কলকাতার বেগম
ময়ূরের মতন পেখম মেলে, দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে এই শহরের সামাজিক জীবনে বিজয় নাচন নেচে গেছেন ‘কলকাতার বেগম’। অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে, চার চারবার বিয়ে করে ও পাঁচ সন্তানের জননী হয়ে এই মহিলা বেঁচেছিলেন ৮৭ বৎসর বয়স পর্যন্ত। কোনদিন নিভে যেতে দেননি তাঁর জীবনের রঙিন আলো। স্তব্ধ হতে দেননি তাঁর সবুজ মনের গতি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আসর জমিয়ে গেছেন তিনি তাঁর গঙ্গ ার ধারের প্রাসাদোপম বাড়ির বৈঠকখানায়। দেশী কায়দায় বিছানো ফরাসের ওপর তাকিয়া হেলান দিয়ে, গড়গড়া টানতে টানতে গল্প করতেন তাঁর রামধনু-রঙে রাঙানো দীর্ঘ জীবনের কাহিনী। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতো কলকাতার বিশিষ্ট ও সম্ভ্রান্ত নাগরিকরা। আদর-আপ্যায়নের তিনি ছিলেন প্রতীক। সকলের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন ভালবাসা, সম্মান ও মর্যাদা। কলকাতার লোক যে তাঁকে কতটা ভালবাসত তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল তাঁর মৃত্যুর সময়। তাঁর শবানুগমন করেছিলেন কলকাতার সমস্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, কলকাতা কাউনসিলের সদস্যবৃন্দ, সুপ্রীম কোর্টের জজেরা, এমন কি ছ’ঘোড়ার গাড়িতে চেপে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন বড়লাট লর্ড মিন্টো। কেল্লার একদল রেজিমেন্টও সঙ্গে গিয়েছিল! তার আগে কলকাতার ইতিহাসে কোনদিন অনুষ্ঠিত হয়নি এমন রাজকীয়ভাবে কোন নাগরিকের শেষকৃত্য।
‘কলকাতার বেগম’ কিন্তু প্রকৃত ছিলেন না কোন নবাবের ঘরণী। বন্ধুত্ব ছিল তাঁর সিরাজের দিদিমা নানী বেগমের সঙ্গে। তিনি তাঁর মজলিসে বসে খোশগল্প করবার সময় কথায় কথায় উচ্চারণ করতেন নানী বেগমের নাম। সে জন্যই কলকাতার লোকরা গুণ- পরিবৃত্তিতে আদর করে তাঁকে অভিধা দিয়েছিলেন ‘বেগম’।
১৭২৫ খ্রীষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল এই মহিলার জন্ম হয় মাদ্রাজে। আর ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারী তারিখে তাঁর মৃত্যু হয় কলকাতায়। ইংরেজ আমলের এই ৮৭ বৎসরের ইতিহাস এবং ওই সময়কালের মধ্যে কলকাতা শহরের বিরাট পরিবর্তন পরিব্যাপ্ত করেছিল তাঁর জীবনকালকে। অতীতের মূককণ্ঠকে ভাষার যাদুতে রূপান্তরিত করবার জন্য যে উপাদানের প্রয়োজন, তার অভাব ছিল না তাঁর। ক্লাইভ থেকে মিন্টোর আমল পর্যন্ত এই দীর্ঘকালের ইতিহাস তাঁর নখদর্পণে ছিল। আলিবর্দি খান ও সিরাজকে তিনি আকছার দেখেছেন, সিরাজের দিদিমা নানী বেগমের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্প্রীতি ছিল, বর্গীর হাঙ্গামার সময় বাঙলার লোককে সন্ত্রস্ত হতে দেখেছেন, ক্লাইভ ও ওয়াটসনের সঙ্গে সংলাপ করেছেন, হোলকার, সিন্ধিয়া ও মারাঠাদের গৌরব রবির অস্তাচল দেখেছেন, নন্দকুমারের ফাঁসি দেখেছেন, বাঙালী বড়লোকদের বাড়ী দুর্গোৎসব ও অন্যান্য পাল-পরবের ঘটা দেখেছেন, ফ্রানসিসের সঙ্গে হেষ্টিংসকে ডুয়েল লড়তে দেখেছেন, নীলকুঠির পত্তন দেখেছেন, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মর্মান্তিক ক্রন্দন শুনেছেন, ছাপাখানার সূত্রপাত দেখেছেন, ব্যাঙ্ক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠা দেখেছেন, শহরে ঘোড়ার গাড়ীর প্রচলন দেখেছেন, রাজভবন ও টাউন হল তৈরী হতে দেখেছেন, ময় ন নূতন দুর্গ নির্মাণ দেখেছেন, এসব ঘটনার তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। এক কথায়, মজলিস জমাবার মত মালমশলা সব সময় তাঁর জিহ্বাগ্রে ছিল।
‘কলকাতার বেগম’-এর দীক্ষিত নাম ছিল ফ্রানসেস। পিতা ছিলেন মাদ্রাজে অবস্থিত ফোর্ট সেন্ট ডেভিড দুর্গের গভর্নর। নাম এডওয়ার্ড ক্রুক। ফ্রানসেস ছিল তাঁর দ্বিতীয় কন্যা। পিতাকে বৃত করতে চেয়েছিল কোম্পানি বাহাদুর মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জের কুঠির গভর্নর হিসাবে। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি ওই পদ, বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যের কারণে। অবসর নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ইংলণ্ডে, ছেলেমেয়েদের রেখে গিয়েছিলেন ভারতে।
ফ্রানসেস চলে আসেন কলকাতায়। উনিশ বছর বয়সে ৩ নভেম্বর ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দে বিয়ে করেন তৎকালীন বাঙলার গভর্নরের ভাই বা বোনের ছেলে প্যারী পারপল টেম্পলারকে। এই স্বামীর ঔরসে তাঁর দুটি পূত্র হয়, কিন্তু দুটিই মারা যায় শৈশবে। ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দের গোড়াতেই তিনি বিধবা হন। মাত্র ন’মাস পরে ২ নভেম্বর ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে আবার বিবাহ করেন জেমস আলথেন নামে এক ব্যক্তিকে। বিয়ের দশ দিন পরেই মারা যান তাঁর দ্বিতীয় স্বামী বসন্ত রোগে। তারপর আবার বিবাহ করেন কলকাতা কাউনসিলের জ্যেষ্ঠতম সদস্য উইলিয়াম ওয়াটসকে। এবার বোধ হয় শিখেছিলেন বাংলা ভাষা; কেননা, ওয়াটস সাহেব ভাল বাংলা বলতে পারতেন।
এই উইলিয়াম ওয়াটস-ই কোম্পানির কাশিমবাজার কুঠির অধিকর্তা নিযুক্ত হন। আলিবর্দি খান তখনও জীবিত। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর তাঁর দৌহিত্র সিরাজদৌল্লা যখন কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ ও লুণ্ঠন করেন, স্ত্রী ও তিন নাবালক পুত্রকন্যা সহ (কন্যা এমেলিয়ার বয়স ছয়, পুত্র এডওয়ার্ডের বয়স চার ও কনিষ্ঠা কন্যা সোফিয়া এক বছরের শিশু) ওয়াটস সাহেব বন্দী হন। শ্রীমতী ওয়াটস ও তাঁর তিন সন্তানকে রাখা হয় সিরাজের দিদিমা নানী বেগমের অভিভাবকত্বে। সিরাজ যখন কলকাতা আক্রমণে ব্যস্ত, নানী বেগম তখন শ্রীমতী ওয়াটস ও তাঁর ছেলেমেয়েদের সুপ্রহরায় পাঠিয়ে দেন চন্দননগরে ফরাসীদের কাছে। চন্দননগরের ফরাসী কর্তৃপক্ষ তাঁদের সাদর অভ্যর্থনা জানায়।
কলকাতা আক্রমণের পর সিরাজ যখন মুরশিদাবাদে প্রত্যাগমন করেন, তখন তিনি ওয়াটস সাহেব ও অন্যান্য ইংরেজ বন্দীদের মুক্তি দেন। এটা নাকি নানী বেগমের আদেশেই ঘটেছিল।
পরের বছর ইংরেজরা যখন কলকাতা শহর পুনরুদ্ধার করে ও সিরাজের সঙ্গে একটা সাময়িক সন্ধি হয়, ওয়াটস সাহেবকে তখন মুরশিদাবাদের নবাব দরবারে রেসিডেন্ট করে পাঠানো হয়। এ সময় ওয়াটস সাহেবকে যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে মুরশিদাবাদে থাকতে হয়েছিল। কারণ, ক্লাইভের সঙ্গে সিরাজের আপস-মীমাংসা সম্পর্কিত আলোচনার সময় তাঁকে প্রায়ই সিরাজের রোষে পড়তে হচ্ছিল। অবস্থা বিপজ্জনক দেখে ওয়াটস সাহেব গোপনে মুরশিদাবাদ থেকে পালিয়ে আসেন। তারপর পলাশীর যুদ্ধ উদ্বোধন করে বাঙলায় ইংরেজ আধিপত্যের সূত্রপাত। এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন শ্রীমতী ওয়াটস। এ ঘটনাগুলিকেই তিনি তাঁর বর্ণালী ভাষায় বর্ণনা করে যেতেন তাঁর ক্লাইভ স্ট্রীটের অদূরে গঙ্গার ধারে অবস্থিত বৈঠকখানায়।
১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে ওয়াটস সাহেব তাঁর পরিবারবর্গকে নিয়ে বিলাত চলে যান, এবং পরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। দীর্ঘকাল ভারতে থাকার দরুন, শ্রীমতী ওয়াটস রপ্ত করে ফেলেছিলেন ভারতের আচার-ব্যবহার। ইংলণ্ডে তার অভাব দেখে, ইংলণ্ডে থাকতে তাঁর মন টিকল না। ১৭৬৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় ফিরে এলেন। ভারতে ফেরবার আগে তিনি বিলাতে তাঁর দুই মেয়ের বিবাহ দিলেন ও পুত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে এলেন। তাঁর বড় মেয়ের ছেলেই ইংলণ্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ১৮১২ থকে ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত।
৪৯ বৎসর বয়সে ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় আবার বিয়ে করলেন সেন্ট জন চার্চের অন্যতম প্রধান যাজক রেভারেণ্ড উইলিয়াম জনসনকে। বোধ হয়, পাদরী সাহেবের সঙ্গে তার বিবাহটা মধুর হয়নি। কেননা, এর কয়েক বছর পরে পাদরী জনসন যখন বিলাতে গেলেন, “কলকাতার বেগম’ তখন অস্বীকৃত হলেন তাঁর সঙ্গে যেতে, এবং কলকাতাতেই থেকে গেলেন।
গঙ্গার ধারে তাঁর প্রাসাদপুরীর বৈঠকখানায় সন্ধ্যার পর বসালেন তিনি কলকাতার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মনোরঞ্জনের জন্য এক বেশ গুলজারী আসর। তাঁর মর্যাদাপূর্ণ অতিথি- সৎকার ছিল প্রশ্নাতীত। ফরাসের ওপর তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ও ক্রীতদাসীদের দ্বারা পরিবৃতা হয়ে,গড়গড়া থেকে তামাক টানতে টানতে, অভ্যাগতদের শুনাতেন তিনি পুরানো কলকাতার অজস্র রঙীন কাহিনী। সেণ্ট জন গির্জায় তখন সমাধি দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বড়লাট লর্ড ওয়েলেসলীর কাছ থেকে তিনি অনুমতি পেয়েছিলেন যে ওখানেই তাঁর সমাধি হবে। যদিও ওয়েলেসলী চলে যাবার পর লর্ড মিন্টোর আমলে তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল, তা হলেও তিনি ওয়েলেসলী প্রদত্ত অনুমতি থেকে বঞ্চিত হননি। সেণ্ট জন গির্জায় তাঁর সুন্দর সমাধিস্তম্ভের ওপর লেখা আছে
‘The oldest British resident in Bengal universally beloved, respected and revered.’