কলকাতার হুজুগ ও হল্লা

কলকাতার হুজুগ ও হল্লা 

এক সময় মশা-মাছির উপদ্রবে উত্ত্যক্ত হয়ে ঈশ্বর গুপ্ত বলেছিলেন এই নিয়েই সুখে আছি কলকাতায়। আজ পরিস্থিতিটা পাল্টে গিয়েছে। মশা-মাছি তো আছেই কিন্তু তারা আজ পরাস্ত হয়েছে কলকাতার হুজুগ হামলা ও হল্লার কাছে। হুজুগ হামলা হল্লা আজ কলকাতাকে গ্রাস করেছে। হুজুগ, হামলা, হল্লাই আজ নাগরিক জীবনের ছন্দ হয়েছে। কলকাতার লোকের এগুলো চাই-ই। এগুলো না হলে কলকাতার লোকের পেটে ভাত হজম হয় না। খবরের কাগজের লোকরাও পায় না ইন্ধন যোগাতে, লোকের পেটের ভাত হজম করিয়ে দিতে। 

‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’ ও সঙ্গে সঙ্গে মিছিল ও তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মাইলব্যাপী গাড়ির লাইন—এসব এখন কলকাতায় মান্ধাতার আমলের জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন কলকাতায় চাই হুজুগ ও হামলা। হুজুগের অন্ত নেই। খেলার হুজুগ, বই মেলার হুজুগ, সার্বজনীন পুজোর হুজুগ থেকে আরম্ভ করে ফুচকাওয়ালাদের ওপর হামলার হুজুগ। এসব হুজুগ নেয়েই তো কলকাতার লোক বেঁচে আছে। মোট কথা একটা না একটা হুজুগ কলকাতায় চাই-ই। একবার সাম্প্রতিক কালের হুজুগগুলো স্মরণ করুণ যা নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা অনেক শ্যাডো ফাইটিং’ করলেন। তাতে গঙ্গার জল অনেক ঘোলা হয়ে গেল। হুজুগ উঠল ‘সরষের তেল আর পাওয়া যাচ্ছে না।’ সুযোগবাদীরা রাতারাতি তেলের দাম কিলো প্রতি দশ টাকা বাড়িয়ে দিল। বিচক্ষণতার সঙ্গে সরকার বললেন না, আগে যা দাম ছিল তার চেয়ে পাঁচ টাকা বেশি দামই ‘ন্যায্য’ দাম হবে। কিন্তু কে কার কথা শোনে? দোকানী সেই উঁচু দামেই তেল বেচতে লাগল। তার নীতি হচ্ছে—‘ফেল কড়ি, নাও তেল’। 

তারপর কাগজে বেরোল ভেলপুরীতে বিষ। অনেক ভেলপুরীওয়ালাকে ধরে নিয়ে গেল। ধরপাকড়টা বেশ সমারোহের সঙ্গেই হল। তারপর সব নীরব হয়ে গেল। আদালতের খবরে দেখলাম না যে তাদের আদালতে হাজির করা হয়েছে। আর হাসপাতালের খবরেও দেখলাম না যে ভেলপুরীখানেবালারা হাসপাতালে পড়ে রয়েছে। এ যেন একজন নামজাদা জাদুকরের ‘ভ্যানিশিং ট্রিক্’। অন্তরালে কি রহস্য ঘটে গেল, কেউ জানল না। 

সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক জীবন আবার সরব হয়ে উঠল। ‘পাকড়াও,পাকড়াও’, শালা ফুচকাওয়ালাদের পাকড়াও’। পুলিশ চোর ডাকাত ধরতে পারে না। মেয়েরা হারিয়ে গেলে তাদের খুঁজে বের করতে পারে না (যদিও বড়াই করেছিল যে দেব কে একমাসের মধ্যে খুঁজে বের করবে)। কিন্তু নিমেষের মধ্যে শহরের উপান্তে ফুচকাওয়ালাদের কারখানার সন্ধান বের করে ফেলল এবং সেখানে হামলা করল। সঙ্গে সঙ্গে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’-ওয়ালারা ছুটে এল তাদের ‘স্বার্থ’ রক্ষার জন্য। একটা সংগঠন তৈরি হল। তারা আবার ‘ক্লাস’ ডাকলেন প্রশিক্ষণ দেবার জন্য কিভাবে ফুচকা তৈরি করতে হয়, তা শেখাবার জন্য। শিক্ষক ও ছাত্র দু পক্ষই গরহাজির ওই ক্লাসে। ফুচকাওয়ালারা জিজ্ঞাসা করল, যারা প্রশিক্ষণ দেবে তাদের ক’পুরুষের অভিজ্ঞতা আছে ফুচকা তৈরির। বলল, ‘আমাদের বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে আমরা ফুচকা তৈরি করে আসছি, আমরা আবার আনাড়িদের কাছ থেকে কি শিক্ষা নেব?’ কিন্তু মজার কথা, সংবাদপত্রে একটাও সংবাদ বেরোল না, কেউ ফুচকা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে বা অমুক হাসপাতালে শুয়ে আছে। বরং সংবাদপত্রে উল্টোটাই বেরোল। রাজ্যের একজন বিশিষ্ট মন্ত্রী বিবৃতি দিলেন, তিনি তো হামেশাই ফুচকা খান, তবে প্রকাশ্যে নয়, অপরের অগোচরে, তাঁর চেহারা দেখলেতো মনে হয় না যে ফুচকা তাঁর শরীরের কোন ক্ষতি করেছে। কিন্তু যাঁরা ফুচকা খাওয়া থেকে বঞ্চিত এবং সেই কারণে পস্তাচ্ছেন, তাঁরা মন্ত্ৰী মহাশয়কে পরিহাস করে উঠলেন। আমরাও তো ছেলেবেলা থেকে আলুকাবলির সঙ্গে ফুচকা খেয়ে এসেছি, কিন্তু তার জন্য কোনদিন তো অসুস্থ হয়ে পড়িনি। 

সে যাই হোক, ফুচকাওয়ালাদের ওপর হামলার নীট ফল যা দেখলাম তা হচ্ছে, এরফলে এদের স্বার্থসংরক্ষণের জন্য একটা সংস্থা ও তার অনুগামী একদল ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ আওয়াজ তোলবার লোক। হয়ত বা এর মধ্যেই তাঁদের নাম ভোটার তালিকাতেও উঠে গেছে। ঠিক এরকমভাবেই রিকশাওয়ালাদের ওপর হামলা চালিয়ে রিকশাওয়ালাদের এক সংস্থা ও দল তৈরি হয়েছে। 

‘হল্লা’ তো আজকের নূতন জিনিস নয়। বহু বছর ধরে দেখে এসেছি ফুটপাতের ওপর ফিরিওয়ালাদের ধরবার জন্য মাসের শেষদিকে একটা করে ‘হল্লা’ বেরোত এবং ফিরিওয়ালাদের ধরে লরি বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হতো। একবার ওদের একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তোমার কত টাকা ফাইন হল?’ উত্তরে বলেছিল। ‘ফাইন আবার কিসের বাবু? মাসের শেষের দিকে ওদের টানাটানি ঘটলেই কিছু প্রাপ্তিযোগের জন্য ওরা এরকম হল্লা করে। আমরা ওদের টানাটানির সমাধান করে দিই।’ 

হুজুগের কথাতেই আবার ফিরে আসছি। ভাবছি ফুচকার পর এবার কার পালা? মনে পড়ে গেল আমার ছেলেবেলার একটা হুজুজের কথা। ঘটনাটা আমি আমার ‘শতাব্দীর প্রতিধ্বনিতে বিবৃত করেছি। সেখান থেকেই ওটা এখানে উদ্ধৃত করছি। ‘একবার গুজব রটল যে পানে একরকম বিষাক্ত পোকা ধরেছে, যার ফলে পান খেলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। লোক আতঙ্কিত হয়ে পান খাওয়া ছেড়ে দিল। তবে যারা গুণ্ডি দোক্তা ইত্যাদি খেত এবং সেই কারণে যাদের পান না খেলে চলত না, তারা জলে কেরোসিন তেল মিশিয়ে সেই জলে পানগুলো ধুয়ে নিয়ে তারপর খেত। তাদের ধারণা ছিল বিষে বিষক্ষয় হবে। সত্যি, পানে পোকা ধরেছিল কিনা জানি না। মনে হয় পানব্যবসায়ীদের জব্দ করবার জন্য কেউ এই গুজব রটিয়েছিল।’ 

আজকের শেষ হুজুগ। কতকগুলো পার্কে গাছ রোপণ করে কলকাতাকে আবার (এক সময় কলকাতা সবুজই ছিল) সবুজ করা হবে। উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় বাংলা বচন—‘বিবি যখন মানুষ হবে, সাহেব তখন গোরে যাবে।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *