2 of 2

কাচের ছবি – বিধায়ক ভট্টাচার্য

কাচের ছবি – বিধায়ক ভট্টাচার্য

আচার্য রাজমোহন সান্যাল পঞ্চাশের পরই কলকাতা ছেড়ে তাঁর মাতৃভূমি কৃষ্ণনগরে একখানি ছোট বাড়ি, নতুন মরিস গাড়ি, ব্যাঙ্কে বেশ কিছু টাকা, স্ত্রী ও একটি কন্যা নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন। ব্রাহ্ম সমাজের আচার্যের মধ্যে যে-প্রশান্তি ও স্তব্ধতা থাকা দরকার, সবই তাঁর মধ্যে ছিল। বিশেষ কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে কলকাতার মন্দিরে যেতে হত, কিন্তু সেও বছরে তিনবার কি চারবার। বাকি দিনগুলি নিজের জমিতে ফুল-ফল ও সবজি লাগিয়ে, পুকুরে মাছের চাষ করে বেশ কেটে যেত। কৃষ্ণনগর শহর থেকে একটু বাইরে এই বাড়িখানি রুচিতে ও পরিচ্ছন্নতায় সকলের দৃষ্টিই আকর্ষণ করত। রাজমোহনবাবুকে কেউ কোনওদিন রাগতে দেখেনি, সবসময় একটা মিষ্টি হাসি, জ্ঞানগর্ভ বাণী এবং মৃদু রসিকতাপূর্ণ মন্তব্য ছিল তাঁর কথা বলার বৈশিষ্ট্য।

সেদিন থানায় ইন্সপেক্টর মণ্ডল অফিসেই রাত্রিযাপন করছিলেন। কারণ, গৃহিণীর সঙ্গে বচসা হওয়াতে তিনি এমনই বিরক্ত হয়ে গেলেন—যাতে আর এক ছাদের নীচে বাস করতেই তাঁর ইচ্ছে হল না। অবশ্য স্বামী বাড়ি থেকে যাওয়ার পর দারোগা-গিন্নি মুচকি হেসে দাসীকে বলেছিলেন, একদিন আপিসে মশার কামড় খেতে দে না।

কিন্তু ঘুম কি আসে? শুয়ে, বসে, জল খেয়ে, সিগারেট টেনে, যখন তিনি আর-একবার ঘুমের চেষ্টা করতে মনস্থ করলেন—তখন পুব আকাশ ফরসা হয়ে গেছে। হাতঘড়ি দেখলেন ইন্সপেক্টর—পৌনে ছ’টা। হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠাতে রিসিভার তুললেন দারোগাবাবু।

কে?

আমি আচার্য রাজমোহন সান্যালের বাড়ি থেকে বলছি।—ভীতিবিহ্বল একটি নারীকণ্ঠ।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কী বলুন তো!

উনি খুন হয়েছেন। গ্যারেজে ওঁর ডেডবডি—।

কী! খুন হয়েছেন? গ্যারেজে?

হ্যাঁ। আপনি একবার আসুন না দয়া করে!

আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।

একজন অফিসার এবং চারজন কনস্টেবল নিয়ে ইন্সপেক্টর মণ্ডল তৎক্ষণাৎ গাড়িতে উঠে বসলেন।

ভারী পরিচ্ছন্ন বাড়ি —দূর থেকেই চোখ টানে। কোলাপসিবল গেটটা খোলাই ছিল। পুলিশের গাড়ি ঢুকে একপাশে দাঁড়াল। পরিষ্কার হয়ে গেছে তখন চারদিক। মণ্ডল বললেন, আগে গ্যারেজটায় চলো তো!

গ্যারেজের দরজা খোলা। ভেতরে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। নিঃসন্দেহে আচার্য সান্যালের। তিনি কাত হয়ে পড়ে আছেন। বুকে গুলি লেগেছে, রক্তটা শুকিয়ে উঠেছে।

গাড়ি ছিল তো গ্যারেজে?

নিশ্চয় ছিল।—সহকারী অফিসার জবাব দিলেন।

গ্যারেজ খোলা ছিল, মেন গেটটাও খোলা ছিল। বেশ বোঝা যাচ্ছে, মার্ডার যে করেছে, সে একজন গাড়িচোর।

মনে হচ্ছে তাই।

বাড়ির ভেতরে কে আছে দ্যাখো তো!—মণ্ডল বললেন।

বেশি ডাকাডাকি করতে হল না। একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের মেয়ে নেমে এল ওপর থেকে।

আপনি কে আচার্যের?—প্রশ্ন করলেন মণ্ডল।

আমি তাঁর সেবা করতাম। রান্নাবান্না, ঘরের অন্যান্য কাজকর্ম—।

কেন? মিসেস সান্যাল আর তাঁর মেয়ে—?

ওঁরা দুজনেই দেওঘরে আছেন। এই সর্বনাশের খবর পেয়ে কী যে করবেন—।—বলতে বলতে মেয়েটি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

চুপ করুন, চুপ করুন। আমাকে কাজ করতে দিন। —ইন্সপেক্টর বললেন, আচ্ছা, আচার্য যে খুন হয়েছেন, সেটা আপনি কখন জানতে পারলেন?

গ্যারেজের পাশের ঘরে কয়লা নিতে এসে। আচার্য প্রতিদিন সাড়ে পাঁচটায় এক পেয়ালা কফি খেয়ে বেড়াতে বেরোতেন। কাজেই আমি পাঁচটায় উঠে কয়লা নিতে গিয়ে দেখতে পাই—গ্যারেজের দরজা খোলা। অবাক হয়ে আর-একটু উঁকি দিয়ে দেখলাম—আমাদের গাড়িটা নেই। ভাবলাম, আচার্য তবে কি কফি না খেয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন? তখন—আরও এগিয়ে গিয়ে ওঁর ডেডবডি দেখতে পেলাম।—আবার কাঁদতে আরম্ভ করল মেয়েটি : আমি কী করব এখন—কী করে আমি মুখ দেখাব মামণিকে?

চুপ করুন, চুপ করুন। মিত্র, এক কাজ করো, বডিটাকে পোস্টমর্টেমে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আমি ওপর থেকে আসছি। চলুন, আপনি আমাকে আপনাদের গাড়ির একটা ডেসক্রিপশান দেবেন। নম্বর, লাইসেন্স সব ওপরেই আছে তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

চলুন, আমাকে দেবেন।

কেন যে আচার্যের ঘুমটা ভেঙে গেল, জেগে উঠে তা তিনি বুঝতে পারলেন না। তবে এ-কথা ঠিক, কী একটি শব্দ তাঁর কানে গেছে। তিনি ঘড়ির দিকে চাইলেন রাত্রি চারটে বেজে পনেরো মিনিট। আচার্য জানলার কাছে গিয়ে নীচে গ্যারেজের দিকে চাইলেন। হ্যাঁ, অন্ধকারে একটা ছায়া চলাচল করছে, মাঝে-মাঝে হাতের টর্চটাও জ্বলে উঠছে।

আচার্যের চোখে-মুখে কৌতুকের আলো ফুটে উঠল। তিনি তাড়াতাড়ি একটা ড্রেসিংগাউন গায়ে চাপিয়ে তরতর করে নেমে গেলেন। বাগানে নেমে গ্যারেজের কাছে গিয়ে দেখলেন, একটি লোক টর্চ জ্বেলে-জ্বেলে গাড়িটা দেখছে।

এটা হচ্ছে কী?—আচার্য শান্ত গলায় বললেন।

কে?—বিদ্যুদবেগে ফিরে দাঁড়াল যুবক।

বলি, এতরাত্রে গাড়ি চুরি করতে ঢুকেছ কেন? যাও, চলে যাও!—এই বলে দু-পা এগোলেন আচার্য।

চাপা গর্জন করে উঠল যুবক, এগিয়ে এসো না—গুলি করব। —এই বলে ট্রাউজারের পকেট থেকে বিদ্যুদবেগে সে একটি রিভলভার বের করে তুলে ধরল।

আচার্য হাসলেন। বললেন, মূর্খ, ওটা কি টয় রিভলভার যে, নিয়ে খেলা করছ? যাও, বাড়ি যাও। রেখে দাও, রিভলভার রাখো।

এই বলে যুবকটির দিকে দু-পা এগোতেই, তার হাতের অস্ত্রের মুখে আগুন জ্বলে উঠল। একটা চাপা আর্তনাদ করে আচার্য রাজমোহন সান্যাল গ্যারেজের মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।

যুবকটি কিছুক্ষণ চেয়ে রইল মৃতদেহের দিকে। তারপর দু-হাত দিয়ে দেহটা ঠেলে সরিয়ে দিল গাড়ির পথ থেকে।….দরজা খুলে গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিল, আলো জ্বেলে দেখে নিল—ট্যাঙ্ক-ভরা তেল আছে…বেরিয়ে গেল কোলাপসিবল গেট দিয়ে।

সমস্ত পরীক্ষা করে বেলা সাতটায় যখন আচার্যের বাড়ি থেকে বেরোলেন ইন্সপেক্টর মণ্ডল, তখন তাঁর মুখে-চোখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। মনে-মনে বললেন, এ কী আশ্চর্য মার্ডার রে বাবা! লোকটা একটা কোনও টেস রেখে যায়নি! কোনওখানে কিছু নেই! আজকাল কলকাতায় যে একশ্রেণীর গাড়িচোর বেরিয়েছে, ডেফিনিটলি এ তাদেরই কারও কাজ। কিন্তু—।

কিন্তুটা হচ্ছে কলকাতা থেকে এত দূরে, এই কৃষ্ণনগরে—আচার্য সান্যালের নতুন মরিস এইটের ওপর তারা কবে থেকে লক্ষ রেখেছিল? দেখা যাক।

আচার্যের মরিস গাড়িটার অ্যাক্সিলারেটারে একটু চাপ দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল বিরল। কাজটা অতি সহজেই হাসিল হয়েছে। মূর্খটা যদি নীচে না নামত, তা হলে অনর্থক এই মার্ডারটা হত না। সামনে ফাঁকা শান্তিপুর-ক্যালকাটা রোড। হাতঘড়িটা দেখল বিরল : চারটে বেজে আটত্রিশ মিনিট। ভালো দাম পাওয়া যাবে গাড়িটার। পার্টসগুলো সব নতুন, ফ্রেশ!…আর-একটু জোরে গেলে ক্ষতি কী? খুব জোরে সিগারেটে টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ভাবল বিরল, যাক, কিছুদিনের মতো নিশ্চিন্ত হওয়া গেল বাবা!

নিশ্চিন্ত হওয়া গেল কি?—পিছনের সিট থেকে একটি শান্ত ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল। —এই দেখো! সাবধান, সাবধান, হেডলাইট জ্বেলে একটা লরি আসছে। স্টিয়ারিংটা একটু বাঁয়ে কাটাও! চার ইঞ্চি ফলস আছে কিনা! আর-একটু কাটাও!…হ্যাঁ, সেভড!

কোথায় শুনেছে এই কণ্ঠস্বর?—ভাবল বিরল। খুব পরিচিত গলা। কোথায় শুনেছে সে? অত্যন্ত চেনা গলা। কিন্তু—।

অত চিন্তা না করে গাড়িটাকে একপাশে রেখে একটু পেছনে চাও না হে! তাহলেই তো চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়ে যাবে।

কৌতূহল জয়ী হল। গাড়িটার বেগ কমিয়ে পেছনে চেয়ে দেখল বিরল। বলল, হ্যাঁ, খুব চেনা চেহারা। আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?

একটু আগে। আচার্য রাজমোহন সান্যালের বাড়িতে।

হঠাৎ বিরলের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি একটা বিদ্যুৎতরঙ্গ বয়ে গেল। সে বোকার মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আবার গাড়িটা চালিয়ে দিল। একটু পরে গম্ভীর গলায় বলল, আপনি কী করে গাড়িতে উঠে পড়লেন?

খুব কি আশ্চর্য ঘটনা সেটা?

কিন্তু কী করে তা সম্ভব?—চিৎকার করে উঠল বিরল।—আমি যে নিজের হাতে—।

খুন করে এসেছ। সেটাও ঠিক।

সেটা ঠিক হলে, এটা কী?

এটাও ঠিক।

দেখুন, হেঁয়ালি রাখুন। তবে হ্যাঁ, অনুগ্রহ করে এটা যেন বলবেন না যে, আপনি ভূত হয়ে এ-গাড়িতে চেপে চলেছেন। কারণ, ভূতকে আমার বড় ভয়!

যদি তাই হয়, তাতেই বা ক্ষতি কী তোমার? ‘তুমি’ বলছি বলে যেন রাগ কোরো না, কেমন? সাবধান! আর-একটা লরি আসছে।

কোনওরকমে এ-গাড়িটাও পাশ কাটাল বিরল। বিচিত্র এক অনুভূতির স্রোত বইছে দেহ-মনে। থরথর করে কাঁপছে সব স্নায়ুতন্ত্রী। প্রথমেই তার মনে হল—এ-লোকটাকে আমি খুন করেছি, অথচ লোকটা আমার সঙ্গে মিষ্টি ভাষায় কথা বলছে! কী আশ্চর্য!

কিছুই আশ্চর্য নয়।—জবাব ভেসে এল : যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে কী করব আর!

বিরল কোনও জবাব দিল না। নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে লাগল।

আরও একটু তাড়াতাড়ি না চালালে তুমি বিপদে পড়বে। কারণ, এতক্ষণে মণ্ডল দারোগা সব তদন্ত শেষ করে থানায় ফিরেছে। এবং টেবিলে মাথা গুঁজে খুব চিন্তা করছে—তোমাকে কী করে ধরা যায়। শুনছ আমার কথা?

হুঁ।—সামনের পথে চোখ রেখে বলল বিরল, দেখুন, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন!

কেন?

আমি আপনাকে খুন করেছি—।

কিছু না, কিছু না।—ফিসফিস করে হাসির আওয়াজ শোনা গেল : তুমি তো ইচ্ছে করে গুলি করোনি!

আজ্ঞে না।—উৎসাহিত হয়ে বলল বিরল, এটা আপনি বুঝতে পেরেছেন তাহলে? কিন্তু আপনাকে এগোতে দেখে—।

হুঁ, হুঁ! আমিও তো তোমাকে মারতে যাচ্ছিলাম না হে! আমি এগোচ্ছিলাম তোমার হাত থেকে পিস্তলটা নিয়ে নিতে। কিন্তু তুমি এত মূর্খ যে, কিছু না বুঝেই দুম করে গুলি করে বসলে।

ও!—একটু থেমে বলল বিরল, আমি সেটা বুঝতে পারিনি।

তা তো বটেই। জেনে-শুনে কি কেউ মানুষ খুন করে? এটুকু বুঝেছি বইকী!

নিঃশব্দ পথযাত্রা। শুধু গাড়ির চাকার আর রাস্তার মিলনের শব্দ। প্রথমে আচার্যকে দেখে যে-ভয়টা জেগেছিল, সেটা একটু-একটু করে কেটে যাচ্ছে। গাড়ি রানাঘাট ছাড়িয়ে গেল। বিরল আবার সিগারেট ধরাল। বলল, আপনি আমার সঙ্গে কোথায় চলেছেন?

আমি তো চলিনি, কিন্তু গাড়িটার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতেও পারছিনা যে! এদিকে মন দিয়ো না। তুমি তোমার নিজের কাজ করে যাও। অন্তত, গাড়িটাকে একটা ভালো জায়গায়… কোথায় দেবে? মানিকতলাতেই ভালো, কী বলো? সেখানে তোমার জুয়াড়ি বন্ধু অ্যালবার্ট আছে।

সিগারেটটা প্রায় মুখ থেকে পড়ে গিয়েছিল আর কী!

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিরল বলল, আপনি সব জানতে পারছেন? সব জানেন?

আনফরচুনেটলি—হ্যাঁ।

আমি কে বলুন তো? কী আমার পরিচয়?

আবার সেই ফ্যাঁসফ্যাঁস হাসি। ঠিক হাওয়ায় দু-খণ্ড কাঠ-ঘষার শব্দ যেন।

তোমার নাম বিরল। তুমি বিকাশবাবুর ছেলে। আহিরীতলায় বাড়ি তোমার। আরও শুনতে চাও? তোমার স্ত্রীর নাম মুক্তি। সে জানে, তুমি গাড়ি মেরামত করতে বেরিয়েছ নাইট ডিউটিতে। কিন্তু—।

থামুন, থামুন আপনি!—ধমক দিয়ে বলে উঠল বিরল, তার মানে, বলতে চান, আপনি সব জানেন?

সব, সব!—বললেন আচার্য সান্যাল।

ও! তাহলে প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্যে আপনি আমার পিছু নিয়েছেন?

ঠিক উলটো। চেষ্টা করছি, তোমায় যদি রক্ষা করা যায়। কেন জানো? ইউ আর এ ফুল! এ বিগ ফুল! যে-বিদ্যা তোমার জানা নেই, তোমার গুরুরা আমার গাড়ির ওপর দিয়ে তোমাকে সেই বিদ্যায় প্রথম হাতেখড়ির সুযোগ দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, যদি নতুন গাড়ি কামাতে পারো, তাহলে দু-হাজার টাকা অবধি এককালীন তোমাকে তাঁরা দিতে পারেন।

ঠিক, ঠিক।—নিজের মনেই বলল বিরল। তারপর আবার নিঃশব্দে চালাতে লাগল। গাড়ি ব্যারাকপুর পার হচ্ছে…।

আরও কিছুক্ষণ পরে বিরল গাড়ি চালাতে-চালাতে পিছনে চাইল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।

খুব ভোরে উঠে মুক্তি রান্নাঘরে ঢুকেছে। নাইট ডিউটি সেরে স্বামী বাড়ি ফিরে চান করবে, খাবে—তারপর শোবে। কাজেই খান-চার-ছয় পরোটা, আর একটু আলু ছেঁচকি করে রাখা দরকার। খেতে-খেতে চা করে দেবে।

হঠাৎ স্বামীকে ঢুকতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল মুক্তি, কী হয়েছে তোমার?

কেন?

এত বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে তোমার চেহারা! চোখ-মুখ বসে গেছে, সারা মুখে কে যেন কালি লেপে দিয়েছে! কী হয়েছে?

কিছু না তো!—জামা ছাড়তে-ছাড়তে মৃদু গলায় বলল বিরল।

কিছু না! তবে চেহারা এমন হল কেন?

কিছুই হয়নি। ও তোমার চোখের ভুল।

এই বলে বিরল যেই ওপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে, সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তি বলে উঠল, মুখ-টুখ ধুয়ে নাও। আমার খাবার কিন্তু তৈরি।

খাব না।

কী?

বলছি, খাব না, খিদে নেই।

সে কী! রোজই খিদে থাকে—।

আজ নেই।—বলে বিরল ওপরে চলে গেল। এই ওপর-নীচে দুখানা ঘর নিয়ে বিরলের সংসার। সুন্দরী তরুণী বধূ মুক্তি। তাকে নিয়ে ভারী শান্তির সংসার তার। কোনওদিন কোনও কারণে ভুল-বোঝাবুঝি হয় না।

খাবার সামনে নিয়ে চুপ করে বসে রইল মুক্তি। আজ যেন স্বামীর ব্যবহারে কেমন বৈলক্ষণ্য দেখা যাচ্ছে। নাইট ডিউটি করে আরও কতদিন তো বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু হাজার ক্লান্ত হয়ে ফিরলেও তো মুখ-হাত-পা ধুয়েছে, স্নান করেছে, খেয়েছে। এই ভাবটা তো আগে—।

জামা ছেড়ে, গেঞ্জিটা খুলে, ট্রাউজার খুলতে যাচ্ছে, এমনসময় দরজার দিকে চাইতেই বিরল দেখল, আচার্য সান্যাল চুপ করে দাঁড়িয়ে। দেখেই দপ করে জ্বলে উঠল সে।

আপনি যাননি এখনও?

যাওয়ার তো উপায় নেই। আগেই তো বলেছি। চব্বিশ ঘণ্টা আমি তোমার সঙ্গেই রয়েছি। যাক সে-কথা। আপাতত যে-কথাটা বলবার জন্যে এলাম—তুমি এখুনি ফ্যাক্টরিতে বেরিয়ে যাও।

কেন?

বেরিয়ে গেলেই তুমি বুঝতে পারবে।

আমার বুঝে দরকার নেই। শরীর ভেঙে আসছে আমার। একটু না ঘুমোলে আর আমি কিছুতেই চলতে পারব না।

পারতেই হবে।

না—না—না, আমি ঘুমোব। চলে যান আপনি।

মূর্খ, আমি তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে বলিনি। বলছি, তোমার সেফটির জন্যে। এখুনি বেরিয়ে গিয়ে মানিকতলা গ্যারেজ থেকে যদি গাড়িখানা সামাল না দাও, তাহলে গ্রেপ্তার হতে আর বিশেষ দেরি হবে না।

কিন্তু আমি যে ক্লান্ত।—অপরিসীম শ্রান্তি ফুটে উঠল বিরলের গলায় : আমি যে আর পারছি না। আমাকে ঘুমোতে দিন।

দরজা ঠেলে মুক্তি ঢুকে হাঁ করে চেয়ে রইল স্বামীর দিকে। একটু পরে বলল, ও কী! কার সঙ্গে কথা বলছ তুমি?

বিরল চেয়ে আছে স্ত্রীর দিকে।

হ্যাঁ গো, কার সঙ্গে কথা বলছিলে তুমি একলা ঘরে?

কই?

কই মানে? এই তো কথা বলছিলে! এসো, খাবে এসো।

ওই ওকে খেতে দাও। আমার আর খাওয়ার দরকার নেই।

কাকে? কাকে খেতে দেব? কী বলছ তুমি?

বিরল দেখল, তখনও আচার্য সান্যাল চুপ করে চেয়ে আছেন তার মুখের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে সে সামলে নিল নিজেকে। বলল, না, কিছু বলিনি। আমি বেরোচ্ছি।

বেরোচ্ছ মানে? এই যে বললে ঘুমোবে, বেরোবে না!

না, ফ্যাক্টরিতে না গেলে চলবে না। দরকার আছে। —এই বলে জামাটা গায়ে দিতে-দিতে আড়চোখে আচার্য সান্যালের দিকে চাইল। তাঁকে তখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জ্বলে উঠল বিরল।

এখনও দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী? বললাম তো, যাচ্ছি।

ধীরে-ধীরে কাছে এগিয়ে এল মুক্তি। ঠিক যেন আচার্য সান্যালকে ভেদ করে এগিয়ে এল। কিছুক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, আজ কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলছ ‘এখনও দাঁড়িয়ে থাকার মানে?’

না, না, তোমাকে বলিনি!

তবে কাকে বলেছ? কে আছে আর এ-ঘরে?

দেখতে পাচ্ছ না?

না।

কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছ না?

না, না! কী বলছ তুমি?

তবে আর দরকার নেই দেখে।—এই বলে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বিরল। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় দেখল, আচার্যও তার সঙ্গে-সঙ্গে নামছেন।

পথে নেমে কিছুটা হেঁটে গিয়ে তবে বাসে উঠতে হয়। সিগারেট ধরিয়ে যখন বিরল চলেছে, তখন সে দেখল, সেই জনাকীর্ণ রাস্তায় নিঃশব্দে তার পাশে-পাশে চলেছেন আচার্য সান্যাল। যেতে-যেতে একসময় তিনি বললেন, বিরল!

আজ্ঞা করুন।

আমি ভেবে দেখলাম যে, গ্যারেজে এখন তোমার যাওয়া উচিত হবে না। কেননা, অলরেডি পুলিশ ওই রাস্তায় পৌঁছে গেছে।

থমকে দাঁড়াল বিরল। ভয়-ভরা গলায় বলল, তাহলে?

তাহলে আবার কী! তোমাদের তো কোড আছে? ডেঞ্জার ইন্ডিকেশন ‘লালবাতি’, না?

হ্যাঁ।

ফোনে লালবাতির কথা বলে দিয়ে মানিকতলাকে সাবধান করে দাও যে, গাড়িটা যেন এখুনি বাইরে নিয়ে গিয়ে রান করাতে থাকে। ঘণ্টাখানেক কি দেড়েকের মধ্যে এই গোলমাল মিটে যাবে, তারপর ফিরিয়ে আনলেই হবে। টেলিফোন করে দাও।

বেশ।—বলে কাছের একটা দোকানে ঢুকতে গেল বিরল টেলিফোন করবে বলে।

আর-একটা কথা।—বললেন আচার্য সান্যাল।

বলুন।—বলল বিরল।

উত্তেজনার ঝোঁকে এই রিভলভারটা তোমার ট্রাউজারের পকেটেই রয়ে গেছে। ওটাকে এক্ষুনি গঙ্গায় গিয়ে ফেলে দিয়ে এসো। অন্য কোথাও নয়, সোজা গঙ্গায়। বুঝেছ? হাজারী বলে তোমার দলের যে-লোকটা এটা তোমায় দিয়েছিল, এটা হারিয়ে গেলে সে রাগ করবে না, বরং ধরা পড়লেই করবে।

বিরল চুপ করে চেয়ে রইল সান্যালের দিকে। একটা উদগত কান্না যেন গলার কাছে এসে ফিরে যাচ্ছে। তবু ঢোক গিলে বলল, আচার্য! আমি আপনাকে হত্যা করেছি। হত্যাকারীর প্রতি এটা কী ধরনের ব্যবহার আপনার?

কী করব বলো, আমার অদৃষ্ট! যাও, যাও, দেরি কোরো না। আর শোনো, রিভলভারটা গঙ্গায় ফেলে দিয়ে সোজা বাড়ি চলে যেয়ো। মুক্তি বসে-বসে কাঁদছে।

হঠাৎ মিলিয়ে গেলেন আচার্য সান্যাল।

গঙ্গার ধারে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বিরল। সমস্ত ব্যাপারটা যেন স্বপ্নের মতো—পরম অবিশ্বাস্য ঘটনা। নিহত ব্যক্তির আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে হত্যাকারীর পিছনে তাকে রক্ষা করতে! ছি! ছি! ভাবল বিরল, অনর্থক লোকটিকে হত্যা করেছি! কোনও দরকার ছিল না। অতি নিরীহ মানুষ। চাইলে হয়তো গাড়িটা দিয়েও দিতে পারত। অতি নিরীহ, অতি ধার্মিক, অত্যন্ত ভালো ভদ্রলোক এই আচার্য সান্যাল। ছিঃ! এ কী করল সে?

ইন্সপেক্টর মণ্ডল টেলিফোন পেয়ে আবার গর্জন করে উঠলেন, অদ্ভুত! অদ্ভুত ঘটনা! ঠিক সময়ে ঠিক জায়গা থেকে কে যেন অতি সন্তর্পণে খুনের সমস্ত প্রমাণ মুছে দিয়ে যাচ্ছে! টেলিফোন থেকে যা বোঝা গেল, তাতে গাড়িটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে—ওই গ্যারেজেই। কিন্তু কোন যাদুমন্ত্রে সব সাবধান হয়ে গেল! বহু খুনের তদন্ত করেছেন, কিনারাও করেছেন তিনি। কিন্তু এমন আশ্চর্য ঘটনা এর আগে তিনি দেখেননি। প্রতিটি ব্যাপারে মনে হচ্ছে, কে যেন পুলিশের ঠিক আগে-আগে চলেছে প্রমাণ সরাতে-সরাতে।

সিগারেটে গভীরভাবে গুটিকয়েক টান দিয়ে ইন্সপেক্টর মণ্ডল আবার চিন্তার সমুদ্রে ডুব মারলেন। এখন একটি মাত্র ভরসা—একটি সূত্র। দেখা যাক।

সন্ধ্যার মুখেই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়ল বিরল। ক্লান্ত দেহ, ক্লান্ত মন, তবু ঘুম আসে না কেন? চোখ বুজে আসছে ঘুমের চাপে, তবু ঘুম আসছে না কেন? মোটরটা নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। পা. বলছে, এটাকে পার্ট-বাই-পার্ট বিক্রি করলে যা হবে, তার চাইতে একটু অপেক্ষা করে বাংলার বাইরে—ইত্যাদি। যাই হোক, ও-ব্যাপারে ঠিক বিরলের মন নেই আজকাল। সে সর্বদাই ভাবছে, আচার্য সান্যালের ব্যবহার। সে অবশ্য আগের দিন কৃষ্ণনগরে গিয়ে শুনেছিল যে, আচার্য অদ্ভুত ভদ্রলোক। সজ্ঞানে কারও কোনও অপকার করতে তিনি নারাজ। কিন্তু তাই বলে মৃত্যুর পরেও মানুষ একইরকম থাকে কি? ঠিক একইরকম!

সত্যি কথা বলতে কী, আজ এই যে বিরল ধরা পড়ছে না, এ কার দয়ায়? কার অনুগ্রহ তাকে বর্মের মতো ঘিরে রেখেছে? কার বিদেহী দুটি চোখ তার দিকে চেয়ে অশ্রান্ত পাহারা দিচ্ছে? তিনি হলেন আচার্য সান্যাল।

একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা অনুভব করল বিরল। মুখে বলে বোঝানো যাবে না—এমন একটা কষ্ট। তবু—তবু এ-লোকটা যদি চলে যেত, যদি না থাকত, কিংবা…হ্যাঁ, বিরল তার সুস্থ মস্তিষ্ক থেকেই চিন্তা করছে, কিংবা যদি আচার্য সান্যাল তাকে ধরিয়ে দিতেন, তবু সে স্বস্তি পেত।

আরও পরে রান্নাঘরে ফেলে আসা সিগারেটের টিনটা নিয়ে মুক্তি ঘরে ঢুকল। কাছে এসে দেখল, বিরল চুপ করে শুয়ে—কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছে অপলক। এই দু-দিন পরে স্বামীর চেহারা যেন নতুন করে দেখল মুক্তি। কী অসম্ভব বিবর্ণ দেখাচ্ছে তাকে! গালের হাড় দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে! এ কী কাণ্ড!

সিগারেটের টিন আর দেশলাইটা মাথার কাছে টিপয়ের ওপর রেখে স্বামীর কাছ ঘেঁষে বসল মুক্তি। আস্তে-আস্তে বাঁ-হাতখানি বিরলের মাথায় বোলাতে-বোলাতে বলল, দ্যাখো, তোমার কী হয়েছে, আমায় বলো! তুমি তো জানো, আমার কাছে কিছুই গোপন রাখতে পারবে না। তবে শুধু-শুধু কেন কষ্ট পাচ্ছ? কী হয়েছে, আমায় বলো!

একমুহূর্ত স্ত্রীর দিকে চেয়ে যেন একটু বিরক্ত হল বিরল। তবু যথাসম্ভব সে-বিরক্তি দমন করে বলল, কিছু না হলে তোমায় কি বানিয়ে বলব?

কিছু হয়নি?

না।

কিচ্ছু হয়নি?

না গো, না!

মুক্তি আর কোনও কথা না বলে শুয়ে পড়ল। টেবিল-ল্যাম্পটার সুইচে বিরল হাত দিতেই খুট করে একটা শব্দ হয়ে ঘর অন্ধকারে ভরে গেল। এতক্ষণ পরে বিছানার পাশে জানলাটা আলোকিত হয়ে উঠল। পূর্ণ চাঁদের জ্যোৎস্নায় ফিন ছুটছে বাইরের পৃথিবীতে। সেইদিকে চেয়ে রইল বিরল। কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ।

ঘুমন্ত স্ত্রীর একখানি হাত জড়িয়ে ধরল বিরলকে। কোথায় কে যেন কী গান গাইছে! এই শান্ত, স্তব্ধ, মাধুরী-মণ্ডিতা বসুন্ধরা ওই একখণ্ড জানলার মধ্য দিয়ে আলোছায়ার বিচিত্র মায়াজাল সৃষ্টি করতে লাগল।

চুরি না করলে কী হয়? অর্থকষ্ট হয়! কিন্তু অশান্তি হয় না। এই পরমাসুন্দরী যুবতী স্ত্রী, কণ্ঠলগ্না হয়ে আছে—একে নিয়ে কি সৎভাবে জীবনযাপন করা যেত না? মোটর-মেকানিক হিসাবে যে-উপার্জন সে করে, তা তো সামান্য নয়!

মুক্তির মনেও সন্দেহ জেগেছে। আজ তিনদিনের আচরণে যে-বৈষম্য প্রকাশ পেয়েছে তার, স্ত্রীর চোখে তা ধরা পড়েছে। এই তিনদিন সে মুক্তির সঙ্গে ভালো করে কথা কয়নি পর্যন্ত।

মুখ ফিরিয়ে চাইল বিরল স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখের দিকে। কী আশ্চর্য সুন্দরী দেখাচ্ছে ওকে!

হঠাৎ একটা অজানিত ভয়ে থরথর করে সর্বশরীর কেঁপে উঠল বিরলের। যদি কোনওরকমে এই হত্যারহস্যের সূত্র ধরে পুলিশ তাকে প্রেপ্তার করে? পুলিশ যদি প্রমাণ করতে পারে যে, সে-ই হত্যাকারী, তবে?

বাইরের কৃষ্ণচূড়া গাছটায় বসে একটা কোকিল ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে। দূরের আর-একটি গাছ থেকে সাড়া দিচ্ছে আর-একটি কোকিল। হঠাৎ সজোরে মুক্তিকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিল বিরল। ঘুম ভেঙে গেল মুক্তির। সে বুভুক্ষু স্বামীর আহ্বানে সাড়া দিল!

কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মিলন—সে-উত্তেজনাও তো ক্ষণিক! তারও তো অবসান আছে! আবার ঘুমিয়ে পড়ল মুক্তি। কিন্তু ঘুম আসছে না বিরলের। সে জানলার দিকে চেয়ে শুয়ে রইল। একটু পরেই তার মনে হল, জানলার বাইরে একখণ্ড কুয়াশা ভাসছে। ক্রমশ সেই ঘনীভূত কুয়াশা-খণ্ড জানলা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দেখা গেল, আচার্য সান্যাল দাঁড়িয়ে আছেন।

বিরক্ত হয়ে উঠল বিরল। বলল, গভীর রাত্রে স্বামী-স্ত্রীর শোওয়ার ঘরে এভাবে না ঢুকলে আপনার রুচির প্রশংসা করতাম।

ঢুকব কেন? আমি তো এই ঘরেই আছি।

এই ঘরে আছেন মানে! সবসময়?

হ্যাঁ।

তার মানে কী? তার মানে আমি যখন—।

হ্যাঁ, আমি এই ঘরেই ছিলাম।

কিছুক্ষণ চুপ করে আচার্য সান্যালের মুখের দিকে চেয়ে রইল বিরল। লোকটাকে তিরস্কার করবে, না প্রশংসা করবে, ভেবেই পায় না সে। স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গ নিকটবর্তিতার লীলা কোনও ভদ্রলোক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখতে পারে, এ তো সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না!…হ্যাঁ, বিরল চোর, বিরল আজ খুনি, তবুও সে এ-কথা চিন্তা করতে পারে না।

ভুল, বিরল, ভুল।—বললেন আচার্য, ও-কথা মনে করে অনর্থক কষ্ট পাচ্ছ কেন? আমার কোনও অস্তিত্ব নেই। এ যা দেখছ, তা অস্তিত্বের অন্ধ অনুকৃতি। তোমাদের মিলনের সময় জানলা দিয়ে বাতাস আসা যেমন বন্ধ করতে পারো না, নিজেদের নিশ্বাস-প্রশ্বাস যেমন রোধ করতে পারো না, আমিও ঠিক তাই। আমিও আজ নিশ্বাসের মতো সহজ। আমি আজ ইচ্ছাগতি। মনখারাপ কোরো না। তোমাদের মিলনের ক্ষণে জানলা দিয়ে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়া ওই চাঁদের আলোকে যেমন স্বীকার করে নিয়েছ, আমাকেও তেমনি স্বীকার করে নাও।

বিরল যেন কেমন হয়ে গেল। সে চুপ করে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবতে লাগল। একটু চুপচাপ।

কিন্তু তোমাকে যে এখুনি উঠতে হবে, বিরল!

কেন?

যেদিন আমাকে হত্যা করো, সেদিন কি খুব দামি কোনও কাপড়ের ট্রাউজার তোমার পরনে ছিল?

বিরল বোবা চাউনি মেলে চেয়ে রইল আচার্য সান্যালের দিকে।

বলো, বিরল, আমার কথার জবাব দাও!

হ্যাঁ, ছিল। খুব দামি কাপড়।

এ-কথা কি ঠিক যে, সুইজারল্যান্ডের সেই কাপড় আর ওই ট্রাউজারের ফ্রান্সের তৈরি বোতাম—কলকাতায় একমাত্র হোসেন আলি হাসান আলির দোকান ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না?

ঠিক, ঠিক!—উত্তেজনায় বিরল উঠে বসল বিছানায়। বলল, না, কোথাও পাওয়া যায় না। সেইজন্যেই হোসেন-হাসান প্রতিটি ট্রাউজার নিজেরা তৈরি করে দেয় এবং একটা নাম-ঠিকানা রাখে। প্রায় আশি টাকা পড়ে একটা ট্রাউজারে, জানেন?

তোমাকে এত করে সাবধান করলাম বিরল, এত করে!—কান্নার মতো শোনাল আচার্যের কণ্ঠস্বর : প্রথম দিন থেকে তোমার পেছনে-পেছনে ছায়ার মতো ঘুরে-ঘুরে তোমাকে সাবধান করছি, তবুও এমন সাঙ্ঘাতিক ভুল তুমি কেন করলে?

কী হয়েছে?—মুখ শুকিয়ে গেল বিরলের।

গাড়িটা পুলিশ উদ্ধার করেছে। ড্রাইভারের সিটের দরজার কবজায় ট্রাউজারের একটুকরো কাপড় একটা বোতামসুদ্ধ ছিঁড়ে গিয়ে আটকে ছিল।

সে কী!

হ্যাঁ। উত্তেজনার মুখে গাড়ি থেকে নেমেছ, বোতামসুদ্ধ কাপড়টা সেখানে ছিঁড়ে রয়ে গেছে।

সর্বনাশ!—বলল বিরল।

অবশ্যই সর্বনাশ। তারপর সেই কাপড়ের খোঁজ নিয়ে হোসেন-হাসানের দোকান থেকে একাশিজন লোক—যারা ওই কাপড়ের ট্রাউজার বানিয়েছিল, তাদের ঠিকানা জোগাড় করে গতকাল সকাল থেকে কলকাতা শহর তছনছ করছে পুলিশ। আজ ভোররাত্রে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে তারা তোমার এখানেও হানা দেবে।

এখন উপায়?—বিবর্ণ হয়ে গেছে বিরল।

উপায়? তুমি তো আমার কথা শুনবে না! আমি যা বলছি, তাতেই তুমি সন্দেহের ছায়া দেখছ। ওঠো! উঠে গিয়ে চুপিচুপি ওই ট্রাউজারটা নিয়ে নীচের তলার রান্নাঘরে ঢুকে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে নিঃশেষে পুড়িয়ে ফ্যালো!

পুড়িয়ে ফেলব! কিন্তু ওটা যে—।

জানি। আশি টাকার মায়া। কিন্তু ওই আশি টাকা বাঁচাতে গেলে আজ ভোর হওয়ার আগেই তুমি আশীবিষে জ্বলে মরবে! যাও, যাও—ওঠো!—আচার্য সান্যালের কণ্ঠে যেন আদেশের সুর বাজল, যাও, ওঠো বলছি! এক্ষুনি গিয়ে ট্রাউজারটা পুড়িয়ে ফেলে প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করো।

ধীরে-ধীরে বিছানা থেকে নামল বিরল। আলনা থেকে ট্রাউজারটা নিয়ে খুঁজে দেখল। সত্যি, তার প্রথম বোতামের ঘরের কাছে খানিকটা কাপড় আর একটা বোতাম নেই। শার্টের পকেট থেকে দেশলাইটা বার করে ট্রাউজারটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে সে দরজায় হেলান দিয়ে ফিরে চাইল পশ্চাতে দণ্ডায়মান আচার্য সান্যালের মুখের দিকে। দেখল, সেই প্রশান্ত মুখখানি যেন করুণায় ছলছল করছে।

হু-হু করে উঠল বিরলের বুকের মধ্যে। সে ধীরে-ধীরে বলল, আচার্য সান্যাল!

আর-একটা কথা। এটাকে পুড়িয়ে রাত সাড়ে তিনটের মধ্যে তুমি এ-বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। বউমা যেন পুলিশকে বলেন, তুমি বিদেশে মোটর সারাতে গেছ। বুঝলে?

আচার্য!—সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বলল বিরল।

কী বলতে চাও, তাড়াতাড়ি বলো।

আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।

কেন? ক্ষমা কীসের জন্যে?

আপনার মতো ভালোমানুষকে—দেবতাকে আমি খুন করেছি বলে। এমনিতেই আমি বিবেকের জ্বালায় জ্বলে মরছি, তার ওপর যদি আপনার ক্ষমা না পাই—।

না, না!—আচার্য যেন আর্তনাদ করে উঠলেন, ক্ষমা! কী বলছ বিরল? তুমি জানো না, আমাকে হত্যা করে তুমি আমার কতবড় উপকার করেছ। ক্ষমার কথা বোলো না। না, না, ক্ষমা-টমা নয়, ক্ষমা-টমা নয়।

কেন নয়? আপনার জীবননাশ করেছি আমি।—বলতে-বলতে বিরলের চোখ ছলছল করতে লাগল : অন্যায় করেছি, আমি স্বীকার করছি। আমাকে ক্ষমা করুন। হত্যাকারীকে জগতে কেউ ক্ষমা করে না, সবাই ঘৃণা করে তাকে। কিন্তু আপনি তা করেননি।

না, না, বিরল!—অদ্ভুত শান্ত শোনাল আচার্যের কণ্ঠ : পৃথিবীতে আমার চাইতে অসুখী কেউ ছিল না। বিশহাজার টাকার ইনশিয়োর করেছিলাম। এই টাকাটা পাওয়ার জন্যে আমার স্ত্রী একদিন…যাক সে-কথা। কৃষ্ণনগরে বাড়ি করার ব্যাপারে আমি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্রতিদিন সেই পাওনাদারের তাগাদা শুনতে-শুনতে পাগল হয়ে উঠেছিলাম। শুধু এই নয়, আরও আছে।

আরও আছে!

আরও আছে, বিরল, আরও আছে। তুমি ছেলেমানুষ, মানবচরিত্রের কতটুকুই বা জানো? যৌবনের উন্মত্ততায় কবে কোথায় কী করেছিলাম, আজ মনে নেই। হয়তো করেছিলাম, নয়তো করিনি—কিন্তু তার জন্যে এই প্রৌঢ় বয়েসে প্রায়শ্চিত্ত করছি। দেহের মধ্যে থেকে-থেকে একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করি। যখন এই ব্যথা ওঠে, তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ি। এই যন্ত্রণার জ্বালায় আমি দু-তিনবার আত্মহত্যাও করতে গেছি। এক অবরুদ্ধ নিশ্বাস-রোধকর আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে প্রাণ আমার মুক্তির জন্যে হাঁপিয়ে উঠেছিল। ঠিক সেইসময় দুঃখত্রাতার ভূমিকায় দেখা দিলে তুমি। দয়া করে গুলি করে আমাকে মৃত্যু-অমৃত দান করলে। তোমার ওপর রাগ করব আমি, যে আমাকে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নবজীবন দান করল?

এই বলে একটু থেমে আচার্য সান্যাল আবার বলতে লাগলেন। এবার তাঁর কণ্ঠস্বর আরও শান্ত, আরও গভীর শোনাচ্ছে :

তাই উপকারীর উপকার করবার জন্যে আমার এই চেষ্টা।—দেখতে-দেখতে আচার্য সান্যালের দু-চোখ জলে ভরে এল : যাই হোক, তুমি আর দেরি কোরো না, বিরল! মনে রেখো, ঠিক চারটে দশ মিনিটে ওরা এখানে আসবে তোমার খোঁজে—সার্চ করবে তোমার বাড়ি-ঘর। তার আগে নিশ্চিহ্ন করে পুড়িয়ে ফ্যালো ওই সর্বনাশা টাউজার। তারপর পালিয়ে যাও বাড়ি থেকে। দিন-সাতেক পর ফিরে আসবে, তখন বিপদ অনেক কেটে যাবে।

কোথায় যাব?

কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই?

না।

একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে আচার্য বললেন, আচ্ছা, তবে ট্রাউজারটা পোড়ানোর পর আমার পেছনে-পেছনে যেয়ো। আমি তোমাকে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসব। আর কথা নয়, এখন যাও। ওঠো, ওঠো, ট্রাউজার নিয়ে নীচে চলে যাও।

ধীরে-ধীরে ট্রাউজার হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বিরল। রান্নাঘরে ঢুকে বসল চুপ করে। কাঁচি দিয়ে টুকরো-টুকরো করে কাটল ট্রাউজারটাকে। তারপর তাতে অগ্নিসংযোগ করল। একটু-একটু করে পুড়তে লাগল ট্রাউজার।

নানা চিন্তার তরঙ্গ উঠছে মনে। কতক্ষণ এইভাবে কেটেছে বলতে পারবে না বিরল। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে সে চমকে উঠে চেয়ে দেখল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তি। ভয়-ভরা অপলক চোখে চেয়ে আছে স্বামীর দিকে। তার চোখে ফুটে উঠেছে ভয়…সন্দেহ…অনুকম্পা একসঙ্গে।

ধীরে-ধীরে এগিয়ে এল মুক্তি। বলল, এত রাতে এখানে কী করছ?

ওই যে একটু দরকার ছিল—মানে ট্রাউজারটা—।

কাছে এগিয়ে এসে বসল মুক্তি। ট্রাউজারটার দিকে চেয়ে বলল, এ তো সেই নতুন ট্রাউজারটা! এটা পোড়াচ্ছ কেন?

এটা—মানে—বড় বাজে কাট, তাই—।

বাজে কাট!

দুজনের চোখাচোখি হল। বিরল চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার আগুনে ফেলে দিল আর-একটা টুকরো।

একটু নিস্তব্ধতা…।

শোনো!—ডাকল মুক্তি।

বলো।—অন্য দিকে চেয়ে জবাব দিল বিরল।

চাও আমার দিকে—।

বিরল এবার চাইল স্ত্রীর দিকে। মুক্তি দেখল, স্বামীর দুটি বড়-বড় চোখ জলে পরিপূর্ণ। একটা উদগত কান্নাকে দমন করে মুক্তি চাপা আর্তনাদ করে উঠল, ওগো, এখনও আমাকে বলো, তোমার কী হয়েছে? কোথায় কী করে এসেছ তুমি? বলো, বলো, তোমার দুটি পায়ে পড়ি!

ট্রাউজার পোড়াতে ভুলে গেল বিরল। সেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মুক্তি সবলে তার মাথাটাকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কান্না-জড়ানো অস্ফুট কণ্ঠে বলল, বলো!

ধীরে-ধীরে, একটু-একটু করে, পুরো কাহিনী ব্যক্ত করতে লাগল বিরল। তার চোখের জলে স্ত্রীর বুকের কাপড় ভিজে উঠল। উঠুক। তবু, কী শান্তি! কী অপরূপ মুক্তি আছে মুক্তির বুকে!

পুলিশ এসে যখন স্ত্রীর বুক থেকে স্বামীকে কেড়ে নিয়ে অ্যারেস্ট করল, তখন সমস্ত ভয়… উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের চিহ্ন মুছে গেছে বিরলের মুখ থেকে। স্ত্রীর চোখের জলে ভিজে গেছে তার মাথার চুলগুলি। অশ্রুধারায় স্নান করে শুচি-স্নাত হয়ে বিরল চলল নরহত্যা নামক অপরাধে বিচারকের মুখোমুখি দাঁড়াতে।

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যেতেই বিরল উঠে দাঁড়িয়ে দেখল, আচার্য সান্যাল দাঁড়িয়ে আছেন। হাসিমুখে ডাকলেন, এসো বন্ধু!

এখনও অপেক্ষা করছেন আপনি?—বিরল বলল।

এত অপেক্ষা করেছি বলেই তো আজ পাওয়া পূর্ণ হল। এসো, পুরীর সমুদ্র দর্শন করে আসি।

তার মানে? আমার চাকরি-বাকরি নেই? আপনার সঙ্গে…।

বলতে-বলতে থেমে গেল। চেয়ে দেখল, তার দেহটা তখনও জেলের ফাঁসিকাঠে ঝুলছে, চারপাশে লোকজন। সে বেঁচে আছে কিনা—বোধহয় সেই পরীক্ষাই চলছে।

কী পাগলামি!—খুব জোরে হেসে উঠল বিরল। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ হল না দেখে আপনি থেমে গেল।

মাসিক রোমাঞ্চ

জানুয়ারি, ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *