কলকাতার ঠাকুর রামকৃষ্ণ
ঠাকুর রামকৃষ্ণ কলকাতারই মানুষ হতেন, যদি না আপতিকভাবে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে পড়তেন।
ছেলেবেলাতেই বাবা মারা যান। জ্যেষ্ঠ রামকুমার সংসারের অনটন অবস্থায় বিব্ৰত হয়ে কলকাতায় আসেন, একটা টোল খুলবেন বলে। সঙ্গে নিয়ে আসেন ছোটভাই গদাধরকে। ওকে দিয়ে যজমানদের পূজা-আসা করাবেন। তাতে আয় কিছু বাড়বে। গদাধরের বয়স তখন ষোল কি সতেরো।
প্রথম এসে ওঠেন সুরতিবাগানে। তারপর যান ঝামাপুকুরে। ‘সেখানেই টোল স্থাপন করেন। গদাধর ঝামাপুকুরের মিত্তিরদের বাড়ি পূজা-আম্রা করতে থাকে।
কলকাতার পণ্ডিতসমাজে তখন উঠেছে এক ঝড়। জানবাজারের রানী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে প্রতিষ্ঠা করেছেন মা ভবতারিণীর মন্দির। ঠিক করেছেন সেখানে মাকে অন্নভোগ দেবেন। পণ্ডিত সমাজ বলে উঠল, শূদ্রাণীর অধিকার নেই অন্নভোগ দেবার! কেউই মন্দিরের পূজারী হতে চাইল না।
রামকুমার বিধান দিলেন, রানী যদি তাঁর গুরুদেবের নামে মন্দির উৎসর্গ করেন, তবে তাঁর মন্দিরে অন্নভোগ নিশ্চয়ই হতে পারবে। রানী তাই-ই করলেন। কিন্তু পূজার ব্যাপারে তাঁর গুরুবংশের শাস্ত্রজ্ঞান সম্বন্ধে রানীর কোন আস্থা নেই। রামকুমারই পূজারী হলেন। চলে এলেন দক্ষিণেশ্বরে। সঙ্গে এল গদাধর।
মন্দিরের পরিচালনার ভার ন্যস্ত হয়েছে রানীর জামাই মথুর বিশ্বাসের ওপর। গদাধরের মধ্যে তিনি পেলেন অলৌকিক শক্তির সন্ধান। কিছুদিন পরে রামকুমারের মৃত্যু হলে, গদাধরই নিযুক্ত হ’ল মায়ের মন্দিরের পূজারী।
গদাধর মন্তর-উত্তরের ধার ধারে না। নিজের ইচ্ছামত মাকে সাজান। মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। মাকে নিবেদন করবার আগেই নিজে মায়ের ভোগ খেয়ে ফেলেন। রানী একদিন মাকে দর্শন করবার জন্য মন্দিরে এসেছেন। ঠাকুর রানীকে মেরেই বসলেন এক চড়। বললেন, মায়ের কাছে এসেও বিষয়-সম্পত্তির কথা ভাবছিস্। রানী মুগ্ধ। জামাই মথুরও তাই।
হিন্দু স্কুলে মথুরের সহপাঠী ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেবেন্দ্রনাথ তখন মহর্ষি একদিন গদাধর (ঠাকুর রামকৃষ্ণ) মথুরকে ধরে বসল, মহর্ষির কাছে নিয়ে চল। মথুরের সঙ্গে একজন খালি গায়ে আগত ব্যক্তিকে দেখে মহর্ষি তো হতভম্ব। তারপর মুগ্ধ ঠাকুরকে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন আগামী মাঘোৎসবের অনুষ্ঠানে।
অনেকদিন পরের কথা মথুর তখন গত হয়েছেন। রামকৃষ্ণ চলেছেন -ম’র সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বাড়ি। বিদ্যাসাগর অভ্যর্থনা করে পরম সমাদরে ঠাকুরকে নিয়ে গিয়ে বসালেন তাঁর দোতলার বসবার ঘরে। ঠাকুর বললেন, আজ সাগরে মিললাম। এতদিন খালবিল, হদ্দ নদী দেখেছি। এইবার সাগর দেখছি। বিদ্যাসাগর সহাস্যে বলছেন তবে নোনাজল খানিকটা নিয়ে যান। ঠাকুর বলছেন, না গো। নোনা জল কেন? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও। তুমি ক্ষীরসমুদ্র। তুমি বিদ্যাদান করছো, অন্নদান করছো। এসব তো নিষ্কাম কাজ। এসব কাজ করলেই তো ভগবান লাভ হয়। আর তুমি তো সিদ্ধ আছোই। বিদ্যাসাগর বললেন, সিদ্ধ কি রকম? ঠাকুর বললেন। আলু, পটল, সিদ্ধ হলে তো নরম হয়, তুমি তো খুব নরম। তোমার এত দয়া। বিদ্যাসাগর বললেন, মশাই কলাই-বাটা তো সিদ্ধ হলে শক্তই হয়। ঠাকুর বলছেন, তুমি তা নয় গো। শুধু পণ্ডিতগুলো দরকচা পড়া। না এদিক, না ওদিক। শকুনি খুব উঁচুতে ওঠে, কিন্তু তার নজর থাকে ভাগাড়ে। যারা শুধু পণ্ডিত, শুনতেই পণ্ডিত, কিন্তু তাদের কামিনীকাঞ্চন আসক্তি—শকুনির মত পচা মড়া খুঁজে বেড়ায়। আসক্তি অবিদ্যার সংসারে। দয়া, ভক্তি, বৈরাগ্য বিদ্যার ঐশ্বর্য। ব্রহ্মবিদ্যাও অবিদ্যার পার। তিনি মায়াতীত। ব্রহ্ম যে কি, মুখে বলা যায় না। সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে। বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, ষড়দর্শন, সব এঁটো হয়ে গেছে। মুখে পড়া হয়েছে, মুখে উচ্চারণ করা হয়েছে—তাই এঁটো হয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস কেবল এঁটো হয়নি, উচ্ছিষ্ট হয়নি, সে জিনিসটা হচ্ছে ব্রহ্ম। ব্রহ্ম যে কি, আজ পর্যন্ত কেউ মুখে বলতে পারেনি। বিদ্যাসাগর বললেন, বা, এটি তো বেশ কথা। আজ একটি নতুন কথা শিখলাম ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হয়নি।
গিরিশ ঘোষ তখন নাট্যজগতের মধ্যাহ্ন গগনে। শুনেছেন এক পরমহংস আসছেন বোসপাড়ার দীননাথ বসুর বাড়িতে। কৌতূহলবশত দেখতে গেছেন। গিরিশ লিখেছেন— “তথায় শ্রদ্ধার পরিবর্তে অশ্রদ্ধা লইয়া আসিলাম’। বহুবার তাঁকে ব্যঙ্গও করেছেন। তারপর গিরিশ পরমহংসদেবকে দেখলেন বলরাম বসুর বাটিতে, মধু রায়ের গলিতে রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে। গিরিশের যে কি হল, সে গিরিশ জানে। গিরিশ ঠাকুরের পরম ভক্ত হয়ে উঠল। দক্ষিণেশ্বরে ছোটে দিনের পর দিন। গিরিশ লিখেছেন,——আমি পতিত, কিন্তু ভগবানের অপার করুণা, আমার কোন চিন্তার কারণ নেই। জয় রামকৃষ্ণ’। এরপর ঠাকুর এসেছেন গিরিশের বাড়িতে। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ এপ্রিল তারিখে। ঠাকুরকে নিয়ে গিরিশ সেদিন উৎসব করছেন। অনেক জ্ঞানী-গুণী লোকের সেদিন সেখানে সমাগম হয়েছে। কীর্তন চলেছে। গিরিশ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করছে, মহাশয় একাঙ্গী প্রেম কাকে বলে? ঠাকুর বলছেন, একাঙ্গী কিনা, ভালবাসা একদিক থেকে। যেমন মতী। কৃষ্ণসুখে সুখী, তুমি সুখে থাক, আমার যাই হোক।
ওই সালেরই ১ সেপ্টেম্বরের কথা। গিরিশ কাঁদতে কাঁদতে দক্ষিণেশ্বরে এসে উপস্থিত। গিরিশ হাতজোড় করে ঠাকুরকে বলছে, তুমিই পূর্ণব্রহ্ম, তা যদি না হয়, সবই মিথ্যা। বড় খেদ রইল তোমার সেবা করতে পেলুম না। ভগবন্ তুমি আমাকে পবিত্রতা দাও যাতে কখনও একটু পাপচিন্তা না হয়। ঠাকুর বলছেন—তুমি পবিত্র তো আছোই— তোমার যে বিশ্বাসও ভক্তি।
মহেন্দ্রলাল সরকার মস্ত বড় বিজ্ঞানী। খ্যাতনামা চিকিৎসকও বটে। তিনিই ঠাকুরের শেষদশায় চিকিৎসা করেছিলেন। ঠাকুরের ঐশ্বরিক শক্তিই তাঁকে ঠাকুরের কাছে টেনে এনেছিল।
ঠাকুর কলকাতায় এসেছিলেন তিনবার থিয়েটার দেখতে। তিনবারই স্টার থিয়েটারে প্রথমবার “চৈতন্যলীলা’ দেখতে ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৪ সালে। দ্বিতীয়বার ওই সালের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ দেখতে। আর তৃতীয়বার ওর পরের সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘বৃষকেতু’র অভিনয় দেখতে। ঠাকুর এমনই অলৌকিক শক্তি যে ‘চৈতন্যলীলা’র অভিনয়ের সময় নটী বিনোদিনী হবিষ্যান্ন করত। থিয়েটার দেখবার দু’বছর আগে ১৮৮২ সালে ১৫ নভেম্বর ঠাকুর কলকাতায় উইলসনের সার্কাস দেখতেও এসেছিলেন।
দাদা রামকুমারের সঙ্গে ঠাকুর যখন প্রথম কলকাতায় আসেন, তখন তিন-চার বৎসর তিনি কলকাতারই অধিবাসী ছিলেন। তাঁর তিরোধানের শেষের কয়েক বছরও তিনি কলকাতায় অনবরত এসেছেন। এ যেন কল্লোলিনী কলকাতার তাঁর প্রতি আবেদন ও আহ্বান।
কলকাতায় তিনি এসেছেন ঠনঠনিয়ার ঈশান মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি, শ্যামপুকুরে প্রাণকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও ‘শ্রী-ম’র বাড়ি। অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ি, সিমুলিয়ায় মধু রায়ের গলিতে রামচন্দ্র দত্তের বাড়ি, কেশব সেনের কমল কুটিরে, শোভাবাজারের বেনেটোলায় অধর সেনের বাড়ি (এখানেই বঙ্কিমচন্দ্র ঠাকুরকে দেখতে এসেছিলেন; ঠাকুর বঙ্কিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তুমি যে বঙ্কিম বা বাঁকা গো; বঙ্কিম বলেছিলেন, সাহেবের জুতায়; ঠাকুর বলেছিলেন, না গো না, তুমি কৃষ্ণপ্রেমে বঙ্কিম বা বাঁকা), পাথুরিয়াঘাটায় যদু মল্লিকের বাড়ি, খেলাত ঘোষের বাড়ি, বাগবাজারে নন্দলাল বসুর বাড়ি ও ওই বাড়ির নিকটে এক বিধবা ব্রাহ্মণীর বাড়ি, মনোমোহনের বাড়ি, সিমুলিয়ায় রাজমোহনের বাড়ি ও বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়ি। বলরাম ভবনে ঠাকুর বহুবার এসেছেন। এছাড়া, তিনি সিন্দুরিয়াপটির ব্রাহ্ম সমাজ, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ, নন্দনবাগান ব্রাহ্ম সমাজ ও সিঁথির ব্রাহ্ম সমাজেও এসেছেন। আরও এসেছেন, মারোয়াড়ি ভক্তমন্দিরে, কাঁসারিপাড়ার হরিভক্তি প্রদায়িনী সভায় ও গরাণহাটায় ষড়ভুজদর্শনে। কাশীপুরের উদ্যানবাটিতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করবার পূর্বে শেষের কয়েক মাস পীড়িত অবস্থায় কলকাতার শ্যামপুকুরেই থেকে গিয়েছেন।