1 of 2

কলকাতার শেয়ার বাজার

কলকাতার শেয়ার বাজার 

১৯৩৬ সালে সবেমাত্র স্টক একসচেঞ্জের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদে নিযুক্ত হয়েছি। পথে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বন্ধু বললেন, ‘কী, শেষকালে ভবের তরী এমন এক ঘাটে ভেড়ালেন, যেখানে ধনস্থানে শনিলাভ ঘটে।’ বন্ধু যে সত্যের অপলাপ করেছিলেন, তা নয়। তবে, শেয়ার বাজারের সংস্পর্শে এলে, লোকে যেমন শনির কোপে পড়ে, তেমনই আবার একাদশ বৃহস্পতির যোগও ঘটে। শেয়ার বাজারে লোকে যেমন সর্বস্বান্ত হয়, তেমনই আবার রাতারাতি বড়লোকও হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অনেক বাঙালীই শেয়ার বাজার থেকে পয়সা কামিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি হচ্ছেন রাজা রামমোহন রায় ও রানী রাসমণি। 

তার মানে, শেয়ার বাজার হচ্ছে শাঁখের করাত। অদৃষ্টের চাকা এখানে দুদিকেই ঘোরে, শেয়ার বাজারে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা আমার চোখের সামনেই ঘটল। আমি ১৯৩৬ সালের অকটোবর মাসে যেদিন স্টক একসচেঞ্জের চাকরিতে ঢুকলাম, সেদিন ইনডিয়ান আয়রন শেয়ারের দাম ছিল ছ টাকা বার আনা। তখন ইনডিয়ান আয়রনের প্রতি লোকের দারুণ আকর্ষণ। সকলেই ইনডিয়ান আয়রন কিনছে। দামও ধীরে ধীরে উঠছে। বড়দিনের ছুটির আগে দাম উঠে দাঁড়াল আঠার টাকা আট আনায়। তার মানে, তিন মাসে দাম বার টাকা এগিয়ে গেল। 

কিন্তু পরের তিন মাসে যা ঘটল তা অভূতপূর্ব। প্রত্যহই ইনডিয়ান আয়রন-এর দাম লাফাতে লাগল। দুনিয়ার সকলের কাছেই সেদিন ইনডিয়ান আয়রন স্বর্ণতরু বলে মনে হয়েছিল— যা মাত্র নাড়া দিলেই টাকা ঝরে পড়বে। সেদিন দেখেছি, পথচারী অন্য কাজে ব্যবসা-পাড়ায় এসে যাবার পথে দু-চারশ আয়রন কিনছে, আর ফেরবার পথে পাঁচ-সাতশ টাকা মুনাফা নিয়ে ঘরে যাচ্ছে। পানওয়ালা, বিড়িওয়ালা, ফেরিওয়ালা, কেউ সেদিন বাদ যায়নি। সকলেই ইনডিয়ান আয়রন কিনে রোজ দু-চারশ টাকা কামিয়েছে। 

১৯৩৭ সালের প্রথম তিন মাস এইভাবেই কাটল। সকলের কাছেই সেদিন ইনডিয়ান আয়রণ পরশমণি। তারপর এপ্রিল মাসের চার তারিখের কথা। বেলা সাড়ে বারোটার সময় আমার ঘরে একজন দালাল ঢুকলেন, কী একটা পরামর্শের জন্যে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘জী, আয়রনকা ভাও ক্যায়া?’ বললেন, ৭৯ টাকা ১২ আনা। সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ উৎসাহ ও উত্তেজনার সঙ্গে বললেন, ‘দেখিয়ে না, পনর দিনকা বীচমে আয়রনকা ভাও সৌ রূপিয়াসে জিয়াদা হো যায়েগা।’ এই কথা উনি বলবার পরমুহূর্তেই শুনতে পেলাম, বাজার থেকে উত্থিত হল এক আর্তনাদ। শব্দ শুনতেই দালালটি বাজারের দিকে ছুটলেন। আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ উত্তর এল, ‘নেপালের এক রানা ৮০,০০০ আয়রন বেচেছেন, আয়রনের দাম পড়ছে।’ পড়তে পড়তে কয়েক লহমার মধ্যেই আয়রন-এর দাম নেমে এল ৬০ টাকায়। যারা আয়রন কিনেছিল, তাদের প্রত্যেকেরই শেয়ার প্রতি বিশ টাকা করে লোকসান হল। সেদিনের কেনাবেচার ফলে, মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াল আঠার কোটি টাকা। অনেকেই সর্বস্বান্ত হল। সাধারণ লোক পালিয়ে গেল। সমস্ত লোকসানের বোঝাটা বাজারের দালালদের ঘাড়ে চাপল। কর্তৃপক্ষ লেনদেনের হিসাব চুকাবার জন্য বাজার দুদিনের জন্য বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু এই দুদিনের মধ্যেই বাজারের দালালরা ওই আঠার কোটি টাকার ঘাটতি এমন সুষ্ঠুভাবে মেটালেন যে, ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা এক প্ৰবন্ধ লিখে স্টক একসচেঞ্জকে অভিনন্দন জানালো। 

শেয়ার বাজার চিড়িয়াখানা নয়, কিন্তু চিড়িয়াখানার অনেক জন্তুজানোয়ারের নাম শেয়ার বাজারের দালালরা বহন করে। যেমন ‘বুল’ বা ষাঁড়, ‘বেয়ার’ বা ভল্লুক। এরা হচ্ছে যথাক্রমে ‘তেজীওয়ালা’ ও ‘মন্দীওয়ালা’। একই ঘটনা বা সংবাদকে অবলম্বন করে, কেউ ‘তেজী’ ধ্যান করে, আবার কেউ ‘মন্দী’ ধ্যান করে। এরই ফলে হয় তেজী-মন্দীর লড়াই। তেজীওয়ালাদের সঙ্গে মন্দীওয়ালাদের লড়াই অনেক সময় সত্যিকারের ষাঁড়ের লড়াইকেও ম্লান করে দেয়। কলকাতার শেয়ার বাজারে সবচেয়ে বড় তেজী-মন্দীর লড়াই ঘটেছিল। আজ থেকে ৭০ বছর আগে—দুই ভাইয়ের মধ্যে। এঁরা হচ্ছেন কলকাতার মারবাড়ী সমাজের বিখ্যাত ‘নাথানী’ পরিবারের বলদেওদাস ও রামেশ্বরলাল। সেদিন বাজারে দাঁড়িয়ে এক ভাই ক্রমাগত হাওড়া জুট মিলের শেয়ার বেচে গেলেন, আর আরেক ভাই তা কিনে গেলেন। দিনের শেষে দেখা গেল এক ভাইয়ের কাছে অপর ভাইয়ের লোকসান দাঁড়িয়েছে ৯৪ লক্ষ টাকা। এক ভাই যখন অপর ভাইকে এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের ওপর ৯৪ লক্ষ টাকার চেক দিল, তখন ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের তো চক্ষু ছানাবড়া। তিনি টেলিফোন করে জেনে নিলেন চেকখানা ঠিক কিনা। 

নাথানীরা ‘দুধওয়ালা’ নামে পরিচিত। এঁরা শেয়ার বাজার থেকে অনেক পয়সা কামিয়েছিলেন। টাকার সদ্ব্যয়ও করে গেছেন। ভারতের নানা স্থানে যে সব ‘দুধওয়ালার ধরমশালা’ আছে, সেগুলো তাঁদেরই অবদান। কিন্তু উত্তরকালে লক্ষ্মী তাঁদের চঞ্চলা হলেন। ধনাঢ্যতা তাঁদের ম্লান হয়ে গেল। 

শেয়ার বাজারের এককালের অনেক আমীরই, পরবর্তীকালে ফকির হয়েছেন। এ রকম একজন দালাল, আমার বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন। নাম ভাদরমল ঝুনঝুনওয়ালা। ভাদরমলের পিতামহ ছিলেন সিউদতরায়, আর পিতা প্রেমসুক। বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকে কলকাতার মারবাড়ী সমাজে এঁদের স্থান ছিল সবার শীর্ষে। 

এঁদের প্রতিপত্তি ও সমৃদ্ধি একটা ঘটনা থেকে বোঝা যাবে। ১৯০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বেলা তিনটের সময় ভাদরমলের বাবা ঘোড়ার গাড়ি (তখনও কলকাতায় মোটর গাড়ির চলন হয়নি) করে নিজ আপিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। মাত্র দু-একদিন হল হ্যারিসন রোডে ট্রামের প্রবর্তন হয়েছে। প্রেমসুকবাবুর গাড়ি ক্লাইভ স্ট্রীট অতিক্রম করে, যেমন হ্যারিসন রোডে এসে পড়েছে, হঠাৎ ট্রামের টম্ টম্ শব্দ শুনে ঘোড়াটা গেল বিগড়ে। ট্রামের সঙ্গে লাগল সংঘর্ষ। ঘোড়া জোতবার ব্যোমটা গাড়ির দরজার ভিতরে গিয়ে আঘাত হানল প্রেমসুকবাবুর বুকে। সঙ্গে সঙ্গেই প্রেমসুকবাবুর মৃত্যু হল। কলকাতার মারবাড়ী সমাজ শোকবিক্ষুব্ধ চিত্তে ছুটে এল ঘটনাস্থলে। নিষ্ঠাবান মারবাড়ী প্রধানরা বিধান দিলেন, প্রেমসুকবাবুর ময়না-তদন্ত হতে পারে না, বা মড়া বাসিও থাকতে পারে না। অবিলম্বেই সৎকার করা দরকার। সেদিন ঘোড়দৌড়ের মাঠে ‘ভাইসরয় কাপ’ বাজী খেলার দিন। বড়লাট লর্ড কার্জন স্বয়ং ঘোড়দৌড়ের মাঠে। সকলে ছুটল ঘোড়দৌড়ের মাঠের দিকে, সরাসরি লর্ড কার্জনের কাছে দরবার করবার জন্য। লর্ড কার্জন আদেশ দিন, ‘অবিলম্বে নিমতলার ঘাটে করোনারস্ কোর্ট বসুক ও প্রেমসুকের লাশ খালাস করে দিক।’ নিমতলার ঘাটে ‘করোনারস্ কোর্ট বসা, কলকাতার ইতিহাসে সেই প্রথম ও শেষ। এ থেকেই ভাদরমলদের প্রতিপত্তির আভাস পাওয়া যাবে। 

প্রথম মহাযুদ্ধের সময় যখন শেয়ার বাজারে মহাধুম পড়ে গিয়েছিল, তখন শেয়ার বাজার থেকে অনেকেই মোটা টাকা কামিয়েছিলেন। আজ সেনট্রাল অ্যাভেনিউর ধু’ধারে যে সব প্রাসাদোপম সৌধ শহরের শোভাবর্ধন করছে, তার প্রায় সবই প্রথম মহাযুদ্ধের সময় শেয়ার-বাজার থেকে অর্জিত অর্থে তৈরি। 

সে সময় ভাদরমলও অনেক পয়সা কামিয়েছিলেন। কিন্তু ভাদরমলের ঘাড়ে চেপেছিল কতকগুলি বদ নেশা। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া কেনা। এক সময় ঘোড়দৌড়ের মাঠে ভাদরমলের সতেরোটা ঘোড়া দৌড়াত। মেয়েছেলের শখও তাঁর বিলক্ষণ ছিল। দেশীয় রাজপরিবারের এক রাজকুমারীকে ভাদরমল রক্ষিতা হিসাবে রেখেছিলেন বলে শুনেছি। এসব বৈভব শেয়ার বাজার থেকে অর্জিত অর্থের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সামনে বিশ- পনেরো বছরের মধ্যে ভাদরমল একেবারে কাহিল হয়ে গেল। বাজারে যা কিছু কেনা-বেচা করে, সবেতেই তার লোকসান। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের চোট আর ভাদরমল সামলাতে পারল না। একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেল। এককালের বাদশাহ ভাদরমল আশ্রয় নিল দৰ্মাহাটা স্ট্রীটে প্রকাশ্য রাজপথের সামনে এক বাড়ির রোয়াকে। ওই রোয়াকের ওপরেই ভাদরম একদিন তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। 

সমসাময়িককালে ভাদরমলের ঠিক বিপরীতটা ঘটেছে বাংগুর পরিবারের। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এক সুদর্শন তরুণ রিক্তহস্তে পাড়ি মেরেছিল সুদূর রাজস্থান থেকে কলকাতা শহরে—ভাগ্যান্বেষণে। সঙ্গে ছিল একটা লোটা ও একখানা কম্বল। আর ছিল তার অসাধারণ আত্মবিশ্বাস ও বৃহস্পতির আশীর্বাদ। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে নিমতলা ঘাটের সিঁড়ির ওপরই দু’তিন রাত কাটাল। নিমতলা ঘাটে তখন প্রত্যহ সকালে স্নান করতে আসতেন, তখনকার দিনের কলকাতার শেয়ার বাজারের বড় দালাল নারায়ণ সোনী। ছেলেটি তাঁর নজরে পড়ল। জিজ্ঞাসাবাদে জানলেন, ছেলেটি তাঁদেরই মহেশ্বরী সম্প্রদায়ভুক্ত। ছেলেটিকে বাড়ি নিয়ে গেলেন এবং নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। যৌতুকরূপে দিলেন বেঙ্গল কোল কোম্পানির ৫০০ শেয়ার। ওই ৫০০ শেয়ারই ছেলেটির অদৃষ্ট ফিরিয়ে দিল। ওই শেয়ারগুলোর সঙ্গে বাঁধা ছিল লক্ষ্মীর অঞ্চল। ধুলোমুঠি ধরে, তো কড়িমাঠিতে পরিণত হয়। মাগনীরাম, রামকুমার, গোবিন্দলাল, নরসিংদাস এঁরা পরবর্তীকালে বাজারের প্রথম পর্যায়ের দালালের স্থান অধিকার করলেন। শেয়ার বাজারে তাঁদের দালালী ব্যবসা এখনও আছে। কিন্তু নরসিংদাসের আমলে বাংগুররা হয়েছেন ভারতের শিল্পসাম্রাজ্যের অন্যতম অধিপতি। 

শেয়ার বাজার থেকে যে শুধু মারবাড়ীরাই পয়সা করেছেন, তা নয়। অতীতকালে অনেক বাঙালীও পয়সা করেছেন। তাঁদের মধ্যে নাম করা যেতে পারে প্রসাদদাস বড়াল, তুলসীদাস রায়, শ্যামলাল লাহা, নন্দলাল রায়, গিরীন্দ্রমোহন পাইন, নবকৃষ্ণ দে, সুরেন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি। 

দীর্ঘ ৩৪ বছর (১৯৩৬-১৯৬৯) শেয়ার বাজারে কাটিয়েছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি কিসের জোরে, লোক সেখানে পয়সা উপার্জন করে—ঝুঁকি নেবার ক্ষমতা, না মনের বল, না অদৃষ্টের সুপ্রসন্নতা? অনেক সময় টাকা হাতের মধ্যে এসেও পালিয়ে যায়। আমার নিজের অভিজ্ঞতা তাই বলে। ১৯৪৫ সাল। একদিন বার্ড-হিলজারস কোম্পানীর চীফ অ্যাকাউনটেণ্ট আমার ঘরে এসেছেন। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন, সুর, এতদিন শেয়ার বাজারে রয়েছ, কিছু পয়সা কি কামিয়েছ?’ বললাম, “না, আমি কখনও শেয়ারের কেনাবেচা করি না।’ সাহেব বললেন, ‘রাতারাতি বড়লোক হতে চাও তো কিছু সাউথ করনপুরা কোল কোম্পানির শেয়ার কিনে ফেল। দাম শেয়ার প্রতি কমসে কম বিশ টাকা বাড়বে। যদি ৫০০০ শেয়ার কেন, তাহলে লাখ টাকা কামাতে পারবে।’ তখনকার দিনের লাখ টাকা আজকের দিনের কোটি টাকারও বেশি। লোভ সামলাতে পারলুম না। তার পরের দিনই ৩০ টাকা দরে ৫,০০০ সাউথ করনপুরা শেয়ার কিনে ফেললুম। কিন্তু আমি কেনবার পরই দাম পড়তে শুরু করল। ২৬ টাকায় এসে ঠেকল। তার মানে ৫,০০০ শেয়ারে ২০,০০০ টাকা লোকসান। এর বেশি টাকা আমার ব্যাঙ্কে ছিল না। সুতরাং ২৬ টাকাতেই শেয়ারগুলো বেচে দিলাম। কিন্তু আমি বেচবার পরের দিন থেকেই সাউথ করনপুরার দাম উঠতে লাগল। কয়েক দিনের মধ্যে দাম গিয়ে পৌঁছাল ৫৬ টাকায়। মনে মনে আক্ষেপ করতে লাগলাম, ‘আহা শেয়ারগুলো যদি একদিন আগে না বেচতাম, তাহলে আজ আমি লাখ টাকার মালিক হতাম।’ আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি, এ বিপর্যয় কেন ঘটেছিল—আমার মনের দুর্বলতা? না সঙ্গতির সংকীর্ণতা? না অদৃষ্টের অপ্রসন্নতা? 

এবার শেয়ার বাজারের ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু বলে এই নিবন্ধ শেষ করব। কলকাতায় শেয়ারের কেনাবেচার সূচনা হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে। পুরো একশ বছরের ওপর দালালরা কেনাবেচা করতেন একটা খোলা মাঠের ওপর এক নিমগাছের তলায়। ১৯০৪ সালে ওখানে যখন বাড়ি তৈরি হয়, তখন দালালরা আশ্রয় নিলেন প্রকাশ্য রাজপথে। দালালদের কোন সংগঠনও ছিল না, নিয়মকানুনও ছিল না। ফলে সওদার নিষ্পত্তি নিয়ে প্রায়ই তাঁদের মধ্যে বচসা হত। এরূপ বচসা একদিন এক বিরাট দাঙ্গায় পরিণত হল, মারবাড়ী ও চোবেদের মধ্যে। এই ঘটনার পরেই সাহেব দালালরা সংগঠন তৈরি করে নিয়মকানুন প্রণয়ন করতে চাইলেন। ফলে, ১৯০৮ সালে বর্তমান ‘ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন’ স্থাপিত হল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় অ্যাসোসিয়েশনের সমৃদ্ধি বাড়ল। তখন ষ্টক এক্সচেঞ্জের আস্তানা ছিল ২নং রয়েল এক্সচেঞ্জ প্লেসে। ১৯২৭ সালে স্টক এক্সচেঞ্জ নিজের বাড়ি তৈরি করবার জন্য ৭ নং লায়নস রেঞ্জের জমিটা কিনল। জমিটা ছিল বিডন ষ্ট্রীটের সাতুবাবু-লাটুবাবুদের। চারজন শরিক ছিলেন, তাঁদের অন্যতমা ছিলেন মতী চন্দ্ৰপ্ৰভা দেবী। শীঘ্রই সেই জমিতে বর্তমান পাঁচ-তলা বাড়ি তৈরি করা হয়। বাঙলার তদানীন্তন শাসনকর্তা স্যার স্টানলি জ্যাকসন ১৯২৮ সালের ২ জুলাই তারিখে নূতন ভবনের দ্বার উদঘাটন করেন। স্টক এক্সচেঞ্জ বিল্ডিং-এর মত এত মজবুত বাড়ী ব্যবসা-পাড়ায় খুব কমই আছে। এর দোতলার দেওয়ালই হচ্ছে চওড়ায় পাঁচ ফুট। এর উপরতলায় হচ্ছে দালালদের আপিস ও নীচের তলায় হচ্ছে বাজারের কেনাবেচার স্থান ও ষ্টক এক্সচেঞ্জের নিজ আপিস। সমস্ত বাড়িটা লণ্ডন ষ্টক এক্সচেঞ্জের অনুকরণে তৈরি। 

আগে শেয়ার বাজার স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ১৯৫৭ সালের ১০ অক্টোবর তারিখের পর থেকে, শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রণীত “সিকিউরিটিজ কনট্রাকটর রেগুলেশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী। এছাড়া আরও এক পরিবর্তন স্টক এক্সচেঞ্জের ইতিহাসে ঘটেছে। আমি যখন স্টক এক্সচেঞ্জে চাকরি নিয়েছিলাম, তখন বেশির ভাগ দালালই ইংরেজ ও বাঙালী। আজ তাঁদের স্থান অধিকার করেছে মারবাড়ী, গুজরাটী ও উত্তরপ্রদেশের লোকেরা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *