“কপটতা ছাড়ো”
সংসার মায়া। মায়ার সংসার। জ্ঞানীর কথা। ব্রহ্ম-তত্ত্বে যিনি প্রতিষ্ঠিত তাঁর বোধে এই দর্শন সত্য। ঈশ্বরদর্শন যাঁর হয়েছে এই মায়ার সংসার তাঁকে কাবু করতে পারে না। ঈশ্বরকে কেমন দেখা! না, এই যেমন গাছ দেখছি।
মায়া হলো কাম-কাঞ্চন। কাম-কাঞ্চন বড় জঞ্জাল। ঠাকুর বলছেন এই কথা। বড় জঞ্জাল। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার বলছেন জঞ্জাল না থাকলে তো সবাই পরমহংস। সত্য কথা। সবাই তো আর পরমহংস নন। সংসারী জীব। সংসারী হলেও ঈশ্বরে মন আছে, এমন মানুষের যে অতিশয় যন্ত্রণা। মুক্তি কোথায়!
ঠাকুর বলছেন : “স্ত্রীলোক নিয়ে মায়ার সংসার করা! তাতে ঈশ্বরকে ভুলে যায়।”
হ্যাঁ যায়। অবশ্যই যায়। কাম-কাঞ্চনই সংসার। অনেকে টাকা গায়ের রক্ত মনে করে। তবে উপায় একটা আছে। মনে রাখতে হবে, “যিনি জগতের মা, তিনিই এই মায়ার রূপ। স্ত্রীলোকের রূপ ধরেছেন। এটি ঠিক জানলে আর মায়ার সংসার করতে ইচ্ছা হয় না। সব স্ত্রীলোককে ঠিক মা বোধ হলে তবে বিদ্যার সংসার করতে পারে। ঈশ্বরদর্শন না হলে স্ত্রীলোক কি বস্তু বোঝা যায় না।”
কাশীপুরের বাগান। ঠাকুর বসে আছেন। শরীর আজ সামান্য ভাল। ভক্তরা ঘিরে আছেন। সমাবেশে অনেকেই আছেন—মহেন্দ্র ডাক্তার, রাজেন্দ্র ডাক্তার, নরেন্দ্রনাথ, মাস্টারমশাই, রাখাল, শশী, ভবনাথ, সুরেন্দ্র। ঠাকুর মাস্টারমশাইকে উদ্দেশ করে বলছেন : “এরা কামিনী-কাঞ্চন না হলে চলে না, বলছে। আমার যে কি অবস্থা তা জানে না। মেয়েদের গায়ে হাত লাগলে হাত আড়ষ্ট, ঝনঝন করে। যদি আত্মীয়তা করে কাছে গিয়ে কথা কইতে যাই, মাঝে যেন কি একটা আড়াল থাকে, সে-আড়ালের ওদিকে যাবার জো নেই। ঘরে একলা বসে আছি, এমন সময় যদি কোন মেয়ে এসে পড়ে, তাহলে একেবারে বালকের অবস্থা হয়ে যাবে; আর সেই মেয়েকে মা বলে জ্ঞান হবে।”
তাহলে মা সারদার সঙ্গে ঠাকুরের সম্পর্কটা কি দাঁড়াবে! সহধর্মিণী; কিন্তু মাতৃসমা। আমার সাধনার সমস্ত ফল, এমনকি জপের মালাটিও তোমাকে সমৰ্পণ করে দিলাম। মন্দিরের মা আর নহবতের মা—দুজনেই এক হয়ে গেলেন। মৃন্ময়ী আর চিন্ময়ী। অচল আর সচল এক হয়ে গেলেন। তুমি সারদা, তুমি জগন্মাতা।
“যারা কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকে, তারা নেশায় কিছু বুঝতে পারে না। যারা দাবা-বোড়ে খেলে, তারা অনেক সময় জানে না, কি ঠিক চাল। কিন্তু যারা অন্তর থেকে দেখে, তারা অনেকটা বুঝতে পারে। স্ত্রী মায়ারূপিণী। নারদ রামকে স্তব করতে লাগলেন, ‘হে রাম, তোমার অংশে যত পুরুষ; তোমার মায়ারূপিণী সীতার অংশে যত স্ত্রী। আর কোন বর চাই না—এই কর যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়, আর যেন তোমার জগৎমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই!’”
মায়ার দুটি রূপের কথা ঠাকুর বলেছেন, অবিদ্যা আর বিদ্যা। অবিদ্যা মায়া কুহকে জড়ায়। সত্যকে দেখতে দেয় না। নিগড়ে জড়ায়। ঈশ্বরকে ভোলায়। দুঃখ, দারিদ্র্য, সংশয়, ভীতিতে আচ্ছন্ন করে। অবিদ্যাকে বিদ্যায় পরিণত করতে হবে। শক্তিকে জাগাতে হবে। প্রার্থনা করতে হবে। নারদের মতো বলতে হবে—তোমার জগৎমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই। তোমার কৃপা বিনা সত্য স্বরূপের দর্শন অসম্ভব। শক্তি! তোমার হাত ধরেই আমি সাধনমার্গে এগুবো।
লোকশিক্ষার জন্য ঠাকুরের বিবাহ করা। আদর্শ গৃহী কেমন করে হতে হয়, উপদেশে সে-শিক্ষা নাও হতে পারে, এই দেখ আমি করে দেখাই। সন্ন্যাসীর আদর্শে স্ত্রীসঙ্গ নিষিদ্ধ। তফাত যাও। তুমি না যাও, আমি যাই। সাধন-ভজন আর হলো কই! মনে মনে নারীবাসনার সঙ্গে কোস্তাকুস্তি করেই সময় গেল!
“অমেধ্যপূর্ণে কৃমিজালসঙ্কুলে স্বভাবদুর্গন্ধনিরন্তকান্তরে।
কলেবরে মূত্রপুরীষভাবিতে রমন্তি মূঢ়া বিরমন্তি পণ্ডিতাঃ।।”
আবার কখনো বলছে : “কামিনী নরকস্য দ্বারম্।”
ধস্তাধস্তির শেষ নেই। তবু যে মন মানে না প্রবোধ।
রাখাল মহারাজ বরানগর মঠে বসে মাস্টারমশাইকে বলছেন : “অনেকে মনে করে, মেয়েমানুষ না দেখলেই হলো। মেয়েমানুষ দেখে ঘাড় নিচু করলে কি হবে? নরেন্দ্র কাল রাতে বেশ বললে, যতক্ষণ আমার কাম, ততক্ষণই স্ত্রীলোক; তা নাহলে স্ত্রী-পুরুষ ভেদবোধ থাকে না।”
ঠাকুর পরিষ্কার বলছেন : “আমি জানি যে, যদি কেউ পর্বতের গুহায় বাস করে, গায়ে ছাই মাখে, উপবাস করে, নানা কঠোর করে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিষয়ে মন—কাম-কাঞ্চনে মন–সে-লোককে আমি বলি—ধিক; আর যার কাম-কাঞ্চনে মন নাই—খায়-দায় বেড়ায় তাকে বলি ধন্য।”
আগামী কালের গৃহীদের জন্য এই আমি রেখে গেলাম—আমার আদর্শ সংসারের মডেল। ছাড়তে তোমরা পারবে না, কারণ, “এটি জগন্মাতার ভুবনমোহিনী মায়া।” তাহলে করবেটা কি! ভেসে যাবে? তলিয়ে যাবে? না, তা কেন? দেহ নয়, আত্মাকে ভালবাসতে শেখ, স্ত্রীসঙ্গ মানেই ভোগসুখ কেন হবে? শ্রদ্ধা কেন আসবে না? ভক্তি কেন আসবে না? বন্ধুবোধ কেন আসবে না? চোখ খোল। নারীর মধ্যে মা আছে ভাবতে পার না? নারীর মধ্যে বোন আছে ভাবতে পার না? আর স্ত্রী মানেই কি নর্মসঙ্গিনী? স্ত্রী যে প্রধানত ধর্মসঙ্গিনী। সহধর্মিণী। সব থাকবে, পালটাতে হবে তোমার দৃষ্টি। শুধু মোড় ফেরাও।
শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা যুগল মূর্তি। পুরুষ ও প্রকৃতি। শিব ও শক্তি। শেষ কথা—একমাত্র কথা—”কপটতা ছাড়ো।”