কলকাতার রাস
হিন্দুর বিশ্বাস বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ গোপীনিদের সঙ্গে রাসলীলা করেছিলেন। কিন্তু কোন প্রাচীন গ্রন্থে এর উল্লেখ নেই। অথচ বাঙালির ‘বার মাসে তের পার্বণ-এর মধ্যে রাসলীলা একটা জনপ্রিয় উৎসব। গত কয়েক শ’ বৎসর বাঙালি নিরবচ্ছিন্নভাবে মহাসমারোহের সঙ্গে রাসলীলা উৎসব পালন করে এসেছে। সেজন্য মনে হয় এটা শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম উদ্ভবের পরই প্রচলিত হয়েছে। তার পূর্বে কার্তিকী পূর্ণিমার সময় বোধ হয় নবদ্বীপে কালীপূজার সমারোহ হত, কেননা নবদ্বীপে তখন শাক্তধর্মেরই প্রাধান্য ছিল। বর্তমানের নবদ্বীপে রাসপূর্ণিমার সময় মহাঘটা ও সমারোহের সঙ্গে কালীপূজা হয়। যাঁরা এই কালীপূজা দেখেছেন তাঁদের মনে হবে এ যেন বৈষ্ণবদের রাসলীলা উৎসবকে স্তিমিত করবার জন্য শাক্তদের এক প্রচেষ্টা।
কিন্তু অন্যত্র রাস পূর্ণিমার দিন রাসলীলা উৎসবই হয়। কলকাতায় এক সময় খুব জাঁকজমকের সঙ্গে রাসলীলা উৎসব অনুষ্ঠিত হত। কলকাতার প্রসিদ্ধ রাস ছিল গোকুল মিত্রের বাড়ির রাস, দর্জিপাড়ার রাস ও রূপলাল মল্লিকের বাড়ির রাস। গোকুল মিত্রের বাড়ির রাস আমি আমার ছেলেবেলায় দেখেছি। বিরাট মেলা বসতো এবং অনেক পুতুল ও সঙ তৈরি করে বিভিন্ন পৌরাণিক ও সামাজিক দৃশ্য দেখানো হত। তবে গোকুল মিত্রের জীবদ্দশায় রাস উৎসবের আরও বেশি ঘটা হত। ওঁদের বাড়ির দক্ষিণে একটা দিঘি ছিল। রাসের সময় ওই দিঘিতে চারখানা নৌকা ভাসিয়ে মেয়েদের কবির গান হত। গোকুল মিত্রের বাড়ির রাসের সূচনা হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নের পর যখন লবণের ব্যবসায়ে ও ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে ঘোড়ার রসদ বেচে তিনি প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এই সময়েই বিষ্ণুপুরের রাজারা তাঁর কাছে তাঁদের গৃহদেবতা মদনমোহন বিগ্রহকে বন্ধক রেখে এক লক্ষ টাকা কর্জ নেন। গোকুল মিত্রের মদন নামে এক ভৃত্য ছিল। একদিন মদনের অনুপস্থিতিতে গোকুল মিত্রের ডাকে সাড়া দিয়ে ঠাকুর মদনমোহন নিজে এসে তাঁকে তামাক সেজে দেন। মদনমোহনকে জাগ্রত দেবতা দেখে গোকুল মিত্ৰ অনুরূপ আর একটি বিগ্রহ তৈরি করান, এবং বিষ্ণুপুরের রাজারা যখন দেনা শোধ করেন, তখন তাঁদের সেই নকল বিগ্রহটি দেন। আসল বিগ্রহটি তিনি নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকেই ও অঞ্চলটির নাম হয় মদনমোহনতলা। এবং এই সময় থেকেই গোকুল মিত্রের বাড়িতে রাস উৎসবের সূচনা হয়
তবে গোকুল মিত্রের রাসের আগে কলকাতার বড় রাস ছিল গোঁসাই ঠাকরুণের রাস। কে এই গোঁসাই ঠাকরুণ তা আমরা জানি না। তবে তাঁর রাস যে এক বিখ্যাত রাস ছিল, তা তাঁর রাসাঞ্চলের নাম ‘রাসপল্লী’ থেকে আমরা বুঝতে পারি। এই রাসপল্লীতে এসেই নবকৃষ্ণ দেব তাঁর বসতি স্থাপন করেছিলেন, এবং পরবর্তীকালে এর নাম হয়েছিল শোভাবাজার।
ঊনবিংশ শতাব্দীর রাসের অনেক খবর আমরা সমসাময়িক সংবাদপত্র থেকে পাই। ২২ নভেম্বর ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দের এক সংবাদপত্রে আমরা পড়ি যে সাহেব-মেমেরাও হিন্দুর বাড়িতে রাসলীলা উৎসবের সময় সমবেত হয়ে আমোদ করতেন। রূপলাল মল্লিক রাসলীলা উৎসবের সময় তাঁর বাড়িতে নাচগানের ব্যবস্থাও করতেন এবং এই উপলক্ষে সাহেবদের নিমন্ত্রণ করতেন। সাহেবরা নর্তকীদের নাচগানে তুষ্ট হয়ে বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করতেন। তারপর সাহেবদের ভূরিভোজে আপ্যায়িত করা হত। সংবাদপত্রে লিখিত হয়েছিল—‘নাচঘরের নীচের তলাতে চারি মেজ সাজাইয়া নানাবিধ খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত করিয়া মেজ পরিপূর্ণ করিয়াছিল। তাহাতে সাহেবরা তৃপ্ত হইলেন ও মদিরা পান দ্বারা সকলেই আমোদিত হইলেন এবং বাদশাহী পল্টনের বাদ্যকরেরা অনুরাগে নানারাগে বাদ্য করিল। তাহাতে শ্রোতা ব্যক্তির মনোহরণ হইল। সকলে কহে যে এমত নাচ বাবুদের ঘরে আর কোথাও হয় নাই।’
তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে বড় রাস উৎসব ও মেলা হত খড়দহে শ্যামসুন্দর ঠাকুরের মন্দির প্রাঙ্গণে। বিশ-ত্রিশ মাইল দূর থেকে হাজার হাজার নরনারী এই মেলায় যোগদান করত। কলকাতা থেকে বহু নরনারী পানসি করে এই মেলায় সমবেত হত। এই মেলার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল জুয়াখেলা। সে যুগের জুয়াখেলা এক ভীষণ ব্যাপার ছিল। জুয়ার নেশায় মত্ত হয়ে লোক নিজ স্ত্রীকে পর্যন্ত বন্ধক রাখত। সমসাময়িক সংবাদপত্রে আমরা পড়ি যে খড়দহের মেলায় জুয়াখেলা নিবারণার্থ সরকার বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন। টালিগঞ্জে মণ্ডলদের রাসের মেলাও খুব বিখ্যাত ছিল। ওখানে বাইজী ও খেমটাওয়ালীদের নাচও হত।
সে যুগের কলকাতায় রাসলীলা উৎসব যে মাত্র বাবুদের বাড়িতেই হত, তা নয়। যেসব গৃহস্থদের বাড়িতে নারায়ণশিলা বা কোন বৈষ্ণবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল, তারাও রাসলীলা উৎসব করতেন। বড়দিনের সময় খ্রীষ্টানরা যেমন রঙিন কাগজের পতাকাদি দিয়ে গৃহসজ্জা করে, হিন্দু গৃহস্থরাও তেমনি শোলার তৈরি রঙিন শোভনদ্রব্য দিয়ে তাদের ঘরদোর সজ্জিত করত। সেকালের লোকের কাছে রাসলীলা যে একটা খুব জনপ্রিয় ও আনন্দের ব্যাপার ছিল, তা বুঝতে পারা যেত, কালীঘাটে রাসলীলার পট কেনার আগ্রহ থেকে।
কলকাতায় রাসের দিনের একটা প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে পরেশনাথের মিছিল। তবে আজকের দিনে রাসের উৎসব যেমন স্তিমিত হয়ে এসেছে, পরেশনাথের মিছিলের জাঁকজমকও বহুল পরিমাণে কমে গিয়েছে। আমাদের ছেলেবেলায় পরেশনাথের মিছিল খুব বিরাট আকারের হত, এবং মিছিল অতিক্রম করতে একঘণ্টা সময় লাগত। আজকাল বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই মিছিল শেষ হয়ে যায়।
সবশেষে কলকাতার এক বিচিত্র রাসের কথা বলব। এ রাস চৈত্র মাসে অনুষ্ঠিত হ’ত। আহিরীটোলার নিমাইচাঁদ গোস্বামী এই রাস করতেন। শ্রীকৃষ্ণের রাস যেমন কার্তিক মাসে হয়, বলরামের রাস তেমনি হয় চৈত্র মাসে। একমাত্র নিমু গোস্বামিই এই রাস করতেন। এ রাস সেকালের কলকাতায় এক দর্শনীয় ব্যাপার ছিল। নিমু গোস্বামী আর কোন পাল-পরব করতেন না। সেজন্যই বাঙলাদেশে প্রবচনের সৃষ্টি হয়েছে ‘জন্মের মধ্যে কর্ম, নিমাইয়ের চৈত্র মাসে রাস’।