কবে হবে
যেন নতুন কোন কথা শুনছি, এই উদার অর্থনীতি, এই পরিবেশের ভারসাম্য অর্থাৎ ‘ইকোলজি’। একটা দেশ চারপাশে পাঁচিল তুলে, বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের সর্বৈব উন্নতি খুঁজে নিতে পারে না, সেটা সম্ভব নয়। সমগ্র পৃথিবীকে একসঙ্গে ভাবতে হবে। ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড কনসেপ্ট’। রাশিয়া শুধুমাত্র নিজের দেশে সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা করতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। বাঁধন খুলে সম্পূর্ণ টুকরো টুকরো। চীন বিচ্ছিন্ন বিপ্লবের পথ পরিত্যাগ করে খোলাবাজারে ঝাঁপ মেরেছে। ভারত অর্থনীতির রদবদলে ব্যস্ত।
পরিবেশ নিয়ে পৃথিবীর সব দেশই চিন্তিত। জঙ্গল কেটে শহর, বন কেটে বসত, নির্বিচার শিকারে প্রাণি-প্রজাতির প্রায় অবলুপ্তি পৃথিবীতে নতুন ধরনের এক সঙ্কট ডেকে আনছে। সমস্যাটা কোন একটা দেশের কিছু মানুষের নয়, সমগ্র বিশ্বমানব বিপদের সম্মুখীন।
এই দুটি সমস্যার আগাম ইঙ্গিত এই শতাব্দীর শুরুতেই স্বামীজী করে গিয়েছিলেন। বিশ্বধর্মমহাসম্মেলনের মঞ্চ থেকে নেমে এসে দেখলেন, তিনি বিশ্বমানবের একজন হয়ে গেছেন। তিনি বাঙলার বাঙালী নন, ভারতের ভারতীয় নন, তিনি বিশ্বের একজন নাগরিক। সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, নারীমুক্তি—এই চারের সমন্বয়ে এক নতুন ধরনের আধ্যাত্মিকতার কথা তিনি জগৎকে শোনালেন।
প্রথম কথা হলো—”সমগ্র বিশ্বকে একই সঙ্গে উন্নতিপথে অগ্রসর না করাইয়া পৃথিবীর কোন স্থানে কোনরূপ উন্নতি সম্ভব নহে। শুধু তাই নয়, সমগ্ৰ প্রাণিজগৎকে পর্যন্ত নিজ সীমার অন্তর্ভুক্ত করিয়া লইতে হইবে।”
বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে পৃথিবীর উন্নত ও অনুন্নত অঞ্চলের আলোছায়ায় দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারছি, অনুন্নত দেশগুলিকে দ্রুত উন্নত করতে না পারলে, উন্নত দেশের প্রগতি থমকে যাবে। জগৎজোড়া ক্ষুধার মাঝে একা আমি রাজভোগ খাচ্ছি—এইটাই পাপ, পরিপূর্ণ এই স্বার্থপরতাই ধর্মবিমুখতা। শতাব্দীর দূরপ্রান্ত থেকে আমি শুনতে পাচ্ছি সেই শাশ্বত কণ্ঠস্বর। হাত-দুটি তাঁর বুকের ওপর। পরিধানে গেরুয়া আলখাল্লা, মাথায় পাগড়ি, দৃপ্ত ভঙ্গি, উজ্জ্বল দুটি চোখে বিশ্বমায়া জড়ানো। বললেন : “আমি এমন একটা ধর্ম প্রচার করতে চাই যা সকলপ্রকার মনের উপযোগী হবে, যা সমভাবে দর্শনমূলক, তুল্যরূপে ভক্তিপ্রবণ, সমভাবে মরমী, আর কর্মপ্রেরণাময় হবে।” আবার বলছেন : “যে- দর্শন আমাদের জগতের একত্ব ও বিশ্বময় একই সত্তার অস্তিত্ব শিক্ষা দেয়, সেই তত্ত্ব উপলব্ধি করার উপায় দেখাবার সামর্থ্য ধর্মের থাকা আবশ্যক।”
কী অপূর্ব কথা তিনি বিশ্বমানবকে শোনাচ্ছেন! যদি মরমী যোগী কেউ আসেন, আমরা তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা করে বৈজ্ঞানিকভাবে মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে দিতে ও হাতেকলমে তা করে দেখাতে প্রস্তুত থাকব। যদি কোন ভক্ত আসেন আমরা তাঁর সঙ্গে একত্র বসে ভগবানের নামে হাসব-কাঁদব। আমরা প্রেমের পেয়ালা পান করে মত্ত হয়ে যাব। যদি একজন উদ্যমশীল কর্মী আসেন, আমরা তাঁর সঙ্গে যথাসাধ্য কর্ম করব। এই জ্ঞান, ভক্তি, যোগ ও কর্মের সমন্বয়ই সার্বভৌম ধর্মের নিকটতম আদর্শ হবে। স্বামীজী বলছেন, যাদের চরিত্রে এই ভাবগুলির একটা বা দুটো প্রস্ফুটিত হয়েছে, আমি তাদের একদেশী বলি, আর সমস্ত জগৎই ঐরকম একদেশী মানুষে ভরে গেছে। আর তাঁরা কেবল সেই রাস্তাটিই জানেন, যে-রাস্তায় নিজেরা চলাফেরা করেন। এই একদেশদর্শিতার ফলে এঁরা অনুদার হয়ে পড়েন, বিচারশক্তি হারিয়ে ফেলেন, নিজেদের অনুসৃত পথ ছাড়া অন্য পথ ও মতকে ভাবেন বিপজ্জনক ও জঘন্য।
তাহলে উপায়! এইসব মানুষের হাত থেকে পৃথিবীকে উদ্ধারের পথ কি? কে হবেন পরিচালক? স্বামীজীর ভরসা ছিল ভারতের ওপর। আমরা যাকে ‘যোগ’ বলি, সেই যোগের পথেই আসতে পারে আদর্শ ধর্ম। জ্ঞান, ভক্তি, যোগ ও কর্মের সমন্বয় না ঘটলে আদর্শ ধর্মের রূপরেখা তৈরি হবে না। জীবনসাধনায় এই চতুমার্গের মিলন না ঘটলে ধর্মপথের পথিক হওয়া অসম্ভব। মন্দিরের ঘণ্টানাড়ায়, তিলকসেবায়, নিরামিষ আহারে ধর্ম নাও থাকতে পারে। খুব ধর্ম হচ্ছে ভেবে শেষে হয়তো নিজেকেই ঠকানো! বাগাড়ম্বরে ধর্ম নেই। কথা গুছিয়ে বলা মানুষের একটা নেশা। বাক্যের নেশা। অনেকে পারেন, অনেকে পারেন না। গুচ্ছের কথা, শাস্ত্রশ্লোকাদি মিশিয়ে পরিবেশন করে শ্রোতাকে মুগ্ধ করা যায়; কিন্তু ধর্মকে আমি প্রত্যক্ষ করেছি কি? ঐটাই তো সারকথা। আত্মার ভিতর অন্বেষণ করে দেখতে হবে সেখানে কি আছে। বুঝতে হবে। বুঝলেই হবে না, উপলব্ধি করতে হবে। উপলব্ধিই ধর্ম। কথায় কি আছে! কিস্যু নেই। কথার বেদিতে, তর্কের খাঁচায় ঈশ্বর নেই। ঠাকুর বলছেন : “এক রাজা রোজ ভাগবত শুনত। পণ্ডিত পড়া শেষ হলে রাজাকে বলত, রাজা বুঝেছ? রাজা ও রোজ বলে, আগে তুমি বোঝ! পণ্ডিত বাড়ি গিয়ে রোজ ভাবে—রাজা এমন কথা বলে কেন যে, তুমি আগে বোঝ। লোকটা সাধন-ভজন করত—ক্রমে চৈতন্য হলো। তখন দেখলে যে হরিপাদপদ্মই সার, আর সব মিথ্যা। সংসারে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। কেবল একজনকে পাঠালে রাজাকে বলতে যে— রাজা এইবারে বুঝেছি।” ঠাকুর গানে বলছেন :
“কথা বলতে ডরাই, না বললেও ডরাই
মনে সন্দ হয় পাছে তোমাধনে হারাই হা-রাই।।
আমরা জানি যে মন-তোর, দিলাম তোকে সেই মন্তোর।
এখন মন তোর, আমরা যে-মন্ত্রে বিপদেতে তরি তরাই।।”
ধর্ম হলো আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্বন্ধ। স্বামীজীর কথা : “মন্দির ও গির্জা, শাস্ত্র ও অনুষ্ঠান—এগুলি কেবল ধর্মের শিশুশিক্ষামাত্র, যাতে প্রবর্তক অর্থাৎ প্রাথমিক সাধক শক্তসবল হয়ে ধর্মের উচ্চতর সোপান অবলম্বন করতে পারে। আর যদি কেউ ধর্ম চায়, তবে এই প্রথম সোপানগুলি একান্ত প্রয়োজন। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতরে যাওয়া।” ঠাকুর বলছেন, ধাপে ধাপে ওঠ। একলাফে ছাতে ওঠা যায় না। বলছেন, পুজোর চেয়ে জপ ভাল, জপের চেয়ে ধ্যান ভাল। স্বামীজীরও এক কথা—
“উত্তমো ব্ৰহ্মসদ্ভাবো ধ্যানভাবস্তু মধ্যমঃ।
স্তুতির্জপোহধমো ভাবো বাহ্যপূজাধমাধমা।।”
-ব্রহ্মভাবে অবস্থিতিই সর্বোৎকৃষ্ট, ধ্যান মধ্যম, স্তুতি ও জপ অধম আর বাহ্যপূজা অধমাধম।
কিন্তু বাহ্য সহায়তার প্রয়োজন আছে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কর্মী হব না ধার্মিক হব! স্বামীজীর দৃঢ় উত্তর : “আমি দৃঢ়ভাবে বলিতেছি, হিন্দুসমাজের উন্নতির জন্য ধর্মকে নষ্ট করিবার কোন প্রয়োজন নাই এবং ধর্মের জন্য যে সমাজের এই অবস্থা তাহা নহে, বরং ধর্মকে সামাজিক ব্যাপারে যেভাবে লাগান উচিত, তাহা হয় নাই বলিয়াই সমাজের এই অবস্থা।”
প্রশ্ন—কবে হবে?