1 of 2

কলকাতায় সতীদাহ

কলকাতায় সতীদাহ 

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার কথা। সহমরণের জন্য রামমোহনের স্বস্তি নেই। অনুমৃতাদের ধোঁয়ায় কলকাতার আকাশ-বাতাস কলুষিত হয়ে গেছে। কলকাতায় যত সতীদাহ হয় আর কোথাও তত হয় না। সমসাময়িক সরকারী নথীপত্রে দেখি ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে (তার মানে রামমোহন আসবার পরের বছরে) কলকাতায় ২৫৩ জন সহমৃতা হয়েছিল, ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে ৪৪১ জন। এ যেন নিষ্ঠাবান সমাজের জিদের জন্য কলকাতায় অনুমৃতার সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে! 

কলকাতাতেই যে সবচেয়ে বেশি অনুমৃতা হত, তা নীচের তালিকা থেকে বুঝতে পারা যাবে— 

ঢাকা 

১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে ৩১ 

১৮১৬ খ্রীঃ ২৪ 

১৮১৭ খ্রীঃ ৫২ 

মুরশিদাবাদ 

১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে ১১ 

১৮১৬ খ্রীঃ ২২ 

১৮১৭ খ্রীঃ ৪২ 

পাটনা 

১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে ২০ 

১৮১৬ খ্রীঃ ২৯ 

১৮১৭ খ্রীঃ ৩৯ 

বেনারস 

১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে ৪৮ 

১৮১৬ খ্রীঃ ৬৫ 

১৮১৭ খ্রীঃ ১০৩ 

বেরেলী 

১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে ১৭ 

১৮১৬ খ্রীঃ ১৩ 

১৮১৭ খ্রীঃ ১৯ 

রামমোহন গোড়া থেকেই উপলব্ধি করেছিলেন যে নিষ্ঠাবান সমাজের বিরোধিতা, দেশবাসীর কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও মানসিক জড়তা মাত্র লেখালেখি করেই দূর করা যাবে না। কেননা, সহমরণ কলকাতায় পরবর্তী দশকেও চলতে থাকে। সমসাময়িক সংবাদপত্রসমূহ থেকে আহরণ করে দু’একটা সমাচার আমরা এখানে দিচ্ছি। ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ নভেম্বর তারিখের সংবাদ পত্রে আমরা পড়ি—‘কমলাকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তি কুলীন ব্রাহ্মণ সর্বসুদ্ধা বত্রিশটি বিবাহ করিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে তাঁহার জীবদ্দশাতেই দশ স্ত্রী লোকান্তরগতা হইয়াছিল। বাইশ স্ত্রী বর্তমান ছিল। তাহার মধ্যে কেবল দুই স্ত্রী তাঁহার বাটীতে ছিল। আর সকলে স্ব স্ব পিত্রালয়ে ছিল। ২১ কার্তিক বুধবার ঐ চট্টোপাধ্যায় পরলোক প্রাপ্ত হইলে তাঁহার সকল শ্বশুর বাটীতে অতি ত্বরায় তাঁহার মৃত্যু সম্বাদ পাঠান গেল। তাহাতে কলিকাতার এক স্ত্রী ও বাঁশবেড়িয়ার এক স্ত্রী ও নিকটস্থা দুই স্ত্রী এই চারিজন সহমরণোদ্যতা হইল। পরে সেখানকার দারোগা এই বিষয় সদরে রিপোর্ট করিয়া সদর হইতে হুকুম আনাইতে দুই দিবস গত হইল। পরে২৩ কার্তিক শুক্রবার তৃতীয় দিবসের মধ্যাহ্নকালে হুকুম আইলে ঐ চারিজন পতিব্রতা সহমরণ করিয়াছে।’ 

আবার ১৮২৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৭ আগস্টতারিখের সংবাদপত্রে পড়ি ‘সিমলা নিবাসী ফকিরচন্দ্র বসু ১ ভাদ্র সোমবার ওলাউঠা রোগে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন। ইহার বয়ঃক্রম প্রায় ৩৬ বৎসর হইয়াছিল। তাহার সাধ্বী স্ত্রী শ্যামবাজার নিবাসী শ্রীমদনমোহন সেনের কন্যা। তাহার বয়ঃক্রম ন্যূনাতিরেক ২২ বৎসর হইবেক এবং সন্তান হয় নাই। ঐ পতিব্রতা রাজাজ্ঞানুরোধে দুই দিবস অপেক্ষা করিয়া বুধবার প্রাতে সুরের বাজারের নিকট সুরধুনী তীরে স্বামীশবসহ জ্বলচ্চিতারোহণ পূর্বক ইহকাল পরিত্যাগ পুরঃসর পরলোক গমন করিয়াছে।’ 

আবার ১৮২৫ খ্রীষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর তারিখের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়— ‘কীর্তিচন্দ্র ন্যায়রত্ন এক সুপণ্ডিত। তিনি সংপ্রতি কোম্পানি বাহাদুর স্থাপিত সংস্কৃত কলেজে এক অধ্যাপক নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তিনি গত ২৬ আশ্বিন বুধবার ওলাউঠা রোগোপলক্ষে পরলোক গমন করিয়াছেন। তাঁহার বয়ঃক্রম অনুমান ৩৫/৩৬ বৎসর হইবেক। ইহার সাধ্বী স্ত্রী সহগমন করিয়াছেন।’ 

খবরগুলো পড়লে মনে হবে যে মেয়েরা সব স্বেচ্ছায় অনুমৃতা হত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা নয়। ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দের ৫ মে তারিখের সংবাদপত্রে যা লেখা হয়েছিল, তা থেকে তাই প্রকাশ পায়। লিখিত হয়েছিল—‘অবলা অনভিজ্ঞা স্ত্রীলোককে শাস্ত্ৰোপদেশ দ্বারা ভ্রম জন্মাইয়া এ রূপ উৎকট কর্মে প্রবৃত্ত করান সাক্ষাৎ যমদূতের ন্যায় হস্তধারণ পূর্বক ঘূর্ণপাকে সাতবার ঘুরাইয়া শীঘ্র চিতারোহণ করাইয়া শবের সহিত দৃঢ় বন্ধন পুরঃসরে জলদগ্নিতে দগ্ধকরণ ও বংশদ্বারা শবের সহিত তাহার শরীর দাবিয়া রাখন ও তাহার কথা কেহ শুনিতে না পায় এ নিমিত্তে গোলমাল ধ্বনি করণ অতি দুরাচার নির্মায়িক মনুষ্যের কর্ম। এমত বিষয়ে তাহার সাহায্যকারি ও সঙ্গিলোক সকলেই দোষী হইতেছেন। শাস্ত্রের ভালমন্দ ভগবান জানেন। আপাতত শাস্ত্ৰ দেখাইয়া এমত কর্মে প্রবৃত্ত হওন কিংবা করান বিশিষ্ট লোকের অনুচিত।’ 

হাত-পা বেঁধে ‘সতী’দের যে পুড়িয়ে মারা হত, তার উল্লেখ রামমোহন তাঁর লেখার মধ্যেও করেছিলেন। 

.

১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দের ৮ আগস্ট তারিখের সংবাদপত্রে পড়ি : ‘২৭ জুলাই ইণ্ডিয়া গেজেট নামক পত্রে এই এক অশুভ সমাচার প্রচার হইয়াছে যে গবর্ণমেণ্ট এইক্ষণে সহমরণ নিবারণের চেষ্টাতে আছেন এবং এতদ্দেশীয় এক খ্যাত ব্যক্তি সকল নগর বাসীর প্রতিনিধি হইয়া ঐ অনুচিত বিষয়ের প্রমাণ ও প্রয়োগ লিখিয়া সমর্পণ করিতে স্বীকার করিয়াছেন এবং তিনি মহামহিম শ্রীযুত গবর্ণর জেনারেল বাহাদূরের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন এবং শ্রীযুতও এই বিষয় নিবারণে নিতান্ত মান্য প্রকাশ করিয়াছেন।’ বলা বাহুল্য এই ‘খ্যাত ব্যক্তি’, স্বয়ং রামমোহন ছাড়া আর কেউই নন। এই উপলক্ষেই রামমোহন সহমরণ সম্বন্ধে ‘সহমরণ বিষয়’ আখ্যাত তাঁর শেষ নিবন্ধ লিখেছিলেন। 

রামমোহনেরই চেষ্টায় গবর্নমেণ্ট ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর তারিখে সহমরণ নিষিদ্ধ করে। এর বিরুদ্ধে ইংলণ্ড রাজার নিকট আরজি পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দের ১০ নভেম্বর তারিখের সংবাদপত্রে আমরা পড়ি—‘শ্রীল শীযুত ইংলণ্ডাধিপতি গত জুলাই মাসের একাদশ দিবস বুধবারে প্রবি কৌন্সেলে হিন্দুদের স্ত্রী দাহ বিষয়ে ভাবতবর্ষের গবর্ণমেণ্টের ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বরের আজ্ঞা গ্রাহ্য করিয়াছেন এবং এদেশের দুএকজন হিন্দু যে পুনরায় স্ত্রী দাহ হয় এজন্য আবেদন লিপি প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহা গ্রাহ্য করেন নাই।’ এরপর কলকাতায় আর সতীদাহ হয় নি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *