1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৩২

বত্রিশ

বেলজিয়াম।

ব্রাসেল্স্।

সারাসকাল রাজনৈতিক নথি দেখে একের পর এক চিঠিতে সই করে ক্লান্তি লাগছে রাজনীতিক এডি অ্যামনের। এখনও স্টাডিরুমের টেবিলে জমে আছে ঝাড়া দেড়ফুট উঁচু কাগজের স্তূপ। নিজের বাড়িতে বসে কাজ করতে ভালবাসেন তিনি। আর্কিটেক্ট জীবনে নিজেই তৈরি করেছেন এই বাড়ির নকশা।

অ্যামনের বাবা বিলিয়নেয়ার। তবে তাঁর মত সারাজীবন টাকার পেছনে ছুটবেন না স্থির করেছিলেন এডি। তাঁদের পারিবারিক বাড়িটা প্রাসাদের মত প্রকাণ্ড হলেও, ওটার চেয়ে ঢের আধুনিক এই বাড়িটাকে অনেক আপন মনে হয় তাঁর। ছোটবেলা থেকে বিলাসের মাঝে বড় হলেও তাতে অভ্যস্ত হননি কখনও। বাবার টাকা নিজের বলে ধরে নেননি।

চুপচাপ কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে টেবিলে রাখা ফ্রেমের ছবিগুলো দেখছেন তিনি। এসব ছবি তাঁর বাবা-মা, স্ত্রী ডায়ানা, তাঁদের ছেলে কার্ক ও মেয়ে ডলির। ছেলেটা এবার দশে পড়ল। ডলির এখন চার বছর। দু’জনই ওরা খুব মিষ্টি করে হাসে। টেবিলে আরও রয়েছে স্টিভের ছবি। তিনি এডির খুব প্রিয় একজন মানুষ!

স্টিভের কথা মনে পড়তেই হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল রাজনীতিকের। কলম নামিয়ে রেখে তুলে নিলেন প্রৌঢ় মানুষটার ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবি। স্টিভ ছিলেন এডির কাছে দরবেশের মত। হাতে ধরে বহু কিছু শিখিয়েছেন তিনি ওকে। চোখে সবসময় ছিল স্নেহের চাহনি। স্টিভ যে আর বেঁচে নেই, সেটা ভাবতে গেলে কষ্ট বোধ করেন এড়ি। আসলে কী করে কী ঘটে গেল, আজও ঠিক বুঝতে পারেন না তিনি।

স্টিভ কাসলার ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত এক সুইস-ফ্রেঞ্চ স্টেট্সম্যান। ছোটবেলা থেকে তাঁকে চেনেন এডি। মানুষটা ছিলেন আপন চাচার মত। রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হলেও রাজনীতির দুনিয়াকে প্রতি পদে চিনিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এডি বড় হওয়ায় বিভেদ বাড়ল দু’জনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। সমাজতন্ত্র নিয়ে এডির ভাবনার জন্যে বেশ বিব্রত হতেন স্টিভ কাসলার। রাতের পর রাত এসব নিয়ে আলাপ করতেন। সেসময়ে দু’জনের বুদ্ধিবৃত্তির যে কুস্তি চলত, তাতে আরও ধারাল হয়েছে এডির রাজনৈতিক চেতনা। স্টিভ কাসলার তাঁর জীবনে না এলে সত্য-মিথ্যা বহু কিছু বুঝতেই পারতেন না তিনি। ফলে কোনদিন এত জনপ্রিয়তাও পেতেন না। ছাতার মত তাঁর মাথার ওপর ছিলেন বৃদ্ধ রাজনীতিক।

তিনি বেঁচে নেই, ভাবতে গেলে গলা শুকিয়ে আসে এডি অ্যামনের। নতুন করে মনে পড়ে সেই রাতের কথা। স্টিভ সেরাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে অস্তিত্ব থাকত না তাঁর।

গত বছরের সেই রাতটার কথা কখনও ভুলবেন না এডি। তিনি ছিলেন কটিনার সেই শ্যালেতে। ভাবতে গেলে তাঁর মনে হয়, এই তো গতকালের ঘটনা।

ব্যস্ত রাজনৈতিক জীবনে ব্যক্তিগত সময় নেই বললেই চলে। তাই একইসঙ্গে পুরো ছয়দিনের ছুটি পেয়ে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে কটিনার সেই গ্রামে হাজির হন এডি। খুব খুশি হয়েছিল বাচ্চারা। চমৎকার সময় কাটাচ্ছিলেন এডি ও ডায়ানা। উনিশ শতকের শ্যালেটা ছিল রূপকথার প্রাসাদের মত। চারপাশে নীরবতা, পাহাড় ও জঙ্গল। বুক ভরে বাতাস নিলে খুশি হয়ে উঠত মনটা।

তবে দ্বিতীয় দিন এল সেই টেলিফোন কল।

এডির ব্যক্তিগত সেল ফোনে কল করে খুব কম মানুষ। ডায়ানা, সেক্রেটারি, হাতে গোনা পরিবারের সদস্য বা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা। সেরাতে কল করেছিলেন স্টিভ কাসলার।

গত ক’মাস এডির সঙ্গে কথা হয়নি তাঁর। প্রৌঢ় রাজনীতিকের গলার আওয়াজ ছিল কেমন যেন অস্বাভাবিক। জড়িয়ে যাচ্ছিল কথা। বোধহয় বেশি ড্রিঙ্ক করছেন। আরও কিছু ছিল আড়ষ্ট কণ্ঠে। কয়েক মুহূর্ত পর এডির মনে হলো, তাঁর প্রিয় দরবেশের গলা থেকে ঝরছে নিখাদ আতঙ্ক। অথচ আগে কখনও তাঁকে ঘাবড়ে যেতে দেখেননি তিনি। কী ঘটেছে জিজ্ঞেস করবেন, তার আগেই বলে উঠলেন কাসলার, ‘এডি, তুমি এখন কোথায়?’

‘ছুটিতে। আপনাকে মেসেজ পাঠিয়েছি। ভুলে গেছেন?’

‘না, ভুলিনি। কিন্তু তুমি এখন ঠিক কোথায়? এই মুহুর্তে?

ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল এডির। দ্বিধা কাটিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি শ্যালেতে আছি। একটু পর ডিনারে বসব। বলুন তো, আসলে কী হয়েছে, আঙ্কেল?’

দ্বিধায় পড়লেন কাসলার। ফোনের লাইনে শোনা গেল হাঁফানির আওয়াজ। তারপর বেসুরো কন্ঠে বললেন তিনি, ‘ওখান থেকে বেরিয়ে যাও!’

‘বুঝলাম না…

‘ওই শ্যালে থেকে বেরিয়ে যাও! সবাইকে নিয়ে! দৌড়ে বেরিয়ে যাও! এক সেকেণ্ডও দেরি কোরো না!’

এরপর কেটে গেল লাইন।

অবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকালেন এডি। খুঁজতে গেলেন পরিবারের অন্যদেরকে। পাশের ঘরে ছিলেন ডায়ানা। গুছিয়ে এনেছেন ডিনারের টেবিল।

কী যেন শুনে খিলখিল করে হাসছিল ডলি।

ক’মুহূর্ত দ্বিধা করলেন এডি। পাগলাটে লাগছিল স্টিভ কাসলারের কথাগুলো। তবে প্রিয় মানুষটার নির্দেশ অমান্য করতে পারেননি। প্রায় দৌড়ে গিয়ে কোলে নিলেন ডলিকে। বামহাতে খামচে ধরলেন স্ত্রীর কাঁধ। ধমকে উঠলেন ছেলে কার্ককে। ‘এক্ষুণি এসো! আমরা বেরিয়ে যাব এই শ্যালে থেকে! এখনই!’

অবাক চোখে স্বামীকে দেখলেন ডায়ানা। তবে তিনি কিছু বলার আগেই আবারও তাড়া দিলেন এডি: ‘চলো, ছুটে বেরোতে হবে এখান থেকে!’

ছুটতে ছুটতে শ্যালে ত্যাগ করে তাঁরা পৌঁছে গেলেন বিশাল বাগানে। ঝুপঝুপ করে ঝরছে তুষার। বাগানের শেষে পাইনের জঙ্গল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ওখানে গিয়ে থামলেন এডি। ঘুরে ভীত দৃষ্টিতে তাকালেন শ্যালের দিকে। তাঁর মুখ দেখে বাচ্চারা বুঝে গেল, মজা করছে না বাবা। এদিকে রেগে গেছেন ডায়ানা। বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী শুরু করলে, এডি? এই শীতের ভেতর এসব কী পাগলামি হচ্ছে!’

বরফ-ঠাণ্ডা পরিবেশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন এডি শক্ত হাতে ধরেছেন সেল ফোন। একবার ভাবলেন, মানসিক সমস্যা হয়েছে আঙ্কেল স্টিভের? নাকি প্র্যাকটিকাল কোনও কৌতুক করেছেন? তবে তিনি তো সে ধরনের মানুষ নন!

‘আমি শীতে জমে যাচ্ছি,’ নালিশ করলেন ডায়ানা। ‘বাচ্চাদেরও ভাল লাগছে না এত ঠাণ্ডায় …’

স্ত্রীর পায়ের মোকাসিন ভিজে গেছে, দেখলেন এডি। গোড়ালিতে জমছে তুষারের কণা।

‘আসলে কী হয়েছে, এডি?’ জানতে চাইলেন ডায়ানা।

‘জানি না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অ্যামন। ‘হয়তো ভুলই করেছি। বোকামি হয়ে গেছে। ঠিক আছে, চলো ফিরে যাই।’

‘আব্বু পাগল হয়ে গেছে!’ পরিচিত গানের সুরে বলল তাঁর ছেলে কার্ক। ‘পাগল আমার আব্বু, পাগল আব্বু…’

ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল পিচ্চি ডলি। ওকে কোলে তুলে নিলেন ডায়ানা। কড়া চোখে দেখলেন স্বামীকে।

স্ত্রীর হাত ধরে আবারও শ্যালের দিকে চললেন এডি। ভীষণ লজ্জা পেয়েছেন। তবে দশফুট যেতে না যেতেই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শকওয়েভ ধাক্কা দিয়ে পিছিয়ে দিল তাঁদের। চোখের সামনে দেখলেন আকাশে উঠেছে শ্যালের বিশাল ছাত। তলা থেকে ভেসে উঠল আগুনের মস্ত কমলা গোলক। ধসে পড়ছে শ্যালের চারদেয়াল। আকাশ থেকে ঝরঝর করে নামল পোড়া ইঁট, কাঁচ ও ভাঙা কাঠের টুকরো। দু’হাতে স্ত্রী ও বাচ্চাদেরকে জড়িয়ে ধরলেন এডি। দ্বিতীয় বিস্ফোরণে ধসে গেল অবশিষ্ট দেয়াল। শুধু যে বাড়িটা বিস্ফোরিত হয়েছে তা নয়, দু’পাশের ছোট দালান ও গাড়ির গ্যারাজগুলোও শুয়ে পড়েছে মাটিতে। এখন ওদিকে আছে শুধু ঘন কালো ধোঁয়া আর লেলিহান আগুনের লকলকে শিখা।

ভীষণ ভয়ে পাথর হলেন ডায়ানা। আতঙ্কে কাঁদছে বাচ্চারা। পরিবার নিয়ে বাগানের কুটিরে আশ্রয় নিলেন এডি। দেরি হলো না ইমার্জেন্সি সার্ভিসে কল দিতে। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো সত্যিকারের ব্যস্ত সময়। পুলিশ, সিকিউরিটির লোক, ফায়ার ব্রিগেড, টেলিভিশন ও সংবাদ মাধ্যম পাগল করে দিল পাহাড়ি উপত্যকার মানুষগুলোকে। প্রাইভেট বিমানে করে সরিয়ে নেয়া হলো এডি অ্যামনের পরিবারকে।

স্টিভ কাসলারের সেই টেলিফোন কলের কথা কাউকে বলেননি এডি। এরপর পেরোল কয়েকটা দিন। ভেবেছিলেন তদন্তে বেরিয়ে আসবে বহু কিছুই। তবে কর্তৃপক্ষ জানাল, বড় ধরনের গ্যাস লিকেজ ছিল শ্যালেতে। কোনও নাশকতার চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

বারবার কাসলারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন এডি। মনে মেলা প্রশ্ন। প্রথম কথা, স্টিভ কীভাবে জানলেন ওই বিস্ফোরণ ঘটবে?

কিন্তু কাসলার উধাও হয়েছেন। এক এক করে পেরিয়ে গেল কয়েকটা দিন। ফোন ধরলেন না রাজনীতিক। একাধিক মেসেজ পাঠালেন এডি। তবে সেগুলোর জবাব দিলেন না স্টিভ। শেষপর্যন্ত ধৈর্য রাখতে না পেরে নিজেই ট্রেনে চেপে জেনেভায় যাবেন ভাবলেন এডি। ওখানেই স্টিভ কাসলারের বাড়ি। কিন্তু সেদিনই এল দুঃসংবাদ।

খালি এক সুড়ঙ্গে ঘণ্টায় এক শ’ ত্রিশ কিলোমিটার বেগে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় স্টিভের পোর্শে। গাড়িটা চুরমার হয়ে আগুন ধরে গেলে কয়েক ঘণ্টার জন্যে বন্ধ ছিল সেই টানেল। স্টিভের লাশটাও বাজেভাবে পুড়ে গেছে। দুর্ঘটনার কোনও সাক্ষী ছিল না। তবে প্রথমে সেখানে পৌঁছে রঙিন ছবি তুলেছে পাপারাজ্জিরা। পরদিন সকালে সেসব ছবি সহ প্রতিবেদন এল দৈনিক পত্রিকায়।

কাসলার পরিবার থেকে জানানো হয়েছে: গত ক’সপ্তাহ প্রচণ্ড মানসিক চাপে ছিলেন স্টিভ। নিজেকে গুটিয়ে নেন। কাছের মানুষগুলোর ধারণা, গোপন কোনও কারণে ভীষণ ভয়ে ছিলেন তিনি। আর সে কারণে তাঁকে অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট ওষুধ দেন ডাক্তার। তবে ওষুধ খাওয়ার সময় প্রচুর ব্র্যাণ্ডি গিলতেন কাসলার।

তাঁর দেহাবশিষ্ট বলতে যৎসামান্য যা ছিল, মেডিকেল পরীক্ষার জন্যে তা যথেষ্ট নয়। রিপোর্টে করোনার উল্লেখ করেছেন, মদ ও মেডিকেল ড্রাগসের প্রভাবে দুর্ঘটনায় মারা যান স্টিভ কাসলার।

এরপর নাম করা এক প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি থেকে কয়েকজন গোয়েন্দাকে ভাড়া করেন এডি অ্যামন। তারা তদন্ত করেছে পুরো ছয় মাস। এডি এটাও ঘোষণা দেন, স্টিভ কাসলারের মৃত্যুর বিষয়ে সন্দেহজনক কোনও তথ্য দিলে সে-ব্যক্তিকে পুরো এক মিলিয়ন ইউরো পুরস্কার দেবেন তিনি। কিন্তু জরুরি কিছুই জানা যায়নি কোথাও।

আসলে গাড়ি-দুর্ঘটনা বা গ্যাস বিস্ফোরণে মানুষের মৃত্যু নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *