ঈশ্বরের অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল। নিয়তির বিধানফল, পাপের প্রায়শ্চিত্ত, ইহজগতে মানবচক্ষে যাহা দেখিবার সাধ্যায়ত্ত, তাহা সকলেই দেখিল। যাহা বুঝিবার তাহা বুঝিল। নানা চিন্তায়, এজিদের পরিণাম, মোহাম্মদ হানিফার জীবনের শেষফল, ভাবিতে ভাবিতে দামেস্ক রাজপ্রাসাদে নব-ভূপতি ও মন্ত্রীদলের নিশাবসান হইল। সম্পূর্ণ সুখভোগে মনের আনন্দে অনেকের চক্ষে নিদ্রা আসিল না। ওমর আলী ও গাজী রহমানের চক্ষু অশ্রুসহ অতি ক্লান্ত-অতি বিশ্রান্ত হইয়াও অনিদ্রায় ঊষার সহিত সম্মিলিত হইল। প্রভাতীয় উপাসনার আহ্বানধ্বনি (আজান) রাজপ্রাসাদ জাগাইয়া তুলিল। উপাসনার পর সকলেই দরবারগৃহে উপবেশন করিলেন।
উপস্থিত কার্যাদির বন্দোবস্ত করাই গাজী রহমানের ইচ্ছা। সময়ে নবীন মহারাজ রাজবেশে রাজ-সিংহাসনে উপবেশন করিলেন। গাজী রহমানের আদেশে মহাপ্রাজ্ঞ বৃদ্ধ মন্ত্রী হামানকে আহ্বান করিয়া প্রধানমন্ত্রী পদে বরণ করা হইল। মন্ত্রীপ্রবর হামান রাজসিংহাসন চুম্বন করিয়া বলিলেনঃ
“ইহাতে নূতনত্ব কিছুই নাই। যাঁহাদের সিংহাসন তাঁহারাই অধিকার করিলেন। মহারাজ এজিদের কর্মফল এবং পিতৃ অভিসম্পাতে অধঃপতন। উষ্ণ মস্তিষ্ক এবং উষ্ণ শোণিতবলে যে রাজা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়া গুরুতর কার্যে হস্তক্ষেপ করেন; যাহা সম্ভবপর নহে, সাধারণের অনুমোদনীয় নহে, বিজ্ঞ বুদ্ধিমান পণ্ডিতগণের অভিমত নহে, বহুদর্শী জ্ঞানবৃদ্ধ প্রবীণ প্রাচীন প্রধান কার্যকারকগণের ইচ্ছা নহে,-সেই অঘটন কার্য ঘটাইতে গেলেই এইরূপ ফল ফলিয়া থাকে। এজিদের পতন, রাজ্য হইতে বিচ্যুতি এবং আত্মজীবন বিনাশ ইহাতে আশ্চর্য কিছুই নাই। অবিবেচক অপরিপক্ব মস্তক-উদ্ধত যুবকদিগের কার্যফল এইরূপই হইয়া থাকে।”
এইরূপ কহিয়া নবভূপতির মঙ্গল কামনা করিয়া নতশিরে অভিবাদনকরত মন্ত্রীপ্রবর হামান উপবেশন করিলেন। রাজকার্যের সমুদয় ভার তাঁহার প্রতি অর্পিত হইল। নবীন মহারাজ আত্মীয়-স্বজন পরিবারসহ পবিত্র ভূমি মদিনায় যাইতে প্রস্তুত হইলেন। মদিনাবাসীরাও মহা আনন্দে নবীন মহারাজ সহিত মদিনা যাইতে উদ্যোগী হইলেন।
বিজয়ী বীরগণ, সৈন্যসামন্ত, আত্মীয়স্বজন ও পরিবার-পরিজনগণসহ বিজয় পতাকা উড়াইয়া বিজয় ডঙ্কা বাজাইতে বাজাইতে নবীন ভূপতি দামেস্ক হইতে মদিনার পথে বহির্গত হইলেন। গাজী রহমানের আদেশে এই শুভ সংবাদ লইয়া বহুসংখ্যক দূত অশ্বপৃষ্ঠে মদিনাভিমুখে ছুটিলেন। দামেস্ক বিজয়, এজিদের পরাজয়, পলায়ন, মোহাম্মদ হানিফার যুদ্ধবিবরণ ইতিপূর্বেই মদিনাবাসিগণ লোক পরম্পরায় শুনিয়া মহাআনন্দিত হইয়া উৎসুকচিত্তে রাজকীয় সংবাদ আশায় দিবারাত্রি অপেক্ষা করিতেছিলেন। সময়ে দামেস্ক হইতে প্রেরিত কাসেদগণ প্রমুখাৎ এই শুভ সংবাদের তত্ত্ব পাইয়া মদিনাবাসিগণ হজরত মোহাম্মদের রওজায় যাইয়া নবীন ভূপতি জয়নাল আবেদীনের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করিলেন এবং নবভূপতিকে সাদরে গ্রহণ করিবার জন্য সমুচিত আয়োজনে মনোনিবেশ করিলেন।
দিনের পর দিন কাটিয়া গেল। নবভূপতির আগমনাশা-দর্শনাশা ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দ্বিতীয় দল, কাসেদ একদিন উপনীত হইয়া ঘোষণা করিল, “জয় জয়নাল আবেদীন। জয় ইমাম বংশের শেষ রাজদণ্ডধর। আজ মদিনা প্রান্তর পর্যন্ত,-ঐ প্রান্তরেই সসৈন্যে নিশাযাপন। আগামীকল্য প্রত্যূষে নগরে প্রবেশ। প্রথম হজরতের রওজা জিয়ারত, পরে অন্তঃপুরে প্রবেশ।”
ঘোষণা প্রচারমাত্র মদিনা নবসাজে সজ্জিত হইতে লাগিল। নবভূপতিকে পরিজনসহ, বিজয়ী বীরবৃন্দসহ গ্রহণ করিতে মদিনা স্বর্গীয় সাজে সজ্জিত হইল। উচ্চ উচ্চ প্রাসাদশ্রেণীর উচ্চমঞ্চে অর্ধচন্দ্র আর পূর্ণতারাখচিত লোহিত নিশানসকল উড়িতে লাগিল। একাল পর্যন্ত যে যে স্থানে নীলবর্ণ নিশান উড়িয়া হাসান-হোসেনের শোক জ্ঞাপন করিতেছিল, আজ সেই সেই স্থানে লোহিত, পীত এবং মনোনয়নমুগ্ধকর নানা রঙ্গের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পতাকাসকল বায়ুর সহিত মিলিয়া মিশিয়া খেলা করিতে লাগিল। রাজপথের উভয় পার্শ্বস্থ গৃহরাজি নানা বর্ণের প্রস্ফুটিত পুষ্পপুঞ্জে সজ্জিত, পুষ্পহারে অলঙ্কৃত হইয়া প্রকৃতির শোভাবর্ধন করিল। গৃহসকলের প্রতি গবাক্ষ সুরঞ্জিত আবরণবস্ত্রে আবৃত-পুষ্পহারে সজ্জিত হইয়া অমরপুরীসদৃশ পরিশোভিত হইতে লাগিল। যাঁহাদের আত্মীয়স্বজন এজিদ্ বধ কৃতসংকল্পে অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া মোহাম্মদ হানিফার সঙ্গী হইয়াছিলেন, তাঁহাদের পরিবার-পরিজন মনের আনন্দে কেহ বসন-ভূষণে সজ্জিতা, কেহ মহাহর্ষে বস্ত্রালঙ্কারে সাজসজ্জার বিষয় ভুলিয়া যেরূপে ছিলেন, সেই প্রকারে আনন্দমনে পুষ্পগুচ্ছ ও পুষ্পমালা সকল সম্মুখে করিয়া গবাক্ষ দ্বারে, কেহ গৃহ প্রবেশের সোপান শ্রেণীতে দণ্ডায়মান রহিলেন। পূর্বাকাশে অরুণোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন মদিনা সজীব ভাব ধারণ করিল, চতুর্দিকেই আনন্দ কোলাহল। রাজপথে, রাজসংশ্রবী গৃহ-সোপানোপরি, অধিবাসিগণের গৃহদ্বারে দলে দলে নগরবাসিগণের সুরঞ্জিত ও সজ্জিত বেশে সমাগম; আনন্দ-কোলাহলে নগরময় কোলাহলে পরিপূর্ণ,-ঐ আসিতেছে, ঐ ডঙ্কাধ্বনি কর্ণে প্রবেশ করিতেছে, ঐ ভেরীর ভীষণ রবে প্রান্তর কাঁপাইতেছে। বিগত নিশায় অনেক চক্ষুই নিদ্রার আকর্ষণ হইতে বঞ্চিত ছিল। মনের আনন্দে, মনের উত্তেজনায় বহুচেষ্টাতেও নিদ্রাদেবীর সহিত সাক্ষাৎলাভ ঘটে নাই, কেহ কেহ প্রভাত সময়ে শরীরের ক্লান্ত হেতু অবসাদে উপবেশন-স্থানেই শয়ন-শয্যাবিহীন, উপাধানবিহীন, উপবেশন স্থানেই অর্ধ শায়িতভাবে শুইয়া পড়িয়াছেন। সুনিদ্রার আকর্ষণ হইলে, আর কী বিলম্ব আছে? না মুখশয্যার অপেক্ষা আছে? যেখানে চক্ষুর পাতা ভারী, সেইখানেই নিদ্রা,-অচেতন। তাহার পর জনকোলাহলে হঠাৎ জাগিয়া কী করিবেন, কী শুনিবেন, কোথায় যাইবেন, কী অপকর্ম করিয়াছি, ক্ষণস্থায়ী অনুতাপ সহ্য করিয়া চতুর্দিক চাহিয়া গত কথাসকল ক্রমে স্মরণপথে আনিতে মহাব্যস্তে মনোমত স্থানে যাইয়া উপবেশন করিলেন। একদৃষ্টে রাজপথ পরিশোভা, সজ্জিত গৃহশ্রেণীর নয়নর ন মনোহর শোভা দেখিতে দেখিতে নিদ্রাবেশের অলসতা দূর করিলেন।
নগরবাসিগণ নব নব সাজে সজ্জিত হইয়া দলে দলে নগরের প্রান্ত সীমা সিংহদ্বার পর্যন্ত যাইয়া বিজয়ী আত্মীয়-স্বজনকে আগু বাড়াইয়া আনিতে উৎসুকনয়নে দণ্ডায়মান রহিয়াছেন।
সময় হইল প্রথম পদাতিকশ্রেণী বিজয় নিশান সহ দেখা দিল,-তৎপশ্চাৎ শস্ত্রধারী যোধসকল শ্রেণীবদ্ধরূপে আসিয়া সিংহদ্বার পার হইল। তৎপরে উষ্ট্রোপরি নকীবদল বাঁশরী বাজাইয়া নবভূপতির জয়-ঘোষণার সহিত আগমন-ঘোষণা অতি সুমিষ্টস্বরে নাকাড়া সহিত বাদ্য করিতে করিতে আসিল। তৎপরে নানারূপ বস্ত্রাভরণে সজ্জিত বীরকেশরীগণ অলঙ্কৃত অশ্বোপরি আরোহণ করিয়া হাসি হাসি মুখে নগরে প্রবেশ করিলেন।-তৎপরে রাজ আত্মীয় ও মহা মহা বীরবৃন্দ রত্নে খচিত জড়িত সাজে সজ্জিত হইয়া বৃহদাকার সজ্জিত অশ্বে আরোহণ ও ভীমকায় রক্ষী দলে পরিবেষ্টিত হইয়া প্রবেশ করিলেন। তাহার পর সুবর্ণ ও রজত দণ্ডে স্থাপিত কারুকার্যখচিত অর্ধচন্দ্র ও পূর্ণতারা সংযুক্ত বহুসংখ্যক নিশানধারী। অশ্বারোহী দলের পশ্চাতে, সুবর্ণদণ্ডে স্থাপিত কারুকার্যখচিত শুভ্র চন্দ্রাতপ শিক্ষিত উষ্ট্রোপরি স্থাপিত হইয়া আতপতাপ নিবারণ করিতেছে-এবং ঐ চন্দ্রাতপ নিন্মে মক্কা মদিনার রাজা, মুসলমান জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মজগতের সর্বপ্রধান ভূপতি, হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার বংশধর মহামহিমান্বিত মহারাজাধিরাজ জয়নাল আবেদীন, নিষ্কোষিত অস্ত্রে সজ্জিত, সহস্র অশ্বারোহী রক্ষী পরিবেষ্টিত হইয়া বীর সাজে অশ্বারোহণে মৃদুমন্দ পদবিক্ষেপণে সিংহদ্বার পার হইয়া নগরে প্রবেশ করিলেন। অমনি দর্শক-শ্রেণী-মুখে জয়নাল আবেদীনের জয়, মদিনার সিংহাসনের জয়, জয় নবভূপতির জয় রব তুমুল আরবে বারবার ঘোষিত হইতে লাগিল। পরিবার পরিজনদিগের বস্ত্রাবৃত হাওদা পৃষ্ঠে উষ্ট্রসকল রক্ষিগণ কর্তৃক বিশেষ সতর্ক সাবধানে পরিলক্ষিত হইয়া মহারাজ পশ্চাৎ নগরমধ্যে প্রবেশ করিল। জনস্রোতের সহিত আনন্দস্রোত প্রবাহিত। দেখিতে দেখিতে পবিত্র রওজা সম্মুখে উপস্থিত। অশ্বারোহী উষ্ট্রারোহী স্ব-স্ব বাহন হইতে অবতীর্ণ হইলেন। কাড়া-নাকাড়ার কার্যসকল ক্ষণকালের জন্য বন্ধ হইল, পতাকা সকল অবনতমুখী হইয়া রওজার মর্যাদা রক্ষা করিল।
মহারাজ জয়নাল আবেদীন-যাত্রীদল সঙ্গীদল আত্মীয়স্বজনগণসহ পবিত্র রওজা মোবারক সপ্তবার তওয়াফ-মান্যের সহিত অতিক্রম করিয়া পূর্ব সাজ-সজ্জা ও বাদ্য-বাজনা সহিত জয়নিশান উড়াইয়া রাজপুরী প্রবেশ করিলেন। পরিবার-পরিজনেরা বহুদিনের পর বহু যন্ত্রণা উপভোগের পর ঈশ্বরের নাম করিয়া অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
গাজী রহমান এবং ওমর আলী প্রভৃতি কিছুদিন নবীন মহারাজের পরিসেবা করিয়া হরিষে বিষাদ মিশ্রিত মনভাবে স্ব-স্ব রাজ্যে গমন করিলেন। হরিষের বিষয় জয়নাল আবেদীন সপরিবারে বন্দিখানা হইতে উদ্ধার, রাজ্যলাভ। বিষাদের কারণ আর কি বলিব-মোহাম্মদ হানিফা চিরবন্দি!
– সমাপ্ত –