তেপ্পান্ন
ডিনার জ্যাকেটের আস্তিন উল্টে কবজিতে সোনার রোলেক্স অয়েস্টার দেখল লুকা ব্রুনার। বলরুমের অন্য আরেক দিকে দাঁড়িয়ে আছে মাইক বুচার। তাকে আবছা ইশারা করল বিলিয়নেয়ার। আনমনে মাথা দোলাল সিকিউরিটি চিফ। এবার সময় হয়েছে।
বিশাল ফায়ারপ্লেসের সামনে কয়েকজন অতিথির সঙ্গে আলাপ করছে ডাক্তার ব্যানওঅর্ট। কাঁধে টোকা পড়তেই বিরক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। চশমার পুরু কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখল মাইক বুচারের চোখ।
‘স্যর, বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত,’ তার কানের কাছে ফিসফিস করল ইংরেজ জানোয়ার, ‘আপনাকে একজন রোগী ফোনে চাইছেন।’
কথাটা শুনে বিস্মিত হলো না ব্যানওঅর্ট। একবার অতিথিদের দিকে মাথা দুলিয়ে আড়ষ্ট পায়ে পিছু নিল বুচারের। যাওয়ার পথে একটা টেবিলে নামিয়ে রাখল শ্যাম্পেনের গ্লাসটা। ডাক্তারকে দূরের দরজা দেখিয়ে অন্যদের দিকে গেল বুচার।
প্রায় কেউই খেয়াল করল না, একজন একজন করে পার্টি থেকে বিদায় নিয়েছে মোট বারোজন লোক। তারা ভাল করেই জানে কোথায় যেতে হবে।
তাদের চলে যাওয়া খেয়াল করেছে ক্রিস্টা গুন্থার। গত তিন বছরে ছয়বার এভাবে এদেরকে উধাও হতে দেখেছে ও। নাকি আটবার? ঠিক মনে পড়ল না ওর। বরাবরের মতই নীরবে, নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছে লোকগুলো। কে-ই বা মনে রাখবে ধূসর চুলের ক’জন ধনী ব্যবসায়ী আপাতত তাদের সঙ্গে নেই!
কেউ ভাবতেও পারবে না, কী কাজে গেছে তারা। এ-ও জানবে না, একটু পর নির্মমভাবে খুন হতে চলেছে একজন মানুষ। ওই বারোজন ব্যবসায়ীর শেষজন হলরুম ছেড়ে যাওয়ায় পরস্পরের দিকে তাকাল ব্রুনার ও বুচার। আরেকবার হাতঘড়ি দেখল বিলিয়নেয়ার। চেহারায় ফুটে উঠল সন্তুষ্টি। ধীর পায়ে দরজার দিকে চলল সে। তার কয়েক ফুট পেছনে ভক্ত কুকুরের মত চলেছে মাইক বুচার।
শ্যাম্পেনে চুমুক দিয়ে স্বাদটা তেতো লাগল ক্রিস্টার।
.
গত দু’শ’ বছরে দি অর্ডার অভ রা-র নেতৃত্বে যারা থেকেছে, তারা ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করেনি গোপন এই করিডোর। পুরনো প্রাসাদের নানান করিডোরের মধ্যে এটা বিশেষ এক জায়গায় গিয়ে থেমেছে। দীর্ঘ করিডোরের দু’দিকে পাথুরে দেয়াল। ছাতে জ্বলছে ফ্লুরেসেন্ট টিউব। পাথুরে মেঝে এবড়োখেবড়ো। করিডোরের শেষে বড় একটা হলঘর। ভেতরে মস্ত এক টেবিলের দু’দিকে বারোটা চেয়ার। টেবিলের মাথায় রাজসিংহাসন। প্রতিটি চেয়ারের সামনে টেবিলে পানির জগ ও গ্লাস।
বারোটা চেয়ারে বসে নীরবে অপেক্ষা করছে বারোজন ব্যবসায়ী। তাদের একজন ডাক্তার ব্যানওঅর্ট। একগ্লাস পানি গিলে শুকনো গলা ভিজিয়ে নিল সে।
হাতঘড়ি দেখে নিয়ে কপালের ঘাম মুছল বিলিয়নেয়ার ব্যবসায়ী অ্যান্টোনি যিনসার। পকেট থেকে নিয়ে অ্যামার ইনহেলার ব্যবহার করল পর পর দু’বার।
বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকে দেখল আরেক বিলিয়নেয়ার জোহান বেলমার। ‘হাঁপানি বাড়ল?’
মৃদু মাথা দোলাল অ্যান্টোনি যিনসার।
বন্ধুত্বের কিছু নেই কারও ভেতর। স্রেফ ব্যবসার কারণে তারা আষ্টেপৃষ্ঠে সম্পর্কিত। আজকের কাজ শেষ হলে হয়তো কিছু দিন কোনও যোগাযোগই হবে না। তারপর ব্যবসার জন্যেই আবারও মিলিত হবে এখানে। আগে বা পরে, নতুন সিগনাল দেবেন কাউণ্ট কোবরা। সবসময় তা-ই করেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার সাধ্য না থাকলেও ভাল করেই সবাই জানে, সম্মিলিত ব্যবসার মঙ্গলের জন্যেই নেয়া হবে জরুরি সিদ্ধান্ত। ইউরোপের জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক নেতা তাদের ক্ষতি করছে বলেই ডাকা হয়েছে আজকের মিটিং। রাতের পর রাত তারা ঘুমাতে পারেনি ওই লোকের ক্ষতিকর কার্যকলাপের কারণে। কাজেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এবার চিরকালের জন্যে বিদায় করা হবে ওই লোকটাকে।
করিডোরে পায়ের আওয়াজ শুনে কেউ কেউ ঘুরে তাকাল ওদিকে। দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকল লুকা ব্রুনার। তার পেছনে হাঁটছে মাইক বুচার।
‘আমার মনে হয় আমরা তৈরি,’ নরম সুরে বলল কাউন্ট কোবরা। ঠোঁটের কোণে ঝুলছে এক চিলতে অলস হাসি।