এ হর্স ফর মাই কিংডম
এবার একটা ঘোড়ার গল্প বলি। গল্পটা বহুকাল কেউ বলেননি। সুতরাং ইতিপূর্বে যাঁরা শুনেছেন তাঁরাও নিশ্চয় ভুলে গেছেন। গল্পটা প্রায় দুই দশকের পুরনো। কাহিনীর সূত্রপাত তারও বহু বছর আগে।
পার্ক স্ট্রিটের মোড়ের গান্ধী-মূর্তির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। পাতাল রেল কলকাতায় প্রথম যাদের উৎখাত করে তার মধ্যে ওই মূর্তিটি আছে। গত দশকের শেষাশেষি কোনও সময় মূর্তিটিকে সরিয়ে পুরনো জায়গা থেকে প্রায় দু’-ফার্লং দূরে ময়দানে রেড রোডের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সব সময় ঠিক নজরে পড়ে না, ন্যুব্জ দেহ, লাঠি হাতে চলমান বৃদ্ধ গান্ধী একটু চোখের আড়াল হয়ে গেছেন আজকাল।
পার্ক স্ট্রিটের মোড়ের গান্ধী-স্ট্যাচু নিয়ে চমৎকার কবিতা ছিল কবি জগন্নাথ চক্রবর্তীর। বিলাসী, বিহ্বল, প্রমোদপরায়ণ পার্ক স্ট্রিট, নাগরিক সভ্যতার এই গ্লানিমুক্তি কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী। কবিতাটি এই মুহূর্তে আমি উল্লেখ করলাম শুধু পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য যে গান্ধী-মূর্তির প্রথম অধিষ্ঠান কোথায় ছিল। কারণ আলোচ্য কাহিনীটি পার্ক স্ট্রিটের মোড়ের মূর্তি নিয়ে।
এই সূত্রে প্রসঙ্গত স্মরণ রাখতে হবে ওই মোড়ে গান্ধী-মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক জবরদস্থ সেনাপতিকে উদ্বাস্তু করে। কারও কারও হয়তো এখনও জেনারেল আউটরামের কথা মনে আছে। দুরন্ত অশ্বপৃষ্ঠে দৃপ্ত আউটরাম বহুকাল পার্ক স্ট্রিটের মুখে অধিষ্ঠান করেছিলেন। উপনিবেশের বিদেশি সেনাপতি আউটরাম তাঁর দোষ-গুণ যাই থাকুক, তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাভক্তি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ঘোড়সওয়ার আউটরামের মূর্তিটি ছিল অসামান্য। তার দিকে তাকালে তেজি ঘোড়ার উদ্ধত নাসার উষ্ণ নিশ্বাসের আঁচ গায়ে এসে লাগত। সাম্প্রতিক কালেই ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ ও রেসকোর্সের কোনাকোনিতে ঘোড়ার পিঠে বাঘাযতীনের মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু বাঘাযতীনের ঘোড়ার সে গতি নেই, দৃপ্ততা নেই।
সম্ভবত অশ্বপৃষ্ঠে আউটরামের মূর্তিটি এখনও ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের উদ্যানে রয়েছে। ময়দানের দিক থেকে ঢুকে বাঁদিকে পুকুর-পারের বাগানের মধ্যে যেন কবে দেখেছিলাম অস্ত্রসমেত উদ্যানবন্দি সেনাপতিকে, ওই পরিবেশে ওই ভাস্কর্যের মহিমা ঠিক বিকশিত হয় না।
গান্ধী-মূর্তিতে ফিরে আসার আগে ওই আউটরামের মূর্তি সম্পর্কে একটা পুরনো গল্প বলে নিই। যখন আউটরামের মূর্তিটি ওই চৌরঙ্গি-পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে ছিল সেই সময় মোড়ের কাছেই সদর স্ট্রিটের এক বাড়িতে একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবার এসেছিল। কিছুদিনের জন্য এই শহরে বেড়াতে। তখন সাহেবসুবোদের কাছে কলকাতা এত অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যায়নি।
সে যা হোক সেই ট্যুরিস্ট পরিবারে, ট্যুরিস্ট কথাটা তখনও অবশ্য চালু হয়নি, একটি বাচ্চা ছেলে ছিল। এই পরিবারটি এসেছিল ইংল্যান্ডের এমন একটা অঞ্চল থেকে জেনারেল আউটরামের বংশও সেখানকার। ইংরেজের স্বাভাবিক স্বজাতিপ্রিয়তাবশত সেই বাচ্চা ছেলেটিকে তার বাপ আসার পরেই আউটরামের মূর্তিটি দেখান, এবং বুঝিয়ে বলেন যে এই আউটরাম আমাদের দেশের, এ খুব সাহসী ছিল। আমাদের জন্য অনেক করেছে।
কী কারণে যেন বাচ্চা-সাহেবটি মূর্তিটির খুব ভক্ত হয়ে পড়ে। সকাল-সন্ধ্যায় সে অবসর পেলেই চৌরঙ্গি পার হয়ে মূর্তিটির পাদদেশে (ছয় পায়ের নীচে, ঘোড়ার চার + আউটরামের দুই) চলে আসত। মূর্তিটির চারপাশে ঘুরে খেলা করত, কখনও মুগ্ধ বিস্ময়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত।
বিদায়ের দিনে বাচ্চাটি কান্নায় ভেঙে পড়ল, মূর্তিটি ছেড়ে যেতে তার মন ভেঙে যাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে তার বাবা মূর্তিটির সামনে তাকে নিয়ে এলেন গুডবাই জানানোর জন্যে। ছেলেটি চোখের জল মুছে হাত তুলে শেষবারের মতো টা-টা জানাল। চলে আসতে আসতে বারবার পিছনে ফিরে তাকাতে লাগল, হাত তুলে বলতে লাগল, ‘বাই বাই আউটরাম, বিদায়, বিদায় আউটরাম।’ অবশেষে যখন আউটরামকে আর দেখা গেল না, তখন বাচ্চাটি তার বাপকে একটি সরল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা বাবা, আউটরামের পিঠে ও পাজি লোকটা কে?’ পিতৃদেবের স্বপ্নভঙ্গ হল, তিনি যেটা ভেবেছিলেন তাঁর পুত্রের স্বদেশের মুখোজ্জ্বলকারী সেনাপতির প্রতি শ্রদ্ধা, সেটা যে নিছক অশ্বপ্রেম তা অবহিত হয়ে তিনি নিশ্চয় মর্মাহত হয়েছিলেন, কিন্তু কী আর করা যাবে তখন চিরসূর্য সাম্রাজ্যের অস্তাচলের দিন ঘনিয়ে এসেছেন।
আমাদের গান্ধী-মূর্তির গল্প আবার ওই আউটরামকে নিয়েই। যুদ্ধের সময় এক মার্কিন ব্যবসায়ী কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলে কিছুকাল ছিলেন। খিদিরপুরে বোমা পড়েছে, যুদ্ধের ফাঁসে দমবন্ধ কলকাতা। সন্ধ্যা হতে না হতেই নির্জন, থমথমে ব্ল্যাক-আউটের কলকাতা।
মার্কিনি ভদ্রলোক চৌরঙ্গির ফুটপাথ ধরে বিকেলের দিকে অল্প একটু হাঁটাহাঁটি করে সন্ধের মধ্যেই হোটেলে ফিরে যেতেন। এই সময়েই তাঁর নজরে পড়ে রাস্তার মোড়ে আউটরামের অসামান্য মূর্তিটি। কোনও কাজ না থাকলে কখনও কখনও তিনি চুপচাপ মূর্তিটিকে পর্যবেক্ষণ করতেন। আসা যাওয়ার পথেও দেখতেন।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। সাহেব দেশে ফিরে গেছেন। এর প্রায় বিশ বছর পরে তিনি আরেকবার এসেছেন কলকাতায়। কলকাতা তখন প্রায় এখন যে রকম, তিনি যেমন দেখেছিলেন তার থেকে একদম আলাদা। রাস্তায় সাহেব-মেম নেই, গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে ভিখিরি, পথে পথে জঞ্জাল; তখন কলকাতার অবক্ষয় শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধের বাজারেও একটা শৃঙ্খলা ছিল শহরে। বিশ বছর বাদে সাহেব এসে দেখলেন এ কলকাতা সে কলকাতা নয়। তার আগে ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা দেখে এসেছেন তিনি।
ভারতবর্ষের এই পরিণতি দেখে দু’-একদিন মনের দুঃখ কাটানোর পর একদিন সাহেবের তার পুরানো সুহৃদ আউটরামের কথা মনে পড়ল। তিনি দেখতে গেলেন পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে সেই দৃপ্ত অশ্বারোহীকে। কিন্তু ততদিনে আউটরাম সবাহন অপসারিত হয়েছেন, সেখানে এসেছেন হাতে লাঠি, বৃদ্ধ গান্ধী।
সাহেব দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলেন, মার্কিনি ইংরেজিতে তিনি যেসব স্বগতোক্তি করেছিলেন, তার মোদ্দাকথা, ‘সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ, এখানে মূর্তি পর্যন্ত বুড়ো হয়ে যায়, সময়ের সঙ্গে যুবক অশ্বারোহী বৃদ্ধ পদযাত্রীতে পরিণত। স্ট্রেঞ্জ, রিয়্যালি স্ট্রেঞ্জ, ইভেন স্ট্যাচুস গ্রো ওলড ইন ইন্ডিয়া।’
আরেকটা ঘোড়ার গল্প আছে। ঠিক ঘোড়ার গল্প নয়, ঘোড়ার অভাবের গল্প।
মহারাষ্ট্রের এক মফস্বল শহরের চৌমাথায় দেখেছিলাম ছত্রপতি শিবাজির এক প্রস্তর মূর্তি। ছত্রপতির মুখ-চোখ, পাগড়ি ইত্যাদি যথাযথ, কিন্তু দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি কেমন যেন অবাস্তব, বিসদৃশ। দুটি পা দু’দিকে ছড়ানো, দুটি হাত নামানো-ওঠানো দু’রকম, পিঠের দিক থেকে শিবাজি কেমন যেন একটু ঝুঁকে আছেন। স্থানীয় এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপারটা কী?’ তিনি মৃদু মৃদু হেসে বললেন, ‘মিউনিসিপ্যালিটি থেকে এই মূর্তিটা বসিয়েছে। অশ্বারোহী ছত্রপতির মূর্তির বায়না দেওয়া হয়েছিল। পরে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং টাকা কম পড়ায় ঘোড়াটিকে ছেঁটে দিতে হয়েছে কিন্তু ততদিনে ছত্রপতির মূর্তি অশ্বারোহীর ভঙ্গিতে তৈরি হয়ে গেছে। তাই এই অবস্থা। তবে চেষ্টা করা হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা ঘোড়া বানিয়ে ছত্রপতির নীচে দিয়ে দেওয়ার।’