কণ্টকাকীর্ণ
যথা সময়েই পৌঁছানো গেল। আমার বন্ধু সমীরের কাকার শ্রাদ্ধবাসর। আশা করেছিলাম বন্ধুবান্ধব অন্যান্য অনেকেই হয়তো আসবেন। কিন্তু গিয়ে দেখলাম আমি একা, আর সবই সমীরদের আত্মীয়স্বজন এবং পারিবারিক বন্ধুবান্ধব। একা একাই চুপচাপ বসেছিলাম, এমন সময় সমীর এসে আমার পাশে বসল।
বাইরের ঘরের পাশে একটা প্যাসেজের মধ্যে বসে আছি। একে একে অতিথি-অভ্যাগত সব প্রবেশ করছেন। সমীর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে–ইনি আমার মেজো মেলোমশাই, ইনি আমার রাঙাদির দেওর। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও সময়োচিত গাম্ভীর্যসহকারে ভদ্রতা বিনিময় করছি। এর মধ্যে একজন মধ্যবয়সি ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন, সুসজ্জিত অবয়ব। কিন্তু সমীর তার পরিচয় দিতেই আঁতকে প্রায় চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম, ইনি আমার যে কাকা মারা গেছেন, আজ যাঁর শ্রাদ্ধ…ইতিমধ্যে ভদ্রলোক আমাদের সামনে এসেছেন। আমি ইতস্তত করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে দেখা হবে আশা করিনি।
ভদ্রলোক বিগলিত হাস্যে জানালেন, হ্যাঁ, আমি একটু দূরে থাকি আজকাল, তার উপরে, আসা-যাওয়ারও অসুবিধা।
ভদ্রলোক ভেতরের দিকে চলে গেলেন। আমি সমীরকে বললাম, আমি চলি ভাই। যাঁর শ্রাদ্ধে এসেছি তার সঙ্গে দেখা হবে এরকম আশা করতে পারা যায় না। এইবার সমীর বলল, আরে, না শুনুন, ইনি হচ্ছেন আমার যে কাকা মারা গেছেন…
আমি বাধা দিয়ে বলি, আমিও সেই জন্যেই বলছিলাম।
এইবার সমীর বাক্য সম্পূর্ণ করে, আরে ইনি হচ্ছেন যে কাকা মারা গেছেন, যাঁর শ্রাদ্ধ তার বন্ধু।
অতঃপর আশ্বস্ত হওয়া গেল। সমীর ইতিমধ্যে আমাকে খুব নিচু চাপা গলায় ফিসফিস করে জানাল যে, এই ভদ্রলোক একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি–কোনও এক বিখ্যাত গন্ধতৈল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের একমাত্র স্বত্বাধিকারী, থিয়েটার রোডে বিশাল বাড়ি এবং তার অন্যান্য ঐহিক গৌরব সম্বন্ধে বহু বিষয়ও আমাকে অবগত হতে হল।
খাওয়ার ডাক পড়ল। এবং সৌভাগ্যবশত আমি ঠিক সেই ভদ্রলোকের পাশেই বসলাম। খেতে খেতে একটা জিনিস দেখে ক্রমশই বিচলিত হচ্ছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, ভদ্রলোক বড় বেশি গলাধঃকরণ করছিলেন। একে ঠিক খাওয়া বলা সম্ভব নয়, কোনও ধনবান ব্যক্তি যে এরকম গোগ্রাসে খেতে পারেন আমার ধারণায় ছিল না। এবং শেষে সেই সর্বনাশ ঘটল। আমি গুনে যাচ্ছিলাম, ষোড়শ অথবা সপ্তদশ মৎস্য খন্ডটি গিলতে গিয়ে ভদ্রলোকের গলায় কাঁটা ফুটল। এতক্ষণ কাটা যে কেন ফোটেনি সেটাই আশ্চর্য। গলায় না ফুটলেও তার পাকস্থলীতে অন্তত শতাধিক কাটা ইতিমধ্যে সমবেত হয়েছিল সে বিষয়ে আমি এবং হয়তো আরও অনেকেই নিঃসন্দেহ ছিল। সুতরাং যখন তিনি ঘোষণা করলেন যে তার গলায় একটা কাটা ফুটেছে, তখন আমরা কেউই বিশেষ আশ্চর্য হলাম না, বরং কেউ কেউ যেন এই ভেবে আশ্বস্ত হলেন যে, এইবার খাওয়ার বহর একটু কমবে।
কিন্তু কার্যকালে দেখা গেল, ফলাফল অন্য আকার ধারণ করেছে। ভদ্রলোক–ইতিমধ্যে জানা গিয়েছিল যে, ভদ্রলোকের নাম শচীবিলাসবাবু, ভয়ংকর হাঁস-ফাস শুরু করে দিলেন। তখন আমি ভদ্রলোককে বললাম, দেখুন, আমি খুব তাড়াতাড়ি খাই, আমার মধ্যে মধ্যেই গলায় কাঁটা ফোটে ও কিছু হয় না।
শচীবিলাসবাবু একবার গম্ভীর হয়ে আমার দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করলেন তারপর কঠিন কণ্ঠে বললেন সকলের জীবনের দাম সমান নয়। সত্যিই এর পরে আমার আর কিছু বলার থাকে না।
একজন পরামর্শ দিলেন শুকনো সাদা ভাত গিলে খেলে কাটা নেমে যেতে পারে। সাদা ভাত আনতে বলা হল। শচীবিলাসবাবু পর পর বড় লোহার হাতার চার হাতা সাদা ভাত গিলে ফেললেন। কিন্তু তাঁর মুখে-চোখে স্পষ্টই দেখা গেল তার কাটা তখনও রয়েছে। এবার একজন পরামর্শ দিলেন আস্ত কলা গিলে খেলে হয়তো একটা সুরাহা হতে পারে। বাড়িতে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য সুলভ হলেও কলা নেই। নিকটবর্তী বাজার তখন প্রায় বন্ধ, তবুও অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে একটা ফলের দোকান খোলানো গেল, কিন্তু দোকানদার কিছুতেই দুজনের কম কলা এতরাত্রে বেচতে নারাজ। যে কিনতে গিয়েছিল সে বাধ্য হয়ে তাই-ই কিনে আনল। সবগুলি কলাই শচীবিলাসবাবুর কাজে লাগল, কিন্তু ফল হল না,ন যযৌ ন তস্থৌ, কাঁটা স্থির। রসগোল্লার রস ফেলে শুকনো শুকনো ছিবড়ে খেলে বোধহয় উপশম হতে পারে–এবার শচীবিলাসবাবু নিজেই বাতলালেন। অনুরূপ প্রক্রিয়ায় রসগোল্লা গ্রহণ করা চলল, না গুনিনি–গোনা সম্ভব ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না। কেননা আমাদের বাকি অন্যান্যদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না, কিন্তু কাটাটি শচীবিলাসবাবুর গলায় তখনও বিধে রয়েছে। না, না এখনও খচখচ করছে। তার কাতরোক্তি অনবরত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
সকলেই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। নমো নমো করে কোনওরকমে খাওয়া শেষ করা গেল। ভাবলাম, যাক এ যাত্রা কোনওক্রমে রক্ষা পাওয়া গেল। কিন্তু শচীবিলাসবাবুর মুখচোখ দেখে চিন্তান্বিত হতে হল। শীতের রাত্রি, ডিসেম্বরের শেষাশেষি প্রবল ঠান্ডা পড়েছে। আমি খেয়ে উঠে ঠান্ডা জলে হাত ধুয়ে শীতে কাঁপছিলাম অথচ শচীবিলাসবাবুর চোখ দেখলাম গোল হয়ে গেছে, তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামও দেখলাম। আমি তখন বাধ্য হয়েই বললাম, একজন ডাক্তারের কাছে গেলে হয় না?
গেলে হয় কী, চলো। শচীবিলাসবাবু ককিয়ে ককিয়ে আদেশ করলেন। আমি সমীরকে বললাম, চলো, দেখা যাক।
শচীবিলাসবাবুর গাড়িতে উঠতে উঠতে শচীবিলাসবাবু বললেন, হ্যারিসের কাছে গেলে হত। হ্যারিস পার্ক স্ট্রিটে বিখ্যাত কর্ণ-কণ্ঠ-নাসিকা বিশেষজ্ঞ। হ্যারিসকে আমিও অল্প অল্প জানি। রাত এগারোটা বেজে গেছে। রাত নটার পর তার কাছে কেউ ভীষণ বিপদে পড়লেও যায় না, পাঁড়মাতাল, বিশেষ করে এই এগারোটা নাগাদ নেশাটা চরমে ওঠে, এখন গলার কাঁটা বার করতে গলা কেটেও ফেলতে পারে। আমি বিশেষ ভরসা পেলাম না। আমি ব্যাপারটা শচীবিলাসবাবুকে একটু সংক্ষেপে বললাম।
শচীবিলাসবাবু বললেন, তা হলে?
তা হলে একটা হাসপাতালে গেলে হয়। সমীর বিনীতভাবে জানাল।
হাসপাতালে…–ভীষণ রকম আঁতকে উঠলেন শচীবিলাসবাবু। যেন তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত গত্যন্তর না দেখে তিনি হাসপাতালে যেতেই রাজি হলেন।
গাড়ি চলেছে। শীতের কনকনে হাওয়া। শচীবিলাসবাবু আমাদের দুজনের মধ্যে বসে। একপাশে সমীর, আর একপাশে আমি। গলার ব্যথায় অল্প অল্প কাতরাচ্ছেন। কিন্তু এরই মধ্যে দেখলাম তার বৈষয়িক বুদ্ধি যথেষ্টই প্রখর। আমার সৌভাগ্যবশত আমি শচীবিলাসবাবু যে তৈলব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সেই তেলটি ব্যবহার করে থাকি। শচীবিলাসবাবু এর মধ্যে একবার আমার মাথা, একবার সমীরের মাথা গুঁকে বললেন, এ ছেলেটি তো বেশ ভাল, আমাদের তেল মাখে। সমীর, তুমি আমাদের তেল মাখো না কেন?
সমীর আমতা আমতা করতে করতে বলল। মাখি, মাখি, কিন্তু আমার মাথা এরকম যে… আমার মাথায় গন্ধ বেরোয় না। শচীবিলাসবাবু এই দুর্দশার মধ্যেও বিচলিত বোধ করলেন এই উক্তিতে। আমি সমীরের এ ধরনের উক্তির সঙ্গে পরিচিত, তবুও হেসে ফেললাম।
গাড়ি হাসপাতালের সামনে এসে গেল। তিনজনে নামলাম। হাসপাতালে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। একজন লোক বসে ঝিমুচ্ছিল, আমাদের দেখেই উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, কার গলায় কাঁটা ফুটেছে? প্রায় হকচকিয়ে গেলাম লোকটির এই গোয়েন্দাদর্শিতা দেখে। অবশ্য পরে বুঝেছিলাম ব্যাপারটা, ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে এত রাত্রে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে জনকয়েক লোক এসে উপস্থিত হলে এদের পুরানো অভিজ্ঞতা থেকেই এরা বুঝতে পারে আসল ঘটনা, কোনও নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে সোজা এতরাত্রে চলে এসেছে। হামেশা এরকম ঘটছে, রোজ রাত্তিরেই এত বড় শহরে কোনও-না-কোনও নিমন্ত্রণ বাড়িতে কারও কারও গলায় কাঁটা ফুটেছে।
যা হোক, লোকটি ভেতরে গিয়ে ডাক্তারকে খবর দিল। একেবারেই তরুণ ডাক্তার। শীতের রাত্রিতে লাল সোয়েটার গায়ে দিয়ে পিছনের একটা কম্পাউন্ডে ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন। এত সামান্য ব্যাপারে খেলায় বাধা পড়ায় বেশ একটু রাগতভাবেই প্রবেশ করলেন বলে বোধ হল। অল্প একটু কথা বলে শচীবিলাসবাবুর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। ভেতরের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন আর আমাদের পর্দার বাইরে দাঁড়াতে বললেন।
আমি আর সমীর দুজনে বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন অনুসরণ করতে লাগলাম। শচীবিলাসবাবুর কণ্ঠ কিঞ্চিৎ ক্ষীণ, সব সময় শোনা যাচ্ছিল না, আর ডাক্তারের প্রশ্ন উগ্র থেকে উগ্রতর হচ্ছিল–কটা মাছ খেয়েছিলেন? চল্লিশ, ত্রিশ? কম? কলা? কলা কডজন? লেডিকেনি– লেডিকেনি খাননি? রসগোল্লা? দই খাননি কেন, দই খেলে কাঁটা নামতে পারে। ও, তা জানতেন না। দেখি, হ্যাঁ, হাঁ করুন, আরও, আর একটু। না কাঁটা নেই। কী বললেন! আছে খচখচ করছে নেই! এখন আর নেই, তাহলে গলা কেটে দেখতে হয়। কেন, কাল সকালে আবার আসবেন কেন? এখন দেখছি নেই, আবার গিয়ে মাছ খেতে চান নাকি? তাহলে কাল সকালে আবার কাঁটা আসবে কোথা থেকে?
এতক্ষণে শচীবিলাসের কণ্ঠ শোনা গেল–
না, এই দিনের বেলায় ভাল করে দেখবেন আর কী?
দিনের বেলায়, দিনের বেলায় কি আপনার গলার মধ্যে সূর্য উঠবে? দেখলাম টর্চ দিয়ে, এর আবার দিন-রাত্রি কী? ডাক্তার রীতিমতো উত্তেজিত।
একটু পরেই শচীবিলাসকে প্রায় নিরাশ হয়েই বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তিনজনে আবার গাড়িতে উঠলাম। একটা ঢেঁকুর তুলে শচীবিলাস বললেন, এই এখনও একটু খচখচ করছে, ডাক্তারটা কোনও কাজের নয়। গাড়ি থিয়েটার রোড পর্যন্ত প্রায় পৌঁছে গেছে, এমন সময় আবার শচীবিলাস চিৎকার করে উঠলেন, এই ভীষণ সাংঘাতিক ভুল হয়ে গেছে। আবার ডাক্তারের কাছে। যেতে হবে। এই গাড়ি ঘোরাও। গাড়ি ঘোরাতে হল, আমি আর সমীর বিস্মিত।
ভয়ানক ঠান্ডা চারদিকে। রাত একটা বোধহয় বেজে গেছে। ঘড়ির দিকে আর তাকাচ্ছি না। আবার হাসপাতালে পৌঁছলাম। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে প্রায় এক ঘণ্টা পরে ডাক্তারকে ঘুম ভেঙে তোলা হল। তিনিও বিস্মিত। চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল আবার? শচীবিলাস বললেন, একটা কথা জানা হয়নি স্যার, রাত্রে কী খাব?