কোরো না।’ সদানন্দ ভেতরের ঘরে যেতেই জানলা দিয়ে বাগান দেখতে পেল। ভালো পেঁপে হয়েছে গাছে। তারপরই নজরে পড়ল ওদিকের ঘরের দরজা খোলা। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘পরিষ্কার করার পর ওদিকের ঘরের দরজা বন্ধ করোনি? বেড়াল ঢুকে নোংরা করবে জানো না।’

‘ঘরে লোক আছে।’

‘অ্যাঁ? লোক? লোক কোত্থেকে এল?’

‘নতুন মাস্টার, যিনি ভাড়া নিয়েছেন। ফিরে এসেছেন।’

‘ফিরে এসেছে? বললেই হল। ওটা ওর বাবার সম্পত্তি নাকি? অসুখ করুক আর যাই করুক, একবার যখন বেরিয়ে গেছে তখন আর আমার ভাড়াটে নয়। একটা টাকা এখনও দেয়নি। ভাড়াটে বললেই হল।’ পেছনের দিকে যাওয়ার দরজা খুলতে গেল সদানন্দ উত্তেজিত হয়ে।

‘ওদিকে যাচ্ছ কেন? কিছু বলার থাকলে ডাক্তারবাবুকে গিয়ে বলো।’

থমকে দাঁড়াল সদানন্দ। ‘ডাক্তারবাবু? এর মধ্যে তিনি কোত্থেকে আসছেন?’

‘তিনিই সঙ্গে করে ওঁকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন তুমি যদি না চাও মাস শেষ হলে অন্য জায়গায় ভাড়া নিয়ে চলে যেতে।’

‘হ্যাঁ। ঢোক গিলল সদানন্দ, ‘তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। থাক তাহলে। ডাক্তারবাবুর সম্মানে আমি আপাতত কিছু বলছি না।’

এই সময় বাইরে থেকে একটা গলা ভেসে এল, ‘সদানন্দ আছ নাকি?’

‘কে?’

আমি নন্দলাল। শুনলাম ডাক্তার বনবিহারী নাকি তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন পুলিশের থাবা থেকে। খুব উপকার করেছেন তোমার। নইলে শ্রীঘরে যেতে হত। চলি।’

সদানন্দর দিকে তাকাল তার বউ। সদানন্দ বলল, ‘ওই তো, বললাম না। আমি ডাক্তারবাবুকে দিয়ে ম্যানেজ করেছি মেজবাবুকে। হে-হে!’ বউ দ্রুত সরে গেল সামনে থেকে।

সদানন্দ বুঝতে পারল নন্দলাল যখন জেনে গেছেন তখন খবরটা আর চাপা থাকবে না। ডাক্তারবাবু তাদের জেল যাওয়া থেকে রক্ষা করেছেন অতএব তার উচিত ওঁর কথা মান্য করা। সে পেছনের দরজা খুলে বাগান পেরিয়ে এসে ডাকল, ‘নতুন মাস্টার আছো নাকি?’

‘সুজয় তার তক্তাপোশে শুয়ে বই পড়ছিল; উঠে বসল। ততক্ষণে ঘরের ভেতর পৌঁছে গিয়েছে সদানন্দ, ‘থাক থাক, শুয়ে থাকো, অসুস্থ মানুষ, উঠতে হবে না।’

‘আমি এখন অনেকটাই সুস্থ।’ সুজয় বলল।

‘হতেই হবে। যিনি তোমার চিকিৎসা করছেন তাঁর তুলনা নেই।’

সুজয় সোজা হয়ে বসে বলল, ‘আপনি এসে ভালো করেছেন। কথা ছিল।’

‘অবশ্যই। বলো না।’

‘আমি সামনের মাসে এক তারিখে স্কুল থেকে অ্যাডভান্স পাব, পেয়ে আপনার এই ক’দিনের বাড়িভাড়া মিটিয়ে দেব। এর মধ্যে অন্য কোথাও ঘর নিশ্চয়ই পেয়ে যাব।’

‘এসব কী বলছ ভাই, আমি বুঝতে পারছি না।’

‘আমার অনুমান আপনি চাইছেন না আমি এখানে ভাড়াটে হয়ে থাকি!’

‘কে বলল?’ হাসল সদানন্দ।

‘অ্যাঁ?’ চোখ বড় হল সুজয়ের।

‘তুমি এরকম ভাবলে কী করে? এত বড় বাড়িতে আমরা দুজন প্রাণী থাকি। দুজনে কতক্ষণ আর কথা বলা যায়। এদিকের এই ঘর তো খালিই পড়ে থাকে। তোমার মতো একজন ভদ্রমাস্টারমশাই যদি আমাদের সঙ্গে বাস করে তাহলে দুটো কথা বলে বাঁচব। হ্যাঁ, প্রথমে একটু—’, থামল সদানন্দ, চারদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার সেই দাদাটিকে দেখছি না, বেরিয়েছেন নাকি?’

‘তিনি তাঁর কাজে চলে গিয়েছেন।’

‘তাহলে তো হয়েই গেল।’

‘আপনি ঠিক বলছেন তো?’

‘অবশ্যই। দ্যাখো, ডাক্তারবাবুর মতো মানুষ তোমাকে অসুস্থ অবস্থায় নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তুললেন। খারাপ লোক হলে করতেন? তা ছাড়া তিনি যখন নিজে তোমাকে এই ঘরে নিয়ে এসেছেন তখন তাঁর ওপর আমি কথা বলতে পারি? বুঝলে, তিনি আমার কাছে, যাকে বলে ভগবান!’

কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে দাঁড়াল সদানন্দ, ‘থাকার সমস্যা তো থাকছে না, খাবে কোথায়?’

‘দুবার বেরুতে হবে। আপনার হোটেল থেকে খেয়ে নেব।’

‘সর্বনাশ।’

‘বুঝলাম না।’

‘এখনও তো বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে। হোটেলের শুকনো লঙ্কা আর বেশি মশলা দেওয়া রান্না পেটে সইবে? একবার পেটের রোগ ধরে গেলে সারাজীবন ভোগাবে মশাই। দিতে হয় একটা কিছু ধরে দেবে, আমি আমার বউকে বলছি দু-বেলা ডাল-ভাত করে দিতে। দুজনের রান্না থেকে তিনজনের অনায়াসে হয়ে যায়। আরে, তোমার জন্যে তো আলাদা কিছু করতে হচ্ছে না।’ সদানন্দ বেরিয়ে গেলে সুজয় ভেবেই পাচ্ছিল না, লোকটার এত পরিবর্তন হল কী করে? একেই কি বলে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া? কিন্তু একটা কিছু ধরে দেবে বললে তো হবে না, অঙ্কটা আগেই ঠিক করে নিতে হবে। ইনি আবার ডিগবাজি খাবেন কিনা কে জানে!

সদানন্দের বউ প্রস্তাব শুনে অবাক হয়ে গেল। সেটা বুঝতে পেরে সদানন্দ বোঝানোর ভঙ্গি করে বলল, ‘ডাক্তারবাবু কী মনে করবেন ভেবে দ্যাখো! অসুস্থ ছেলেটা এখান থেকে অতদূরের দোকানে খেতে যাবে, আসবে, অথচ আমরা বাড়িতে বাড়ির রান্না খাব, এটা ওঁর ভালো লাগবে? মুখে কিছু বলবেন না কিন্তু আমরা তো পাষাণ নই।

‘বুঝলাম। কিন্তু ভাতের থালা ওই ঘরে পৌঁছে দেবে কে?’ সদানন্দর বউ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি তো দেড়টা নাগাদ ঘরে ফেরো, ততক্ষণ অসুস্থ লোকটা না খেয়ে থাকবে?’

‘একটা কাজের মেয়ে থাকলে ভালো হত।’

‘তাকে তো মাইনে দিতে হত।’

‘তা অবশ্য।’

‘বিনা মাইনের এই আমি যদি গিয়ে দিয়ে আসি?’

‘ঢোঁক গিলল সদানন্দ। ‘তা ভাইয়ের মতো তো। দিনে দুবার গিয়ে দিয়ে আসা! তাতে নিশ্চয়ই মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’ সে অন্যদিকে মুখ ঘোরাতেই তার বউয়ের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি চলকে উঠল।

ছুটি শেষ হওয়ার দিনে সন্তানকে নিয়ে বনবিহারী বাসে উঠলেন ওর জিনিসপত্র সমেত। প্রতি বছর এই যাওয়ার দিনে সন্তানের মুখ ভার হত। বোঝাই যেত, যেতে তার ইচ্ছে করছে না। বাসস্টপে কালীচরণের কনুই ধরে থাকত শক্ত করে। এবার তা করল না। বেশ সহজ স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল তাকে যেটা বনবিহারীর ভালো লাগল না। গতকাল সন্তান সদানন্দর বাড়িতে গিয়ে সুজয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছে তাঁকে কিছু না বলে। কালীচরণও জানতে পারেনি। আশেপাশে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে চলে গিয়েছিল। রাত্রে খেতে বসে নিজেই বলেছিল সন্তান। খুব বিরক্ত হলেও কিছু বলেননি বনবিহারী। যাওয়ার মুখে ওকে বকাবকি করতে ইচ্ছে হয়নি।

নীচের শহরে পৌঁছে রিকশা নিয়ে ওর স্কুল হোস্টেলে গিয়ে দেখলেন বেশ কয়েকজন আবাসিক এর মধ্যে এসে গেছে। হোস্টেলের ভেতরে অভিভাবকদের যাওয়া কর্তৃপক্ষ পছন্দ করেন না। স্বাভাবিক মুখে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্তান ভেতরে চলে গেল। পেছনে দারোয়ান, ওর মালপত্র নিয়ে।

হোস্টেলের অফিস ঘরে গেলেন বনবিহারী। যিনি সুপার তিনি স্কুলেরই শিক্ষক। সুপার হাতজোড় করলেন, ‘আসুন ডাক্তারবাবু। নাতি এসে গেছে।’

‘হ্যাঁ। এইমাত্র এল।’

‘ছেলেরা আগের দিন এলে আমাদের তো হয়ই, ওদেরও সুবিধে হয়। এই কথাটা অনেক অভিভাবক বুঝতে পারেন না। কেমন আছেন?’

‘ভালো। আপনাকে একটা অনুরোধ জানাতে এলাম।’

‘বলুন।’

‘আমি বা আমার কাজের লোক কালীচরণ ছাড়া আর কেউ যদি সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে আসে আপনি অনুমতি দেবেন না।’

‘অবশ্যই। কখনও বলেননি, এবার কি কিছু হয়েছে?’

‘এখনও হয়নি, আর কারও সঙ্গে দেখা না করলে ওরই মঙ্গল হবে। আচ্ছা! নমস্কার!’ বনবিহারী খানিকটা স্বস্তি নিয়ে বেরিয়ে এলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *