কলকাতার কি বিকল্প আছে?

কলকাতার কি বিকল্প আছে? 

প্রায় দেড়শ বছর আগের কথা। ঈশ্বর গুপ্ত কলকাতার মশামাছির উপদ্রবে বিব্রত হয়ে ব্যঙ্গ করে প্রশ্ন করেছিলেন—কি সুখে আছি কলকাতায়? আজও অনুরূপ প্রশ্ন জাগে শহরবাসীর মনে। মশামাছির উৎপীড়ন, এখনও আছে। সেজন্য মনে হয় কি সুখে আছি কলকাতায়? 

কলকাতার মানুষ যে সুখে আছে, তার কারণ অনেক। কলকাতা এক বিরাট কর্মশালা। হাজার হাজার লোকের এটা কর্ম নিযুক্তির কেন্দ্র, রুজি-রোজগারের স্থান। তাছাড়া, কলকাতা আছে নানারূপ আকর্ষণ, যথা রাজভবন, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল, যাদুঘর, চিড়িয়াখানা, জাতীয় গ্রন্থাগার, বিড়লা প্ল্যানেটরিয়াম, থিয়েটার, সিনেমা ও সাস্কৃতিক সংস্থাসমূহ। সর্বোপরি কলকাতায় আছে শহীদ মিনার, যার তলায় কলকাতার জেহাদী লোকরা সমবেত হয় মিটিং করবার জন্য। এসব ছাড়াও, কলকাতায় আছে প্রশস্ত রাজপথ, যেগুলো যখন-তখন ব্যবহৃত হয় মিছিলের জলুসের জন্য। 

এক সময় কলকাতার ছিল এক অনন্যসাধারণ আভিজাত্য। কলকাতা ছিল সারা ভারতের রাজধানী। সেই মর্যাদার গুণে কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভের জন্য ছুটে আসত সিংহল, ব্রহ্মদেশ ও ভারতের নানা প্রদেশের বিদ্যায়তনসমূহ। ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে রাজধানী হিসাবে তার মর্যাদা হারালেও, বর্তমান মহানগরী গড়ে উঠেছে তার পরে। আজ কলকাতায় আছে বিশতলা-পঁচিশতলা বাড়ি। আবার কলকাতারমাটির তলায় আছে দুর্গপল্লী, পাতাল রেল ও আরও কত কি! 

কিন্তু এসবকে ম্লান করে দেয়, কলকাতা যখন অতিবর্ষণ হেতু প্লাবিত হয় বন্যার জলে। 

কলকাতার বন্যার কারণ, কলকাতা গড়ে উঠেছে কোন সুচিন্তিত পরিকল্পনা ব্যতিরেকে। যখন যা কিছু উদ্ভট ‘আইডিয়া’ কর্তৃপক্ষের মাথায় আশ্রয় নিয়েছে, তখনই তাঁরা তা রূপায়িত করবার চেষ্টা করেছেন। তার পরিণতি কি, তা একবারও চিন্তা করেননি। এই ধরুন না, লবণ হ্রদ বুজিয়ে লেক টাউন, সল্ট লেক ইত্যাদি উপনগরী তৈরি করা। এর ফলে সমগ্র পূর্ব কলকাতা বৃষ্টিতে জলবন্দী হয়ে পড়ে। তাছাড়া, কলকাতার প্রসার ঘটেছে বিপদসঙ্কুল পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে। হওয়া উচিত ছিল উত্তরদিকে, যাতে বন্যার জল সহজে ভাগীরথীতে গিয়ে পড়তে পারত। 

আগে শহর কলকাতার মধ্যে মাত্রা দু-চার জায়গা ছিল, যেখানে অতিবর্ষণ হলে বৃষ্টির জল জমত। সে জায়গাগুলোর মধ্যে ছিল ঠনঠনিয়া, লায়নস রেঞ্জ, সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যুতে দমকলের আড্ডার সামনে। আজ সাবেককালের সাহেবপাড়া ক্যামাক ষ্ট্রীটের মতো রাস্তাও বন্যায় নদী বয়ে যায়। 

যা পরিস্থিতি ঘটে তাতে সমগ্র কলকাতাই হয় জলবন্দী। জলনিকাশের যে ব্যবস্থা অবলম্বিত হয় তার ফলাফল অত্যন্ত নিদারুণ। চৌবাগার খালে পাম্প করে ফেলা কলকাতা শহরের জল নতুন করে ভাসায় তিলজলা ও তপসিয়া এলাকার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। কলকাতার জল ভাগীরথীতে ফেললে এ শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটে না। 

এটা সাধারণ বুদ্ধির ব্যাপার যে কলকাতার আজ যে হাল হয়েছে, তার একমাত্র কারণ, কলকাতায় যথোপযুক্ত পয়ঃপ্রণালীর অভাব। আজকের এ পরিস্থিতি যদি আরও দশ-পনেরো বৎসর স্থায়ী হয়, তাহলে কলকাতা ভিনিস নগরীতে পরিণত হবে। তখন কলকাতার রাস্তায় মোটরগাড়ি বা অন্য যানবাহন আর চলবে না। চলবে মাত্র নৌকা। 

কলকাতার যে মূল ও প্রধান পয়ঃপ্রণালী, তা তৈরি হয়েছিল ১৮৬৫-৭১ খ্রীষ্টাব্দ সময়কালে, তৎকালীন কলকাতার ঘরবাড়ি ও জন সংখ্যার পরিপেক্ষিতে। কলকাতায় তখন পাকাবাড়ি ছিল ১৬,০২২, আর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩,৫৪,৮৭৪। কালপ্রবাহে তা ঊর্ধ্বগতি লাভ করে ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫,৫৬,৪৭৮ বাড়িতে, আর জনসংখ্যা ৩১,৪৮,৭৪৬। তার পরের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। কিন্তু তা যে অনেক বেড়ে গেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 

মূল পয়ঃপ্রণালীর পাশে সি, এম, ডি-এ সহচরী পয়ঃপ্রণালীর জন্য নল বসিয়েছে। কিন্তু তা যে কিছুই নয়, তা আজকের বন্যাবিধ্বস্ত কলকাতা প্রমাণ করছে। 

কলকাতার গঙ্গায় চড়া পড়ছে। লবণ হ্রদ বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে, কলকাতার আশপাশের খালগুলো মজে গিয়েছে, কলকাতার জলনিকাশের সব পথই আজ রূদ্ধ। কলকাতার আজ যে অবস্থা হয়েছে, মনে হয় কর্তাব্যক্তিরা তিন পুরুষ ধরে চিন্তা করলেও তার কোন সমাধান করতে পারবেন না। এটা একমাত্র তাঁদের দূরদর্শিতার অভাবের জন্যই ঘটেছে। 

জন্মসূত্রে কলকাতা গড়ে উঠেছিল বন্দর শহর হিসাবে। আজ কলকাতা তার সে মান আর রাখতে পারেনি। বন্দর শহরের প্রধান প্রয়োজন নদীর নাব্যতা রক্ষা করা। ভাগীরথীর নাব্যতা আমরা ক্রমশই খর্ব করেছি। ইংরেজ আমলে ভাগীরথীতে নিয়মিত পলি উত্তোলন করা হত। আজ আর যথাযথভাবে তা করা হয় না। যার ফলে বাগবাজারের সামনে গঙ্গায় চড়া পড়তে শুরু করেছে। 

আমরা কলকাতার নাব্যতা পুনরুদ্ধারের পরিবর্তে বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছি হলদিয়ায় বিকল্প বন্দর তৈরির কাজে। কিন্তু হলদিয়া কোনদিনই বন্দর হিসাবে কলকাতা বন্দরের প্রাচীন গৌরব দাবি করতে সক্ষম হবে না। 

কলকাতার বিকল্প নেই। বন্দর শহর ছাড়া, বৃহত্তর কলকাতা শিল্পনগরীও বটে। সেজন্য জ্বালানী হিসাবে কয়লার সান্নিধ্যের জন্য আসানসোল অঞ্চলে আমরা বিকল্প কলকাতা নির্মাণের কথাও চিন্তা করেছিলাম। তারই পদক্ষেপে দুর্গাপুর ইস্পাতনগরী গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেও কলকাতার বিকল্প হিসাবে কোন বন্দর শহর ও শিল্পনগরী ছাড়া, কলকাতা জনবহুল শহরও বটে। সেজন্য কলকাতার জনবাহুল্য হ্রাস করবার জন্য আমরা কলকাতার আশেপাশে বা সন্নিকটে সহচরী-নগর নির্মাণকার্যও শুরু করেছিলাম। কিন্তু কল্যাণীর বিফলতা ও ব্যর্থতা কর্তৃপক্ষকে নিবৃত্ত করেছে, বেশিদূর অগ্রসর হওয়া থেকে। সল্ট লেক সিটিও আমরা তৈরি করেছি, কিন্তু পূর্ব কলকাতার হাল দেখে মনে হয় যে আগামী দশ-পনেরো বছরের মধ্যে এটাও বন্যা কবলিত হবে। 

কলকাতা হচ্ছে কলকাতাই। এর বিকল্প নেই। সেজন্য কলকাতাকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কি করে কলকাতাকে সাময়িক বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে; সেটাই সরকারের চিন্তা ভাবনা করা উচিত। 

একটা প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। সেটা হচ্ছে কলকাতার প্রতি অঞ্চলে একটা করে পাম্পিং স্টেশন স্থাপন করে ও সঙ্গে সঙ্গে ভাগীরথী ও চিৎপুর-বেলিয়াঘাটা খাল ও বিদ্যাধরী ও কেষ্টপুরের খালের সংস্কার করে কলকাতার জলনিকাশের কোন ব্যবস্থা করা যেতে পারে কিনা, সে বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *