2 of 2

কম্পি বড় ভাল মেয়ে – সুব্রত সেনগুপ্ত

কম্পি বড় ভাল মেয়ে – সুব্রত সেনগুপ্ত

কম্পি বড় ভাল মেয়ে। তাকে যখন যা করতে বলা হয়, সে তাই করে। যা পায় তাই খায়। যা পায় তাই পরে। ভাল খাব, ভাল পরব বলে উৎপাত করে না। সে কখনও কারও সঙ্গে ঝগড়া করে না।

কম্পি বড় ভাল কিন্তু এতটা ভাল হওয়া ভাল কি না আমার মাঝে মাঝে তাতে সন্দেহ হয়। কম্পি সব সময় সত্যি কথা বলে। মানে সে যে কথাটা সত্যি বলে জানে, সেটাই বলে। যত শক্তিমান আর প্রভাবশালী লোক সম্পর্কেই হক, আসল কথা কম্পি কখনও গোপন করে না। সেজন্য কখনও যে বিপদে পড়তে হয় না তা নয়। কিন্তু সবাই জানে সত্যি কথা বলা একটা গুণ। কাজেই কল্পির গুণ স্বীকার করতেই হবে। কম্পির আরও অনেক গুণ আছে। যেমন, সময় জ্ঞান। দম না দেওয়ায় আমার হাতের ঘড়ি ভুল সময় দেখাতে পারে। কিন্তু কম্পির ভুল হয় না। সে যদি বলে ৬টার সময় আমার বাড়িতে আসবে সে ঠিক পাঁচটা বেজে ষাট মিনিটেই আসবে। কিছুতেই একষট্টি মিনিট হবে না। কি করে পারে কে জানে? হয়তো যখন আসার কথা তার আগেই সে এসে পড়ে। এসে অপেক্ষা করে তারপর সময় হতেই সামনে এসে হাজির হয়। কিন্তু যাই হোক আমি তার সঙ্গে তাল দিতে পারি না। প্রায়ই আমার দেরি হয়। নিজের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও দেখা করার থাকলে আর দেরি করে পৌঁছলে দেখি, কম্পি চলে গেছে। তখন আমার মনে পড়ে ওর ১৫ মিনিট অপেক্ষা করার কথা ছিল। ১৫ মিনিট ও নিশ্চয় ছিল। আমার তার চাইতে বেশি দেরি হয়েছে। জানা কথা ১৫-র জায়গায় ও ১৬ মিনিট কিছুতেই থাকবে না। হতে পারে, ওর হাতে তখন আর কোনও কাজ নেই। তবু ও বেশি সময় অপেক্ষা করবে না। দরকারটা ওর পক্ষে কি আমার পক্ষে যত জরুরিই হোক ও যতক্ষণ থাকার কথা তার চেয়ে বেশিক্ষণ কিছুতেই থাকবে না। এতে ওর ওপর রাগ করা যাবে না। কারণ সবাই জানে, সময়ানুবর্তিতা খুব ভাল জিনিস।

আমার কম্পি শুধু গুণে নয় রূপেও চমৎকার। তার মাথার চুল থেকে পায়ের নখে কোথাও কোনও খুঁত নেই। কম্পি রোগা নয়, মোটাও নয়। বাড়াবাড়ি রকমের লম্বা নয়, বেঁটে তো নয়ই। চমৎকার তার গলার স্বর, চমৎকার তার শরীরের গড়ন। এমন গড়ন—কোথাও এতটুকু মেদ নেই, যেখানে যে বাঁক যেভাবে থাকা দরকার ঠিক তাই আছে। তার বুক, কোমর আর কোমরের নীচের অংশের মাপের অনুপাতও ভারী চমৎকার—কিন্তু এ নিয়ে আর বেশি কিছু বলব না। শরীরের যে সব জায়গা ঢাকা থাকে তা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করলে লোকে নিন্দে করে, মন্দ বলে।

কম্পি অবশ্য তাতে কিছু বলবে না। সে কখনও কোনও রকম অভিযোগ করে না। ওকে নিয়ে এই এক সুবিধে। ও ঘ্যানর ঘ্যানর করে না। ও মন খারাপও করবে না। কম্পির কখনও সব খারাপ হয় না।

কিন্তু আমার মন, কখনও কারণে কখনও অকারণে খারাপ হয়ে যায়। তখন কি করতে হবে কম্পি জানে। ও একটা রবীন্দ্রসংগীত, একটা অতুলপ্রসাদী, দ্বিজেন্দ্র গীতি একটা রজনীকান্তের গান একটা করে জানে। তার মধ্যে নিধুবাবুর টপ্পা, ঠুংরি এমনকি একেবারে আধুনিক আছে। আমার মন খারাপ হলে কম্পি, আমি যে গানটা শুনতে চাই, সে গানটাই শোনাবে। অনেক কবিতাও ওর মুখস্থ, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ থেকেও ও অনেকটা মুখস্থ বলতে পারে।

এই আমার প্রেমিকা কম্পি। তাকে এক কথায় বলা যায়, মডেল প্রেমিকা। একটা মেয়ের যত রকম গুণ থাকতে পারে কম্পির মধ্যে তার সবগুলোই আছে।

আর একটা কথা সবার সামনে বলতে লজ্জা করছে, প্রেমে কম্পির কোনও তুলনা নেই। এখনই বহু আগে দেখা উত্তরা নামে একটা মেয়ের কথা মনে পড়ছে। তার সঙ্গে একদিন সকালে আলাপ হল। দুপুরে আমরা একসঙ্গে সিনেমা দেখতে গেলাম। বিকেলে একটা দোকানে চাইনিজ খাওয়ার পর সে ফিরে যাওয়ার আগে আড়ালে নিয়ে গিয়ে যেই তাকে একটু আদর করতে গেছি অমনি, ও কি, ও না-না করে উঠল। কোরে বাপু, তুই এতক্ষণ একটা ছেলের সঙ্গে কাটালি। দেখছিস একপা, একপা, করে দু-জন দু-জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিস। একটার পর আর একটা ঘটছে, তখন কোনও আপত্তি নেই তবে এখন না-না করা কেন? তুই জানতি না এ রকম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে? ন্যাকা! আরও অবাক কাণ্ড না-না করার পর একটু জোর করতে মেয়ে যেন গলে পড়লেন। যেন দেহে বল নেই। এ আবার কি! আমার কম্পি মোটেই এরকম নয়। তাকে আদর করার সময় সে পাল্টা আদর করতে জানে। আমি তাকে কাছে টেনে দু-হাতে জড়িয়ে ধরলে সে জানে তাকে শুধু গা ছেড়ে দিলে চলবে না। তাকেও দু-হাতে জড়িয়ে ধরতে হবে। তারপর আমি তার চমৎকার ঠোঁটে—যাক এ সব একেবারে দু-জনের কথা, অন্যের কাছে বলতে নেই।

কিন্তু কখনও কখনও কম্পিকে নিয়ে অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়। তার জন্য তাকে যে দায়ী করা যায় তা নয়। তবে অস্বস্তি অস্বস্তিই।

সেদিন লিন্ডসে স্ট্রিটে একটা দোকানে গিয়েছি কম্পিকে নিয়ে। বাছাবাছির পর একটা ম্যাক্সি ভারী পছন্দ হয়েছে। ওর হাতে দিয়ে বললাম, দেখতো, তোমাকে কেমন মানায়? আমি ভেবেছি, মেয়েরা যেভাবে কাঁধ থেকে শাড়ি ঝুলিয়ে দেখে কম্পিও তাই দেখবে। আর নেহাত পরে দেখার ইচ্ছে হলে, ওই তো ছোট্ট ট্রায়াল রুম আছে, সেখানে ঢুকে ম্যাক্সিটা পরবে। কিন্তু কম্পি এসব কিছুই না করে এক ঘর লোকের সামনে ফস করে শাড়ি খুলে ফেলে, ব্লাউজ খুলতে আরম্ভ করল। তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরে বললাম, ছিঃ করছ কী? —ও বলল, কেন তুমিই তো বললে, কেমন মানায় দেখতে? — আমি রেগে বললাম, বলেছি তো কি হয়েছে, তোমার একটুও লজ্জা নেই?

নির্বিকার মুখে কম্পি জিজ্ঞেস করল, লজ্জা কি?

মুহূর্তে আমার রাগ পড়ে যায়। লজ্জা কি তাতো কম্পি জানে না। ও লজ্জা পেতে শেখেনি। কোমল গলায় বললাম, ঠিক আছে। লক্ষ্মীটি, জামা-শাড়ি ঠিক করে নাও।

ম্যাক্সি আর কেনা হল না। কম্পি শাড়ি-জামা ঠিক করার পর ওর হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলাম।

এরকম অস্বস্তির ঘটনা আরও ঘটে। এতক্ষণে আপনারা যা ভাবতে শুরু করেছেন কম্পি কিন্তু তা নয়। সে মোটেই যন্ত্রমানবী নয়।

কম্পি রক্তমাংসের মেয়ে। তবে কম্পি একা নয়। তার মতো আরও মেয়ে আছে। ছেলেও আছে। কম্পির আগে হয়তো কম্পির মা নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করেছে। তার আগে কম্পির দিদিমা, দিদিমার মা আরও আগে। এ ভাবে ধাপে ধাপে কম্পি কম্পি হয়েছে। কম্পিরা কম্পিদের মতো। কিন্তু আমি যে আবার আমার মতো।

ও কম্পি, এসে গেছ? তোমার কথাই হচ্ছিল—এই দেখুন কম্পি এসেছে। না, ওকে হাসি মুখে নমস্কার জানাবেন না বা কি খবর-টবর জিজ্ঞেস করবেন না। ওসব ভদ্রতা-টদ্ৰতা, সৌজন্য- বিনয়ের ও ধার ধারে না। কি, কম্পি ঠিক বলেছি? আচ্ছা, উত্তর না দাও একটু হেসো না? হাসতে পয়সা খরচ হয় না।—কম্পি কি ভেবে, উত্তর দিল, খরচ না হোক অকারণে হাসব কেন?

—ওহ। তোমার সব কিছুতে একটা কারণ চাই।

—চাইব না! কারণ ছাড়া কেউ কিছু করে?

—কি জানি।

—কি জানি কেন? তোমার যত ভাবালুতা।

—হবে। আমি যা, আমি তাই। এতে আমার কোনও দোষ নেই।

—আমি অকারণে কাউকে দোষ দিই না।

—জানি।

—জান? তবে বলতো আমি যে সব বুঝে চলি, চলার চেষ্টা করি সেটা আরও খারাপ?

—খারাপ কে বলল?

—তবে ফোনে তুমি ও কথা বললে কেন? আমার জ্বর হয়েছিল সে কথা তোমাকে জানাইনি ঠিকই। কিন্তু তুমি বলো, অসুখের কথা তোমাকে জানানোর চাইতে ডাক্তারকে জানানো বেশি জরুরি কি না। আর তোমার সঙ্গে সাত দিন দেখা না হলে পাগল হতে যাব কেন? আমি বুঝব, তুমি কাজে আটকে গেছ। তোমারও সে রকম ভাবা উচিত।

—শুধু উচিত দিয়ে জীবন চলে?

—চলা উচিত। ও রকম আবেগের কোনও মানে হয় না।

—কম্পি আমি সামনের সপ্তাহে জাপানে চলে যাচ্ছি।

উদ্বেগ বা অভিমানের কোনও ছায়া কম্পির মুখে পড়ে না। স্থির চোখে সে আমার দিকে তাকায়। সহজ গলায় প্রশ্ন করে, কেন?

বলি, অফিস থেকে আমায় পাঠাচ্ছে। ওখানে একটা সমীক্ষা হবে।

কম্পি নিশ্চিন্তে বলে, ও। কত দিনের জন্য?

—ছ-সাত মাস। এক বছরও লাগতে পারে।

—কবে যাবে?

—কাল।

—ও। ঠিক আছে। আমি তা হলে চলি। পনের মিনিট সময় নিয়ে এসেছিলাম। সময় হয়ে গেছে।

ব্যাস, আর কিছু না। কম্পির চোখ ছল ছল করে না। কারণ সে বুদ্ধিমতী। শরণ সে সব কিছু বুঝে চলে। কম্পি গট গট করে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হয়, আমার থাকা, না-থাকায় ওর কিছু যায় আসে না। ওকে ডেকে বলি, জাপান থেকে আমাকে কানাডায় পাঠাতে পারে। ওখানে আমাকে স্থায়ী ভাবে রেখে দেওয়ার কথাও হচ্ছে। এখনও ঠিক হয়নি অবশ্য।

কম্পি বলে, ও। কি ঠিক হয় আমায় জানিও।

কম্পি চলে যায়। ঠিকই তো! অফিসের কাজে যেতে হবে, কাজেই বলার কি থাকতে পারে? কম্পি অবুঝ মেয়ে নয়। কিন্তু—

পরের দিন সকালে জাপানের প্লেনে চেপে বসি। কম্পি কি আসবে? আসাটা ওর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না জানি না। আমার হয়তো অকারণে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে। আমি তো কম্পির মতো নই। সে জন্যই সব অর্থহীন মনে হয়। আপনাদের বলা হয়নি, আমি কম্পির মতো রক্ত-মাংসে তৈরি হইনি। আমাকে মানে সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি এই যন্ত্রের মানুষকে একশ বছর আগে যাঁরা তৈরি করেছিলেন একশ বছর পরের অবস্থা তাঁরা আঁচ করতে পারেননি। তাঁরা ভেবেছিলেন, মানুষের অনুভূতি থাকে। নিখুঁত যন্ত্র মানবেরও তা থাকা দরকার। তাই আমার মাথার পেছনে ছোট্ট অনুভূতির কোষ তৈরি করা হয়েছিল। যার ফলে একশ বছর আগের মানুষের মতো আমার মধ্যে আবেগের জন্ম হয়, ভাবের উদয় বিলয় ঘটে। আমার স্রষ্টারা জানতেন না পরের কালের মানুষরা ছুটতে ছুটতে, গতি বাড়াতে বাড়াতে অনুভব ইত্যাদি বাহুল্য মনে করে ছুড়ে ফেলে দেবে। কে বুঝবে আমার অবস্থা। আমি কি করব আমার আবেগ নিয়ে। নাকি আমিও অনুভূতির কৃত্রিম কোষ ফেলে দিয়ে কম্পিদের দলে যোগ দেব?

হঠাৎ দেখি, কম্পি হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে। আর ঠিক তখনই প্লেনটা ওড়ার জন্য দৌড়তে শুরু করল। ওর তো দেরি হয় না। কি জানি কি কারণে কম্পি দেরি করে ফেলেছে।

২৬ ডিসেম্বর ১৯৮২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *