কঙ্কাল-সারথি
উঃ! ম্যালেরিয়ার মতন ছ্যাঁচড়া অসুখ পৃথিবীতে আর কিছু আছে কি? উঁহু!
এই দেখো না, শখ করে সেদিন ঢাকুরিয়ার লেক দেখতে গিয়েছিলুম, সন্ধ্যার একটু আগে। হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে আমার জ্বর এল।
সে কী যে-সে জ্বর, যে-সে কাঁপুনি? না-পারি দাঁড়াতে, না-পারি বসতে— একেবারে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লুম। কী শীত রে বাপ! পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো হয়ে রইলুম।
সেইভাবে কতক্ষণ ছিলুম, ভগবান জানেন। তবে একবার চাদরের ভেতর থেকে জুল-জুল করে চোখ মেলে উঁকি মেরে দেখলুম, চারিদিকে গাঢ় অন্ধকারের মেলা, কোথাও জনমানবের সাড়া নেই।
বুকটা ছাঁৎ করে উঠল। কোথায় বাগবাজারে আমার বাড়ি, আর কোথায় পড়ে আছি আমি একলা। গুন্ডারা গলায় ছুরি বসাতে পারে, সাপে কামড়াতে পারে, বিনা চিকিৎসায় প্রাণপাখি ফুড়ুক করে পালিয়ে যেতে পারে! বাড়ির লোক এতক্ষণে হয়তো ভেবেই সারা হচ্ছে!
আর তো এখানে থাকা চলে না! যেমন করেই হোক, আমাকে আজ বাড়ি যেতে হবে।
অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালুম। গায়ের ভেতর দিয়ে তখনও যেন আগুনের ঝলক ছুটছে। চোখের সামনে দিয়ে যেন রাশি রাশি সরষে ফুল নাচতে নাচতে একবার আঁধার সাগরে ডুবে যাচ্ছে, আর একবার ভেসে ভেসে উঠছে। প্রতিবার পা ফেলি আর মনে হয়, এই বুঝি আমি দড়াম করে পপাত ধরণীতলে হলুম। তবু থামলুম না, টলতে টলতে এগিয়ে চলেছি মাতালের মতো।
রাত ঝাঁ-ঝাঁ করছে। সেই রাত্রে আমি প্রথম বুঝতে পারলুম, পৃথিবী কত বেশি স্তব্ধ হতে পারে! শহরের হট্টগোলে রাগ হয় বটে, কিন্তু এ স্তব্ধতাও সহ্য করা অসম্ভব! একটা ব্যাঙ, কী একটা ঝিঁঝিপোকা কী একটা পাহারাওয়ালার নাক পর্যন্ত ডাকছে না, গাছের পাতায় বাতাসের একটু নিশ্বাস পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না।
সারি সারি কোম্পানির আলোর থামগুলো নীরবে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত চক্ষে যেন থমথমে অন্ধকারকে নিরীক্ষণ করছে। তিমির তুলির প্রলেপ-মাখানো গাছপাতার ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির-পর-বাড়ি দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু তারাও যেন প্রেতপুরীর মতো নিস্তব্ধ। তাদের ভেতর থেকে একটা ঘুম-ভাঙা খোকার কান্নার আওয়াজ পর্যন্ত জেগে উঠছে না। কে যেন আজ নিদুটির মন্ত্র পড়ে সমস্ত জগৎকে বোবা করে দিয়েছে।
জ্বরের ঘোরে চলেছি তো চলেছিই। এই নিঃশব্দ পল্লি ছেড়ে শহরের শব্দের রাজ্যে গিয়ে পড়বার জন্যে প্রাণ যেন আইঢাই করতে লাগল। কিন্তু এ পথ আর শেষ হতে চায় না। এ পথ যেন আজও শেষ হবে না, কালও শেষ হবে না। আমাকে যেন কোনো অভিশপ্ত আত্মার মতন চলতে হবে অনন্তকাল ধরে! এক বেচারি ইহুদির গল্প পড়েছিলুম। কার শাপে তাকে নাকি অনন্তকাল ধরে সারা বিশ্বে ছুটোছুটি করে বেড়াতে হয়েছিল। আমারও তাই নাকি?
মাথাটা একবার নাড়া দিয়ে ভাবলুম, ‘দূর ছাই, এসব কী উদ্ভট কথা ভাবছি! জ্বরে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
মাঝে মাঝে এক-একটা মাঠ— যেন এক-একটা অন্ধকারের মায়া-সরোবর। সেখান দিয়ে যেন অন্ধকারের ঢেউ বইছে। অন্ধকারের স্রোত ছুটে আসছে আমাকে গ্রাস করবার জন্যে! অন্ধকারের তরঙ্গের ভেতরে গাছগুলোকে দেখাচ্ছে বড়ো বড়ো দৈত্য-দানবের মতো— পথিকের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে তারা ওৎ পেতে প্রস্তুত হয়ে আছে। কান্না-ভরা কনকনে বাতাস এসে চুপি চুপি যেন আমার কানে কানে বলে যাচ্ছে— ওহে নিঝুম রাতের অজানা মানুষ, এ মৃত্যুপুরীর ভিতর দিয়ে কোথায় চলেছ তুমি? আমার কথা শোনো, ভূতপ্রেতরা একে-একে জেগে উঠছে, এইবেলা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাও, যাও গো!
আরও খানিক অগ্রসর হয়ে মনে হল, পৃথিবীর সমস্ত শব্দ এসে আমার দুই পায়ের দুই জুতোর ভিতরে আশ্রয় নিয়েছে। প্রত্যেকবার পা ফেলি আর সেই শব্দগুলো জুতোর ভেতর থেকে চমকে উঠে রাজপথের ওপরে আছাড় খেয়ে পড়ে আমাকে চমকে চমকে তোলে। শব্দ শুনতে চাই, নিজের পায়ের শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু কেন জানি না, সে শব্দ শুনে শুনে মন আমার খুশি হবে কী, আরও বেশি নেতিয়ে পড়তে লাগল!— সে যেন রাজপথে ঘুমন্ত কোনো অশরীরী প্রেতাত্মার চিৎকার, আমার পদাঘাতে সে যন্ত্রণায় গজরে গজরে উঠছে!
আঃ! এতক্ষণ পরে রসা রোডের মোড়ে এসে পড়লুম। আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ট্রামওয়ের একটা লোহার থামে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ জিরিয়ে নিলুম।
এখানটাও তেমনি নির্জন ও তেমনি নিস্তব্ধ হলেও আমার মন যেন অনেকটা আরাম পেল। এই তো ট্রামের রাস্তা। এই পথ ধরে সিধে গেলেই— যত মাইল দূরেই থাক— আমাদের পাড়া বাগবাজার যাওয়া যাবেই যাবে! খানিক দূর এগোতে পারলেই লোকজনেরও সাড়া পাব নিশ্চয়, আর ট্রাম ও বাস বন্ধ হলেও ট্যাক্সি মেলাও তো অসম্ভব নয়।
তখন জ্বরে আমার চোখ ছলছল করছে, কান করছে ভোঁ-ভোঁ, আর মাথা ঘুরছে বোঁ-বোঁ করে। বার বার ইচ্ছে হতে লাগল পথের ওপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়বার জন্যে, কেবল বাপ-মায়ের বিষণ্ণ মুখের কথা ভেবেই মনের সে ইচ্ছা দমন করলুম, অনেক কষ্টে। নিজে-নিজেই বললুম— মন, তুমি শান্ত হও! এই পথের শেষেই আছে তোমার বাড়ি, তোমার আত্মীয়স্বজন, তোমার নরম তুলতুলে বিছানা। কোনোরকমে চক্ষু মুদে এই পথটুকু পার হতে পারলেই— ব্যাস, সকল কষ্ট, সকল ভাবনার অবসান!
হঠাৎ দূর থেকে একটা শব্দ জেগে উঠে চারিদিকের নিস্তব্ধতার মুখে যেন ভাষ্য দিলে। ঘড় ঘড় ঘড় ঘড় করে একটা বাজ ডাকার মতো শব্দ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার পরেই শুনলুম ভেঁপুর আওয়াজ— ভোঁপ, ভোঁপ, ভোঁপ, ভোঁপ!
ট্যাক্সি, না বাস?
আহ্লাদে চাঙ্গা, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে রইলুম।
তারপরেই দেখা গেল, নীচে দুটো আর ওপরে একটা আলো। তিনটে আলো দেখেই বুঝলুম, ট্যাক্সি নয়, বাস আসছে!
তাহলে জ্বরের ধমকে আমি ভুল বুঝেছিলুম। বাস যখন চলছে তখন রাত খুব বেশি হয়নি। কিন্তু আশ্চর্য, এরই মধ্যে এ-অঞ্চলটা এমন ভয়ানক নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে? বাবা! আমার কলকাতার গোলমাল বেঁচে থাক, এ অঞ্চলে আবার ভদ্রলোক বাস করে?
কিন্তু বাসের আলো অত বেশি জ্বলছে কেন, সামনের সারা পথে সে যেন আগুনের ঢেউ বইয়ে ছুটে আসছে! আর এই নিরালা পথে অত জোরে ভেঁপু বাজাবারই বা দরকার কী, এ-অঞ্চলের সন্ধের পরেই ঘুমকাতুরে লোকগুলোর কানে যে তালা ধরে যাবে!
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ধুলোয়-ধুলোয় পথ অন্ধকার করে একখানা রাঙা টকটকে মস্ত বড়ো বাস আমার কাছে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন তীব্র তীক্ষ্ন স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ধর্মতলা— ওয়েলিংটন— শ্যামবাজার!’
আমি তাড়াতাড়ি বাসে উঠে একখানা গদি-মোড়া আসনের ওপর থপ করে বসে পড়লুম। হোক শ্যামবাজারের বাস। এই স্তব্ধ মড়ার মুল্লুক থেকে তো এখন সরে পড়ি। শ্যামবাজার থেকে বাগবাজার পায়ে হেঁটে যেতে এমন বিশেষ দেরি লাগবে না।
কিন্তু কেন জানি না, বাসের ভেতর ঢুকেই আমার বোধ হল, আমি যেন এক জগৎ ছেড়ে আর এক অচেনা জগতের ভেতরে প্রবেশ করলুম!
বাস ছুটছে, আর ভেঁপু বাজছে। এত বেগে বাস ছুটছে, তার জানালাগুলো সব খোলা রয়েছে, অথচ বাইরে থেকে বাতাসের একটুখানি ঝলক পর্যন্ত আমার গায়ে লাগছে না। ভারি অবাক হয়ে গেলুম। আমার জ্বর কী এত বেশি হয়ে উঠেছে যে, দেহের অনুভব করবার ক্ষমতাটুকুও আর নেই!
পথ তেমনি নির্জন আর নিঃসাড়। কিন্তু বাতাসও কি আজ ঘুমিয়ে পড়েছে? আমার মনে হতে লাগল, দমবন্ধ হয়ে সারা পৃথিবী আজ মারা পড়েছে— তার কোথাও আর জীবনের লক্ষণ নেই। বেঁচে আছি খালি আমি ও এই বাসের ড্রাইভার আর কন্ডাকটার।
আমরা তিনজন ছাড়া বাসের ভেতরেও কোনো আরোহী ছিল না। থাকবেই বা কেন? এত রাতে কার ঘাড়ে ভূত চাপবে যে বাসে চড়ে বেড়াতে বেরোবে!
বাসের ভেঁপু বাজছে আর বাজছে। কান যে ঝালাপালা হয়ে গেল! কন্ডাকটরের দিকে ফিরে বিরক্তস্বরে বসলুম, ‘ড্রাইভারকে বারণ করে দাও! পথে লোকও নেই গাড়িও নেই— তবু এত হর্ন বাজাচ্ছে কেন?’
লোকটা শিখ। মস্ত বড়ো লম্বা দেহ, মস্ত বড়ো দাড়ি। কালা আর বোবার মতো আমার পানে আড়ষ্ট চোখে তাকিয়ে রইল।
আবার বললুম, ‘শুনছ? হর্ন দিতে বারণ করো!’
সে তবুও জবাব দিলে না। ড্রাইভারকে হর্ন থামাতেও বললে না। লোকটা সত্যি-সত্যিই কালা ও বোবা নাকি? কিন্তু তাই বা হবে কী করে? এই খানিক আগেই তো সে ধর্মতলা— ওয়েলিংটন— শ্যামবাজার বলে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করছিল।
সে বোধ হয় আমার কথার জবাব দিতে চায় না। এরা কি ভেবেছে যে এদের ভেঁপুর আওয়াজে সারা শহরের ঘুম ভেঙে যাবে, আর তাহলেই সবাই বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে ছুটে এসে বাসের প্যাসেঞ্জার হয়ে বসবে?
কিন্তু শহর জাগবার লক্ষণ প্রকাশ করলে না। পথের আশেপাশে নেড়ি কুকুরগুলো আরাম করে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু এই বাসের সাড়া পেয়েই তারা তাড়াতাড়ি উঠে লেজ পেটের তলায় ঢুকিয়ে ছুটে পালাতে লাগল— মহা ভয়ে ঘেউ ঘেউ করে কাঁদতে কাঁদতে। আজকে বাইরের জীবের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে কেবল ওই কুকুরগুলোর কাছ থেকে, কিন্তু তারাও দেখা দিয়েই অদৃশ্য হচ্ছে।
কুকুরগুলো কেন আমাদের বাস দেখে পালাচ্ছে? মনের ভেতর কেবল এই প্রশ্নই জাগতে লাগল— কেন? কেন? কেন?
কন্ডাকটার কেন আমার কথার জবাব দিচ্ছে না?— কেন? কেন? কেন?
ড্রাইভার কেন ক্রমাগত ভেঁপু বাজাচ্ছে?— কেন? কেন? কেন?
কন্ডাকটারের দিকে ফিরে বললুম, ‘তোমার ভাড়ার পয়সা নাও।’
সে মস্ত একখানা কালো হাত বাড়ালে। ভাড়া দিয়ে টিকিট নেওয়ার সময় আমার হাতে তার হাতের ছোঁয়া লাগল— উঃ, অমনি মনে হল কে যেন একখানা তীক্ষ্ন বরফের ছুরি নিয়ে আমার হাতে খ্যাঁচ করে খোঁচা মারলে! জ্যান্ত মানুষের হাত এমন ঠান্ডা কনকনে হয়!
আশ্চর্য হয়ে তার মুখের পানে তাকালুম। তার লম্বা চুল আর দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে ভরা মুখখানা বাসি মড়ার মতো স্থির। তার চোখেও পলক পড়ছে না। তার চোখ যেন পাথরে গড়া।
আমার বুকটা গুর-গুর করতে লাগল। আজকে শহরের এই নির্জনতা, পৃথিবীর এই নিঃশব্দতা, বাতাসের এই অভাব, ভাড়াটে বাসের এই ভেঁপুর আওয়াজ, কন্ডাকটারের এই উদাসীন মূর্তি— সমস্তই যেন রহস্যময়, সমস্তই যেন অস্বাভাবিক।
কী কুক্ষণেই আজ বাড়ির বাইরে পা দিয়াছি!
যতবার ফিরে তাকাই, ততবারই কন্ডাকটারের সেই মড়ার মতো স্থির মুখ আর পলক-হারা পাথুরে দৃষ্টি চোখে পড়ে। কেমন একটা অমানুষিকভাবে আমার মনটা ছেয়ে গেল। আর সহ্য করতে পারলুম না। সামনের বেঞ্চের ওপরে দুই হাতের ভিতরে মাথা রেখে চোখ মুদে আমি চুপ করে বসে রইলুম। ভাবলুম শ্যামবাজারে পৌঁছবার আগে আর মাথা তুলে চাইব না।
কিন্তু মাথা তুলতে হল— আবার চোখ খুলতেও হল।
প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় কেটে গেছে, গাড়িও না-থেমে ক্রমাগত ছুটছে, তবু এখনও শ্যামবাজার এল না কেন?
মুখ তুলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমার আর বিস্ময়ের সীমা রইল না। শ্যামবাজার তো অনেক দূরের কথা, গাড়ি এখনও ভবানীপুরেই আসেনি! অথচ গাড়ি এত বেগে ছুটছে যে, পথের দু-পাশের বাড়িগুলো তীরের মতন পিছনে সরে সরে যাচ্ছে। এও কি সম্ভব?
হতভম্বের মতন মুখ ফিরিয়ে দেখি, গাড়ির ভেতরে দশ-বারোজন লোক বসে রয়েছে। নিজের চোখকেও আমি বিশ্বাস করতে পারলুম না?
আমি হলপ করে বলতে পারি, এতক্ষণের ভেতরে গাড়ি একবারও থামেনি; তবু কোত্থেকে এরা এল, কখন এরা গাড়িতে উঠল?
একে-একে সকলের মুখের পানেই তাকিয়ে দেখলুম। সব মুখই মড়ার মতন স্থির, নির্বিকার; সব চোখের পাথুরে দৃষ্টিই আড়ষ্ট হয়ে আছে। কে যেন শ্মশান থেকে কয়েকটা মৃতদেহ তুলে এনে বেঞ্চির ওপরে সারি সারি বসিয়ে দিয়ে গেছে!
তাদের ভেতরে বাঙালি আছে, খোট্টা আছে, সায়েব আছে। কিন্তু তারা সবাই চেয়ে আছে আমার দিকেই। সে চাউনিতে কোনো ভয়ের আমেজ নেই। সে চাউনি যেন চাউনিই নয়; অথচ সে চাউনি দেখলেই গা-ছমছম করে, দেহের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। তাদের চাউনি যেন চোখের ভিতর দিয়ে আসছে না, আসছে আলোকের ওপার থেকে অন্ধকারের আত্মার ভেতর থেকে, যে দেশে জ্যান্ত মানুষ নেই সেই দেশ থেকে! ভাবহীন অথচ ভয়ানক তাদের সেই চাহনি!
আর এক আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, গাড়ির ঝাঁকুনিতেও তাদের কারুর দেহ একটুও নড়ছে না। গাড়ির ভেতরে বসেও তাদের দেহ যেন গাড়িকে না-ছুঁয়ে শূন্যে বিরাজ করছে। মনে হতে লাগল, আমার অজ্ঞাতসারে যেমন হঠাৎ তারা গাড়ির ভেতর উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তেমনি হঠাৎ তারা আবার হাওয়া হয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যেতে পারে, আমার অজান্তেই। যেন তারা ছায়ার কায়াহীন অনুচর— দেখা দেয়, ধরা দেয় না।
আমার সভয় দৃষ্টি আবার পথের দিকে ফিরিয়ে নিলুম। গাড়ি তেমনি হেঁচকি তোলা আওয়াজের মতন ভেঁপুর শব্দ করতে করতে তিরবেগে ছুটছে; কিন্তু তখনও ভবানীপুর আসেনি। আমি শ্যামবাজারে, না সোজা যমালয়ের দিকে চলেছি!
কী এক দুঃসহ অজানা টানে অস্থির হয়ে চোখ আবার গাড়ির ভেতরে ফেরালুম। গাড়িতে ইতিমধ্যে লোকের সংখ্যা আরও বেড়ে উঠেছে। নতুন লোকগুলোও স্থির নেত্রে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
সমস্ত গাড়ির ভেতরে একটা বোটকা গন্ধ ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। যেন বাসি মড়ার গন্ধ! হাসপাতালের মড়ার ঘরে গিয়ে আমি এইবার এইরকম গন্ধ পেয়েছিলুম।
আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিলে, বুকের কাছটা শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। আমি কি জেগে আছি, না স্বপ্ন দেখছি?
আর থাকতে না-পেরে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বললুম, ‘এই কন্ডাকটার, গাড়ি বাঁধো!’
কন্ডাকটার কোনো সাড়া দিলে না, গাড়ি থামাবারও চেষ্টা করলে না।
আবার বললুম, কিন্তু ফল হল না।
রেগে দাঁড়িয়ে উঠে কন্ডাকটারের দেহ আমি নাড়া দিতে গেলুম; কিন্তু তাকে ছুঁতে পারলুম না। চোখের সামনে তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে পাচ্ছি না— সে যেন হাওয়া দিয়ে তৈরি।
হঠাৎ গাড়ির সব লোক একসঙ্গে অট্টহাস্য শুরু করে দিলে। সে অদ্ভুত বীভৎস হাসি আসছে যেন অনেক দূর থেকে, অনেক আকাশ ভেদ করে অনেক সমুদ্র পাহাড় প্রান্তর পার হয়ে, অনেক নরকের অন্ধকারে ডুব দিয়ে; অথচ তার আওয়াজ এত স্পষ্ট যে, আমার কান যেন ফেটে যাওয়ার মতো হল।
আমি পাগলের মতো চিৎকার করে বললুম, ‘গাড়ি থামাও, জলদি থামাও— এই ড্রাইভার!’ গাড়ি-থামানো ঘণ্টার দড়ি ধরে আমি ঘন ঘন নাড়তে লাগলুম।
ড্রাইভার এতক্ষণ পরে আমার দিকে মুখ ফেরালে— সে মুখে একতিলও মাংস নেই! সে মুখ সাদা ধবধবে হাড়ের মুখ; নাক-চোখের জায়গায় তিন-তিনটে গর্ত, দু-ঠোঁটের জায়গায় দু-সারি দাঁত বেরিয়ে আছে!
এতক্ষণ তবে এই পোশাক পরা কঙ্কালটাই গাড়ি চালিয়ে আসছে।
গাড়ির ভেতরে অট্টহাসির আওয়াজ বেড়ে উঠল।
আর সইতে পারলুম না। সেই ভীষণ অট্টহাসি শুনতে শুনতে আমি একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেলুম।
জ্ঞান হলে দেখলুম, নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। আমার চারপাশে বসে মা, বাবা, ভাই আর বোনেরা।
শুনলুম, আমি নাকি রসা রোডের ফুটপাতের ওপরে জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে শুয়েছিলুম।
কালকের রাতের বিভীষিকার কথা সকলকে বললুম।
বাবা বললেন, ‘ও-সব বাজে কথা। জ্বরের ঝোঁকে লেকের ধার থেকে রসা রোড পর্যন্ত এসে তুমি বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলে। তারপর ওই সব খেয়াল দেখেছ।’
কিন্তু আমার মন বলতে লাগল, ‘না-না, আমি যা দেখেছি তা খেয়াল নয়, খেয়াল নয়!’