কাঠকয়লার আগুন – অন্তিম পর্ব

অন্তিম পর্ব

‘তোমার ছেলে সঙ্গে যাচ্ছে না। সে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্যে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার জন্যে কোনও চিন্তা হচ্ছে না?’

এবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মামণি। চোখ নীচের দিকে। হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলল না। বনবিহারী বললেন, তাহলে তুমি যাবেই!’

মাথা ওপর-নীচ হল, মুখে হাসি ফুটল মামণির।

সরে এলেন বনবিহারী। এ কেমন মা! জীবজন্তুরাও তো সন্তান স্নেহে মরিয়া হয়। একটা পাখিও তার ছানাকে খাওয়াতে দূর দূর থেকে খাবার সংগ্রহ করে গলায় নিয়ে ফিরে এসে বাচ্চার মুখের ভেতর উগরে দেয়। আর মামণি তো মানুষ। তার সন্তান সম্পর্কে কোনও হেলদোল কেন থাকবে না? শরীরে এসেছিল, শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে, এর বাইরে কোনও অনুভূতি নেই? ঈশ্বর জানেন। বনবিহারী শ্বাস ফেললেন। এই মেয়েকে তিনি তো ফেলেও যেতে পারেন না।

পৌনে চারটের সময় শশী ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এল। বনবিহারীর নির্দেশে কালীচরণ বাড়ির সব দরজা জানলা ভালো করে বন্ধ করে ফেলেছে। তিনটে সুটকেস আর একটা টিনের বাক্স গাড়ির ডিকিতে চাপিয়ে দেওয়ার পরে বনবিহারীর খেয়াল হল, শশী ড্রাইভার মামণিকে দেখে কী ভাববে? নীচ থেকে ফিরে এসে এখানে গল্প করবেই। ডাক্তারবাবু, তাঁর কাজের লোক এবং, একটি যুবতীকে সে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। তখনই গল্প উঠবে কে স্ত্রীলোক? কথাটা নিশ্চয়ই দারোগাবাবুর কানে যাবে। তিনি দুই-এ দুই-এ চার করবেন।

কিন্তু বনবিহারীকে অবাক করে কালীচরণের পিছন পিছন একগলা ঘোমটা দিয়ে যে বেরিয়ে এল তাকে মামণি বলে চিনতেই পারলেন না বনবিহারী। যেন একটি দেহাতি রমণী। বনবিহারী হুকুম করলেন, ‘তোমরা পেছনে বসো।’

কালীচরণ আপত্তি করতে যাচ্ছিল। বনবিহারীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। ওরা পেছনে উঠে বসলে দরজায় তালা ঝুলিয়ে বনবিহারী শশী ড্রাইভারের পাশে বসে বললেন, ‘চলো।’

গাড়ি বড় রাস্তায় তুলে শশী ড্রাইভার বলল, ‘আপনি চলে যাচ্ছেন শুনে সবাই মন খারাপ করেছে।’

‘চলে যাচ্ছি মানে? আবার তো ফিরে আসব।’

‘কতদূরে যাচ্ছেন?’

‘এই তো,’ বলেই সজ্ঞানে মিথ্যে বললেন, ‘কালীচরণের দেশে।’

সঙ্গে সঙ্গে কালীচরণ পেছন থেকে বলে উঠল, ‘বিহারে।’

পথে তেমন কথা হল না। জঙ্গল এলাকা পার হয়ে এল গাড়ি। স্বস্তি হল। সন্তান যদি জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত আর যদি কোনওভাবে খবরটা পেয়ে যেত তাহলে নিশ্চয়ই দর্শন দিত।

ট্রেনে বার্থ পাওয়া গেল। স্টেশনমাস্টারই ব্যবস্থা করে দিলেন বনবিহারীর পরিচয় পেয়ে। ঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়ল। ওঁরা ছাড়া আরও তিনজন যাত্রী একই কুপেতে। ভাগ্যভালো, তারা হিন্দিভাষী। আর একটি সুখবর এই ট্রেন শিয়ালদার বদলে হাওড়া স্টেশন পৌঁছাবে সকাল সাড়ে সাতটায়। বনবিহারী বললেন, ‘কালীচরণ খাবার বের করো, খিদে পেয়ে গেছে।’

এসি থ্রিটায়ারের যাত্রীরা বোধহয় অকারণে রাত জাগতে ভালোবাসেন না। রাত সাড়ে নটার মধ্যেই কুপের বাকি তিনজন শুয়ে পড়ায় বনবিহারীদেরও শুতে হল। স্টেশন মাস্টারের কল্যাণে দুটো লোয়ার আর একটা আপার বাথ পাওয়া গিয়েছিল। কালীচরণ প্রথমে আপনি জানিয়েছিল, সে ওপরে উঠবে না। তার পক্ষে বনবিহারীর মাথার ওপরে শোওয়া সম্ভব নয়। বিস্তর ধমক খেয়ে সে ওপরে উঠল। লোয়ার বার্থে শোওয়ার পর বনবিহারী পাশ ফিরতেই দেখলেন মামণি লম্বা হয়ে শুয়ে তাঁর দিয়ে অপলক তাকিয়ে রয়েছে। মুখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি। খুব দ্রুত ছুটছে ট্রেন। শীততাপনিয়ন্ত্রিত কামরাতেও তার আওয়াজ খানিকটা মৃদু হলেও শোনা যাচ্ছে। বনবিহারী ভাবছিলেন, যেখানে যাচ্ছেন সেখানে তাঁর জন্যে কী অপেক্ষা করছে তা তিনি জানেন না। এখন কোনও রাস্তা খোলা নেই। স্রোতে যখন গা ভাসিয়েছেন তখন ভেসে চলা ছাড়া উপায় কী! একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। ট্রেনটা বেশ জোরে নড়ে উঠতেই সেটা কেটে গেল। বনবিহারী পাশ ফিরতেই দেখতে পেলেন মামণি সেই একই ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই মামণির ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। বনবিহারী নীচু গলায় বললেন, ‘ঘুমিয়ে পড়ো।’

মামণি দ্রুত মাথা নাড়ল, না। অর্থাৎ সে এইভাবেই তাকিয়ে থাকবে।

বনবিহারী চোখ বন্ধ করলেন।

হাওড়া স্টেশন নেমে কুলিদের হাঁকাহাঁকি, যাত্রীদের চেঁচামেচি, ভিড় সামলে ঘাটশিলার ট্রেন খুঁজে বের করতে সময় লাগল। কোনওরকমে মালপত্র তোলার পর শুধু মামণির বসার জন্যে জায়গা পাওয়া গেল। কিন্তু বনবিহারী দাঁড়িয়ে থাকলে মামণি কিছুতেই বসবে না।

বনবিহারী বললেন, ‘ওইটুকু জায়গায় দুজনের বসা সম্ভব নয়। তুমি বোসো।’

মামণি মাথা নেড়ে ইশারায় বনবিহারীকে বসতে বলল।

যাদের পাশে জায়গাটা পাওয়া গিয়েছিল তারা স্ত্রীলোক। বনবিহারীর কাছাকাছি বয়সের স্ত্রীলোকটি বললেন, বয়স্ক বাবা দাঁড়িয়ে থাকলে মেয়ে কী করে বসতে পারে? আপনি বসুন, আপনার মেয়ে এখন দাঁড়াক। পরে নিশ্চয়ই খালি জায়গা পেয়ে যাবে।’

বনবিহারী কিছু বলার আগে মামণি গোঁ-গোঁ করে হাত নেড়ে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া বোঝাল। স্ত্রীলোকরা তার অর্থ বুঝতে না পারলেও বনবিহারী পারলেন। মামণি বাবা এবং মেয়ের সম্পর্কটা অস্বীকার করছে। সে কিছুতেই যখন বসল না তখন বনবিহারী বসলেন। এবার মামণির মুখে হাসি ফুটল।

ঝাড়গ্রাম আসতেই মামণি এবং কালীচরণ বসার জায়গা পেয়ে গেল।

ভরদুপুরে ঘাটশিলায় যখন ট্রেন থামল তখন বনবিহারী দেখলেন খুব কম যাত্রী নামল ট্রেন থেকে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে স্টেশন ফাঁকা। এখন কি মাল বইবার জন্য কুলিরাও নেই? স্টেশনের বাইরে এসেই তিনি বুঝতে পারলেন আগের সেই জমজমাট চেহারাটা আর নেই। একটা লোক খবরের কাগজ সাজিয়ে দোকান করে বসেছিল, বনবিহারী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানে ভালো হোটেল আছে?’

‘ভালো মানে ওই আর কি। এখন তো এখানে টুরিস্ট তেমন আসে না।’

‘কেন?’

‘খোঁজখবর রাখে না?’

‘না।’

‘মাওবাদীদের ভয়ে। তা ছাড়া দেখার তো কিছুই নেই।’ লোকটি বলল, ‘ওই ওপাশে গেলে রিকশা পেয়ে যাবেন। বলবেন বলাকা হোটেলে যাবেন।’

এই সময় একটা পুরোনো জিপ গাড়ি এসে দাঁড়াল। জিপ থেকে নেমে এক বৃদ্ধ কাগজওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ট্রেন চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘একটা ফ্যামিলিকে দেখেছ? পাঁচজন।’

‘না। এরাই তিনজন এসেছেন।’

‘অদ্ভুত। টেলিফোনে বুক করেছিল অথচ আসবে না যে তা জানায়নি, আমি এতটা পথ তেলপুড়িয়ে গাড়ি নিয়ে এলাম।’ বৃদ্ধ বিরক্ত।

কাগজওয়ালা বনবিহারীকে বলল, ‘এই মরা জায়গায় থেকে কী করবেন? শাপে বর হয়েছে, দাদুর রিসর্টে চলে যান।’

‘এই, আমারটা রিসর্ট নয়, আশ্রম। আপনারা কি বেড়াতে এসেছেন?’

‘কিছুদিন থাকব বলে এসেছি। একটু নির্জনে।’

‘কিছুদিন?’ বৃদ্ধ ভাবলেন, ‘আমার গেস্টহাউসে আপনাদের বেশি খরচ হয়ে যাবে। তবে পাশেই আমাদেরই একটা খালি বাড়ি আছে, দুটো ঘর, মাসে চার হাজার ভাড়া দিলে থাকতে পারবেন। অসুবিধে হবে?’

‘বিন্দুমাত্র নয়।’ বনবিহারী খুশি হলেন।

‘তাহলে ওই গাড়িতে মালপত্র তুলুন।’

গাড়ি চলতে শুরু করলে বৃদ্ধ বললেন, ‘জায়গাটা শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। তিন কিলোমিটার দূরে একটা গ্রাম আছে। সপ্তাহে দুদিন হাট বসে। সেখানে মোটামুটি সব পেয়ে যাবেন। আপনার মেয়ে নিশ্চয়ই রান্না করতে পারে। অন্য লোকটি কে?’

‘আমার সঙ্গে বাল্যকাল থেকে আছে।’ বনবিহারী দ্রুত বললেন।

জঙ্গল, পাহাড় পেরিয়ে দারুণ সুন্দর একটি উপত্যকায় পৌঁছে যেখানে গাড়ি থামল সেখানে গেটের ওপর লেখা আছে, ‘সেবাশ্রম’। বৃদ্ধ বললেন, ‘এই হল আমার জায়গা। আশেপাশের যত গ্রাম আছে তার শিশুদের পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়েছি আমরা। বেশির ভাগেরই বাবা পালিয়ে আছে, কেউ কেউ মারা গিয়েছে।’

‘কেন?’ বনবিহারীর কপালে ভাঁজ পড়ল।

পুলিশ ওদের মাওবাদী বলে চিহ্নিত করেছে।

‘মাওবাদী?’

‘ঘাবড়ে গেলেন নাকি? না, না। ভয়ের কিছু নেই। ওদের বাচ্চারা আমার এখানে এসে পড়াশুনা করে, দুপুরে খায় বলে ওরা আমাদের ওপর কখনওই অত্যাচার করে না। আপনি চিন্তা করবেন না। ঘুরে দেখুন চারপাশ, তারপর কথা হবে।’ বৃদ্ধ ওঁদের নিয়ে গেলেন পাশের বাড়িতে, যার একতলায় একটি ঘর এবং কিচেন বাথরুম, দোতলায় দ্বিতীয় ঘরটি। বললেন, ‘যথেষ্ট বেলা হয়ে গেছে। আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে গুছিয়ে নিন, আমি জলখাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। রাতের খাবার আশ্রমেই খেয়ে নেবেন। কাল থেকে আপনাদের সংসার শুরু করবেন।

বৃদ্ধ চলে গেলে গোছগাছ শেষ হলে কালীচরণকে ডাকলেন বনবিহারী। কোনও ভণিতা না করেই বললেন, ‘তুমি কিচেনে শুতে পারবে?’

‘ওখানে তো পা ফেলার জায়গা নেই, খুব ছোট।’ কালীচরণ বলল।

‘তাহলে মামণি শোবে কোথায়? নীচের ঘরটা তো ওর চাই।’

কালীচরণ বলল, ‘ও যদি ওপরের ঘরের মেঝেতে শোয় তাহলে কোনও ঝামেলা থাকে না। সবাই তো ওকে আপনার মেয়ে বলে ভাবছে।’

মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘সে কী চায়?’

‘জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আঙুল দিয়ে ওপরটা দেখিয়ে দিল।’ কালীচরণ বলল, ‘আর আপত্তি করবেন না। সত্যি তো, ও আপনার মেয়ের মতো।’

বিকেলে আশ্রম ঘুরে দেখলেন বনবিহারী। জনা পনেরো আদিবাসী ছেলে যাদের বয়স আট থেকে চোদ্দোর মধ্যে, আশ্রমে মানুষ হচ্ছে। এদের বাবারা মাওবাদী, কেউ মরেছে, কেউ পালিয়েছে। আশ্রমের ব্যবস্থাও ভালো। দানের ওপর ভরসা করে চলছে।

বৃদ্ধ বললেন, ‘পুলিশের হুকুম, এখানে যারা এসে থাকবে তাদের নাম-ঠিকানা থানায় জানিয়ে দিতে হবে। আপনারা নাম-ঠিকানা একটা কাগজে লিখে রাখবেন। কাল সকালে পাঠিয়ে দেব।’

এখানে বিদ্যুৎ রাত দশটায় চলে যায়। তখন হ্যারিকেন জ্বালতে হয়। খাওয়া- দাওয়ার পর বনবিহারী তক্তাপোষে শুয়ে পড়েছিলেন, নীচের মেঝেতে বিছানা করে মামণি। আলো নিভতেই সে হ্যারিকেন জ্বালাল। এবং তারপরেই গুলির শব্দ শোনা গেল। রাতের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল এক মুহূর্তে। তারপর পালটা গুলির শব্দ। এবার বেশি দূরে নয়।

হঠাৎ মামণি মুখে হাত দিয়ে গোঙাতে লাগল ভয়ে। হ্যারিকেনের স্বল্প আলোয় তা মুখ সাদা দেখাচ্ছিল। বনবিহারী বললেন, ‘চুপ, শব্দ কোরো না।’ ঠিক তখনই বিকট শব্দে বোম ফাটল কাছাকাছি। মামণি ছুটে এসে বনবিহারীকে জড়িয়ে ধরল। বনবিহারী বললেন, ‘চুপ, শব্দ করো না।’ তাঁর মনে হল এটা যে একটা যুদ্ধক্ষেত্র তা জানলে তিনি কখনওই এখানে আসতেন না। আজকের রাতটা কোনওমতে কেটে গেলে এখান থেকে চলে যাবেন তিনি। তখনই সম্মিলিত চিৎকার এবং একটি লোকের আর্তনাদ কানে এল। মামণি সেটা শুনে বনবিহারীর শরীরের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে ভয়ে। এবং তখনই বনবিহারীর বোধ এল। মামণির অর্ধনগ্ন শরীর তাঁর শরীরের সঙ্গে মিশে আছে। তিনি মুখ ফেরাতেই দু-হাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে মামণি তাকে চুম্বন করল ঠোঁটে। সঙ্গে সঙ্গে একটা নোনতা শিহরণ ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে। সমস্ত শরীরে ঝিমঝিম ভাব। ততক্ষণ মামণির জিভ তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। বনবিহারী আর পারলেন না। তিলতিল করে এতদিন ধরে যে বাঁধ তিনি নির্মাণ করেছিলেন তা আজ ভেঙে গেল। মামণির সক্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গত করল তাঁর শরীর।

ভাসানের তৃপ্তি নিয়ে মামণি যখন তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল তখন বনবিহারী হতভম্ব। আচমকা ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটা তাকে ক্রমশ পীড়া দিতে শুরু করল। না, এভাবে চলতে পারে না।

তিনি ফিশফিশিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আমায় বিয়ে করবে?’

জড়িয়ে ধরা হাত আরও শক্ত হল। মামণির মাথা নড়ল সম্মতিতে। বনবিহারী বললেন, ‘আমি তোমার চেয়ে যে অনেক বড়।’

মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করল মামণি।

ঠিক তখনই বাইরে থেকে গলা ভেসে এল, ‘দরজা খুলুন।’

তারপরেই বৃদ্ধের গলা কানে এল, ‘বনবিহারীবাবু, দরজা খুলুন।’

কোনওরকমে নিজেকে আবৃত করে বনবিহারী নীচে নেমে এলেন।

কালীচরণ বলল, ‘বাবু, পুলিশ!’

বনবিহারী দরজা খুললেন। পুলিশ অফিসার বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এরা?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনারা আজ এসেছেন?’ অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।

বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ।’

‘এখানে কয়েকমাস মাওবাদীরা পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে যায়নি। আজ কেন গেল?’ অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমার জানা নেই।’

‘আপনারা এখানে কাউকে আশ্রয় দিয়েছেন?’

‘না।’

‘এই, সার্চ করো।’ অফিসার বলতেই একজন সেপাই বাড়িতে ঢুকে পড়ল।

‘আপনি কোথায় থাকেন।’

বনবিহারী বললেন। জানালেন তিনি একজন ডাক্তার।

‘এ কে?’

‘আমাদের পরিচারক।’

টর্চের আলো ফেললেন অফিসার একটু দূরে। সেখানে সদ্যমৃত রক্তাক্ত একটি শরীর পড়ে আছে, ‘চেনেন?’

‘না।’

সেপাইটি নেমে এল মামণিকে সঙ্গে নিয়ে। শোওয়ার পোশাক ওর পরনে। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইনি কে?’

বনবিহারী পরিষ্কার গলায় বললেন, ‘আমার স্ত্রী।’

বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকালেন। কালীচরণের চোখ বড় হল।

‘ঠিক আছে। কিন্তু দুজনের দেখছি বয়সের বেশ তফাত!’ অফিসার বললেন।

‘বেশি বয়সে বিয়ে করলাম।’

‘ও। ঠিক আছে, যান আপনারা।’

মৃতদেহ নিয়ে পুলিশের গাড়ি চলে গেল। বৃদ্ধ বললেন, ‘ছি ছি ছি, আমি তখন ভুল করে মেয়ে বলেছিলাম, আপনি সংশোধন করে দেবেন তো।’

বনবিহারী হাসলেন।

বৃদ্ধ চলে গেলে কালীচরণ বলল, ‘যে ছেলেটা গুলি খেয়ে মরেছে তার বয়স বেশি নয়।’

‘আমি দেখিনি।’ বনবিহারী বললেন।

‘আমাদের সন্তানের যে কী হল!’ কালীচরণ বলতেই আচমকা কেঁদে উঠল মামণি। আর্তনাদ হয়ে গেল কান্নার শব্দ।

বনবিহারী হতভম্ব। যে মা এতটা কাল সন্তান নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিল না; ছেলে বেঁচে আছে না মরে গেছে তা নিয়ে কোনও উদ্বেগ দেখায়নি সে আজ হঠাৎ কালীচরণের কথা শুনে এইভাবে কাঁদছে কেন? আজ একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা কি ওর বুকের ভেতর জমে অনড় হয়ে থাকা পাথরটাকে সরিয়ে দিল!

বনবিহারী এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখতেই কান্নাটা ফোঁপানিতে নেমে এল।

বনবিহারী বললেন, ‘চলো।’

বনবিহারীর বাজুতে মুখ রাখল মামণি।

কালীচরণ মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে।

(সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *