কাজের মেয়ে
কথাটা কাজের মেয়ে। কিন্তু সর্বদাই যে সে কাজের তা নয়, অনেক সময়েই সে অকাজের মেয়ে।
সে কাচের গেলাস ভেঙে ফেলে, সে ডালে নুন বেশি দেয়, ফ্রিজের দরজা ধপাস করে বন্ধ করে। কর্তা অফিস যাওয়ার মুখে ভাত খেতে বসেছেন, তাকে গৃহিণী একশো দই আনতে পাঠিয়েছেন, ঘণ্টা দেড়েক পরে, কর্তা অফিস চলে যাওয়ার ঢের ঢের বাদে একটা ছোট ভাঁড় হাতে সে বাড়ি ফিরল, দেরির কারণ দইয়ের দোকানের সামনে একটা পাগল কোথা থেকে এসে উপস্থিত হয়েছে। এতক্ষণ সে বান্ধবীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে উন্মাদের কার্যক্রম অনুধাবন করছিল।
কিন্তু তার উপরে রাগ করা চলবে না।
সে মধ্যবিত্তের সংসারের নয়নের মণি, শিবরাত্রির সলতে। তাকে তোষণ করতে হবে, পোষণ করতে হবে।
বিনিময়ে সেও অনেক কিছু করবে। সে দশভুজা। সে ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণার চা, দেশলাইয়ের কাঠি ফুরিয়ে গেলে তার সঞ্চিত দেশলাই থেকে কাঠি এনে দেবে বাবুর সিগারেট ধরাবার জন্য। সে ঘর ঝাঁট দেবে, বাসন মাজবে, কাপড় কাচবে, দরকার হলে ইস্তিরিও করবে। আগে তার একটা গল্প বলে নিই। তারপরে আবার তার কথা।
সারাদিনের পরিশ্রমের পর একদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে এসে কৃষ্ণকান্তবাবু দেখেন তিজেল হাঁড়ির মততা থমথমে মুখ তাঁর সহধর্মিণীর।।
একটু জিজ্ঞাসাবাদ করার পর কৃষ্ণকান্তবাবু জানতে পারলেন যে বাড়ির কাজের মেয়েটি, নাম করুণা, রাগ করে কাজ ছেড়ে বিকেলবেলায় দেশে চলে গেছে। কৃষ্ণকান্তবাবু এ কথা শুনে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি তাকে এমন কী বলেছিলে যে সে রাগ করল? দেশে চলে গেল?’
সহধর্মিণী রুক্ষ কণ্ঠে বললেন, আমি তাকে কিছু বলিনি। তুমি বলেছিলে।’
কৃষ্ণকান্তবাবু এ কথা শুনে একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন, ‘আমি? আমি আবার করুণাকে কবে কী বললাম?’
সহধর্মিণী পালটা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আজ দুপুরে অফিস থেকে ফোন করে করুণাকে গালাগাল করনি?
মাথায় হাত দিলেন কৃষ্ণকান্তবাবু। বললেন, ‘সর্বনাশ! আমি তো ভেবেছিলাম ফোনটা তুমি ধরেছ, তোমাকেই তো গালাগাল করেছি, আমি কি বুঝতে পেরেছি যে করুণা ফোনটা ধরেছে?’
এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাহিনীর সারমর্ম হল গৃহিণীকে গালাগাল করা চলে, কাজের মেয়েকে গালাগাল করা চলে না। গৃহিণীকে ভালমন্দ যা বলা যায়, পরিচারিকাকে তা বললে সে কাজ ছেড়ে চলে যাবে। তাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না, সে একেবারে দূরে দেশে চলে যাবে। ডায়মন্ডহারবারের গহনে কিংবা কাঁথির উপকুলে।
অনেকদিন আগে আরও একটি কাজের মেয়ের কথা লিখেছিলাম, এখনও কারও কারও তাকে হয়তো মনে আছে। এই সূত্রে তাকে আরেকবার স্মরণ করি।
সে ঘরের মেঝে মুছছিল। গৃহিণী তার পাশে দাঁড়িয়ে একটু ঘরমোছার নমুনা দেখে তাকে আরও ভাল করে মুছতে বললেন।
এই কথা শুনে পরিচারিকা বলল, ‘ও কথা বোলো না বউদি, ওই অলক্ষণ কথা বোলো না।’
বউদি অবাক, ঘর মোছর আবার লক্ষণ, অলক্ষণ কী?
পরিচারিকা তখন বুঝিয়ে বলল, ‘পাশের তেরো নম্বর বাড়ির বউদি ওই রকম বলতেন, আমি মেঝে মুছে মুছে ঝকঝকে করে দিয়েছিলাম। তারপর সেবাড়ির দাদাবাবু সেই মেঝেতে পা পিছলিয়ে পড়ে কোমর ভেঙে আজ সাড়ে তিন মাস হাসপাতালে।’
এই পরিষ্কার করার ব্যাপারে আমার স্ত্রী মিনতিকে একদা আমি ভয়াবহভাবে জব্দ হতে দেখেছিলাম। প্রায় নতুন কাজের মেয়েটি চেয়ার টেবিল ঝাড়ছিল। মিনতি এগিয়ে গিয়ে তাকে বলল, ‘এই চেয়ারের হাতলে ধুলোটা কেমন জমে রয়েছে। অন্তত এক মাসের পুরনো ধুলো।’
কাজের মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘তার আমি কী জানি? আমি তো মাত্র সাতদিন এসেছি।’
ধুলো ঝাড়ার আর একটা কাহিনী আছে।
সেই একই গল্প। কাজের মেয়েটি ধুলো ঝাড়ছিল, গৃহিণী আলমারির মাথায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘করুণা, এখানে এত ধুলো জমে আস্তর পড়ে গেছে আমি ইচ্ছে করলে এর ওপরে আঙুল দিয়ে আমার নাম সই করতে পারি।’
করুণা বলল, ‘বউদি, ওই তো তোমাদের সুবিধে। তোমরা লেখাপড়া জানো বলে নিজের নাম লিখতে পারো। আমরা তো লেখাপড়া জানিনে, নামসইও করতে পারিনে। আমাদের কত কষ্ট ভাবো তো।’
এসব ভেবে লাভ নেই।
বরং আর একটা অতি বাজে, অতি অবিশ্বাস্য কথিকা দিয়ে কাজের লোককে ছেড়ে দিই।
বাড়িতে নতুন কাজের লোক লেগেছে। গৃহিণী তাকে বললেন, ‘দ্যাখো, আমি খুব বেশি কথা বলি না। যদি দ্যাখো যে আমি আঙুল তুলেছি, সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নেবে যে তোমাকে আমি ডাকছি, তোমাকে আসতে বলছি।
নবনিযুক্তা পরিচারিকা বলল, ‘গিন্নিমা, আমিও খুব কম কথার লোক। যদি দ্যাখেন আপনার আঙুল তোলা দেখে আমি ঘাড় নাড়ছি, বুঝবেন আমি আসছি না।’