কলকাতার শিবমন্দির
কালীমন্দিরের মত কলকাতায় শিবমন্দিরেরও ছড়াছড়ি। মনে হয়, কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন শিবমন্দির হচ্ছে, হয় নন্দরাম সেনের আর তা নয় তো বনমালী সরকারের। বনমালী সরকারের শিব মন্দিরের হদিশ পাওয়া এখন কঠিন। একটি জীর্ণ ভাঙা মন্দিরকে বনমালী সরকারের মন্দির বলে অভিহিত করা হয়, কিন্তু সে অভীধা সন্দেহজনক বনমালী সরকার ছিলেন ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ডেপুটি ট্রেডার। আর নন্দরাম সেন ছিলেন কলকাতার প্রথম কালেকটর র্যালফ শেলডনের সহকারী। নন্দরাম সেন প্রতিষ্ঠিত রামেশ্বর শিবের মন্দির নন্দরাম সেন ষ্ট্রীটে অবস্থিত। মন্দিরটার প্রকৃত প্রতিষ্ঠা তারিখ একটা বিতর্কিত ব্যাপার। মন্দিরের মাথায় লেখা আছে ১০৬১ বঙ্গাব্দের ৩১ চৈত্র নন্দরাম সেন কর্তৃক মন্দির প্রতিষ্ঠিত। ইংরেজি হিসাবে এই তারিখ দাঁড়ায় ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাস। কিন্তু এই তারিখটাকে কেউ কেউ চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে নন্দরাম সেন র্যালফ্ শেলডন সাহেবের সহকারী হবার পরেই তিনি মন্দিরটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
কলকাতার শিব মন্দিরগুলির মধ্যে বৌবাজারে কেণ্ডারডাইন লেনে অবস্থিত কলকাতা দুর্গের দেওয়ান ত্রিলোকরাম পাকরাশী স্থাপিত মন্দিরগুলিও খুব প্রাচীন। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে নবরত্ন ও আর দুটি পঞ্চরত্ন মন্দির। কলকাতার নূতন দুর্গনির্মাণের সময় যে সকল মাল মশলা ব্যবহৃত হয়েছিল, এই মন্দিরগুলি সেই সেই মালমশলায় নির্মিত। সেজন্য মনে হয় এগুলি অষ্টাদশ শতাব্দীর ষাটের দশকে তৈরী হয়েছিল।
তবে কলকাতায় অন্যান্য যে সব শিব মন্দির দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলি বাঙলার চিরাচরিত আটচালা রীতিতে গঠিত মন্দির। এ সব মন্দিরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১২৬৪ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার জমিদার জয় মিত্র মশায় গঙ্গার ধারে বরানগরে যে কালী মন্দির তৈরী করেছিলেন তার সংলগ্ন ১২টি শিব মন্দির। আরও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হাটখোলার বণিক মদন দত্তের দুইপুত্র প্রতিষ্ঠিত দুর্গেশ্বর শিবমন্দির, দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মন্দিরের প্রাঙ্গণে অবস্থিত ১২টি শিবমন্দির, নন্দরাম সেন ষ্ট্রীটের রামেশ্বর শিবমন্দির (আগে দেখুন), ঠনঠনিয়ার শিবমন্দির, বাগমারীর শিবমন্দির, শ্যামবাজারে কৃষ্ণরাম বোস স্ট্রীটের শিবমন্দির, সীতারাম ঘোষ স্ট্রীট ও আমহার্ষ্ট স্ট্রীটের মোড়ের শিবমন্দির, বারাণসী ঘোষ স্ট্রীট ও চিত্তরঞ্জন অ্যাভেন্যুর মোড়ের শিবমন্দির, দক্ষিণ কলকাতায় বাওয়ালীর মণ্ডলদের নির্মিত শিবমন্দিরসমূহ, টালিগঞ্জ ষ্টুডিওর কাছে সীতারাম ঘোষ ও বাবুরাম ঘোষ নির্মিত এগারটি শিবমন্দির, আদিগঙ্গার ‘পশ্চিমে অবস্থিত সাবর্ণ চৌধুরীদের প্রতিষ্ঠিত মা করুণাময়ী কালীমন্দিরের সংলগ্ন ১২টি শিবমন্দির। এ ছাড়া বড়িশাতে সাবর্ণ চৌধুরীদের বসত বাড়ীর চৌহদ্দীর মধ্যে অনেক আটচালা শিবমন্দির ও পঞ্চরত্ন মন্দির আছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে আটচালা মন্দির যে মাত্র শিবমন্দিরই হয় তা নয়। আদিগঙ্গার পূর্ব পারে টালিগঞ্জ রোডে একটা বড় আটচালা রাধামোহনের মন্দির আছে। এটা ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দে বাওয়ালীর উদয়নারায়ণ মণ্ডল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে আরও বারোটা আটচালা শিবমন্দির আছে। এরই কিছু উত্তরে আরও কয়েকটি মন্দির আছে। এর মধ্যে দশটা আটচালা মন্দির, একটা নবরত্ন মন্দির ও দুটি পঞ্চরত্ন মন্দির। এগুলি ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে বাওয়ালীর উদয়নারায়ণ মণ্ডল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরই কাছাকাছি সাম্প্রতিককালে তৈরী একটা বড় আটচালা লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির আছে। পুরানো আটচালা মন্দিরের মধ্যে ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত ভূকৈলাস রাজবাড়ীর শিবগঙ্গা জলাধারের উত্তর দিকের ঘাটের দুই পাশে দুটা বড় শিবমন্দির আছে। সমসাময়িক কালের কতকগুলি আটচালা শিবমন্দির বাগবাজারেও ছিল। এগুলি দুর্গাচরণ মুখুজ্জে মশায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এগুলো সবই গিরিশ অ্যাভেন্যুর গর্ভে গিয়েছে। মাত্র একটা পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। কলকাতায় ভাল বৈষ্ণব মন্দিরও আছে। তার মধ্যে পড়ে বাগবাজারের গৌড়ীয় মঠ ও রামকান্ত বোস স্ট্রীটের নববৃন্দাবন মন্দির ও কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রীটের গোবিন্দজীর মন্দির। সম্প্রতি গড়িয়াহাটায় এক জোড়া সুন্দর রাধাকৃষ্ণের মন্দির তৈরী হয়েছে। (লেখকের ‘কলকাতার চালচিত্র’ হতে গৃহীত।)