কলকাতার থিয়েটার
কলকাতায় যত নাটক অভিনীত হয়েছে ভারতের আর কোথাও তত হয়নি। সে দিক থেকে কলকাতাকে নাটুকে শহর বলা যেতে পারে। এমন নাটক-পাগল শহর ভারতে আর দ্বিতীয় নেই। কলকাতার মত এত স্থায়ী রঙ্গমঞ্চও ভারতে বিরল। কলকাতায় স্থায়ী রঙ্গালয় স্থাপনের দিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দু হাজার নাটক রচিত হয়েছে। তার মধ্যে হাজারের ওপর নাটক অভিনীতও হয়ে গিয়েছে। একেবারে সূচনায় কলকাতায় তিনটা রঙ্গমঞ্চ ছিল। আজ তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কুড়ি। কলকাতার প্রতি রঙ্গমঞ্চে নাটকের অভিনয় দেখবার জন্য প্রতি রজনীতে সমবেত হয় ন্যূনপক্ষে দু হাজার নরনারী। কলকাতার এ রেকর্ড ভারতে অবিনশ্বর।
কলকাতায় স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হয় ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত কলকাতার রঙ্গমঞ্চ ও নাটক অভিনয়ের ইতিহাসকে মোটামুটি দু ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্বের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৮৭৩ থেকে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। এটাকে গিরিশ যুগ বলা হয়। এর পরের যুগ ছিল শিশিরকুমার ভাদুড়ীর যুগ। প্রথম যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল সুরেলা অভিনয় ও নট-নটীদের একঘেয়ে বেশভূষা ও মলিন দৃশ্যপট। রূপস। করবার উপকরণও ছিল মামুলী, যথা আলতা, সিঁদুর হলুদগুঁড়ো, পিউরী, খড়ি, ভুষোর কালি। আর রঙ্গমঞ্চ আলোকিত করা হত পাদ-প্রদীপ দিয়ে। বেশভূষারও কোন কালোপযোগী বৈশিষ্ট্য ছিল না। আজ যে পোষাক পরে চন্দ্রগুপ্তের আবির্ভাব ঘটত, কাল সেই পোষাক পরেই জাহাঙ্গীরের ভূমিকা অভিনীত হত। তা ছাড়া এ যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতি রজনীতে তিন-চারখানা করে নাটকের অভিনয়। পাল-পার্বনে দশ-বারোখানা নাটকও অভিনীত হত। আজ সন্ধ্যায় অভিনয় শুরু হয়ে, কাল প্রভাতে সাতটা-আটটায় শেষ হত।
দ্বিতীয় যুগের উদ্বোধন করেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী। সুরেলা অভিনয়ের অবসান ঘটে। তার পরিবর্তে আসে স্বাভাবিক অভিনয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বেশভূষা ও দৃশ্যপট কালোপযোগী করা হয়, এবং রঙ্গমঞ্চ নির্মাণের ক্ষেত্রে নূতন টেকনিক অবলম্বিত হয়। পাদ-প্রদীপের পরিবর্তে আসে মঞ্চের ওপর আলোকসম্পাত। ১৯৩১-এর পর ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চের প্রবর্তন হয়। এককথায় নাট্যজগতে শিশিরকুমার এক বিপ্লব আনেন।
তবে নাট্যজগতের দীর্ঘ ইতিহাসে, কলকাতায় রঙ্গমঞ্চ পরিচালনার জন্য যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে অর্থব্যয় করেছেন, তাঁরা কেউই টাকা পয়সার দিক দিয়ে লাভবান হন নি। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এমন কি শিশিরকুমার যিনি নাট্যশালার দ্বিতীয় পর্বের ইতিহাসে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন, তিনিও ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ঋণের চাপে বিপর্যস্ত হয়ে তাঁর ‘রঙ্গম’ নাট্যমঞ্চ বন্ধ করে দেন। বস্তুতঃ কয়েকজন নাট্যামোদী ধনী ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতাতেই এদেশে নাট্যশালা চলেছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা তো পায়নি, বরং পেয়েছে সরকারী বিরোধিতা। রঙ্গমঞ্চে নাটক অভিনয় নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এক আইন প্রণয়ন করেন। ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে দেশ স্বাধীনতা লাভ করা সত্ত্বেও ওই আইন বলবৎ থাকে। অনেক আন্দোলনের পর ১৯৭২ খ্রীষ্টাব্দে ওই আইনের বিলোপ সাধন করা হয়। তখন থেকেই নাটক অভিনয় স্বাধীনতা পেয়েছে। তার ফলে ইদানীংকালে বহু শৌখিন নাট্যসম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে।
আধুনিককালের রঙ্গমঞ্চ বা থিয়েটার বিলাতী কালচার-এর অঙ্গ। ইংরেজরা যখন কলকাতায় বসতি স্থাপন করে, তখন তারা নাটক অভিনয়ের জন্য একটা রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করে। এটার নাম চিল ‘প্লে হাউস’। পরে আর একটা থিয়েটার স্থাপিত হয়, নাম “দ্য ক্যালকাটা থিয়েটার’। ১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে লেবেডফ নামে এক রুশ-দেশীয় ভদ্রলোক কলকাতার ডোমতলায় এক অস্থায়ী মঞ্চ স্থাপন করে, কলকাতায় প্রথম বাংলা নাটকের অভিনয়ের আয়োজন করেন। দুদিন অভিনয়ের পর তিনি দেশে ফিরে যান।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইংরেজরা কলকাতায় ‘এথেনিয়াম থিয়েটার’, বৈঠকখানা থিয়েটার’ ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’, ‘সানস্ সুচি থিয়েটার’ প্রভৃতি নামে আরও কতকগুলি থিয়েটার স্থাপন করে।
ইংরেজদের দেখাদেখি বাঙালীরাও নাটক অভিনয় করবার জন্য মেতে ওঠে। বড় লোকের বাগানবাড়ি, বসতবাড়ি ও স্কুলবাড়িতে অস্থায়ী রঙ্গমঞ্চ বেঁধে বিলাতী কায়দায় নাটক অভিনয় শুরু হয়। এইসব অভিনয়ের মধ্যে কৃষ্ণরাম বসু স্ট্রীটে (বর্তমান শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর পিছনে) নবীনচন্দ্র বসুর বসতবাড়িতে অনুষ্ঠিত ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের অভিনয় উল্লেখযোগ্য, কেননা, এখানে স্ত্রীলোকের ভূমিকায় মেয়েরাই (রূপজীবিকারা) অভিনয় করেছিল। বিদ্যার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল ষোড়শবর্ষীয়া রাধামণি, রানী ও মালিনীর ভূমিকায় প্রৌঢ়া জয়দুর্গা ও বিদ্যার সহচরীর ভূমিকায় রাজকুমারী বা রাজু।
এরপর বেশ কিছুদিন স্কুল-কলেজের ছাত্রদের নাট্যাভিনয় ছাড়া, কলকাতায় আর কোন অভিনয়ের উদ্যোগ দেখা যায়নি। ১৮৫৪ থেকে ১৮৬৮ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কলকাতায় আবার বড়লোকদের বাড়িতে রঙ্গমঞ্চ বেঁধে নাটক অভিনয় করবার একটা হুজুগ লেগে যায়। এই সূত্রে কয়েকটা নাট্যসমাজও স্থাপিত হয়েছিল, যথা ‘শোভাবাজার প্রাইভেট থিয়েট্রিকাল সোসাইটি’, ‘বহুবাজার নাট্যসমাজ’, ‘বাগবাজার নাট্যসমাজ’, ‘আরপুলি নাট্যসমাজ’ প্রভৃতি। তবে এদের বধ্যে ‘বাগবাজার নাট্যসমাজ’ ছিল সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী, এবং পরে এদের চেষ্টাতেই কলকাতায় স্থায়ী রঙ্গালয় স্থাপিত হয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, ধর্মদাস সুর, রাধামাধব কর, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী প্রমুখ। (কলকাতায় নাট্যাভিনয় সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণের জন্য অতুল সুরের ‘কলকাতার চালচিত্র’ গ্রন্থ দ্রঃ)।
কলকাতার থিয়েটারের ইতিহাসে ১৮৭৩ সালটা সবচেয়ে স্মরণীয়। কেননা ওই বছরের গোড়ার দিকেই কলকাতায় এক সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপিত হয়। সাতুবাবুর দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ সাতুবাবুদের বাড়ির সংলগ্ন মাঠে এক খোলার ঘরে ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নামে এক থিয়েটার স্থাপন করেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওরই কাছে ৬নং বিডন স্ট্রীটে এক কাষ্ঠনির্মিত সুরম্যগৃহে বাগবাজারের বিখ্যাত ধনী ভুবন নিয়োগী কলকাতার প্রথম রঙ্গ ালয় ‘দ্য গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’ স্থাপন করেন। তিনিই বাগবাজার নাট্যসমাজকে রিহারসেলের জন্য তাঁর বৈঠকখানার প্রকাণ্ড হলঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। অমৃতলাল বসু তাঁর ‘স্মৃতিকথা’য় লিখেছেন—‘বড় মানুষ ভুবন নিয়োগী একটু আশ্রয় দিয়েছিল তাই গিরিশের মত অসাধারণ নাট্যকার কেরাণীগিরিতে জীবন পর্যবসিত করে নাই। স্কুল মাস্টারের কেদারাই অর্ধেন্দু মুস্তাফী ও ধর্মদাস সুরের মত কলাবিদদের প্রতিভার রঙ্গমঞ্চ হয় নাই, তাই নগেন্দ্ৰ, মহেন্দ্র, কিরণ, মতি, বেলবাবু প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের নাম বঙ্গ নাট্যশালার ইতিহাসে অমর অক্ষরে লিখিত হয়েছে।’
(পরে ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার অবস্থিত হয়েছিল, ওখানেই একটা খালি জমি বহুদিন ধরে পড়েছিল।) কেউ কেউ বলে ওখানে মহারাজ নন্দকুমারের বংশধর রাজা গুরুদাসের বাড়ি ছিল। ওই জমিটাই ভুবনমোহন নিয়োগী মহেন্দ্রনাথ দাসের কাছ থেকে লীজ নিয়ে এক কাঠের বাড়ি তৈরি করান ও তার নাম দেন ‘দ্য গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’। ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর তারিখে ‘দ্য গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে’ প্রথম অভিনয় হয়। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে গোড়ার দিকে স্ত্রীলোকের ভূমিকা পুরুষরাই করত কিন্তু ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় থেকে গ্রেট ন্যাশনাল মেয়েদের ভূমিকায় মেয়ে অভিনয় করতে শুরু করে। প্রথম যে কজন মেয়ে গ্রেট ন্যাশনালে থিয়েটারে অভিনেত্রীরূপে যোগদান করে তাদের মধ্যে ছিল ক্ষেত্ৰমণি, কাদম্বিনী, যাদুমনি, হরিদাসী, রাজকুমারী, বিনোদিনী ও নারায়ণী। এদের সকলকেই সংগ্রহ করা হয়েছিল শহরের রূপজীবী মহল থেকে। আর পুরুষ অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী, অমৃতলাল বসু, ধর্মদাস সুর, মতিলাল সুর, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বেলবাবু, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্রনাথ বসু, অবিনাশচন্দ্ৰ কর, রাধামাধব কর, ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর (আর.জি.কর মেডিকেল কলেজ-এর প্রতিষ্ঠাতা) প্রমুখ। যেসব নাটক গ্রেট ন্যাশনালে মঞ্চস্থ হয়েছিল তার মধ্যে চিল নীলদর্পণ, বিধবা বিবাহ, প্রণয় পরীক্ষা, কৃষ্ণকুমারী, কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, কমলে কামিনী, সধবার একাদশী, হেমলতা, কুসুমকুমারী, সতী কি কলঙ্কিনী, পুরুষবিক্রম, রুদ্রপাল, আনন্দকানন, শত্রুসংহার। শরৎসরোজিনী, নবীন তপস্বিনী, জামাইবারিক, নয়শো রূপেয়া, তিলোত্তমা সম্ভব, বিষবৃক্ষ, পদ্মিনী, অপূর্ব সতী, ডাক্তারবাবু, কণকপদ্ম, বৃত্রসংহার, হীরকচূর্ণ, বিদ্যাসুন্দর, কর্ণাটকুমার, ভীমসিংহ, সুরেন্দ্র-বিনোদিনী ও গজদানন্দ। শেষের দুখানা নাটকের অভিনয় নিয়ে গ্রেট ন্যাশনাল সরকারী রোষের সামিল হয়। রঙ্গমঞ্চে নাটক অভিনয় নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার আইন প্রবর্তন করেন (১৮৭৬)। এখানেই থিয়েটারের স্বাধীনতা পর্বের সমাপ্তি ঘটে।
সুরেন্দ্র-বিনোদিনী ও গজদানন্দ নাটকের অভিনয়ের পদাঙ্কে যে মাত্র সরকারি নিয়ন্ত্রণ এল তা নয়। ভুবন নিয়োগী নানারকম মামলা-মকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ল। এতে ভুবন নিয়োগীর অজস্র অর্থব্যয় হল। তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। তা সত্ত্বেও তিনি কয়েক মাস নাটক মঞ্চস্থ করেন। মিউনিসিপ্যালিটির ট্যাক্স বাকী পড়ায়, মিউনিসিপ্যালিটি থিয়েটারটা নীলাম করে দেয়। প্রতাপ জহুরী নামে এক মাড়োয়ারী নীলাম থেকে থিয়েটারটা কিনে নেয়। স্থাপনের দিন থেকে নীলামের দিন পর্যন্ত গ্রেট ন্যাশনালে ৯৯ রজনী অভিনয় হয়েছিল।
তারপর প্রতাপ জহুরীর পরিচালনায় থিয়েটারটা চলতে থাকে। কিন্তু প্রতাপ জহুরী দু- চার বছরের বেশী থিয়েটারটা চালাতে পারে না। প্রতাপ জহুরী আর থিয়েটার ব্যবসা করবে না জেনে, ভুবন নিয়োগী থিয়েটারটা তার স্ত্রী ভুবনমোহিনী দেবীর নামে লীজ নেয়। কিন্তু ভুবন নিয়োগী নিজেকে দেউলিয়া বলে ঘোষণা করে স্ত্রীর নামে বেনামীতে লীজ নিয়েছে, এই অভিযোগে প্রতাপ জহুরী ভুবন নিয়োগীর নামে মামলা করে। বিচারে প্রতাপ জহুরী জয়লাভ করে। তখন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার আবার নীলামে বিক্রি হয়ে যায়। স্টার থিয়েটার সম্প্রদায় গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারটা কিনে নিয়ে বাড়িটাকে ভেঙে ফেলে।
স্টার থিয়েটারের জন্মের কথাটা এখানে বলা যাক। তার অভিনয় চাতুর্যের জন্য নটী বিনোদিনী সে যুগে নাট্যসম্রাজ্ঞী অভিধা পেয়েছিল। থিয়েটারের মালিকদের কাছ থেকে ভাল ব্যবহার না পাওয়ার জন্য তার মনে সাধ ছিল সে নিজে একটা থিয়েটার করবে। গুরুমুখ নামে এক ধনী সুপুরষ সে সময় বিনোদিনীর সংস্পর্শে আসে। তার সহায়তায় ৬৮নং বিডন স্ট্রীটের জমিটা শ্যামবাজারের প্রখ্যাত ধনী কীর্তি মিত্রের কাছ থেকে লীজ নেওয়া হয়। থিয়েটার নির্মাণের কাজ চলতে থাকে। এদিকে গিরিশচন্দ্র নাটক লিখে রিহারসেল দিতে থাকেন। প্রথমে ঠিক হয় যে থিয়েটারটার নাম হবে ‘বি-থিয়েটার’। কিন্তু চক্রান্তের ফলে থিয়েটারটার নামকরণ করা হয় ‘স্টার থিয়েটার’। তা সত্ত্বেও নিজের মনের অন্তর্বেদনা চাপা দিয়ে বিনোদিনী সেখানে অভিনয় করে যেতে থাকে। ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ২১ জুলাই তারিখে স্টার থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয় ‘দক্ষযজ্ঞ’,যা ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ আগস্ট তারিখে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব দেখতে আসেন। বঙ্গীয় নাট্যসমাজ এতে ধন্য হয়। ওই সালের ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি আবার ওখানে ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকের অভিনয় দেখেন। ঠাকুর ওখানে আরও দুখানা নাটকের অভিনয় দেখেছিলেন— ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ ও ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘বৃষকেতু’। কথিত আছে যে ‘চৈতন্যলীলা’ নাটক অভিনয়ের সময় বিনোদিনী হবিষ্যান্ন করত। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটকে চিন্তামনির ভূমিকায় অভিনয়ের পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে বিনোদিনী মঞ্চজীবন ত্যাগ করে সংসার জীবনে প্রবেশ করে।
এর কয়েক বছর আগে নাট্যজগতে আর এক স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে ব্রহ্মবান্ধব কেশবচন্দ্র সেন চিরঞ্জীব শৰ্মা ছদ্মনামে ‘নব বৃন্দাবন’ নামে এক নাটক রচনা করে স্বয়ং উক্ত নাটকে পাহাড়ীবাবা ও বাজীকরের ভূমিকায় অভিনয় করেন। আরও উল্লেখনীয় উক্ত নাটকে নরেন্দ্রনাথ (পরে স্বামী বিবেকানন্দ) দণ্ডী শিষ্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
এরপর স্টার থিয়েটার বিডন স্ট্রীট থেকে উঠে এসে হাতিবাগানে এক নতুন রঙ্গশালা নির্মাণ করে। বিডন স্ট্রীটে স্টার থিয়েটারের শেষ অভিনয় ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দের ৩১ জুলাই তারিখে ‘বুদ্ধদেব চরিত’ ও ‘বেল্লিক বাজার’ এবং হাতিবাগানের নূতন বাড়িতে প্রথম অভিনয় ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ মে তারিখে ‘নসীরাম’ নাটক।
এদিকে ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নগেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায় বিডন স্ট্রীটে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের জমিতে মিনার্ভা থিয়েটার স্থাপন করেন। ওখানে গিরিশচন্দ্রের অনূদিত সেকস্পীয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ নাটক প্রথম মঞ্চস্থ হয়। ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ জুলাই ‘প্রফুল্ল’ নাটক স্টার ও মিনার্ভা উভয় রঙ্গমঞ্চেই অভিনীত হয়। মিনার্ভায় গিরিশচন্দ্র যোগেশের ভূমিকায় অভিনয় করেন, আর স্টারে ওই ভূমিকায় অমৃতলাল মিত্র অভিনয় করেন। ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে মিনার্ভা থিয়েটারে তিনকড়ি লেডি ম্যাকবেথের ভূমিকায় অভিনয় করে বিখ্যাত হন। (এখানে উল্লেখনীয় যে ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে মিনার্ভা থিয়েটার আগুনে ভস্মীভূত হবার পর ওখানে নূতন মঞ্চগৃহ নির্মিত হয়)।
১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রখ্যাত দার্শনিক পণ্ডিত ও অ্যাটর্নী হীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভ্রাতা অমরেন্দ্রনাথ দত্ত বিডন ষ্ট্রীটে স্টার থিয়েটারের পুরানো বাড়িতে ক্লাসিক থিয়েটার স্থাপন করে নাট্যজগতের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করেন। তিনিই থিয়েটারে মঞ্চ ব্যবস্থাপনা, ঠ্যালা সীন প্রভৃতি প্রবর্তন করে নাট্যশালার দৃশ্যপট ও সাজস য়ি নূতনত্ত্ব আনেন। নাট্যাভিনয় প্রচারের জন্য তিনি নানাবর্ণে মুদ্রিত প্ল্যাকার্ড ও হ্যাণ্ডবিল প্রভৃতিরও প্রবর্তন করেন। এছাড়া দর্শকদের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য তিনি নানারূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। শিশিরকুমার ভাদুড়ীর ভাষায় “তিনি ছিলেন রঙ্গজগতের নেপোলিয়ান’। বস্তুত অমরেন্দ্রনাথের সময়কালটাই ছিল শিশির-পূর্ব যুগের রঙ্গালয়ের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। নাটক অভিনয় দর্শন এ সময় বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাধারণ রঙ্গালয়ের সংখ্যাও এ সময় বেড়ে যায়।
১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ এপ্রিল তারিখে ক্লাসিক থিয়েটারে প্রথম অভিনয় শুরু হয় গিরিশচন্দ্রের ‘নলদময়ন্তী’ ও বেল্লিকবাজার’ নিয়ে। (অনেকের মতে প্রথম নাটক ছিল ‘হারানিধি’)। অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে ক্লাসিক থিয়েটারে যাঁরা যোগদান করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, নয়নতারা, সরোজিনী, মহেন্দ্রলাল বসু, অঘোরনাথ পাঠক, গোবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ দাস, ধর্মদাস সুর, পূর্ণচন্দ্র ঘোষ, হরিভূষণ ভট্টাচার্য, চুনীলাল দেব ও নৃপেন্দ্র চন্দ্র বসু বা ন্যাপা বোস। ক্লাসিক থিয়েটার অসামান্য সাফল্য অর্জন করে জেনারেল এসেমব্লীজ ইনস্টিটিউশনের রসায়নের অধ্যাপক ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘আলিবাবা’ নাটক মঞ্চস্থ করে ( ১৮৯৭)। এই নাটকে আবদাল্লার ভূমিকায় ন্যাপা বোসের ও মর্জিনার ভূমিকায় কুসুমকুমারীর অভিনয় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়। ন্যাপা বোসের পরিকল্পিত নাচের গুণে নাটকটি অল্পদিনের মধ্যে এমনই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে এই নাটকটির অভিনয় থেকে ক্লাসিক থিয়েটারের লক্ষাধিক টাকা আয় হয়েছিল। ন্যাপা বোসের সঙ্গে আমাদের পরিবারের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল, এবং সেই সূত্রে আমি আমার ছেলেবেলায় শতাধিকবার ‘আলিবাবা’র অভিনয় দেখেছি। আবদাল্লার ভূমিকা ছাড়া, আরও যে সব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ন্যাপা বোস যশস্বী হয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল ‘ফকড়ে’, ‘দেলদার’ ও ‘নিমচাঁদ’।
অমরেন্দ্রনাথের অভিনয়ও আমি বহুবার দেখেছি। ‘আলিবাবা’য় তিনি হুসেনের পার্ট করতেন। আরও যে সব ভূমিকায় তাঁকে অভিনয় করতে দেখেছি তা হচ্ছে ‘পলাশীর যুদ্ধ’-এ সিরাজ, ‘পাণ্ডব গৌরব’-এ ভীম, ‘হারানিধি’-তে অঘোর, ‘প্রফুল্ল’-তে ভজহরি, ‘ভ্রমর’-এ গোবিন্দলাল ( এই নাটকের অভিনয়কালে তিনি অশ্বপৃষ্ঠে মঞ্চে আবির্ভূত হতেন এবং রোহিনীকে জল থেকে তুলে ভিজে কাপড়ে মঞ্চে উঠে আসতেন) ও ‘রঘুবীর’, ‘হরিবাজ’, ‘সীতারাম’ প্রভৃতি নাটকে নাম ভূমিকায়। ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর তারিখে স্টার থিয়েটারে ‘সাজাহান’ নাটকে ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় অভিনয় করাকালীন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এটাই তাঁর শেষ অভিনয়। এখানে উল্লেখনীয় যে, যে বৎসর অমরেন্দ্রনাথ অভিনয়কালে অসুস্থ হয়ে পড়েন, ঠিক তার আগের বছরে ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ জুলাই তারিখে গিরিশচন্দ্রও ‘বলিদান’ নাটকে করুণাময়ের ভূমিকায় অভিনয়কালে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেটাই তাঁর শেষ মঞ্চাবতরণ। অমরেন্দ্রনাথই ছিলেন স্টার থিয়েটারে প্রাণপুরুষ এবং তাঁর মৃত্যুর পর স্টার থিয়েটারের অবনতি ঘটে।
গিরিশচন্দ্রের অভিনয় নৈপুণ্যের ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন তাঁর পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ বা দানীবাবু। দানীবাবুর অভিনয়জীবন পেশা হিসাবে গ্রহণ করা সম্বন্ধে গিরিশচন্দ্রের ঘোর আপত্তি ছিল। এক তরুণী বিধবাকে বিবাহ করে অর্থাভাবের মধ্যে পড়লে, তাঁর পিসিমার অনুরোধে বিখ্যাত অভিনেতা অমৃতলাল মিত্র তাঁকে স্টার থিয়েটারে নিয়ে আসেন ও পিতার অজ্ঞাতসারে অভিনয় শিক্ষা দিতে থাকেন। কলকাতার বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে দানীবাবু খ্যাতির তুঙ্গে ওঠেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ইচ্ছানুক্রমে বন্যার্তদের সাহায্যকল্পে কলকাতার ‘দুর্গেশনন্দিনী’র যে অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার অভিনয়ে দানীবাবু ওসমানের ভূমিকায় ও তারাসুন্দরী আয়েষার ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় চাতুর্য দেখিয়েছিলেন। শিশির যুগেও তাঁর অভিনয়নৈপুণ্য অম্লান ছিল। ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দের ২ অক্টোবর নাট্যমন্দিরে গিরিশ স্মৃতি সমিতির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘প্রফুল্ল’ নাটকের অভিনয়ে দানীবাবু ‘যোগেশ’-এর ভূমিকায় ও শিশিরকুমার ‘রমেশ’-এর ভূমিকায় একসঙ্গে অভিনয় করে কলকাতার নাট্য জগতের ইতিহাসে এক নজীরহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাঙলার বাইরে থেকে মনোমোহন পাঁড়ে নামে এক ভদ্রলোক কলকাতায় এসে ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে মিনার্ভা থিয়েটারের পরিচালনা করেন। এই সময় কোহিনূর থিয়েটার নামে আর একটা থিয়েটার স্থাপিত হয়। ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে মনোমোহন পাঁড়ে কোহিনুর থিয়েটার কিনে নেন। ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি তার নাম দেন ‘মনোমোহন থিয়েটার’। দানীবাবুর অধিনায়কত্বে মনোমোহন থিয়েটার বেশ ভাল চলে। আর যে সব থিয়েটার এ সময় চলেছিল তার মধ্যে ছিল ন্যাশনাল, গ্রাণ্ড ন্যাশনাল, অ্যালফ্রেড, বেঙ্গল, বীণা (পরে সিটি থিয়েটার), অরোরা, ইউনিক, গ্রাণ্ড, ক্লাসিক, স্টার, মিনার্ভা ইত্যাদি।
আজ যেখানে ‘ ‘ সিনেমা অবস্থিত ওখানে ছিল একটা নোংরা মাঠ। লোকে ওখানে মলমূত্র ত্যাগ করত। আগাসী সার্কাস ওই মাঠটা পরিষ্কার করে ওখানে সার্কাস দেখাতে শুরু করে। গ্রীষ্মকালে আগাসী সার্কাস চলে যাবার পর, ম্যাডান কোম্পানী ওখানে তাঁবু ফেলে চলচ্চিত্র (এলফিনস্টন বায়োস্কোপ) দেখাতে আরম্ভ করে। তাঁবুটা একদিন পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। তখন ম্যাডান কোম্পানী ওখানে কর্ণওয়ালিস থিয়েটার নির্মাণ করে। প্রথমে ওখানে চলচ্চিত্রই দেখানো হত। কিন্তু পরে ম্যাডান কোম্পানী চলচ্চিত্র দেখাবার জন্য ওর দক্ষিণের জমিতে ‘উত্তরা’ সিনেমা স্থাপন করে, কর্ণওয়ালিস থিয়েটারকে এক সাধারণ রঙ্গালয়ে পরিণত করে। ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নাম দিয়ে ম্যাডান কোম্পানী শিশিরকুমার ভাদুড়ীকে তাঁদের থিয়েটারের পরিচালক ও অভিনেতা নিযুক্ত করে। শিশিরকুমার বিদ্যাসাগর কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে স্কটিশ চার্চেস কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করবার পর থেকেই তিনি ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটুট মঞ্চে শৌখিন অভিনেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে ওখানে রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকে কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করলে, রবীন্দ্রনাথ তা দেখে বলেছিলেন, ‘কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র। একদা ওই পার্টে আমার যশ ছিল।’
কর্ণওয়ালিস থিয়েটারেই ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর তারিখে ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘আলমগীর’ নাটকে শিশিরকুমারের সাধারণ রঙ্গমঞ্চে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে।
মতভেদ হওয়ায় শিশিরকুমার ম্যাডান কোম্পানী ত্যাগ করেন। ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে ইডেন গার্ডেন একজিবিশনে শিশিরকুমার কয়েকজন প্রতিভাধর নট-নটীদের নিয়ে এক নাট্যগোষ্ঠী গড়ে তুলে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সীতা’ নাটক মঞ্চস্থ করেন। রামচন্দ্রের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় এই সময় শহরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ‘সীতা’ জনপ্রিয় হওয়ায়, তিনি অ্যালফ্রেড থিয়েটার (পরে গ্রেস থিয়েটার) ভাড়া নিয়ে ‘বসন্তলীলা’ অভিনয় করেন। ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দে শিশিরকুমার মনোমোহন থিয়েটার ভাড়া নিয়ে ‘নাট্যমন্দির’ নাম দিয়ে ওখানে যোগেশ চৌধুরীর ‘সীতা’ নাটক অভিনয় করেন। (নাট্যমন্দিরের মোট মূলধন ছিল পাঁচ লক্ষ টাকা, এবং ডিরেক্টর ছিলেন তুলসীচরণ গোস্বামী, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র ও শিশিরকুমার ভাদুড়ী)। ‘সীতা’ নাটকের প্রথম অভিনয় হয় ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দের ৬ আগস্ট তারিখে। ওইদিন রসরাজ অমৃতলাল বসু রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘শিশির কুমারই থিয়েটারে নবযুগের প্রবর্তক’। ‘সীতা’র অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘শিশির ভাদুড়ীর প্রয়োগনৈপুণ্যে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে’। ‘সীতা’ নাটকের অভিনয়ের ব্যবস্থাপনায় শিশিরকুমার যাঁদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন হেমেন্দ্র কুমার রায়, মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নৃপেন্দ্র চন্দ্র বসু (ন্যাপা বোস), অন্ধগায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে, চারুচন্দ্র রায়, প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। প্রযোজনার বৈশিষ্ট্য ছিল কনসার্টের বদলে রসনচৌকি, প্রবেশপথে আলপনা ও পূর্ণকলস, প্রেক্ষাগৃহে চন্দন-অগুরু-ধূপের গন্ধ, পাদ প্রদীপের পরিবর্তে আলোকসম্পাত ও সীনের পরিবর্তে বক্স সেট। আরও উল্লেখযোগ্য এই অভিনয়ে জনতার দৃশ্যে একশ জন অভিনেতা ও অভিনেত্রীর অংশগ্রহণ করা। এই অভিনয়ে রামের ভূমিকায় শিশিরকুমারের ও সীতার ভূমিকায় প্রভার অভিনয় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিল। ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে শিশিরকুমার তাঁর নাট্যমন্দির কর্ণওয়ালিস থিয়েটারে স্থানান্তরিত করেন। এখানে অভিনয় শুরু হয় ওই বছরের ২৬ জুন তারিখে। প্রথম অভিনীত নাটক ‘সীতা’। পরবর্তী নাটক ‘বিসর্জন’। ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে শিশিরকুমার আর্ট থিয়েটার (১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রবোধচন্দ্র গুহ কর্তৃক স্টার থিয়েটারে গঠিত) ভাড়া নিয়ে নব নাট্যমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে তিনি এখানে মঞ্চস্থ করেন ‘বিরাজ বৌ’, ‘বিজয়া’, ‘সরমা’, ‘দশের দাবী’, ‘রীতিমত নাটক’, শ্যামা’ ও ‘যোগাযোগ’। ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে শিশিরকুমার ‘ রঙ্গম’ (নাট্যনিকেতনের নতুন নাম) প্রতিষ্ঠা করে, ওখানে ‘মাইকেল’ নাটকের নাম ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন। শিশিরকুমারের ন্যায় প্রতিভাশালী অভিনেতা এদেশে আর জন্মায় নি। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দিতে চাইলে তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে প্রার্থনা করেছিলেন এক জাতীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করবার জন্য সহায়তা।
ইতিমধ্যে ১৯২৬ খ্ৰীষ্টাব্দে, অ্যালফ্রেড মঞ্চে ‘মিত্র থিয়েটার’, ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণ কলকাতায় ‘পূর্ণ থিয়েটার’ (উমাশশী সর্বপ্রথম এখানে আত্মপ্রকাশ করে), ১৯৩১ খ্রীষ্টব্দে ‘রঙমহল’ (অভিনেতা রবি রায় ও গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত), ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে ধর্মতলা স্ট্রীটে চীপ থিয়েটার’, নতুনবাজারে ‘রঙমহল’, ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে ‘নাট্যভারতী’ ১৯৫৪ খ্রীস্টাব্দে মানিকতলার খালধারে ‘কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ ১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দে বিশ্বরূপা’ ( রঙ্গমের নামান্তর) ও ১৯৭৩ খ্রীষ্টাব্দে ‘রঙ্গনা’ প্রভৃতি থিয়েটারের আবির্ভাব ঘটে। সম্প্রতি বামফ্রন্ট সরকার ‘শিশির মঞ্চ’ এবং ‘গিরিশ মঞ্চ’ স্থাপন করেছেন।
এবার আমি থিয়েটারের নবযুগে (তার মানে ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের পর) রঙ্গমঞ্চে যে সকল বিশিষ্ট নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তার উল্লেখ করছি।
মিনার্ভা থিয়েটারের মঞ্চে উপেন্দ্রকুমার মিত্রের পরিচালনায় ‘আত্মদর্শন’, ‘গয়াতীর্থ’ ও ‘ধর্মদ্বন্দ্ব’; দেলওয়ার হোসেন ও চণ্ডী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘চিরন্তনী’, ‘কাঁটা কমল’, ‘সুপ্রিয়ার কীর্তি’, ‘ডাক্তার’, ‘মাটির মায়া’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘দেবদাস’, ‘রাষ্ট্রবিপ্লব’, ‘দুই পুরুষ’, ‘ধাত্রী পান্না’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘তুষারকণা’, ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্ৰ’, ‘সুবৰ্ণ গোলক’, ‘কেরানীর জীবন’, ‘কর্ণ-কুন্তী কৃষ্ণা’, ‘কৃষ্ণ কুণ্ডুর পরিচালনায় ‘জাহাঙ্গীর’, ‘এরাও মানুষ’, ‘ কৃষ্ণ সারথি’; রাসবিহারী সরকারের পরিচলনায় ‘জীবনটাই নাটক’, ‘ঝিন্দের বন্দী’ ও উৎপল দত্তের ‘লিটল থিয়েটার’-এর পরিচালনায় ‘নীচের মহল’, ‘অঙ্গ ার’, ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘ ‘চৈতালী’, ‘রাতের স্বপ্ন’, ওথেলো’, জুলিয়াস সীজার’, ‘কল্লোল’, ‘ভি-আই-পি’, ‘অজেয় ভিয়েতনাম’, ‘যুদ্ধং দেহি’, ‘তীর’, ‘মানুষের অধিকার’, লেনিনের ডাক’ ইত্যাদি।
স্টার থিয়েটার মঞ্চে আর্ট থিয়েটারের পরিচালনায় ‘একাঙ্কিকা’, ‘কর্ণার্জুন’, ‘চিরকুমার সভা’; শিশিরকুমারের নব নাট্য মন্দিরের পরিচালনায় ‘বিরাজ বৌ’, ‘বিজয়া’, ‘সরমা’, দশের দাবী’, ‘রীতিমত নাটক’, ‘শ্যামা, ‘যোগাযোগ’, ‘পোষ্যপুত্র’; বিমল পালের পরিচালনায় ‘বিদ্যাপতি’, ‘অভিসারিকা’, ‘কালের দাবী’; সলিলকুমার মিত্রের পরিচালনায় ‘চক্রধারী’, ‘রাণী ভবানী’, ‘রাণী দুর্গাবতী’, ‘মহারাজ নন্দকুমার’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘টিপু সুলতান’, ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’, ‘শতবর্ষ আগে’, স্বর্গ হতে বড়’, ‘রাজসিংহ’, ‘কালিন্দী’, ‘নৌকাডুবি’, ‘বালাজী রাও’, রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’, ‘সূর্যমহল’, ‘কলঙ্কবতী’, ‘পদ্মিনী’, ‘রাজনর্তকী’, (এই সময় স্টার থিয়েটার ভবন নবীকৃত করা হয়) ‘শ্যামলী’, ‘পরিণীতা’, কান্ত’, ‘ডাকবাংলো’, রামকৃষ্ণ’, ‘শ্রেয়সী’, ‘শেষাগ্নি’, ‘স্বর্ণকীট’, ‘তাপসী, ‘একক দশক শতক’, ‘দাবী’, ‘শর্মিলা’, ‘সীতা’, ‘শাপমোচন’, ‘বালুচরী’ ইত্যাদি।
রঙমহলে (১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে অভিদেতা রবি রায় ও গায়ক কৃষ্ণচন্দ্ৰ দে কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত) বিষ্ণুপ্রিয়া; শিশির মল্লিক, যামিনী মিত্র ও সতু সেনের পরিচালনায় ‘মহানিশা’, ‘অশোক’, ‘পতিব্রতা’, ‘কাজরী’, ‘বাংলার মেয়ে’; অমর ঘোষের পরিচালনায় ‘চরিত্রহীন’; যামিনী মিত্র, কৃষ্ণচন্দ্র দে ও রঘুনাথ মল্লিকের পরিচালনায় ‘ডিকেটটিভ’, ‘স্বামী স্ত্রী’, ‘মেঘমূক্তি’, ‘তটিনীর বিচার’, যামিনী মিত্র ও অমর ঘোষের পরিচালনায় ‘মাকড়সার জাল’, ‘মাটির ঘর’, ‘বিশ বছর আগে’, ‘রত্নদীপ’; যামিনী মিত্র ও দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘রক্তের ডাক’, ‘তুমি ও আমি’, ‘মায়ের দাবী’; অভিনেতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘মাইকেল’, ‘ভোলা মাস্টার’, ‘সানি ভিলা’, ‘রামের সুমতি’, ‘অধিকার’, ‘বিংশ শতাব্দী’, ‘সন্তান’, ‘রাজপথ’, ‘সেই তিমিরে’, ‘অনুপমার প্রেম’, ‘বাংলার প্রতাপ’, ‘ক্ষুদিরাম’, ‘রিজিয়া’, ‘মেবার মতন’, ‘বঙ্গে বর্গী’; সীতানাথ মুখোপাধ্যায় ও অমিয় বসুর পরিচালনায় ‘এই স্বাধীনতা’, ‘খবর বলছি’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘চাঁদ বিবি’, ‘জীজাবাই’, ‘জীবন সংগ্রাম’, ‘দূরভাষিণী’, ‘উল্কা’, ‘শেষ লগ্ন’, ‘শতবর্ষ আগে’, ‘কবি’, ‘কালপুরুষ’, ‘মায়ামৃগ’, ‘একমুঠো আকাশ’, ‘এক পেয়ালা কফি’, ‘অনৰ্থ’, ‘চক্ৰ’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’; ও শিল্পগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনায় ‘কথা কও’, ‘স্বীকৃতি’, ‘নাম বিভ্ৰাট’ ‘টাকার রঙ কালো’, ‘প্রতিমা’, ‘অতএব’, ‘ছায়া নায়িকা’, ‘নহবত’, ‘সেমসাইড’, ‘আমি মন্ত্রী হব’, ‘বাবা বদল’ ও ‘উত্তরণ’।
রঙ্গমে শিশিরকুমারের পরিচালনায় ‘মাইকেল’, ‘বিপ্রদাস’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘দুঃখীর ইমান’, ‘পরিচয়’, ‘তকত-ইতাউস’, ‘প্রশ্ন’; (সরকার ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রহণের পর নামকরণ করা হয় ‘বিশ্বরূপা’), ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘ক্ষুধা’, ‘ডাউন ট্রেন’, ‘মায়া ময়ূর’, ‘সেতু’, ‘জব জার্নকের বিবি’, ‘রঙ্গিনী’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘এক পেয়ালা কফি’, আগন্তুক’, ‘ঘর’, ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’, ‘স্বরলিপি’ ইত্যাদি।
এ যুগের নাটকের মধ্যে যেগুলো অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করে, তার মধ্যে উল্লেখনীয় ‘শ্যামলী’ (৪৮৪ বার), ‘পরিণীতা’ (১৩৫বার), ‘ কান্ত’ (৩৩২ বার), ‘সেতু’ (একটানা অভিনয়ে রেকর্ড), ‘এণ্টনী কবিয়াল’ (আড়াই বছর), ‘তাপসী’ (৪৬৭ বার), ‘একক দশক শতক’ (২১৪ বার), ‘দাবী (৫৮০ বার), শর্মিলা’ (৫৫১ বার), সীমা’ (২০৩ বার)। উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটারে ‘অঙ্গার’ দু বছরের ওপর অভিনীত হয়।
এ যুগের প্রখ্যাত নাট্যকারদের মধ্যে ছিলেন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মন্মথ রায়, শচীন সেনগুপ্ত, যোগেশ চৌধুরী, বিধায়ক ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয় বৈরাগী, দেবনারায়ণ গুপ্ত, মহেন্দ্র গুপ্ত ও প্রবোধবন্ধু অধিকারী।
শিশিরকুমার ভাদুড়ী ছাড়া এ যুগের প্রথিতদশা অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন নরেশ মিত্র, অহীন্দ্র চৌধুরী, দানীবাবু, রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায়, যোগেশ চৌধুরী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তুলসী চক্রবর্তী, রবি রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, জহর গাঙ্গুলী, ছবি বিশ্বাস, ভূপেন রায়, রঞ্জিৎ রায়, মহেন্দ্র গুপ্ত, উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, রবি ঘোষ, বসন্ত চৌধুরী, তারাকুমার ভাদুড়ী, বিশ্বনাথ ভাদুড়ী ও আরও অনেকে।
আর এ-যুগের প্রখ্যাতা অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন প্রভাদেবী, কঙ্কাবতী, তারাসুন্দরী, আশ্চর্যময়ী, সরযূদেবী, ইন্দুবালা, নীহারবালা, নিভাননী, রাজলক্ষ্মী, শেফালিকা, মলিনাদেবী, অপর্ণাদেবী, শান্তি গুপ্তা, শিপ্রা মিত্র, জ্যোৎস্না বিশ্বাস, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুতপা চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়, মাধবী চক্রবর্তী, কাননবালা, নীরদাসুন্দরী, নরীসুন্দরী, তৃপ্তি মিত্র ও আরও অনেকে।
১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপিত হয়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত, এই ১১৫ বৎসর সময়কালের মধ্যে রঙ্গালয়ের ইতিহাস নানা বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মালিকানা স্বত্ব ও পরিচালনার কর্তৃত্ব নিয়ত পরিবর্তিত হয়েছে। রঙ্গমঞ্চের আলো একবার জ্বলেছে, আবার একবার নিভেছে। যাঁরা থিয়েটার চালিয়েছেন তাঁরা কেউই ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি। মাত্র সলিল মিত্রের কর্তৃত্বে স্টার থিয়েটার (আর্ট থিয়েটার) ৩৩ বছর ও উপেন্দ্রকুমার মিত্রের অধীনে মিনার্ভা থিয়েটার ২২ বছর কোনরকমে একটানা তাদের জীবন অতিবাহিত করেছে। তা না হলে বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চের মালিকানা স্বত্ব অনবরত বদলেছে। কিন্তু তারই অন্তরালে ঘটেছে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। থিয়েটারে নাটক অভিনয় দেখবার জন্য দর্শকবৃন্দের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ। থিয়েটারে নাটক অভিনয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী আবির্ভূত হয়েছে— চলচ্চিত্র ও যাত্রাভিনয়। কিন্তু তাতে থিয়েটারের দর্শকদের ভীড় কমে নি। গোড়ার দিকে ভদ্রসমাজ থিয়েটারকে অশ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখত। কুলবধূরা তো কখনও থিয়েটারে যেতেন না। গিরিশচন্দ্রই প্রথম তাঁদের জন্য স্টার থিয়েটারে চিক দিয়ে ঘেরা স্বতন্ত্র আসনের ব্যবস্থা করেন। শিশিরকুমারের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত থিয়েটারের দর্শকবৃন্দ অধিকাংশই আসত হাট-বাজার থেকে। শিশিরকুমারের আবির্ভাবের পর থেকেই ভদ্র ও শিক্ষিতসমাজ থিয়েটারের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তখন থেকেই থিয়েটার অসাধারণ জনসমাদর লাভ করে। শুধু তাই নয়, আগে অভিনেত্রীদের সংগ্রহ করা হত শহরের রূপজীবী মহল থেকে। আজ তা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। ভদ্র পরিবারের মেয়েরা বিনা দ্বিধায়, বিনা সঙ্কোচে ও সানন্দে নাটক অভিনয়ে অংশগ্রহণ করছে। তা ছাড়া, অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বিলুপ্ত হবার পর, অগণিত শৌখিন নাট্যগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে। রাজ্য সরকার তাদের উৎসাহ দিচ্ছেন ‘রাজ্য নাট্যোৎসব’ আয়োজন করে। ১৯৮৬ সালের অনুষ্ঠানে অভিনয় করল পঞ্চাশের ওপর নাট্যসমাজ। এছাড়া বামফ্রন্ট সুরমা মঞ্চ স্থাপন করেছে, দক্ষিণ কলকাতায় ‘শিশির মঞ্চ’ ও উত্তর কলকাতায় ‘গিরিশ মঞ্চ’। আজ স্কুল, কলেজ, অফিস, ক্লাব সকলেই একটা করে নাট্যসমাজ গড়ে তুলেছে। শহরে যে সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় তার শেষে নাট্যাভিনয়ের আয়োজন। ইদানীংকালের আরও এক বৈশিষ্ট্য গ্রুপ থিয়েটার ও অনুরূপ সংস্থাসমূহ কর্তৃক মুক্ত অঙ্গ নে অভিনয়। বাঙালী যে নাটকপাগল, তা এসব থেকেই প্রমাণিত হয়। একসময় গিরিশচন্দ্র স্বপ্ন দেখেছিলেন—‘কালে অভিনয়কার্যের গরিমা প্রকাশ পাইবে এবং সর্বসাধারণ নটের আদর করিবে।’ গিরিশের সে স্বপ্ন আজ সফল হয়েছে। জীবনসংগ্রামের নানারকম সমস্যায় জর্জরিত আজকের মানুষ। আজকের নাটক সে সমস্যা রূপায়িত করে মানুষকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছে।