কলকাতার আদিরূপ
এটা গালগল্প নয়, নিছক ঐতিহাসিক সত্য যে, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র বাড়িখানা যে ভূমিখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তারই তলদেশ দিয়ে একসময় প্রবাহিত হত কলকাতার প্রাচীন খালটা। ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জোব চার্ণক যখন প্রথম সুতানটিতে এসে অবতরণ করেন তখন এ খালটা তো ছিলই, পরবর্তীকালেও ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিউ সেক্রেটারিয়েট বিলডিং-এর নিকট ভাগীরথী থেকে নির্গত হয়ে খালটা হেস্টিংস স্ট্রীটের ওপর দিয়ে এগিয়ে এসে বর্তমান কলকাতা রেজিস্ট্রি অফিসের কাছে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে পূর্বদিকে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ অফিস, চাঁদনী চকের উত্তর, ওয়েলিংটন স্কোয়ার ও ক্রীক রো ধরে শিয়ালদহ-বৌবাজারের কাছে লবণ হ্রদে গিয়ে পড়ত। কলকাতার প্রাচীন মানচিত্র থেকে খালটার এই গতিপথ নির্ণয় করা হয়েছে। নিউ সেক্রেটারিয়েট বিলডিং- এর সামনে খালটার উত্তরদিকে শেঠ-বসাক পরিবারের রাসবিহারী শেঠের বাড়ি ছিল। ক্রীক রো অঞ্চলের বাসিন্দারা ওই খালটার জল ব্যবহার করত। ওই খালটায় নামবার জন্য অনেক বাড়ির সঙ্গে সংলগ্ন যে সিঁড়ি ছিল, তার ভগ্নাবশেষ বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত কলকাতার প্রাচীন লোকরা দেখেছে।
ওই খালটা রীতিমত নাব্য ছিল, কেননা সমসাময়িক বিবরণীতে আমরা পড়ি – ‘large boats could come up it’. ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের ঝড়ে এই খালটায় অনেক বড় বড় নৌকা ডুবে গিয়েছিল, যা থেকে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দক্ষিণ অঞ্চলের নাম হয়েছিল ‘ডিঙ্গাভাঙ্গা’।
খালটা লবণ হ্রদে যেখানে গিয়ে পড়েছিল, সেখানেই ছিল বৈঠকখানার সেই পৌরাণিক বৃক্ষটি, যার তলায় বলা হয় জোব চার্ণক বসে তামাক খেতেন। তা থেকেই নাকি জায়গাটার নাম হয়েছিল বৈঠকখানা। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দেও গাছটা ছিল এবং ১৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দে আপজনের মানচিত্রে জায়গাটা দেখানো হয়েছে।
এই সম্পর্কে যে প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবে মনে জাগে, তা হচ্ছে সুতানটি-হাটখোলা থেকে জোব চার্নক। শিয়ালদহ-বৌবাজারের মোড়ে লবণহ্রদের ধারে গাছতলায় কেন তামাক খেতে যেতেন? কলকাতার কোন ইতিহাসকারই এ প্রশ্নের উত্তর দেন নি। সেজন্য মনে করি এ প্রশ্নটার উত্তর এখানে দেওয়া প্রয়োজন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষমুহূর্ত পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের পণ্যবাহী নৌকাসমূহ লবণ হ্রদ অতিক্রম করেই কলকাতায় আসত। ভেবে নেওয়া যেতে পারে যে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতেও তাই করত। এই সব পণ্যবাহী নৌকাসমূহ কলকাতার ওই প্রাচীন খাল দিয়েই ভাগীরথীতে এসে পড়ত এবং বেতোরের পর্তুগীজ বণিকদের কাছে তাদের মাল বেচত। ইংরেজরা কলকাতায় আসবার পরেও তারা ওই পথেই কলকাতায় আসত। খানিকটা পথ এগিয়ে গিয়ে সস্তায় মাল গস্ত করা যাবে বলেই, জোব জাৰ্ণক বোধহয় বৈঠকখানার ওই গাছতলায় বসে তামাক খেতেন ও মাল গস্ত করতেন। এটাই মনে হয় এই ঘটনার সহজ ব্যাখ্যা।
ভাগীরথীর যেখান থেকে খালটা শুরু হয়েছিল, তারই দক্ষিণে খালটার অপর পারে ছিল শেঠ-বসাকদের আবাদভূমি ও তাঁতশালা। তার পূর্বদিকে ছিল চৌরঙ্গীর বিরাট জঙ্গ ল। এই জঙ্গলের ভিতর দিয়েই ছিল কালীঘাটে তীর্থযাত্রীদের যাবার পায়ে হাঁটা পথ। ১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দে হলওয়েল এই রাস্তার উল্লেখ করেছেন।
বোধ হয় ১৭৩৭ খ্ৰীষ্টাব্দের ঝড়ের পর খালটা ভাঙ্গা ডিঙ্গিতে ভরতি হয়ে যাবার পর ওটা অনাব্য হয়ে পড়ে। তখনই খালটাকে বুজিয়ে ফেলা হয়। খালটা বুজিয়ে ফেলবার পর এর পাশের অঞ্চলেই কলকাতার ব্যবসাপাড়া গড়ে ওঠে। বর্তমান বেটিঙ্ক স্ট্রীটের তখন নাম ছিল কসাইটোলা। এটা বিস্তৃত ছিল ধর্মতলা স্ট্রীটের মোড় থেকে লালবাজারের মোড় পর্যন্ত। এই রাস্তার ওপর অনেকগুলি মাংসের দোকান ছিল, সেজন্যই এটাকে কসাইটোলা বলা হত।
কিন্তু শীঘ্রই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কসাইটোলাই কলকাতার বড় ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়। কারণটা আর কিছুই নয়। আগে খালটা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল গোবিন্দপুরকে। গোবিন্দপুরে খালটার উত্তরদিক পর্যন্তই ছিল লোকালয়। লালদিঘির দক্ষিণে যেখানে এখন টেলিগ্রাফ অফিস অবস্থিত ওখানে একটা বাড়ি ছিল, যে বাড়িতে কোম্পানির ক্যালিকো প্রিন্টাররা বাস করত। এর আশেপাশে আরও কতকগুলো মাটির ঘর ও পাকা বাড়ি ছিল ও একটা পুষ্করিণী ছিল। ওর পূর্বদিকে ছিল কলেট সাহেব ও কর্নেল স্কটের বাড়ি। পশ্চিমে খানিকটা উঁচু ডাঙ্গা ছিল। তারপর ছিল বেলামী সাহেবের বাড়ি ও কোম্পানির আস্তাবল। আস্তাবলের পশ্চিমে ছিল ক্যাপটেন র্যানী, ক্যাপটেন ক্লেটন, মিস্টার উডও মিস্টার স্মিথের বাড়ি। তারপর ছিল হাসপাতাল ও বারুদখানা ও তার পশ্চিমে ছিল কলকাতার প্রাচীন কবরস্থান। এখানেই পরে সেণ্ট জন চার্চ স্থাপিত হয়। এখন যেখানে মেটকাফ হল, ওখানে শেঠদের এক আবাসবাটী ছিল। এটা কোম্পানির প্রধান দালাল রামকৃষ্ণ শেঠের বাস্তুভিটা। তখন ওটা ভাড়া দেওয়া ছিল আরমতি সাহেবকে। রামকৃষ্ণ শেঠের বাড়ির দক্ষিণে ছিল রাসবিহারী শেঠও তার ভাইদের পরিত্যক্ত বাড়ি। বাঁকশাল স্ট্রীটও হেস্টিংস স্ট্রীটের (তার মানে খাল ধারে) মধ্যে কলকাতার জমিদার হলওয়েল সাহেবের দুখানা বাড়ি ছিল।
এই হচ্ছে খালধারের উত্তদিকের চেহারা। এবার দক্ষিণ দিকের চেহারাটা দেখা যাক। খালের ওপারে (তার মানে দক্ষিণ দিকে।) শেঠ-বসাকদের আবাদভূমি ও তাঁতশালা ছাড়া, সমস্ত চৌরঙ্গী অঞ্চলটা ছিল বনজঙ্গলে আবৃত। ওই জঙ্গলের মধ্যে ছিল এক সাধুর আশ্রম ও মন্দির যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল চেতুয়া বরদার বিতাড়িতা রানী অজিতাসুন্দরী।
খালটা বুজিয়ে দেবার পর, এই দুই অঞ্চলের মধ্যে আর কোন বিচ্ছিন্নতা রইল না। কলকাতার সঙ্গে চৌরঙ্গী অঞ্চল একাকার হয়ে গেল। ওই সময় থেকেই চৌরঙ্গীর জঙ্গ লটা পরিষ্কার করা শুরু হয়। সমসাময়িক বিবরণী থেকে আমরা জানতে পারি যে চৌরঙ্গ পী অঞ্চলে দু-একখানা বাড়িও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ ময়দানে নূতন দুর্গও নির্মাণ হয়ে গিয়েছিল। শহর এইভাবে দক্ষিণে এগিয়ে যাওয়ার ফলে সাহেবপাড়া এগিয়ে এল চীনাবাজার অঞ্চল থেকে কসাইটোলা পর্যন্ত। কসাইটোলার বড় রাস্তা ছাড়া, আশপাশের অলিগলিগুলোতেও লোক বসবাস করতে শুরু করে দিল। সুতরাং নূতন সাহেবপাড়াকে কেন্দ্র করে কসাইটোলাতে যে একটা ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে উঠবে, তাতে কোন বিচিত্রতা নেই। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে খবরের কাগজে যে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বেরুত, তা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে কসাইটোলায় নানারকম দোকান প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দের এক বিজ্ঞাপনে দেখি ৫১নং কসাইটোলায় পিটার অগিয়ার অ্যাণ্ড বাটলার বন্দুকের কারবার করছে। এই কারবারটা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ পর্যন্ত চালু ছিল। ১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে চার্লস বেনেট নামে এক ব্যক্তি মেয়েদের কেশবিন্যাসের জন্য ১০নং ম্যাঙ্গো লেনে এক দোকান খুলছেন। ম্যাঙ্গো লেনের জন মরিস নামে এক ব্যক্তি নীলচাষের অভিজ্ঞতা নিয়ে চাকুরীর সন্ধান করছেন। ৩৩নং কসাইটোলায় আলেকজাণ্ডার ওয়াট নামে এক ব্যক্তি জুতার দোকানের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।
এই সময় এসপ্ল্যানেড (এসপ্ল্যানেড তখন নূতন দুর্গের প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল) সাহেব-মেমেদের বেড়াবার স্থান ছিল। ১৭৯২-৯৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত আপজনের কলকাতার মানচিত্রে পরিদৃষ্ট হয় যে কাউনসিল হাউস স্ট্রীট তখন তৈরি হয়ে গেছে এবং পশ্চিমদিকে ওরই সমান্তরাল রাস্তার ওপর অবস্থিত ছিল পুরানো পোস্ট অফিস। সেজন্যই ওই রাস্তাটার নাম এখনও ওলড পোস্ট অফিস স্ট্রীট। কাউনসিল হাউস স্ট্রীটের শেষে এখন যেখানে ট্রেজারী বিলডিং ওখানেই ছিল গভর্ণরের বাড়ি। এক কথায় খালধার আর খালধার ছিল না, হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাহেব-সুবো ও গভর্নরের নিবাস-স্থল। বর্তমান রাজভবন তৈরী করেছিলেন ১৮০৩ খ্রীষ্টাব্দে মারকুইস অভ ওয়েলেসলী। ওয়েলেসলীর বক্তব্য ছিল :—‘India should be governed from a palace and not from a counting house, with the ideas of a prince, not with those of a retail dealer in muslins and indigo’.