এত বুড়ো হব নাকো
সাহেবরা যাদের বলেন সিনিয়র সিটিজেন (Senior Citizen) সেই সিনিয়রিটির বার্ধক্যের সবরকম সুবিধাগুলো খুঁজে খুঁজে নেব। আয়করে সুবিধা নেব, ব্যাঙ্ক ডিপোজিটে সুদের হার বেশি পাব, রেল-বিমানের ভাড়ায় কনসেশন নেব। কোথাও গেলে যুবকেরা উঠে দাঁড়িয়ে জায়গা ছেড়ে দেবে, বাসে-ট্রামে তো অবশ্যই। না ছাড়লে মনে মনে রাগ করব, দিনে দিনে কী হচ্ছে?
এর পরেও কেউ যদি রাস্তাঘাটে ‘দাদু’ বলে ডাকে, কেউ যদি ‘বুড়ো’ বলে? রাগ করব, খেপে যাব, মনে দুঃখ পাব?
বয়েস বেড়ে গিয়েছে, বুড়ো হয়ে গিয়েছি, বুড়ো হচ্ছি এসব সত্য সবাই মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের কাছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতো ‘বয়েস দাঁড়ায়ে থাকে, কোনও মাঠে স্কেল-কাঠি হাতে, মানুষ মাপিতে যায় মানুষী মাপিতে যায়…’। তাঁরা হয়তো ভাবেন, মাপতে না গেলেই হল। চুলে কলপ দেন, মুখে ফেসিয়াল করেন, আর এক প্রস্থ রঙিন জামাকাপড় তৈরি করতে দেন। এসব বেশি বয়েসের পক্ষে বেমানান কি না ভাবার অবকাশ নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কোনও দিন এত বুড়ো হব নাকো আমি।’ পড়ন্ত বয়েসে নায়িকার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তার চেয়ে ভাল, তুমি চলে এসো একা’… যেন কোনও নবীন কবি বলছেন।
বার্ধক্যের প্রকৃত অনুরাগী ছিলেন জীবনানন্দ। তাঁর কবিতায় শীত-হেমন্ত এবং বার্ধক্য একাকার হয়ে গিয়েছিল— শীতের রাত, কুয়াশা, সন্ধ্যার বাতাস, স্থবিরতা, শিশিরের শব্দ জীবনানন্দের কাব্যে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় জীবনানন্দ বার্ধক্য উপভোগ করে যেতে পারেননি, বুড়ো হওয়ার আগেই এক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়।
আপাতত বার্ধক্য নিয়ে কাব্যকথা থাক।
দু’-একটা সুখ-দুঃখের নতুন পুরনো গল্প বলি।
আমার এক পুরনো দিনের মাস্টারমশাইয়ের বয়স প্রায় পঁচাশি হয়ে গিয়েছে। সেই কোন পুরনো আমলে কলেজের নিচু ক্লাসে তাঁর কাছে সাহিত্যপাঠ করেছিলাম, কিঞ্চিৎ ঋণ তাঁর কাছে আমার আছে। আমার বাড়ির থেকে খুব দূরে থাকেন না। সুখের কথা, তাঁর স্ত্রীও বেঁচে আছেন।
কখনও কখনও ছুটির দিনের সকালে আমি তাঁকে দেখতে যাই, অনেক সময়েই একটা উদ্দেশ্য থাকে, তাঁর কাছে কিছু জানতে যাই।
গত রবিবার সকালে তাঁর বাসায় গিয়েছি, শুনলাম তিনি বাসায় নেই। গুরুপত্নী বললেন, “চিকিৎসকের পরামর্শে তোমাদের মাস্টারমশাই হাঁটতে বেরিয়েছেন।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কখন ফিরবেন?”
গুরুপত্নী বললেন, “বলা অসম্ভব।”
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করি, “কেন, কতটা হাঁটবেন?”
গুরুপত্নী বললেন, “ডাক্তার দু’ কিলোমিটার হাঁটতে বলেছেন।”
মাস্টারমশাই কখন ফিরবেন ঠিক নেই বুঝে আমি উঠে পড়লাম।
গুরুপত্নীকে বললাম, “আমি তা হলে বিকেলের দিকে আসব।”
তিনি হেসে বললেন, “দু’ কিলোমিটার হাঁটা শেষ করতে করতে বিকেল পার হয়ে অনেকদিন সন্ধ্যা হয়ে যায়।” তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “রাতের দিকেও এসে লাভ নেই। সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে এত ক্লান্ত হয়ে পড়েন, চারটি খেয়ে তখনই শুয়ে পড়েন।”
বৃদ্ধ বয়সে অনেকের মাথায় অনেক রকম ঝোঁক চাপে। এই বৃদ্ধকে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। বরং আমরা বৃদ্ধান্তরে যাই।
ডাক্তার ও বৃদ্ধের গল্পের অন্ত নেই।
অল্প বয়সে, যতদিন রক্ত গরম থাকে, রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে, হৃদস্পন্দন ঠিক থাকে তখন খুব বেকায়দায় না পড়লে ডাক্তারের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু প্রত্যেক বৃদ্ধের ডাক্তার আছে, অনেক ক্ষেত্রেই নিজস্ব নির্দিষ্ট চিকিৎসক।
এক বৃদ্ধের ডান পা ফুলে গিয়েছে, সঙ্গে বেশ ব্যথা। তিনি গৃহ চিকিৎসককে দেখাতে ডাক্তারবাবু ওষুধ দিলেন। ওষুধ খেয়ে কিন্তু বৃদ্ধ রোগী নিবৃত্ত হলেন না। তিনি জানতে চাইলেন, “আমার ডান পা-টা হঠাৎ ফুলল কেন, আর এত ব্যথাই বা কেন?”
প্রশ্ন শুনে ডাক্তারবাবু নির্বিকারভাবে বললেন, “ও কিছু নয়। বয়স তো হয়েছে আপনার, এ রকম একটু-আধটু হবে।”
বৃদ্ধটি কর্মজীবনে ফৌজদারি আদালতের উকিল ছিলেন। এ ধরনের কথা বলে তাঁর কাছে পার পাওয়া কঠিন। তিনি ডাক্তারবাবুকে ধরলেন, “দ্যাখো ডাক্তার, আমার ডান পা আর বাঁ পা তো একসঙ্গেই জন্মেছে, দুটোরই সমান বয়েস। তবে একা ডান পা ফুলবে, ডান পায়ে যন্ত্রণা হবে আর পাশেই বাঁ পা, সহোদর, সমবয়সি, তার ক্ষেত্রে ফোলা-যন্ত্রণা কিছু নেই কেন?”