কনে-দেখা আলো – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
এক সঙ্গে দশ পা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশিই আমি হেটেছি দিব্যেন্দুর সঙ্গে। খানিকটা হৃদ্যতা হয়েছে বলা যায়, কিন্তু তার নাম সৌহার্দ্য নয়। তবু এই কাজের ভারটা আমারই ওপর চাপাল দিব্যেন্দু।
আমাদের জাত একেবারে আলাদা। না মেলে রুচিতে, না মেলে জীবনযাত্রায়। তবু আমার ওপর ওর অসীম শ্রদ্ধা। আমি ভিন্ন গোত্রের বলেই বোধ হয় এই শ্রদ্ধাটা—নিজের দলটার ওপরে ওর বিশ্বাস নেই বিন্দুমাত্রও। এমনটাই হয়ে থাকে সম্ভবত।
তবু প্রতিবাদ করেছিলাম আমি।
—আরে, এসব ফ্যাসাদে আবার আমাকে কেন?
—না দাদা, আপনিই যান। এখানে আপনিই আমার গার্জেন—
—তোমার বাবাকে চিঠি লিখে দাও না। বহরমপুর তো দূরে নয়, স্বচ্ছন্দে এসে দেখে যেতে পারবেন।
দিব্যেন্দু বলল, আপনি জানেন না বাবাকে। এ ব্যাপারে ভয়ঙ্কর লিবারাল তিনি, আমার ইচ্ছার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন সব।
—তবে তুমি নিজেই যাও না!
—না সুকুমারদা, সে ভারি বিশ্রী লাগবে আমার। ভদ্রলোকের সঙ্গে যদি পরিচয় না থাকত, তা হলে হয় বন্ধু-টন্ধু সেজে যেতে পারতুম একরকম করে। কিন্তু সে পথও বন্ধ। কাজেই এ ব্যাপারে আপনিই ত্রাণ করতে পারেন আমাকে। হাঁ-না, যা বলবেন।
—কিন্তু— আমি বিব্রত হয়ে বললাম, এত বড় দায়িত্বটা কি আমার দিক থেকেই নেওয়া উচিত? সারা জীবনের ব্যাপার—একবার ফাঁস আটকে গেলে আর খোলবার উপায় থাকবে না। শেষে তোমার দুঃখের পাপটা অনুতাপ হয়ে চেপে থাকবে আমার ঘাড়ে।
—কিছু ভাববেন না সুকুমারদা—একটা দার্শনিক ভঙ্গি করল দিব্যেন্দু : অত বাজে সেন্টিমেন্টাল নই আমি। এটাকে আমি জীবনের একটা আনুষঙ্গিকের বেশি মনে করি না। কাজেই ব্যক্তিত্বের বিরোধ বাধলে কম্প্রোমাইজ করে নিতে পারব। তা ছাড়া অনেক দেখেশুনে নিয়েও তো ঠকে মানুষ। কাজেই ডার্ক হর্সই ভালো।
এমন সহজিয়া দৃষ্টিভঙ্গি যার, বোঝানো সম্ভব নয় তাকে। তবু শেষ চেষ্টা করলুম একবার।
—এর চাইতে তোমার বন্ধুদের কাউকে পাঠালে—
—ছেড়ে দিন ওদের কথা—মুখ বিকৃত করলে দিব্যেন্দু : অপদার্থ সব। ক্লাবে আড্ডা দেওয়া, অফিস-তত্ত্ব আর সস্তা স্নবারির রুটিনে বাঁধা দিন ওদের। অত্যন্ত ডিসেন্ট হবার চেষ্টা করে বলেই বোধ হয় ডিসেন্সির বালাই নেই কিছু। না-না, ওদের দিয়ে চলবে না। আপনিই যান সুকুমারদা। বিবেচক মানুষ আপনি—ভুল আপনার হবে না। ওদের পাঠালে হয়তো আমোক খানিকটা অপমানই করে আসবে ভদ্রলোকদের।
আমি হাসলুম : একটু অবিচার করছ না কি বন্ধুদের ওপর?
—একেবারে না।—দিব্যেন্দু তাচ্ছিল্যভরে বললে, রোজই তো দেখছি কিনা। গিয়ে হয়তো ফস্ করে বুড়ো ভদ্রলোকের মুখের সামনেই পাইপ ধরিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকবে : ওয়াল্জ নাচতে পারেন কি না, ও’নীলের নতুন নাটকটা সম্বন্ধে আপনার কী মনে হয়, বার্নার্ড শ বড় না রবীন্দ্রনাথ বড়, স্যালাড কি করে তৈরি হয় বলুন দেখি? নাঃ, আপনাকেই যেতে হবে সুকুমারদা। মনে-প্রাণে খাটি বাঙালি আপনি—আর ব্যাপারটা বাঙালি মতে হলেই আমি খুশি হব।
দেখলাম, কিছুতেই ছাড়বে না। রাজি না হয়ে উপায় রইল না অগত্যা। বিপন্ন মুখে গায়ে চড়িয়ে ফেললাম জামাটা।
আশ্বাস দিয়ে দিব্যেন্দু বললে, কিচ্ছু ঘাবড়াবেন না সুকুমারদা। আট বছর যখন জেল খাটতে পেরেছেন তখন এ পরীক্ষাতেও তরে যাবেন নির্ঘাত। দুর্গানাম করতে করতে চলে যান—আমার মর্যাল সাপোর্ট রইল।
—থাক, তার দরকার নেই—আমি পথে বেরিয়ে পড়লাম।
অপরাধের মধ্যে একই বাড়ির দুটি পাশাপাশি ফ্ল্যাটে বাস করি আমরা। আমি একটা খবরের কাগজের অ্যাসোসিয়েট এডিটর আর দিব্যেন্দু সবে ঢুকেছে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে। আমি থাকি বুড়ি পিসিমাকে নিয়ে, আর দিব্যেন্দু থাকে একা।
আকাশ-পাতাল পার্থক্য শিক্ষায়, সংস্কারে, জীবনযাত্রায়। আমার বাবা ছিলেন সেকেলে কংগ্ৰেসকর্মী, তার মানে নিষ্ঠা ছিল পাহাড়ের মতো। একটা স্কুলে হেডমাস্টারি করতেন, শেষ পর্যন্ত তাও ছেড়ে দিয়ে নামলেন গ্রামসংগঠনে। ফলে যা হওয়ার তাই হল। প্রায় না খেয়ে মরলেন, যদিও সব কাগজেই প্রকাশিত হয়েছিল একটা করে সচিত্র শোকসংবাদ।
তখন আমি ম্যাট্রিকুলেশন পড়ি। বাপের দৃষ্টান্ত দেখে আমার শিক্ষালাভ করা উচিত ছিল, কিন্তু ঘটনাটা ঘটল একেবারে উল্টো রকম। একদিন যখন ইংরেজ ডি-পি-আই স্কুল দেখতে এসেছেন, তখন বিনা বাক্যব্যয়ে আমি সোজা হাই বেঞ্চের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম, চিৎকার করে বললাম, বন্দে মাতরম্— ভারতমাতা কি জয়—
রাস্টিকেট হয়ে গেলাম, কিন্তু সেইটাই হল কপালের রাজটিকা। সে টিকা আর মুছল না। আট, বছর জেল খাটলাম তারপরে। হাঙ্গার স্ট্রাইক এবং আরো নানারকম অত্যাচারের ফলে আল্সারেশন হল পেটে, থেকে থেকে ওঠে অসহ্য যন্ত্রণা। তাই আপাতত কিছুটা প্রশমিত হয়ে আছি— চাকরি নিয়েছি এই খবরের কাগজে। যেটুকু সময় পাই, রাজনীতির চর্চা করেই কাটে। আত্মজীবনীমূলক একখানা উপন্যাস লেখবারও চেষ্টা করছি—সাংবাদিকতার ফলে কিছুটা সাহিত্যিক খ্যাতি অর্জনের স্পৃহাও জেগেছে মনের মধ্যে। মোটের ওপর নিজের গণ্ডিটির বাইরে বেশ পরিতৃপ্ত আছি আমি।
ওদিকে ঝুনো সরকারী চাকুরের ছেলে দিব্যেন্দু—নিউ দিল্লীর ইঙ্গ বঙ্গীয় আবহাওয়ায় মানুষ। বাপ পেনশন নেবার আগে ছেলেরও সুরাহা করে দিয়েছে। থাকে পাশের ফ্ল্যাটে। জুতো মচমচিয়ে আসে ওর বন্ধুরা, শব্দ করে হাসে, ফ্লাশ খেলবার কলরব চলে অনেক রাত পর্যন্ত। আত্মজীবনী লিখতে বসে সুর কেটে যায় আমার—ভূকুঞ্চিত করি অসীম বিরক্তিতে।
তবু একদিন পরিচয় হয়ে গেল।
দেখলাম, এমনিতে বেশ ছেলেটি। রক্তে রক্তে রাজভক্তি থাকলে কী হয়, একটা গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে দেশকর্মীদের সম্পর্কে। বললে, আপনাদের সঙ্গে কথা কইতেও আমাদের লজ্জা করে দাদা।
সম্পর্কটা স্বচ্ছ হয়ে গেল দেখতে দেখতে। তেলে জলে মিশ খায় না বটে, কিন্তু তেল স্বচ্ছন্দেই জলকে বিব্রত না করে লঘুভাবে ভাসতে পারে তার ওপর। রুচির পার্থক্যকে আমরা সহজ করে নিলাম সৌজন্য দিয়ে।
কিন্তু তার পরিণাম এতটা গড়াবে ভাবিনি। দিব্যেন্দুর গার্জেন হিসেবে তার বিয়ের পাত্রী দেখবার জন্য এখন আমাকে ছুটতে হচ্ছে মহানির্বাণ রোড়ে। বিড়ম্বনা, বাস্তবিক।
ট্রাম চলেছে, আমার চিন্তাও চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। ছুটির দিন—বেশি ভিড় নেই ট্রামটাতে। একেবারে সামনের সিটটাতে গিয়ে বসেছি, বাতাসের ঝলক এসে লুটিয়ে পড়ছে চোখেমুখে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি, পথের দুধারে শান্ত নিশ্চিন্ত বিকেল। সমস্ত ভবানীপুরটাই যেন ছুটির আমেজে ভরা, কারুর কোনো তাড়া নেই—যেন নিশ্চিন্তভাবে বেড়াতে বেরিয়েছে সব। একটা সিনেমা হাউসে নতুন বই খুলেছে, সেখানে একগাদা ভিড়। নানা রঙের শাড়ি পরা মেয়েরা চলেছে লঘু ছন্দে, দোকানে দোকানে ঢুকছে মার্কেটিং করতে।
হঠাৎ বিষন্ন হয়ে উঠল মনটা। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে মনের সামনে ভেসে উঠল একটি কাল্পনিক মেয়ের ছবি। আগে থাকতেই যথাসাধ্য সাধন করানো হয়ে গেছে তাকে, তারপর আত্মীয়স্বজনেরা ঘিরে বসে তালিম দিচ্ছে : কেমন করে ঘরে ঢুকে নমস্কার করতে হবে, বসতে হবে সঙ্কোচে মাথা নিচু করে, অতি-সাবধানে কেমন করে জবাব দিতে হবে নিষ্ঠুর পরীক্ষকের প্রতিটি কূট প্রশ্নের। ভয়ে দুঃখে জল এসে গেছে মেয়েটির চোখের কোনায়, বুকের মধ্যে কাঁপছে থরথর করে, ঘামে গলে গলে যাচ্ছে মুখের ওপরকার স্নো আর পাউডারের প্রলেপ। বাঙালির ঘরে জন্মাননার অপরাধে চরম অমর্যাদার দুর্লগ্ন গণনা করছে সে—বাইরে কারুর পায়ের শব্দ শোনবামাত্র বুকেরস্পন্দনযেন থেমে আসতে চাইছে তার।
সত্যি, কী নৃশংসতা! দেশটা এত বদলালো, কিন্তু এ জিনিসটা যেমন ছিল রয়ে গেল তেমনিই। চুল মেপে হয়তো আজকাল আর দেখা হয় না, ‘উঁচু-কপালী চিরুন দাঁতী’ কি না তাও হয়তো দেখা হয় না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ; কিন্তু নির্লজ্জ নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে রূপ যাচাই করে নেওয়া হয়, অন্তত দেড়খানা রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করা হয়, অকারণ আর অর্থহীন সাহিত্যচর্চার চেষ্টা করা হয় খানিকটা, এমব্রয়ডারি থেকে শুরু করে মাছের আঁশের কাজ আর শ্রীনিকেতন মাকা চামড়ার কাজ এসে জড়ো হয় স্তুপাকারে। সমস্ত প্রক্রিয়াটার মধ্যেই যেন একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রথা—যেন নগ্নাঙ্গী ক্রীতদাসীদের প্রকাশ্যে বিক্রয় করা হচ্ছে বোগদাদ কিংবা মিশরের বাজারে।
কী যে বিশ্রী লাগছিল বলবার নয়। যখন বেরিয়ে পড়ি তখন হঠাৎ-পাওয়া অভিভাবকতার আত্মপ্রসাদে মনটা কিছু উৎসাহিত ছিল বোধ হয়। কিন্তু ট্রাম যতই এগোচ্ছে, ততই সেটা ফিকে হয়ে আসছে। নাঃ, উচিত হয়নি আসা।
আর আচ্ছা ছেলেও তো দিব্যেন্দু। ইংরেজি কেতায় মানুষ—সেইভাবেই একটা বিয়ে করলেই তো চুকে যেত। কখনো কখনো ওর ফ্ল্যাটে দুটি-একটি মহিলাবন্ধুরও আনাগোনা তো দেখতে পাই। কিন্তু কী অদ্ভুত খেয়াল বিয়ে করবে নাকি একেবারে বিশুদ্ধ হিন্দু-পদ্ধতিতে। এর মধ্যে নাকি একটা থ্রিল্ আছে—একটা রহস্যময়তার রোমান্স আছে। চেনা মেয়েকে বিয়ে করার কথা ভাবলে নাকি হাসি পায় দিব্যেন্দুর।
ওর না হয় হাসি পেল, কিন্তু এখন যে কান্না পাচ্ছে আমার। আমি আদর্শবাদী মানুষ, সমাজ সম্বন্ধে একেবারেই আলদা আমার দৃষ্টিকোণ। কিসের জন্যে পা বাড়িয়েছি এমন একটা ঘাতকবৃত্তির ব্যাপারে? তা ছাড়া আমার একটিমাত্র কথার অতি সূক্ষ্ম একটি সূত্রে দুটি মানুষের ভবিষ্যৎ দুলছে— কী প্রয়োজনটা ছিল এমন একটা অপ্রীতি এবং অস্বস্তিকর ভার তুলে নেবার।
কিন্তু এখন আর ফেরা চলে না। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বিব্রত মুখ তুলে তাকাতে দেখি ট্রামটা রাসবিহারী অ্যাভেনিউ-এ এসে পড়েছে। বিকেলের শান্ত আলোয় দু পাশের পথে চলেছে স্বচ্ছন্দগতি মেয়েরা। ওদের পাশাপাশি একখানা লজ্জা-করুণ মুখের ছায়াভঙ্গি আমাকে অপরাধী করে তুলতে লাগল।
—আসুন, আসুন—
গৌরাঙ্গবাবু আহ্বান জানালেন সসম্ভ্রমে। দর্শনের প্রবীণ অধ্যাপক, চেহারায় দার্শনিকসুলভ একটা শান্ত অসহায়তা আছে। দেখলেই বোঝা যায় এমন মানুষ যিনি ঘরমাফিক জামার বোম লাগাতে জানেন না, দু জোড়ার দু পাটি জুতো পরে বেরিয়ে যান কলেজে। অর্থাৎ মানুষটির চাল-চলন সম্পর্কে গৃহিণীর সব সময়ে জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে রাখতে হয়। মাথায় বারো-আনি টাক, চোখে পুরু পরকলার চশমা, বেঁটে চেহারার এই ফর্সা ভদ্রলোকটিকে দেখে আমার অপরাধবোধটা আরো প্রবল হয়ে উঠল।
আমি নীরবে অনুসরণ করলাম।
যে ঘরটিতে নিয়ে গিয়ে গৌরাঙ্গবাবু আমায় বসালেন, তার চেহারা দেখে আরো নিরুৎসাহ হয়ে গেলাম। সাদাসিদে ধরনের বসবার ঘর—আয়োজনের চাইতে প্রয়োজনের দিকেই লক্ষটা বেশি। তিন দিকের তিনটি আলমারিতে বই ঠাসা—বেদান্তদর্শন, লাইফডিভাইন থেকে ডায়ালেক্টিক্যাল্ মেটিরিয়ালিজম পর্যন্ত। দেওয়ালে অবনীন্দ্রনাথের একখানা ল্যান্ডস্কেপ, বাকি কয়েকখানা কয়েকটি মানুষের ছবি। রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইনকে চেনা গেল—অন্যান্যদের কখনো আমি দেখিনি, খুব সম্ভব বিদেশী দার্শনিকের দল।
এ-বাড়ির মেয়ের সঙ্গে কি দিব্যেন্দুর কালচারে মিলবে? অধ্যাপনার আওতায় যে বড় হয়েছে সে কি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে ক্লাব-জীবনের আবহাওয়ার সঙ্গে? কী জানি!
গৌরাঙ্গবাবু বললেন, মেয়ে আমার ভাগনী। বাপ-মা মারা যায় মেদিনীপুরের ফ্লাডে, সেই থেকেই আছে আমার কাছে। এখন যদি দয়া করে আশ্রয় দেন আপনারা।
—ছিঃ ছিঃ, কেন লজ্জা দিচ্ছেন। ওসব বলে আর অপরাধী করবেন না।
গৌরাঙ্গবাবু বললেন, তা ছাড়া আর কী বলুন। এদেশে জন্মেছে বলেই এমন দুভাগ্য! আর কোথাও মেয়েদের এমন অসম্মান তো বইতে হয় না।
শেষের দিকে ভদ্রলোকের স্বর উত্তেজনায় কেঁপে উঠল। দেখলাম আমার অনুমান ঠিক—দর্শনের আদর্শ অধ্যাপকই বটে। অনুগ্রহ করে যারা পাত্রী দেখে ধন্য করতে আসে অপ্রিয় সত্য যে তাদের শোনাতে নেই এ সাধারণ ধারণাটুকু পর্যন্ত নেই ওঁর।
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন গৌরাঙ্গবাবু, কিন্তু বাধা পড়ল। দরজার ওপারে চুড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। বুঝলাম গৃহলক্ষ্মী সতর্ক হয়েই আছেন। স্বামী যে বেফাঁস কথা বলে জিনিসটাকে কাঁচিয়ে দিচ্ছেন, সেটা টের পেয়ে দিচ্ছেন সতর্ক করে।
—বসুন, আসছি— উঠে গেলন গৌরাঙ্গবাবু।
আমি চুপ করে বসে রইলাম। সমস্ত ঘরটার এমন একটা শুচিশুভ্র রূপ আছে যে নিজেকে যেন একান্ত অনধিকারী বলে বোধ হচ্ছে। যে মেয়েটিকে দেখতে এসেছি তার চাইতে আমিই যেন বিপন্ন হয়ে উঠেছি অনেক বেশি। রবীন্দ্রনাথের মূর্তির দিকে চোখ পড়ল যেন কঠিন ভৎসনা-ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ; আলমারির বইগুলো যেন গম্ভীর অবজ্ঞায় নির্ধারণ করে দিচ্ছে আমার ক্ষুদ্রতার সীমানা। সংকোচের আর অবধি রইল না।
জানলা দিয়ে সারা ঘরে শেষ দিনের আলো পড়েছে—সূর্য ডোববার সময় হয়ে এল। একেই কি বলে কনে-দেখা আলো? লাজনত চোখের দৃষ্টির মতো ভীরু আর করুণ, যেন দ্বিধাভরে সামান্য একটুখানি চোখ মেলে তাকিয়েছে সে। একটু পরেই সে আলো নিবে যাবে, কালো রাত্রির মতো হারিয়ে যাবে ধনপক্ষ্ম চোখের পাতার নিচে। এই আলোতেই দিনান্তের স্লান ছায়ার মতো সে আসবে ঘরে, গোধূলির আকাশের মতো বিষন্ন ললাটে সন্ধ্যাতারার মতো টিপটি উঠবে ঝলমল করে।
—আয়, আয়, লজ্জা কী?
আমি চকিত হয়ে উঠলাম। যে মেয়েটিকে দেখবার জন্যে এসেছি, আনা হয়েছে তাকে। গৌরাঙ্গবাবুর পাশে-পাশে জড়িয়ে জড়িয়ে পা ফেলে সে আসছে— বলি দেবার জন্যে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেন হাড়িকাঠের দিকে।
ভালো করে আমি তাকাতে পারলাম না। কাচের আবরণের ওপর শেষ রৌদ্রের আভা পড়েছে জ্বলছে রবীন্দ্রনাথের ছবিখানা—আমার ওপর যেন নিষেধের সেই কঠিন দৃষ্টিটা তেমনি করেই মেলে রেখেছেন। কনে-দেখা আলোয় ছায়াসঙ্গিনীর মতো যে ঘরে এসে পা দিয়েছে তার দিকে স্থূল মর্মঘাতী চোখ তুলে আমি তাকাবো কেমন করে?
—বোস, বোস এখানে—
কাপড়ের খসখস আওয়াজ পেলাম। অদূরের কৌচে মৃদু শব্দ উঠেছে একটা—বসল মেয়েটি। একটা স্তব্ধতা ঘন হয়ে রইল ঘরের মধ্যে।
—সুকুমারবাবু দেখুন—
না তাকিয়ে উপায় ছিল না এবার। ভীরু আলোর শ্রান্ত রশ্মিতে মেয়েটিকে দেখলাম আমি। মাথা নত করে বসেছে। সমস্ত দেহভঙ্গির মধ্যে একটা শিথিল শ্রান্তি। পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়ে আজ যেন চূড়ান্তভাবে অবসন্ন হয়ে গেছে সে, নিজেকে সঁপে দিয়েছে ভাগ্যের হাতে। শরীরে মনে তার কোথাও একবিন্দু প্রতিবাদ অবশিষ্ট নেই—ভাঙাহাটের একটা জীর্ণ পশুর মতো যে-কোনো ক্রেতার হাতে নামমাত্র মূল্যে বিকিয়ে যাওয়ার জন্যই তার প্রতীক্ষা।
কিন্তু এভাবে চুপ করে থাকারও কোনো মানে হয় না। শেষ পর্যন্ত স্তব্ধতা ভাঙতে হল আমাকেই।—কি নাম আপনার?
নেতিয়ে পড়া মেয়েটি থরথর করে কেঁপে উঠল হঠাৎ বিস্ফারিত করে ধরল বিহ্বল দৃষ্টি। আর্তস্বরে বললে, কুমারদা!
আমার কণ্ঠ থেকে তেমনি করে বেরিয়ে এল : মিনু।
—আপনি চেনেন তা হলে ওকে? আর্তনাদের মতো মনে হল গৌরাঙ্গবাবুর গলার আওয়াজ। কনে-দেখা আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, ছাইয়ের মতো বিবর্ণ হয়ে গেছে তাঁর মুখ।
মিনুকে আমি চিনব না?
ছ বছর আগে যখন দেখেছিলাম তখন তেরো-চৌদ্দ বছরের মেয়ে। মেয়ে নয়, শিখারূপিণী। পরিষ্কার সতেজ গলায় বলেছিল, ওরা বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু এটা বোঝে না যে একটা মানুষকে আটকালেই বিপ্লবকে ঠেকানো যায় না।
আমি সবিস্ময়ে বললাম, তোমার ভয় করে না?
—না। কেন করবে?
—ওরা যদি তোমাকেও ধরে নিয়ে যায়?
—জেলে যাব। সবাই যাচ্ছে—আমি পারব না?
আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। চেহারায় এমন একটা বিশেষত্ব আছে যে এই মেয়েকে ভুল করবার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই কোথাও। কৈশোরের স্বভাবস্নিগ্ধ লাবণ্যের ওপর পড়েছে একটা আগ্নেয়-প্রতিফলন। বাঁ গালের পাশে একটা শুকনো কাটা দাগ—কোমল মুখখানায় এনে দিয়েছে একটা স্বাতন্ত্র, একটা উগ্র ব্যক্তিত্বের ছাপ।
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে যেন অপ্রতিভ বোধ করলে একটু। লজ্জা পেল।
বললে, সে থাক, চলুন এখন।
দেখি, মেজে থেকে লণ্ঠনটা তুলে নিয়েছে হাতে।
—কোথায়?
—সেই ব্যবস্থা করতেই তো এলাম।—পাকা গিন্নীর মতো মুখের ওপর একটা গাম্ভীর্যের আবরণ টেনে আনল মিনু : এ-বাড়ি আজ রাত্রেই সার্চ করতে আসতে পারে। পাশের গায়েই ক্যাম্প করেছে কিনা, যখন-তখন এসে হামলা বাধায় এদিকে। এখানে থাকলে ধরা পড়ে যাবেন। চলুন আমাদের বাড়িতে।
—এই জন্যে এত রাত্রে একা একা এলে? তোমার ভয় করল না?
—ভয়? মিনু হাসল : ভয় করব কাকে? সাপ তো? ইংরেজের চাইতে তারা খারাপ নয়।
আমিও হাসলাম : ‘পথের দাবী’ পড়েছ বুঝি?
—পড়েছি বইকি। অনেক বই পড়েছি আমি— বাবা পড়িয়েছেন। কিন্তু ওসব কথা থাক এখন। চলুন, রাত হয়ে যাচ্ছে সত্যি।
পথে বেরুলাম দু’জনে। অন্ধকার রাত, অল্প অল্প মেঘ জমেছে আকাশে। কিন্তু আলো নেই কোথাও—ভয়ে আতঙ্কে মূৰ্ছিত হয়ে আছে পৃথিবী। একটি মানুষের সাড়াশব্দ নেই কোনোখানে। শুধু অনেক দূরে আকাশের কোলটা রাঙা হয়ে উঠেছে একটু একটু করে।
মিনু কঠোর কণ্ঠে বললে, দেখেছেন, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
আমি জবাব দিলাম না।
—মানুষের ওপর যা খুশি অত্যাচার করছে, গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে—লোকে আশ্রয় নিচ্ছে বনে-জঙ্গলে। কিন্তু এরও শোধবোধ হবে একদিন— কড়াক্রান্তিতে এর হিসেব নেব আমরা।
কথাটা শুধু ছেলেমানুষের উক্তিই নয়—এ যেন সমস্ত দেশের মর্মযন্ত্রণার আকৃতি। এবারেও আমি জবাব দিলাম না। আমার মাথার ওপরেই মোটা পুরস্কার ঘোষণা করা আছে ওদের। তা ছাড়া ছেলেমানুষ মিনু কতটুকু দেখেছে আর? ওর চাইতে ঢের বেশি দেখতে হয়েছে আমাকে—ক্রোধে, অপমানে আর অমানুষিক হিংস্রতায় টগবগ করে ফুটে উঠেছে রক্ত।
গাঁয়ের পথ দিয়ে চলেছি দু’জনে। কালিপড়া লণ্ঠনে পথের কিছুই দেখা যায় না ভালো করে। হু-হু করে এলোপাতাড়ি বাতাস বইছে—মাতলামি করছে দু’ধারের ঝোপঝাড়। কিন্তু কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া পাওয়ার উপায় নেই। একটা আদিঅন্তহীন শ্মশানের মধ্য দিয়ে শ্মশান-প্রেতের মতো যেন এগিয়ে চলেছি আমরা।
ওদিকে আকাশটা আরো রাঙা হয়ে উঠল—গ্রাম জ্বলে যাচ্ছে। আগুনের একটা অতিকায় শিখা হাতির শুঁড়ের মতো দিগন্তে উঠে হাউইয়ের মতো মিলিয়ে গেল।
মিনু বললে, জানেন, একটা বন্দুক পেলে আমিও যুদ্ধ করতে পারি ওদের সঙ্গে।
—ছুঁড়তে জানো? —জানি—দীপ্তকণ্ঠে জবাব এল।
হঠাৎ ওদিকে কতগুলো ঝোপঝাড়ের মাথার ওপর দিয়ে আলোর একটা রেখা সরীসৃপের মতো বয়ে গেল লক্লকিয়ে—যেন একটা ক্ষুধার্ত জিহ্বা লেহন করে নিলে অন্ধকারকে। বেশ শুনতে পেলাম স্তব্ধ আতঙ্কিত রাত্রির চেতনার মধ্যে চমকে উঠছে একটা নিষ্ঠুর আওয়াজ—বুটের আওয়াজ।
মিনু চমকে উঠল।
—আসছে!
আমি বললাম, হুঁ।
—তা হলে? বিদ্যুদবেগে হাতের লণ্ঠনটা মিনু নিবিয়ে দিলে ; তা হলে?
—তাই ভাবছি। ছুটতে পারবে?
—ক্ষেপেছেন? মিনু চাপা গলায় ধিক্কার দিলে ; তা হলে তো সঙ্গে সঙ্গেই টের পেয়ে যাবে। আর হাতে ওদের বড় বড় টর্চ—দু মাইল দূর থেকে ওরা রাইফেলের গুলিতে ফেলে দিতে পারে। পালাবেন কী করে?
—তাই তো!
—আর তাই তো তাই তো নয়, ওরা এসে পড়ল বলে—দেখছেন না?
দেখলাম বইকি! ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার সরীসৃপের লক্লকে জিভের মতো অন্ধকারকে লেহন করে চলে গেল টর্চের আলোটা।
মিনু আমার হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিলে।
—আর দেরি করবেন না। এই ঝোপটার মধ্যে নেমে আসুন। একটা খানা আছে, ওখানেই লুকিয়ে থাকা যাবে। চলে আসুন কুমারদা, শিগগির।
আমরা নেমে গেলাম।
খানার মধ্যে হাঁটু অবধি কাদা, চারিদিকে কাঁটাবন। একটা পচা দুর্গন্ধ উঠছে কোথা থেকে। অন্ধকার যেন বুকের ওপরে চেপে বসতে চাইছে। মিনু ফিসফস করে বললে, ভয় নেই কুমারদা, খুব নিরাপদ জায়গা।
এতটুকু ছোট মেয়ে আমাকে—অভয় দিচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমার হাসি পেল না। ভয় আমার করছিল সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সাপের ভয় আছে—ওদের হান্টিং টর্চ আর রাইফেলের মহিমাও অজানা নয়।
বুটের শব্দ আসছে এগিয়ে। মচ্-মচ্-মচ্-মচ্। বাঙলাদেশের বুক মাড়িয়ে বীরপদভরে এগিয়ে চলেছে ওরা। একেবারে কাছে এসে পড়েছে, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে কথাবার্তার আওয়াজ। খানিকটা উৎকট হাসির শব্দ পাওয়া গেল—মদ গিলেছে নিশ্চয়।
ভয়ে ঢিবঢিব করতে লাগল বুকের মধ্যে। সিরসির করতে লাগল হাত-পা। কাছে এসে গ্রেপ্তার করবার কষ্টটুকুও স্বীকার করবে না, দেখতে পেলেই সোজা গুলি চালিয়ে দেবে।
—কিছু আছে আপনার সঙ্গে? মিনু ফিসফিস করে জানতে চাইল।
—কিসের কথা বলছ? নিঃশব্দ স্বরে আমি প্রশ্ন করলাম।
—কোনো অস্ত্র?
—না।
—ধ্যাত, ভারি বোকা আপনি। খালি হাতে বেরুতে হয় কখনো? আমি একখানা ছোরা রেখেছি কোমরে। যদি সুযোগ পাই কখনো—মিনুর চাপা গলাটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।
অন্ধকারে মিনুর একখানা হাত এসে ঠেকেছিল আমার হাতে। চমকে উঠলাম আমি, মুহূর্তের জন্যে মনে হল আমার পাশে একটি কিশোরী মেয়ে বসে নেই—খানিকটা তীব্র আগুন স্পর্শ করেছে আমাকে—সেই আগুন যা একদিন সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একাকার করে দেবে।
বুটের শব্দ, টর্চের আলো, জড়ানো গলার কোলাহল আর মাতালের হাসির শব্দ আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম আমি—হৃৎপিণ্ড তখনো জলের ঢেউলাগা পদ্মপাতার মতো দোল খাচ্ছে। হঠাৎ মিনুর স্বচ্ছ গলার নির্দেশ পেলাম : চলুন এবার।
তার প্রায় পনেরো দিন পরে যখন এ গ্রামে আবার ফিরে এলাম আমি, সেদিন বিকেলেই পুরো চব্বিশ ঘণ্টা মিলিটারি ক্যাম্পে আটক থাকার পর ফিরে এসেছে মিনু।
আমি দেখতে গেলাম অনেক রাত্রিতে। ঘরে আর কেউ নেই, শুধু একটা মেটে-প্রদীপ জ্বলছে মৃত্যুম্নান দ্যুতিতে। বিছানার ওপর শীতের পাপড়িঝরা পদ্মের মতো লুটিয়ে আছে মিনু। কতগুলো প্রমত্ত জানোয়ারের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি তার ছোরাখানা দিয়ে।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। চোখের জল মুছে ফেলে বললাম, বোন, তোদের এই অপমানের মধ্য দিয়েই ওদের চিতা তৈরি করব আমরা—সে ভার নিয়েছি। কিন্তু এতেই এমন করে ভেঙে পড়বি কেন? তুই আগুন—সে আগুনকে কেউ স্নান করতে পারে না। সে নিত্যশুচি।
মিনু জবাব দেয়নি।
পরদিন ধরা পড়লাম আমি। চার বছর জেল তারপরে। তারপর আজকে—
সচেতন হয়ে উঠতে দেখি, আজ মিনুর চোখ জলে চকচক করছে। পরমুহূর্তেই সে উঠে দাঁড়ালো, ছুটে পালিয়ে গেল অন্দরের দিকে।
আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন গৌরাঙ্গবাবু।
—সবই যখন জানেন আপনি, তখন আপনাকেই উপায় করতে হবে। গ্রামের সামান্য দু’চারজন ছাড়া এ খবর আর কারুর জানা নেই। ছেলেমানুষ—সেদিন কী হয়েছে না হয়েছে তার জন্যে কি শাস্তি পাবে সারা জীবন? আপনি ব্যবস্থা করে দিন। নিজের ভাগনী বলে বলছি না—মিনুর মতো মেয়েকে মাথায় করে রাখা উচিত।
সংক্ষেপে বললাম, তা আমি জানি। আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। যা ওর পরম গৌরব, এ হতভাগা দেশে তাই চরম লজ্জা। কিছু ভাববেন না—সব ব্যবস্থা আমি করে দেব।
এবার জামার আস্তিনে চোখ মুছে ফেললেন গৌরাঙ্গবাবু, বললেন, আপনার ওপরেই ভরসা করে থাকব। ছেলেটি অত্যন্ত সুপাত্র— যদি হাতছাড়া হয়ে যায়—
—না, হাতছাড়া হবে না।
অবরুদ্ধ স্বরে গৌরাঙ্গবাবু বললেন, কী যে উপকার করলেন আমার—এ ঋণ কোনোদিন ভুলতে পারব না।
পথে বেরিয়ে এলাম। অনেকখানি রাস্তা হেঁটে গিয়ে ট্রাম ধরতে হবে আমাকে।
গৌরাঙ্গবাবুর কথা ভাবছি না, কিন্তু মিনুর চোখেও কি দেখলাম এই একই আকুলতা—একই কাতরতা? না—এ হতে দেওয়া যাবে না, কিছুতেই না। ও আগুনকে নিবতে দেওয়া যায় না। দিব্যেন্দুকে আমি জানি। দুদিন পরেই দেখতে পাব গায়ে দামী গয়না আর শাড়ি পরে একটা চর্বির ঢিবি হয়ে গেছে মিনু—হয়ে গেছে একটা ছাইয়ের স্তুপ। এ হতে পারে না।
যে লজ্জাকে ঢাকতে গিয়ে আজ মিনু এমন করে দাঁড়িয়েছে অপমানের মুখোমুখি, এমন করে আত্মহত্যা করতে—সে লজ্জাকে ভুলতে দেওয়া যাবে না। সেই লজ্জার গ্লানিই ওকে জ্বালিয়ে তুলুক, জাগিয়ে তুলুক, অসহ্য ঘৃণা আর বিদ্বেষের বিস্ফোরক গড়ে তুলুক ওর প্রাণের মধ্যে। আত্মহত্যা না করে আত্মবিদারণ করুক ও। ওকে দিয়েই সার্থক হোক আমার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের শেষ অধ্যায়। দিব্যেন্দুকে কী বলব তা স্থির করে নিয়েছি আমি।
আকাশে কখন ডুবে গেছে সূর্য। কনে-দেখা আলো লঘু তরল অন্ধকারে কখন গেছে হারিয়ে।
১৩৫৫ (১৯৪৮)