কনফুসিয়াস
কনফুসিয়াসের নাম আমরা শুনেছি। তাঁর দার্শনিকতা, তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের কথা আমাদের অল্প স্বল্প জানা আছে। চীনের ঐ প্রবাদপুরুষটি সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট কোন ধারণা না থাকাই স্বাভাবিক। কারণ আমরা এমন একটা যুগে এসে হাজির হয়েছি, যে-যুগে জীবন যন্ত্রণাই আছে, জীবন দর্শন নেই।
সুং রাজ্যের এক বিশিষ্ট পরিবারে কনফুসিয়াসের জন্ম। বহুকাল আগে, খ্রীস্টের জন্মের সাতশ বছর আগে অষ্টম শতাব্দীতে কনফুসিয়াসের এক পূর্বপুরুষ সুং প্রদেশের ডিউকের অভিভাবক ছিলেন। আততায়ীর হাতে ডিউক নিহত হলেন। তাঁর বংশধররা সুং ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। পালিয়ে এলেন লু প্রদেশে। লুর, সাও অঞ্চলে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হলেন। ডিউকের হত্যায় শোকাহত কনফুসিয়াসের সেই পূর্বপুরুষ, নিজের অক্ষমতার বেদনায় দেহ রাখলেন। সোচুয়ানে ডিউক হিয়াং-এর রাজত্বকালের দশম বছরে একটি ঘটনা ঘটেছিল। জনৈক শু হে, যাঁর আবাসস্থল ছিল সাওতে, তিনি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় প্রাসাদের দরজা তুলে ধরে তাঁর সহযোদ্ধাদের পালাতে সাহায্য করেছিলেন। চীনের সেইসময় রাজনৈতিক ইতিহাস এইরকম রক্তাক্তই ছিল। এক যায় তো আরেক আসে। এই শু লিয়াং হে-ই নাকি ছিলেন কনফুসিয়াসের পিতা। কনফুসিয়াসের মায়ের পরিচয় প্রায় অজ্ঞাত।
কনফুসিয়াস পশ্চিম দুনিয়ায় যে নামে পরিচিত ছিলেন তা হলো—কুং চিউ অথবা কুং চুং নি। কনফুসিয়াসের জন্মকাল আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ৫৫২ অথবা ৫৫১ অব্দ। অতি অল্প বয়সেই অনাথ হয়েছিলেন। যৌবনের ঘটনা সঠিক জানা যায় না। শুধু এইটুকুই জানা যায়, কনফুসিয়াসের দিন কেটেছে দারিদ্র্যে। লেখাপড়ায় অসম্ভব ঝোঁক ছিল। তাঁর লেখা থেকেই জানা যায়, ‘কম বয়সে আমার দিন কেটেছে আর্থিক অনটনে। সেই কারণেই কায়িক পরিশ্রমের হীন কাজে আমি এত দক্ষ। পনের বছর বয়সেই আমি লেখাপড়ায় মন দিই।’ পরে কনফুসিয়াস হয়েছিলেন পুলিশ কমিশনার। ধীরে ধীরে কনফুসিয়াস হয়ে উঠলেন ঋষি। তাঁর জীবনদর্শন, শিক্ষা, আদর্শ শক্তিশালী কোন সম্রাটের সাম্রাজ্যের চেয়েও বিস্তৃত হলো। এত বছর পরেও তিনি সমান জীবিত ও আদৃত। সামন্ত রাজাদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে করতে আদর্শ মানবের চরিত্র কি হওয়া উচিত সেই সম্পর্কে তাঁর একটা আদল তৈরি হতে থাকে। কনফুসিয়াস নির্দেশিত আদর্শ মানবের পথ হলো নিজের মধ্যে মানবিক গুণসমূহ ফুটিয়ে তোল, উদারতাকে কর তোমার পথ, আর আনন্দ খোঁজ শিল্প ও সংস্কৃতির মধ্যে।
কনফুসিয়াসের মতে আদর্শ নৈতিক চরিত্র হলো, সাধনা হলো, যতদূর সম্ভব ভালমানুষ হওয়া। ভালমানুষ হতে হবে শুধুমাত্র ভাল মানুষ হওয়ার জন্যেই। এই গুণ ভাঙিয়ে জীবনের বৈষয়িক সাফল্য খুঁজলে হবে না। সাফল্য অসাফল্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হতে হবে। অনেকটা গীতার প্রতিধ্বনি। গীতার সাম্যস্থিতি—
“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যত্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।”
কর্ম ভালই হোক আর মন্দই হোক, মনোধর্মের সাম্যভাবকেই বলে যোগস্থিতি।
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন
মা কর্মফল হেতুভূমা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।”
কর্মফলের আশা করবে না, কুকর্ম বা নিষিদ্ধকর্মের সঙ্গে যোগ রাখবে না। নিষ্কাম সৎকর্মই মানুষের আদর্শ। কর্মেই মানুষের চরিত্রের প্রকাশ। শুভ কর্মচারীকেই মানুষ ভাল লোক বলে। কনফুসিয়াস সেই ভাল লোকই হতে বলেছিলেন। ‘কালটিভেট ভারচুস’ গুণের চাষ কর অন্তর্জমিনে। ‘বি অন দি রাইট পাথ’ সঠিক পথে চল।
কনফুসিয়াসের উপদেশ, জীবনদর্শনকে আবার নতুনভাবে নতুন উদ্যোগে ঝালাবার চেষ্টা চলেছে। সারা পৃথিবী জুড়ে চলেছে তামসিকতার নৃত্য। কনফুসিয়াস ছিলেন রাজা মহারাজাদের উপদেষ্টা। তাঁদের মত ও পথের কট্টর সমালোচক। সময় সময় ভ্রষ্ট রাজনৈতিক পুরুষদের পরিত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। কনফুসিয়াস যার ওপর সবচেয়ে জোর দিতেন, তা হলো আচরণবিধি, নৈতিকতা। অনেকটা হিন্দি প্রবাদের মতো—”আপ সাচ্চা তো জগৎ সাচ্চা।” কনফুসিয়াস বলে গেছেন—”একজন মানুষ যদি নিজে সাচ্চা থাকে তাহলে আদেশ ছাড়াই মানুষ তাকে মানতে বাধ্য হবে। কিন্তু সে যদি নিজে ঠিক না থাকে তাহলে উলটোটাই হবে। আদেশ করলেও কেউই তাকে মানবে না।”
জনৈক শাসক কনফুসিয়াসকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন : “যারা উচিত পথে চলছে না, তাদের কি আমি খুন করব?”
কনফুসিয়াস বললেন : “তা কেন? রাজ্য চালাতে গেলে খুন করতে হবে কেন। আপনি নিজে সকলের ভাল চান, দেখবেন সাধারণ মানুষও ভাল হয়ে গেছে। ভদ্র, সৎ মানুষের ধর্ম হবে বাতাসের মতো, আর ক্ষুদ্র মানুষের ধর্ম হবে ঘাসের মতো। বাতাসকে ঘাসের ওপর দিয়ে বয়ে যেতে দিন, দেখবেন ঘাস কেমন আপনিই নুয়ে পড়েছে।”
এখানে ক্ষুদ্র মানুষ বলতে কনফুসিয়াস যাঁদের বোঝাতে চেয়েছেন তাঁরা হলেন শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের। জনসাধারণ সম্পর্কেও তাঁর নির্দেশ অতি চমৎকার। জনৈক ডিউক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন—”সাধারণ মানুষ যাতে অসন্তুষ্ট না হয় তার জন্যে আমার কি করা উচিত?” কনফুসিয়াস বললেন : “সৎ, ন্যায়পরায়ণদের উৎসাহ দিয়ে সামনে টেনে আন। অসৎ অসাধুদের ফেলে দাও ভাগাড়ে, দেখবে সাধারণ মানুষ তোমাকে প্রাণের চেয়েও আপন করে নেবে। উলটোটা করে দ্যাখ, অসাধুদের আস্কারা দাও সাধারণ মানুষ তোমাকেই ফেলে দেবে ভাগাড়ে।”
পরবর্তী কালে এই উক্তিটিকেই আরেকটু সংশোধন করে কনফুসিয়াস বলেছিলেন : “সৎ ন্যায়নিষ্ঠদের সমর্থন করে সর্বত্র তাদের প্রতিষ্ঠায় চোর আর দুর্নীতিপরায়ণরা ক্রমে হীনবল হয়ে, স্বভাব পালটে ফেলে সততার আদর্শ গ্রহণ করবে।”
কনফুসিয়াস আরো বললেন : “পুণ্যের রাজত্বকে ধ্রুবতারার সঙ্গে তুলনা করা চলে। ধ্রুবতারা আকাশে অবিচল থেকেও অন্য সব তারার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে।”
কনফুসিয়াস-এর আদর্শে দেশের শাসকরা এমন একটা ভাব দেখাবেন যেন কিছুই করছেন না, অথচ তাঁদের নৈতিক শক্তির অদৃশ্য প্রভাবে সবকিছু হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষ সঠিক পথ নির্বাচনের ক্ষমতা রাখে না, তাদের সঠিক পথে চালাতে হয়। তারা বোঝে না কেন কোন্ পথে তারা চলতে বাধ্য হচ্ছে। সে বিচারশক্তি তাদের নেই। কনফুসিয়াস বলেছিলেন : “যারা জ্ঞানী হয়ে জন্মায় তারা শ্রেষ্ঠ। তারপরের স্তরই হলো তারা, যারা লেখাপড়ার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করে। এর পরের স্তরে তারা যারা বিপদে পড়ে লেখাপড়ার দিকে ঝুঁকে জ্ঞানী হয়। একেবারে নিম্নস্তরে তারা, যারা ঠেকেও শেখে না, শিখতে চায় না। জ্ঞানের অন্বেষণই কনফুসিয়াসের মতে মানুষের শ্রেষ্ঠ কর্ম! অভাব অভিযোগ থাকবেই, তার মধ্যেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ঝুপড়িতে বসবাস, তাতে কি! আহার এক মুঠো ভাত এক লোটা জল তাতেই বা কি? জীবনের আনন্দ এর মধ্যেই যে বজায় রাখতে পারে সে-ই শ্রেষ্ঠ।”
কনফুসিয়াস বলছেন : “মানুষ অনেক কিছু পেতে পারে শিক্ষার মাধ্যমে। তীর ছোঁড়া শিখতে পারে। রথ চালানো শিখতে পারে। লেখক হতে পারে। গণিতজ্ঞ হতে পারে। কিন্তু মানুষের বিচরণের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলো— সাহিত্য ও সঙ্গীত, আর ভদ্রলোকের উপযুক্ত আচরণ।”
নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে কনফুসিয়াস ভারি সুন্দর একটি কথা বলে গেছেন—”পনের বছর বয়সে আমি লেখাপড়ায় মন লাগাই। তিরিশে আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখি। চল্লিশে আমার সব সন্দেহ চলে গেল। পঞ্চাশে আমি বিবিধ বিধান বুঝতে শিখলুম। ষাটে আমার কানে এল সুর। সত্তরে আমি আমার হৃদয়ের ইচ্ছাকে অনুসরণ করলুম আর তখনি আমি শিখে গেলুম সীমা কাকে বলে।” জীবনেচ্ছারও একটা সুপরিকল্পিত অনুসরণ রেখা থাকা উচিত। নয় তো বন্য হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
জীবনের বাধ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন : “পিতামাতা যখন জীবিত থাকেন তখন তাঁদের সেবাই হলো সন্তানের ধর্ম। মৃত্যুর পর তাঁদের যথাশাস্ত্র সৎকারের ব্যবস্থা করা সন্তানের ধর্ম। সৎকারান্তে পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করা সন্তানের ধর্ম।” পরে আরো ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন : “পিতা আর মাতাকে তাঁদের নিজস্ব রোগ-ব্যাধি ছাড়া আর কোন উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেল না।” এই নির্দেশকে আরো প্রসারিত করে বলেছিলেন : “একালে পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য বলতে বোঝায় দুবেলা দুটি খেতে দেওয়া; আরে সে তো কুকুর ছাগলকেও মানুষ খেতে দেয়। তাতে কি হলো? দিতে হবে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান।”
কনফুসিয়াসের কাল আর আমাদের কাল। আমাদের কাল আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। সম্মান তো দূরের কথা, আমরা ভরণপোষণের কথাও ভুলে যাই। কনফুসিয়াস বলছেন : “অনেক সময় দেখা যায়, সন্তান তার কর্তব্য পালন করছে। আদেশ বহন করছে, আহারাদির ব্যবস্থা করছে; কিন্তু মুখে লেগে রয়েছে বিরক্তি। এই বিরক্তির ভাব থাকলে সব পণ্ড হয়ে গেল।”
আমাদের হিন্দু ভাবধারার সঙ্গে কনফুসিয়াসের শিক্ষার অদ্ভুত মিল। যেমন কনফুসিয়াস বলছেন : “পিতামাতার পারলৌকিক ক্রিয়াদি অতি সযত্নে সম্পাদন কর। উৎসর্গ প্রভৃতি করার সময় তোমার পূর্ব পূর্ব পুরুষদের কথা বিস্মৃত হয়ো না।” আমরা শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়ার সময় ঊর্ধ্বতন তিন-চার পুরুষকেও পিণ্ডদান করি। কনফুসিয়াস বলছেন : “পিতার জীবৎকালে তাঁর সন্তান কি করতে চেয়েছিল লক্ষ্য কর, পিতার মৃত্যুর পর সে কি করে তাও লক্ষ্য কর। যদি দেখ মৃত্যুর তিন বছরেও সে পিতার পথ পরিত্যাগ করেনি, তাহলেই তাকে সুসন্তান বলা যেতে পারে।”
কনফুসিয়াসকে আবার আমরা নিয়ে আসতে পারি আমাদের জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে। আমরা তাতে লাভবানই হব। আধুনিক মানুষের দৃষ্টি আবার অতীত শিক্ষার দিকে ঘুরতে শুরু করেছে। কনফুসিয়াসের আরেকটি মহৎ উক্তি দিয়ে নিবন্ধ শেষ করছি।
“তোমার ভাল কাজ অন্যের নজরে পড়ল না বলে বিচলিত হয়ো না, বরং অন্যের কাজের প্রশংসা তুমি করতে পারলে না বলে বিচলিত হও।”