ওলাইতলার বাগানবাড়ি
স্টেশনমাস্টার তাঁর লণ্ঠনটা আমার মুখের সামনে তুলে ধরলেন। তারপর থেমে থেমে বললেন, ‘ওলাইতলার বাগানবাড়ি!… আপনিও ওলাইতলার বাগানবাড়িতে যাচ্ছেন?…কিন্তু কেন?’
‘মামুদপুরের জমিদার কৃতান্ত চৌধুরি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, তাঁর একজন ম্যানেজার দরকার।’
‘তিন-শো টাকা মাহিনা। কেমন, তাই নয় কি?’
‘হুঁ।’
‘তারাও এই কথা বলেছিল।’
‘কারা!’
‘আপনার আগে যারা ম্যানেজারি করতে এসেছিল। গেল আট হপ্তায় আটজন লোক এই ইস্টিশানে নেমে ওলাইতলার বাগানবাড়িতে গেছে। কিন্তু তারা কেউ আর এ পথ দিয়ে ফেরেনি।…বুঝলেন মশাই? তারা কেউ আর ফেরেনি!’
‘তার মানে?’
‘মানেটানে জানি নে। প্রত্যেকেই এসেছে আপনার মতো ঠিক শনিবারেই। আর ঠিক সন্ধ্যা ছয়টার গাড়িতে।…আশ্চর্য কথা! আট হপ্তায় আটজন! জমিদার কৃতান্ত চৌধুরির কত ম্যানেজারের দরকার?’
আমার মনটা কেমন ছাঁৎ করে উঠল। শুধালুম, ‘আচ্ছা, এই জমিদারবাবুকে আপনি চেনেন?’
‘উহুঁ। তবে তাঁর নাম শুনেছি। অল্পদিন হল এখানে এসে ওই পোড়ো বাগানবাড়িখানা কিনে তিনি বাস করছেন। তাঁর সম্বন্ধে নানান কানাঘুষো শুনছি। আজ পর্যন্ত গাঁয়ের কেউ তাঁকে দেখেনি। দিনের বেলায় ওই বাগানবাড়িখানা পোড়ো বাড়ির মতো পড়ে থাকে। কেবল রাত্রেই তার ঘরে আলো জ্বলে। লোকজনকেও দেখা যায় না। ও-বাড়ির সবই অদ্ভুত!’
আজ অমাবস্যা। আকাশে চাঁদ উঠবে না। তার উপরে মেঘের-পর-মেঘ জমে আছে। ঠান্ডা হাওয়া পেয়ে বুঝলুম, বৃষ্টি আসতে আর দেরি নেই। সঙ্গে আমার শখের বুলডগ রোভার ছিল। ওলাইতলার বাগানবাড়ির দিকে অগ্রসর হবার উপক্রম করলুম। স্টেশনমাস্টারের কথায় কান পাতবার দরকার নেই—লোকটার মাথায় বোধহয় ছিট আছে, নইলে এমন সব আজগুবি কথা বলে?
স্টেশনমাস্টার ডেকে বললেন, ‘মশাই, তাহলে নিতান্তই যাবেন?’
‘এই রকম তো মনে করছি।’
‘তাহলে পথঘাট একটু দেখেশুনে যাবেন। ওলাইতলার বাগানবাড়ির ঠিক আগেই একটা গোরস্থান আছে, আগে সেখানে ক্রিশ্চানদের গোর দেওয়া হত। গোরস্থানের নাম ভারী খারাপ, সন্ধ্যার পর সেদিকে কেউ যেতে চায় না।’
আমি আর থাকতে পারলুম না, বললুম, ‘মশাই, মিথ্যে আমায় ভয় দেখাচ্ছেন, আমি কাপুরুষ নই। দরকার হলে ওই গোরস্থানে শুয়েই রাত কাটাতে পারি।’
অত্যন্ত দয়ার পাত্রের দিকে লোকে যেমনভাবে তাকায়, সেইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে স্টেশনমাস্টার একটুখানি ম্লান হাসি হাসলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।
দামোদর নদীর ধারে ওলাইতলার সেই প্রকাণ্ড বাগান ও প্রকাণ্ড বাড়ি।
মাইলখানেক পথ চলার পর যখন তার ফটকের সুমুখে গিয়ে দাঁড়ালুম, তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। দেউড়িতে দ্বারবানের কোনো সাড়া না-পেয়ে, ফটক ঠেলে ভিতরে গিয়ে ঢুকলুম।
আমার হাতে ছিল একটি হ্যারিকেন লণ্ঠন। তারই আলোতে যতটা পারা যায় দেখতে দেখতে এগুতে লাগলুম। অনেক কালের পুরোনো বাগান এবং তার অবস্থা এমন যে তাকে বাগান না-বলে জঙ্গল বলাই উচিত।
পুকুরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলুম, পানায় তার জল নজরে পড়ে না, ঘাটগুলোও ভেঙে গিয়েছে। বাড়িখানার অবস্থাও তথৈবচ। ভাঙা জানলা, ভাঙা থাম, চুন-বালি সব খসে পড়েছে।
যে-জমিদার তিন-শো টাকা মাইনে দিয়ে ম্যানেজার রাখবেন, এইখানে তাঁর বাস! মনে খটকা লাগল।
অসংখ্য ঝিঁঝি পোকার আর্তনাদ ছাড়া কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া নেই; অথচ বাড়ির ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। একটু ইতস্তত করে চেঁচিয়ে ডাকলুম, ‘বাড়িতে কে আছেন?’
সামনের ঘর থেকে মোটা গলায় সাড়া এল, ‘ভেতরে আসুন।’
ঘরের ভিতরে ঢুকলুম। মস্ত বড়ো ঘর, কিন্তু কোণে কোণে মাকড়সার জাল, দেয়ালে দেয়ালে কালি-ঝুল, মেঝেয় এক ইঞ্চি পুরু ধুলো। একটা ময়লা রং-ওঠা টেবিল, তিনখানা ভাঙা চেয়ার ও একটা খুব বড়ো ল্যাম্প ছাড়া ঘরে আর কোনো আসবাব নেই।
অতিশয় শীর্ণ কুচকুচে কালো এক জরাজীর্ণ বুড়ো লোক আদুড় গায়ে একখানা চেয়ারের উপরে বসে আছে। তার বুকের সব ক-খানা হাড় গোনা যায়।
বুড়ো কথা কইলে, ঠিক যেন হাঁড়ির ভিতর থেকে তার গলার আওয়াজ বেরুল। সে বললে, ‘আপনি কাকে চান?’
‘জমিদার কৃতান্তবাবুকে।’
‘ও নাম আমারই। আপনার কী দরকার?’
‘আপনি একজন ম্যানেজার খুঁজছেন, তাই—’
‘বুঝেছি, আর বলতে হবে না। বসুন।’
কৃতান্তবাবুর কাছে গিয়েই রোভার হঠাৎ গরর-গরর করে গর্জে উঠল।
কৃতান্তবাবু ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘ও কী! সঙ্গে কুকুর এনেছেন কেন? কামড়াবে নাকি!’
রোভারকে এক ধমক দিলুম। সে গর্জন বন্ধ করল বটে, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে অনেক তফাতে সরে গিয়ে তীক্ষ্ণ সন্দিগ্ধ চোখে কৃতান্তবাবুর মুখের পানে তাকিয়ে রইল।
বিরক্তভাবে কৃতান্তবাবু বললেন, ‘ও কুকুর-টুকুর এখানে থাকলে চলবে না। ওকে এখনই তাড়িয়ে দিন।’
আমি বললুম, ‘তাড়ালেও ও যাবে না। রোভার আমাকে ছেড়ে একদণ্ডও থাকে না, রাত্রেও আমার সঙ্গে ঘুমোয়।’
‘রাত্রেও ও-বেটা আপনার সঙ্গে ঘুমোয়? কী বিপদ, কী বিপদ!’ বলে তিনি চিন্তিত মুখে ভাবতে লাগলেন।
রোভার রাত্রে আমার সঙ্গে ঘুমোবে শুনে কৃতান্তবাবুর এতটা দুশ্চিন্তার কারণ বুঝতে পারলুম না।
খানিকক্ষণ পরে কৃতান্তবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘একটু বসুন। আপনার খাওয়া-শোয়ার ব্যবস্থা করে আসি।’
‘সে জন্যে আপনার ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আগে যে জন্যে এসেছি সেই কথাই হোক।’
‘আজ আমার শরীরটা ভালো নেই। কথাবার্তা সব কাল সকালেই হবে।’ এই বলে কৃতান্তবাবু বেরিয়ে গেলেন।
খানিক পরেই তিনি আবার ফিরে এসে বললেন, ‘আসুন, সব প্রস্তুত।’
তাঁর পিছনে পিছনে অগ্রসর হলুম। মস্ত উঠান ও অনেকগুলো সারবন্দি ঘর পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গিয়ে উঠলুম। বাড়ির সর্বত্রই সমান ভগ্নদশা, ধুলো আর জঞ্জালের স্তূপ, চামচিকে আর বাদুড়ের আনাগোনা। একটা চাকর-বাকর পর্যন্ত দেখা গেল না। নির্জন বাড়ি যেন খাঁ-খাঁ করছে।
একটা ছোটো ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। সে ঘরখানা বেশি নোংরা নয়। একপাশে ছোটো একখানা চৌকি, তার উপরে বিছানা পাতা। আর একপাশে থালায় খাবার সাজানো রয়েছে।
কৃতান্তবাবু বললেন, ‘এখনি খেয়ে নিন, নইলে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
নানান কথা ভাবতে ভাবতে মাথা হেঁট করে খেতে খেতে হঠাৎ মুখ তুলে দেখি, কৃতান্তবাবু একদৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে আছেন; আর তাঁর কোটরগত দুই চক্ষুর ভিতর থেকে যেন দু-দুটো অগ্নিশিখা জ্বলছে! আমি মুখ তুলে তাকাতে-না-তাকাতেই সে আগুন নিভে গেল। মানুষের চোখ যে এমন জ্বলতে পারে, আমি তা জানতুম না। ভয়ানক!
কৃতান্তবাবু বললেন, ‘আজ তাহলে আমি আসি। খেয়ে-দেয়ে আপনি শুয়ে পড়ুন।’ বলে যেতে যেতে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘আর দেখুন, রাত্রে এ ঘরের জানলাগুলো যেন খুলবেন না। একে তো বৃষ্টি হচ্ছে, তার উপরে—’ বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন।
‘থামলেন কেন, কী বলছিলেন বলুন না।’
‘ওধারের জানলা খুললে গোরস্থান দেখা যায়।’
‘তা দেখা গেলেই বা!’
‘সেখানে হয় তো এমন কিছু দেখতে বা এমন সব গোলমাল শুনতে পাবেন, রাত্রে মানুষ যা দেখতে কী শুনতে চায় না।’
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলুম।
কৃতান্তবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, আর এক কথা। আপনার ওই বিশ্রী বুলডগটাকে বেঁধে রাখবেন। কুকুর অপবিত্র জীব, রাত্রে ও যে বিছানায় গিয়ে উঠবে—এটা আমি পছন্দ করি না। বুঝলেন?’
‘আচ্ছা।’
কৃতান্তবাবু বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর শেষ ইচ্ছা আমি পূর্ণ করিনি। রাত্রে রোভার বিছানার উপরে আমার সঙ্গেই শুয়েছিল।
অনেক রাত্রে দারুণ যাতনায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। কে আমার গলা টিপে ধরেছে! দু-খানা লোহার মতন শক্ত হাত আমার গলার উপরে ক্রমেই বেশি জোর করে চেপে বসতে লাগল!
প্রাণ যখন যায়-যায়, আচম্বিতে আমার গলার উপর থেকে সেই মারাত্মক হাতের বাঁধন আলগা হয়ে খুলে গেল! তারপরেই ঘরময় খুব একটা ঝটাপটি ও হুড়োহুড়ির শব্দ! কিন্তু তখন সেদিকে মন দেওয়ার সময় আমার ছিল না। গলা টিপুনির ব্যথায় তখন আমি ছটফট করছি।
ব্যথা যখন একটু কমল, ঘর তখন স্তব্ধ। তাড়াতাড়ি উঠে বসলুম, আলোটা নিবে গিয়েছিল, আবার জ্বাললুম। কিন্তু যে আমার গলা টিপে ধরেছিল ঘরের ভিতরে সেও নেই, বিছানার উপরে রোভারও নেই!
‘রোভার’ ‘রোভার’ বলে অনেকবার ডাকলুম, কিন্তু তার কোনো সাড়া পেলুম না।
হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, রাত একটা বেজে গেছে।
দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর দিকে তাকিয়ে দেখলুম, অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে আছে। সে অন্ধকার দেখলেই প্রাণ কেমন করে ওঠে! সে অন্ধকার যেন জ্যান্ত কোনো হিংস্র জন্তুর মতন আমার ঘাড়ের উপরে লাফিয়ে পড়বার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে। চট করে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলুম।
ঘরের এ দরজাটা আগেই বন্ধ করে শুয়েছিলুম। কিন্তু যে আমাকে আক্রমণ করেছিল, সে তাহলে কোন পথ দিয়ে এ ঘরে ঢুকেছিল?
এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে, ঘরের ভিতরে আর একটা দরজা আবিষ্কার করলুম। ঠেলতেই সেটা খুলে গেল এবং ভক করে বিষম একটা দুর্গন্ধ এসে আমাকে যেন আচ্ছন্ন করে দিলে।
আলোটা তুলে ভালো করে দেখলুম। সে কী ভীষণ দৃশ্য! ঘরের মেঝেতে রাশি রাশি হাড়, মড়ার মাথার খুলি ও রক্তমাখা কাঁচা নাড়িভুঁড়ি ছড়িয়ে পড়ে আছে! একদিকে একটা কাঁচা মড়ার মুণ্ডও মাটির উপরে হাঁ করে রয়েছে!
দুম করে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলুম। এ আমি কোন পিশাচের খপ্পরে এসে পড়েছি? আমার দম যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল—তাড়াতাড়ি ঘরের জানলাগুলো খুলে দিলুম।
বাইরে আকাশ ভরা অন্ধকারকে ভিজিয়ে হুড়হুড় করে বৃষ্টি পড়ছে আর চকচক করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর বোঁ-বোঁ করে ঝোড়ো হাওয়া ছুটছে।
আর, ও কী! বিদ্যুতের আলোতে বেশ দেখা গেল, সামনের তালগাছটার তলায় কে যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাচছে! ঠিক যেন একটা ছোটো ল্যাংটো ছেলে! সে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে আর গান গাইছে—
ধিনতাধিনা পচা নোনা,
হাড়-ভাতে-ভাত চড়িয়ে দে না!
চোষ না হাড়ের চুষিকাঠি,
রক্ত চেঁচেপুছে নে না!
মামদো মিয়া সেঁওড়া গাছে
মড়ার মাথার উকুন বাছে,
পেত্নি দিদি একলা নাচে,
তানানানা, দিম-দেরোনা!
গুবরে-পোকার চাটনি খেয়ে,
শাঁকচুন্নি আসছে ধেয়ে,
কন্ধকাটার পানে চেয়ে
মুখখানা তা যায় না চেনা!
হাড় খাব আর মাংস খাব,
চামড়া নিয়ে ঢোল বাজাব,
দাঁতের মালায় বউ সাজাব
নইলে যে ভাই, মন মানে না!
ঠ্যাং তুলে ওই গো-ভূত ছোটে,
গোর থেকে বাপ, হুমড়ো ওঠে,
চোখ দিয়ে তার আগুন ফোটে,
এই বেলা চল, লম্বা দে না!
গান হঠাৎ থেমে গেল। আবার বিদ্যুৎ চমকাল, কিন্তু ছোঁড়াটাকে আর তালতলায় দেখতে পেলুম না। কে এ? গাঁয়ের কোনো ঘর-হারা পাগলা ছেলে নয় তো? তাই হবে। কিন্তু সে বেয়াড়া গান থামলে কী হয়, চারিদিককার সেই আঁধার-সমুদ্র মথিত করে আরও কত রকমের আওয়াজই যে ঝোড়ো হাওয়ার প্রলাপের সঙ্গে ভেসে আসছে!
কখনো মনে হয়, একদল আঁতুড়ের শিশু ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কাঁদছে! কখনো শুনি, আড়াল থেকে কে খিলখিল-খিলখিল করে হাসছে! মাঝে মাঝে কে যেন ঝমঝম করে মল বাজিয়ে যাচ্ছে আর আসছে, যাচ্ছে আর আসছে! থেকে থেকে এক-একটা আলেয়া আনাগোনা করছে, তাদের আশেপাশে কারা যেন ছায়ার মতো সরে সরে যাচ্ছে এবং বাগানের কোথা থেকে একটা হুলো বেড়াল একবারও না-থেমে কেবল চ্যাঁচাচ্ছে ম্যাও ম্যাও।…আজ কি এখানে রাজ্যের ভূতপ্রেত, দৈত্য-দানা এসে জড়ো হয়েছে, না ভয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে—যা দেখছি, যা শুনছি সমস্তই অলীক কল্পনা!
অ্যাঁ! ও আবার কে? ঘরের দরজা কে ঠেলছে?
আমার মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠল। জানি না, দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কোন বিকট বীভৎস মূর্তি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে!
আবার কে দরজা ঠেললে। আমার সমস্ত দেহ যেন পাথর হয়ে গেল!
তারপরে আবার দরজার উপরে ঘন ঘন ঠেলা এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে কুকুরের ডাক। আঃ, রক্ষে পাই! এ যে আমার রোভারের ডাক!
ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই রোভার এসে একলাফে আমার বুকের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই নির্বান্ধব ভূতুড়ে পুরীতে রোভারকে পেয়ে মনে হল, তার চেয়ে বড়ো আত্মীয় এ পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই।
হঠাৎ রোভারের মুখের দিকে আমার চোখ পড়ল। তার মুখময় রক্ত লেগে রয়েছে! অবাক হয়ে ভাবছি, এমন সময় বাইরের বাগান থেকে অনেক লোকের গলা পেলুম।
জানলার ধারে গিয়ে দেখি ছয়-সাতটা লণ্ঠন নিয়ে চোদ্দো-পনেরো জন লোক বাড়ির দিকেই আসছে। তাদের পোশাক দেখেই বুঝলুম, তারা পুলিশের লোক। এবং তাদের ভিতরে সেই স্টেশনমাস্টারকেও যখন দেখলুম তখন আর বুঝতে বিলম্ব হল না যে, থানায় খবর দিয়েছেন তিনিই। মনে মনে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে লণ্ঠনটা নিয়ে আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লুম।
পুলিশের লোকেরা সিঁড়ির তলাতেই ভিড় করে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত স্বরে গোলমাল করছিল।
ব্যাপার কী? ভিড় ঠেলে ভিতরে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলুম, জমিদার কৃতান্ত চৌধুরির কুচকুচে কালো ও লিকলিকে রোগা হাড়-বের-করা দেহটা সিঁড়ির তলায় গড়াগড়ি দিচ্ছে! তাঁর চোখ দুটো কপালে উঠেছে এবং সে চোখ দেখলেই বোঝা যায়, কৃতান্তবাবু আর ইহলোকে বর্তমান নেই। এবং কৃতান্তবাবুর গলদেশে মস্ত একটা গর্ত, তার ভিতর থেকে তখনও রক্ত ঝরে-ঝরে পড়ছে।
এতক্ষণে বুঝলুম, রোভারের মুখে রক্ত লেগেছে কেন?…তাহলে এই কৃতান্ত চৌধুরিই আমাকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল, তারপর রোভার তার টুঁটি কামড়ে ধরে এ যাত্রা মতো তার সব লীলাখেলা শেষ করে দিয়েছে!…
…স্টেশনমাস্টার দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে বললেন, ‘কিন্তু এ কী অসম্ভব কাণ্ড!’
ইনস্পেক্টর বললেন, ‘আপনি কী বলছেন?’
স্টেশনমাস্টার কৃতান্ত চৌধুরির মৃতদেহের উপরে ঝুঁকে পড়ে ভালো করে তার মুখখানা দেখে বললেন, ‘না, কোনোই সন্দেহ নেই। এ হচ্ছে এই গাঁয়ের ভুবন বসুর লাশ। ঠিক আড়াই মাস আগে ভুবন বসু কলেরায় মারা পড়েছে। কিন্তু তার দেহ দাহ করা হয়নি, কারণ তার লাশ চুরি গিয়েছিল।’
—