কলকাতার ফেরিওয়ালা
ইংরেজদের রাজা অমর। তারা বলে “দি কিং ইজ ডেড্ লঙ লিভ দি কিং’। কথাটা কলকাতার ফেরিওয়ালাদের ক্ষেত্রেও খাটে। কলকাতার ফেরিওয়ালারা অমর। কালে কালে তাদের মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু তারা পুনর্ভূ হয়েছে অন্য বেসাত নিয়ে। ফেরিওয়ালাদের পরিচয় তাদের ডাকে। ‘মিশি লেবে গো’, ‘কুয়োর ঘটি তোলাবে গো’ ইত্যাদি উনিশ শতকের ফেরিওয়ালার পরিচিত ডাক। শতাব্দীর চাকা ঘোররার আগেই তাদের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের অনেক ফেরিওয়ালার ডাকও স্তব্ধ। যেমন ‘টাকায় চারখানা কাপড়, একখানা ফাউ’, ‘এক পয়সায় চারখানা দেশলাই’, ‘রাম রাম সিগারেট, এক পয়সায় দশটা’, ‘নাকের আসল মুক্তা লেবে গো’ ইত্যাদি। আরও অন্তর্হিত হয়েছে আমার ছেলেবেলার অনেক ফেরিওয়ালার ডাক। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে না উঠতে শুনতাম ‘চাই মুড়ির চাক’ ‘ছোলার চাক চিঁড়ের চাক’ বা শীতকালে ভোরবেলা ‘চাই খেজুর রস’।
সকাল থেকে আরও অনেক ফেরিওয়ালা আসত। প্রথম আসত বাংলা কালিওয়ালা। চাল পুড়িয়ে তার ভুষো দিয়ে এই কালি তৈরি করা হত। শহরের সব দোকানদারই এই বাংলা কালি দিয়ে লিখত, খাগের কলমে। তারপর আসত আতর ও ফুলেল তেলওয়ালা। সঙ্গে সঙ্গে কাবুলিওয়ালার পরিচিত কণ্ঠ শোনা যেত ‘চাই হিং’। পর পর আসত ধোপা ও নাপিত। (তখন কলকাতায় ল ি বা সেলুন ছিল না।) দুধওয়ালারও আবির্ভাব ঘটত সঙ্গে সঙ্গে। আরও আসত বাড়ি বাড়ি ঠাকুরদের গান করবার জন্য নামসঙ্কীর্তনের দল।
একটু পরেই শোনা যেত ‘তিলফুট, চন্দরপুলি, ‘জিভেগজা’, ‘পাঁপড় চাই’, ‘শিল কাটাবে গো’, ‘ধামা বাঁধাবে গো’, ‘ছুরি কাঁচি ব’টি সান দেবে গো’, ‘প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ, লক্ষ্মীর পাঁচালী’, ‘চাই আমসত্তর’, ‘ছাতা সারাবে গো’, ‘রিপুকর্ম করাবে গো, ‘কাপড় কোঁচাবে গো’, ‘শিশি বোতল কাগজ চাই’, ‘মাথার চুল বাঁধার ফিতে এক পয়সায় পাঁচ হাত’। সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিত ফলওয়ালা, আম, কালোজাম, গোলাপজাম, লিচু, আঙুর, বেদানা, ন্যাসপাতি ইত্যাদি বেচবার জন্য। এর মধ্যেই দেখা দিয়ে যেত তারের ধাঁধাওয়ালা ও কাগজের ফুল ও বাঁশিওয়ালা।
মেয়ে ফেরিওয়ালাদের মধ্যে আসত কয়লাওয়ালী এরা মাথায় ঝুড়ি করে কয়লা বেচত), ঘুঁটেওয়ালী, মাটিওয়ালী। এরা সবাই অবাঙালী। বাঙালী মেয়ে ফেরিওয়ালীর মধ্যে ছিল বসবার পিঁড়ে, টুল, জলচৌকি ইত্যাদি বিক্রিওয়ালীরা। এদের পুরুষরা বাড়িতে বসে এগুলো তৈরি করত, আর মেয়েরা ফেরি করত।
দুপুরের আগেই আসত চাষীরা মাথায় থলে ভরতি ধান, সরষে, হলুদ নিয়ে পাইকারি দরে সেগুলো গেরস্ত লোকদের বেচবার জন্য।
দুপুরের পরে আসত চুড়িওয়ালীর দল, মেয়েদের হাতে কাঁচের চুড়ি পরাবার জন্য। এরা সবাই উত্তরপ্রদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক। অবশ্য অনেক বাঙালী মেয়ে ফেরিওয়ালীর ডাক শোনা যেত, ‘দাঁতের পোকা বের করাবে গো, ‘বাত সারাবে গো’, ‘ভানুমতীর খেল সাপের খেল দেখবে গো’। আরও আসত বাসনওয়ালীর দল, পুরানো কাপড়ের পরিবর্তে নূতন বাসন দেবার জন্য। আর আসত তাঁতি বউ, বাড়ি বাড়ি তাঁতের শাড়ি বেচবার জন্য। কাঁসরের আওয়াজ শুনলেই বোঝা যেত এবার আসছে কাঁসার বাসন বিক্রিওয়ালা। তার আগেই ঘুরে যেত পাথরের বাসনওয়ালা। (তখনকার দিনে প্রতি পরিবারে কাঁসার বাসন ছাড়া বহু পাথরের বাসন ব্যবহৃত হত।) দুপুরবেলা আরও অনেক ফেরিওয়ালা আসত,—মালাই বরফওয়ালা, পা। রবফওয়ালা, ‘বুড়ির মাথার পাকাচুল’, আলুকাবলি ও ফুচকাওয়ালা। বিকেলের দিকে আসত চানাচুরওয়ালা, মস্ত বড় এক বারকোষের ওপর চানাচুর সাজানো থাকত। গরম রাখবার জন্য মাঝখানে একটা ছোট হাঁড়িতে কাঠকয়লা জ্বালা থাকত। প্যাকেট করে চানাচুর তখন বিক্রি হত না।
বিকেলবেলা চ্যাঙারি মাথায় করে গলায় পৈতে ঝোলানো ফেরিওয়ালার ডাক শোনা যেত ‘চাই পাউরুটি বিস্কুট’। আমাদের পাড়ায় দু-তিনখানা পাউরুটির কারখানা ছিল। সেখানে দেখতুম একটা হুকে অনেক পৈতে ঝোলানো থাকত। ফেরিওয়ালা পথে বেরুবার আগে একটা পৈতে পরে নিত। লোক বামুনের হাতের পাউরুটি খাচ্ছি বলে বিশ্বাস করত। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের রুটি অবশ্য পাওয়া যেত, এবং যদিও তার মোড়কের ওপর লেখা থাকত ‘হস্তদ্বারা স্পষ্ট নয়’ তাহলেও নিষ্ঠাবান পরিবারের লোক তা খেত না। পাউরুটিওয়ালার পরেই আসত কেরোসিন তেলওয়ালা। বোতলে তেল ভরে দিয়ে দরজার মাথার ফ্রেমে খড়ি দিয়ে একটা দাঁড়ি টেনে দিত। মাসকাবার হলে ওই দাঁড়ির হিসাবে পাওনা কড়ি মিটিয়ে নিত। সন্ধ্যের মুখে আসত কুলপি বরফওয়ালা, তপসে মাছওয়ালা, ঘুগনি ও অবাক জলপানওয়ালা, ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’, ‘কুড়মুড় ভাজা’ ইত্যাদি। রাত্রে আসত বেলফুলের মালাওয়ালা ও ‘হীরেমতী রাক্ষুসী’।
আমি এখন বাগবাজারে কলকাতার এক অতি পুরানো পাড়ায় থাকি। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ফেরিওয়ালার আনাগোনার শেষ নেই। যে ডাকগুলো শুনি, তা থেকে বুঝে নিন্ আগেকার কোনগুলো আছে আর এখন নতুন কি সৃষ্টি হয়েছে। ‘রিপুকর্ম চাই’, ‘ছেঁড়া কাপড় আছে, কাপড়’, ‘ঘড়িওয়ালা, পুরানো ঘড়ি, অচল ঘড়ি’, ‘পুরানো জুতা আছে, চামড়ার জুতা’, ‘প্রথম ভাগ’, দ্বিতীয় ভাগ, লক্ষ্মীর পাঁচালী’, ‘এই প্লাটিকস পুরানো’, ‘টিন লোহা, প্লাসটিকস’, ‘শিশি বোতল হবে’, ‘পুরানো কাগজ খাতা বই’, ‘পুরানো টিনের কৌটার বদলে বাসন’, ‘শিল কাটাবো গো’, ‘পাতিলেবু’, ‘চালের খুদ আছে গো’, ‘ইলিশ মাছ’, ‘মুড়ি-ই-ই’, ‘ঘুটে রাখবে’, ‘মাটি, মাটি লেবে গো’, ‘ইষ্টিলের বাসন লেবে মা, বাসন’, ‘মধু লেবে গো’, ‘লোহা প্লাটিকস্’, ‘ছাতা সারাবে, ফোল্ডিং ছাতা’, ‘ইঁদুর মারা বিষ, আরশোলা, ছারপোকা মারবে’, ‘আলুকাবলি’, ‘হজমি গুলি’, ‘মিষ্টি পান’, বাংলা পান’, ‘চাই পাঁঠার ঘুগনি’, ‘চাই ভেলপুরি’, ইত্যাদি। এখন প্রাতঃকালের প্রথম ডাক হচ্ছে ‘কেরোসিন’। তবে কেরোসিনওয়ালা এখন আর দরজার মাথার ফ্রেমে খড়ি দিয়ে দাগ কাটে না। তার নীতি হচ্ছে—‘ফেল কড়ি, নাও তেল’।