বন্দিগৃহ! বন্দিগৃহ সুবর্ণে নির্মিত, মহামূল্য প্রস্তরে খচিত, সুখসেব্য আরামের উপকরণে সুসজ্জিত হইলেও মহাকষ্টপ্রদ-যন্ত্রণাস্থান। সুখ-সম্ভোগের সুখময় সামগ্রী দ্বারা পরিপূরিত হইলেও বন্দিগৃহ, দেহদগ্ধকারী মহাকষ্টপ্রদ জ্বলন্ত অগ্নিময় নরকনিবাস। সুবর্ণ পাত্রে সুস্বাদু সুমিষ্ট সরস খাদ্য-পরিপূরিত রসনা পরিতৃপ্ত করিতে, সুন্দর বন্দোবস্তের সহিত সুব্যবস্থা থাকিলেও বন্দিগৃহ মহাকাল যমালয়। কোন বিষয়ের অভাব-অনটন না হইলেও সর্বতোভাবে মশান হইতে শ্মশান আদরের। অমূল্য রত্ন স্বাধীনতাধন যে স্থানে বর্জিত, সে স্থান অমরপুরীসদৃশ মনোনয়নমুগ্ধকর সুখ-সম্ভোগের স্থান হইলেও মানবচক্ষে অতি কদাকার ও জঘন্য। বুদ্ধিশক্তিসম্পন্ন সজীব প্রাণীর নয়নে কণ্টকসমাকীর্ণ বিসদৃশ বিজন বন। বিজন বনেও পশুদিগের স্বাধীনতা আছে, ইচ্ছানুসারে পরিভ্রমণ, স্বজাতি-স্বজন পরিদর্শন ক্ষমতা আছে, বন্দিখানায় বন্দির ভাগ্যে তাহাও নাই। সুতরাং বাধ্যবাধকতা, অধীন-অধীনতা সংস্রবে স্বর্গসুখও মহা যন্ত্রণাদায়ক। যন্ত্রণাদায়ক কেন? সুখস্বাচ্ছন্দ্যের আমূল পরিচ্ছেদক।
বন্দির মনে নানা ভাব! নানা চিন্তা, নানা কথা। কাহারো অন্তরে আত্মগ্লানির মহাবেগ শতধারে ও সহস্র প্রকারে ছুটিয়া হৃদয়ের অন্তঃস্থল পর্যন্ত অগ্নিদাহের ন্যায় দগ্ধ করিয়া উত্তমাঙ্গস্থিত সপ্তদ্বারে তাপের শেষ পর্যন্ত ক্রমে ক্রমে বহির্গত হইতেছে। কাহারো অনুতাপানল আক্ষেপ-ইন্ধনে পরিবর্ধিত হইয়া সতেজে রসনা আশ্রয়ে ছুটিয়া ছুটিয়া বাহির হইতেছে। কেহ মনের কথা মনভারে মনে মনে চাপিয়া হৃদয়ের রক্ত সমধিক হা-হুতাশে জলে পরিণত করিতেছে; কাহারো প্রতি লোমকূপ হইতে সে হা-হুতাশকৃত জলের কথঞ্চিৎ অংশ গর্মচ্ছলে বহির্গত হইয়া অবসাদে নির্জীব প্রায় করিতেছে। কেহ গত কথা স্মরণ করিয়া বন্দিখানাস্থিত মনুষ্যঘাতী জল্লাদের কুঠারহস্তে দণ্ডায়মান উচ্চমঞ্চের উপরিভাগপ্রতি স্থিরনেত্রে দৃষ্টি করিয়া মস্তিষ্কের মজ্জা পরিশুষ্ক করিতেছে! বন্দিমাত্রই যে ন্যায় ও যথার্থ বিচারে দণ্ডিত-তাহা নহে। ভ্রান্তি-ভ্রম মানবেই সম্ভবে! ইহাও নিশ্চয়, নির্ভুল অন্তর জগতে নাই। ভ্রমশূন্য মজ্জাও মানুষের নাই। ইহার পর নিরপেক্ষ সদ্বিচারক সংখ্যা অতি অল্প। কত বন্দি-ভ্রমে, পক্ষপাতিত্বে, অনুরোধে, বিভ্রাটে আজীবন ফাটকে আটক রহিয়াছে।
পাঠক! এই তো আপনার সম্মুখে দামেস্ক কারাগারের অবিকল চিত্র। সুবিচার, অবিচার, হিংসা, দ্বেষে কত বন্দি, কত স্থানে কত প্রকার শাস্তিভোগ করিতেছে, বন্দিখানায় তুল্য কোন খানাই জগতে নাই। প্রহরীদল মানবাকার হইলেও স্বভাব ও ব্যবহারে পশু হইতেও নীচ। তাহাদের শরীর যে রক্ত-মাংস-হৃদয়-সংযোগে গঠিত, ইহা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। চতুষ্পার্শ্বে প্রাচীরবেষ্টিত স্থানটুকুই তাহাদের রাজ্য। সে রাজ্যের অধীশ্বরই তাহারা। প্রবল প্রতাপে আধিপত্য করার কল্যাণে, রাক্ষস ভাব, পশু ভাব, অমানুষিক ভাব আসিয়া তাহাদের মস্তকে নির্ভর করিয়াছে। দয়া, মায়া, অনুগ্রহ, স্নেহ, ভালবাসা অন্তর হইতে একেবারে সরিয়া পড়িয়াছে। মুখখানিও রসনাসহকারে এমনই বিকট ভাব ধারণ করে যে, কর্কশ, নীরস, অন্তর্ঘাতী, মর্মপীড়িত, নিদারুণ বাক্য-রোগে সর্বদা বন্দিদিগকে জর্জরিত করিতে থাকে। তদুপরি যথা-অযথা যন্ত্রণা-পদাঘাত-দণ্ডাঘাত বন্দিভাগ্যে কথায় কথায় হইতে থাকে। দামেস্ক নগরের এজিদের বন্দিগৃহ নরক হইতেও ভয়ানক। শাস্তির মাত্রাও সেই প্রকার। ক্রমে দেখিতে পাইবেন বিধির বিধানে, এজিদ্ আজ্ঞায়, মারওয়ানের মন্ত্রণায়, প্রভু হোসেন পরিবার, জয়নাল আবেদীন, সকলেই ঐ বন্দিখানায় বন্দি। কিন্তু ইহাদের প্রতি কোনরূপ শাস্তির বিধান নাই। পৃথক্ খণ্ডে,-ভিন্ন কক্ষে ইহাদের স্থান নির্ধারিত হইয়াছে। দৈনিক আহারের ব্যবস্থা বন্দিগৃহের প্রধান অধ্যক্ষ হস্তে। তিনি যে সময় বিবেচনা করেন, সে সময় শুষ্ক রুটি এবং একপাত্র জল, যাহা বরাদ্দ আছে, তাহাই দিতে অনুমতি করেন। অন্য অন্য বন্দির ভাগ্যে তাহাও নাই।
পাঠক! ঐ দেখুন! দামেস্ক বন্দিগৃহে শাস্তির চিত্র দেখুন! অধিকক্ষণ দেখাইব না। কোন্ চক্ষু এই অমানুষিক ব্যাপার দেখিতে ইচ্ছা করে?-তবে মহারাজ এজিদের বিচার-চিত্র অনেক দেখিতেছেন, বন্দিখানার চিত্রও দেখুন।
ঐ দেখুন, জীবন্ত নরদেহ লৌহপিঞ্জরে আবদ্ধ হইয়া কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করিয়াছে। অত্যাচারে, অনাহারে, অনিয়মে শরীর জীর্ণ, বর্ণ বিবর্ণ, চক্ষু কোটরে। জিহ্বা তালু শুষ্ক-কণ্ঠ নীরস। মুখাকৃতি বিকৃত, শরীর অন্তঃসারশূন্য অস্থিপুঞ্জের সমাবেশ। কাহারো হস্তপদে জিঞ্জির, কাহারো হস্তপদ মৃত্তিকার সহিত জিঞ্জিরে আবদ্ধ। কোন বন্দি মৃত্তিকাশয্যায় শায়িত অথচ হস্তপদ লৌহশৃঙ্খলে লৌহ-পেরেকে ভূতলে আবদ্ধ। কাহারো বক্ষঃস্থল পর্যন্ত ভূগর্ভে নিহিত, কাহারো গলদেশ পর্যন্ত মৃত্তিকায় প্রোথিত। ঐ দিকে দেখুন। নরাকার রাক্ষসগণ হাসিতে হাসিতে জীবন্ত জীবের অঙ্গ হইতে সুতীক্ষ্ণ ছুরিকা দ্বারা কেমন করিয়া চর্ম ছাড়াইতেছে, লবণ মাখাইতেছে, সাঁড়াশি দিয়া চক্ষু টানিয়া বাহির করিতেছে। দেখুন, দেখুন, লৌহশলাকা-উত্তপ্ত লৌহশলাকা-মানুষের হাতে-পায়ে হাতুড়ির আঘাতে বসাইয়া মৃত্তিকার সহিত কি ভাবে আঁটিয়া দিতেছে। এ সময়ে তাহার প্রাণে কী বলিতেছে, তাহা কী ভাবা যায়, না সহজ জ্ঞানে বোঝা যায়। হস্ত পদ মৃত্তিকার সহিত লৌহ পেরেকে আবদ্ধ, বক্ষে পাষাণ চাপা, চক্ষু ঊর্ধ্বে, কোন দিকে দৃষ্টির ক্ষমতা নাই, দৃষ্টি কেবল অনন্ত আকাশে! আর দেখুন, পা দুখানি কঠিনরূপে ঊর্ধ্বে বাঁধা, মস্তক নিন্মে হস্তদ্বয় ঝুলিয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে, জিহ্বা-মুখ হইতে বাহির হইয়া নাসিকা ঢাকিয়া চক্ষুর উপরে হেলিয়া পড়িয়াছে! চক্ষু উল্টাইয়া ফাটিয়া রক্ত পড়িবার উপক্রম হইতেছে, ইহাতেও নিস্তার নাই, সময়ে সময়ে র্দোরার আঘাতে শরীরের চর্ম ফাটিতেছে! রক্ত পড়িতেছে! কী মর্মঘাতী অন্তরভেদী ভীষণ ব্যাপার! আর দেখা যায় না! চলুন, অন্যদিকে যাই।
ঐ যে বৃদ্ধ বন্দি-লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ, নিবিষ্টচিত্তে ধ্যানে মগ্ন, হাবভাব দেখিয়া যেন চেনা চেনা বোধ হইতেছে। কোথায় যেন দেখিয়াছি মনে পড়ে। অনুমান মিথ্যা নহে। এই মহাত্মা মন্ত্রীপ্রবর হামান হজরত মাবিয়ার প্রধানমন্ত্রী, এজিদের পুণ্যাত্মা পিতার প্রিয় সচিব মহাজ্ঞানী বৃদ্ধ হামান, এজিদ্ আজ্ঞায় বন্দি-লৌহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ! বৃদ্ধবয়সে এই যন্ত্রণা! মন্ত্রী প্রধান হামান কী যথার্থ বিচারে বন্দি? মহারাজ এজিদ্ কী অপরাধে ইহাকে কারাগারে নিক্ষেপ করিয়াছেন, তাহা কি মনে হয়? হানিফার সহিত যুদ্ধে অমত, দামেস্কাধিপতির স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে গমনে অমত প্রকাশ, এজিদের মতের সহিত অনৈক্য-সুতরাং এজিদ্ আজ্ঞায় বন্দি। দামেস্কনগরের ভূতপূর্ব দণ্ডধর হজরত মাবিয়ার দক্ষিণ হস্তই ছিলেন-এই হামান। এজিদের হস্তে পড়িয়া মহা ঋষির এই দুর্দশা! হায় রে জগৎ! হায় রে স্বার্থ!
দামেস্ক-সিংহাসনের চির-গৌরব সূর্য এজিদ-কল্যাণে অস্তমিত!
পিতার মাননীয়-পিতার ভালবাসার পাত্রকে কোন্ পুত্র অবজ্ঞা করিয়া থাকে? হামানের চিন্তা ভ্রমসঙ্কুল ছিল না। আশা ও দুরাশার পথে অযথা দণ্ডায়মান হইয়া কুহকে মাতাইয়া ছিল না-কারণ এ-আশা মানুষেরই হয়। মানুষের দৃষ্টান্তেই মানুষ শিক্ষা পায়। আশা ছিল,-মন্ত্রীপ্রবরের মনে আশা ছিল, এজিদ্ মাবিয়ার সন্তান, পিতৃ অনুগৃহীত বলিয়া অবশ্যই দয়া করিবে; বৃদ্ধ বয়সে নবীন রাজপ্রসাদে সুখী হইয়া নিশ্চিন্তভাবে ঈশ্বর আরাধনায় জীবনের অবশিষ্ট অংশ কাটিয়া যাইবে। নিয়তির বিধানে তাহা ঘটিল না। অথচ এজিদের স্বেচ্ছাচার বিচারে বৃদ্ধ বয়সে লৌহ-নিগড়ে আবদ্ধ হইতে হইল। শুনুন, মন্ত্রীপ্রবর মৃদুমৃদু স্বরে কি বলিতেছেন।
“রাজার অভাব হইলে রাজা পাওয়া যায়, রাজ-বিপ্লব ঘটিলে তাহারও শান্তি হয়, রাজ্যমধ্যে ঘোর বিদ্রোহানল প্রজ্বলিত হইলেও যথাসময়ে অবশ্যই নির্বাণ হয়, উপযুক্ত দাবী বুঝাইয়া দিলে সে দুর্দমনীয় তেজও একেবারে বিলীন হইয়া উড়িয়া যায়। মহামারী, জলপ্লাবন ইত্যাদি দৈবদুর্বিপাকে রাজ্যধ্বংসের উপক্রম বোধ হইলেও নিরাশ-সাগরে ভাসিতে হয় না-আশা থাকে। রাজার মজ্জা-দোষে কি মন্ত্রণা অভাবে রাজ্যশাসনে অকৃতকার্য হইলেও আশা থাকে। মূর্খ রাজার প্রিয়পাত্র হইবার আশায়, মন্ত্রণাদাতাগণ অবিচার অত্যাচার নিবারণে উপদেশ না দিয়া অহরহ তোষামোদের ডালি মাথায় করিয়া প্রতি আজ্ঞা অনুমোদন করাতেই যদি রাজা প্রজায় মনান্তর ঘটে, তাহাতেও আশা থাকে-সে ক্ষেত্রেও আশা থাকে। কিন্তু স্বাধীনতা-ধনে একবার বঞ্চিত হইলে সহজে সে মহামণির মুখ আর দেখা যায় না। বহু আয়াসেও আর সে মহামূল্য রত্ন হস্তগত হয় না। স্বাধীনতা-সূর্য একবার অস্তমিত হইলে পুনরুদয় হওয়া বড়ই ভাগ্যের কথা।”
“রাজা আর রাজ্য, এই দুইটি পৃথক্ কথা-পৃথক ভাব-পৃথক্ সম্বন্ধ। রাজা নিজ বুদ্ধি-দোষে অপদস্থ হউন, সমযুক্তি সুমন্ত্রণায় অবহেলা করিয়া পর-পদতলে দলিত হউন, স্বেচ্ছাচারিত্ব দোষে অধঃপাতে যাউন, তাহাতে রাজ্যের কি? কার্য অনুরূপ ফল, পাপানুযায়ী শাস্তি। স্বেচ্ছাচারী, সুমন্ত্রণা-বিদ্বেষী, নীতি বর্জিত, উচিতে বিরক্ত, এমন রাজার রাজ্যপাট যত সত্বর ধ্বংস হয়, ততই মঙ্গল, ততই রাজ্যের শনিক্ষয় ও ভবিষ্যৎ মঙ্গলের আশা। দামেস্ক-রাজ্যের আর মঙ্গল নাই। বিনা কারণে, প্রেমের কুহকে, পীরিতের দায়ে, প্রণয় বাসনায়, পরিণয়-ইচ্ছায়, যদি এই রাজ্য যথার্থই পরকরতলস্থ হয়, পরপদভরে দলিত হয়, আমাদের স্বাধীনতা লোপ হয়, তবে সে দুঃখের আর সীমা থাকিবে না, সে মনোকষ্টের আর ইতি হইবে না। রাজা প্রজারক্ষক, বিচারক, প্রজাপালক এবং করগ্রাহক। কিন্তু রাজ্যের যথার্থ অধিকারী প্রজা। দায়িত্ব প্রজারই অধিক। রাজ্য প্রজার, রক্ষার দায়িত্ব বাসিন্দামাত্রেরই। যদি রাজ্যমধ্যে মানুষ থাকে, হৃদয়ে বল থাকে, স্বদেশ বলিয়া জ্ঞান থাকে, পরাধীন শব্দের যথার্থ অর্থ বোধ থাকে, জন্মভূমির মূল্যের পরিমাণ জ্ঞান থাকে, একতা-বন্ধনে আস্থা থাকে, ধর্মবিদ্বেষে মনে মনে পরস্পর বৈরীভাব না থাকে, জাতিভেদ, হিংসা, ঈর্ষা এবং ঘৃণার ছায়া না থাকে, অমূল্য সময়ের প্রতি সর্বদা লক্ষ্য থাকে, আলস্যে অবহেলা এবং শৈথিল্যে বিরোধী যদি কেহ থাকে, চেষ্টা থাকে, বিদ্যার চর্চা থাকে, আর সর্বোপরি ঈশ্বরে ভক্তি থাকে, তবে যুগ-যুগান্তরে হউক, শতাব্দী পরে হউক, সহস্রাধিক বর্ষ গত হউক, কোনকালে হউক, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরাধীনতা-গগনে স্বাধীনতা-সূর্যের পুনরুদয় আশা একবার করিলেও করা যাইতে পারে। কিন্তু দামেস্করাজ্যে সে আশা-আশা-মরীচিকা। দামেস্ক বীরশূন্য। দামেস্ক চিন্তাশীল দেশহিতৈষী মহোদয়গণের অনুগ্রহ হইতে বঞ্চিত। সে উপকরণে গঠিত কোন মস্তক আছে কি না, তাহাতেই বিশেষ সন্দেহও হইবে কি না তাহাতেও নানা সন্দেহ।”
“যেদিন রমণী-মুখচন্দ্রিমার সামান্য আভায় ধরণীপতির মস্তক ঘুরিয়াছে, মহীপাল এজিদের মহাশক্তিসম্পন্ন মজ্জা, পরকর-শোভিত মর্দিত কমলদলের মুমূর্ষু অবস্থার ঈষৎ আভায় গলিয়া বিপরীত ভাব ধারণ করিয়াছে, সেইদিন নিরাশার সঞ্চার হইয়া স্বাধীনতা ধনে বঞ্চিত হওয়ার সূত্রপাত ঘটিয়াছে। রাজার আচার, রাজার ব্যবহার, প্রজার আদর্শ এবং শিক্ষার স্থল। যে রাজচক্ষু কোমলপ্রাণা কামিনীর কমল-অক্ষির কোমল তেজ সহ্য করিতে অক্ষম, সে চক্ষু মোহাম্মদ হানিফার সুতীক্ষè তরবারির জ্বলন্ত তেজ সহ্য করিতে কখনো সক্ষম হইবে না। সে অসীম বলশালী মহাবীরের অস্ত্রাঘাত কি রূপজ মোহে ঘূর্ণিত মস্তক সহ্য করিতে পারে? কখনোই নহে। আর আশা কি?-কামিনী কটাক্ষশরে জর্জরিত হৃদয়ের আশ্বাস জন্য রাজনীতি উপেক্ষা করিয়া অকারণ রণবাদ্য বাজাইতে যে মন্ত্রী মন্ত্রণা দেয়, সে মন্ত্রী গাজী রহমানের মন্ত্রণা ভেদ করিয়া কৃতকার্য হইতে কোনকালেও ক্ষমবান হইবে না, কখনোই গাজী রহমানের সমকক্ষ হইতে পারে না। যদি যুদ্ধই ঘটিয়া থাকে, তবে নিশ্চয়ই পরাভব-নিশ্চয়ই দামেস্কের অধঃপতন-নিশ্চয়ই দামেস্ক-সিংহাসনে জয়নাল আবেদীন-নিশ্চয়ই এজিদের মৃত্যু, মারওয়ানের মনোগত আশা বিফল। পীরিত, প্রণয়, প্রেম,-এই তিন কারণেই আজ দামেস্কের-এই দুর্দশা! কী ঘৃণা!! কী লজ্জা!!!”
“বৃদ্ধ বয়সে অবিচারে পিঞ্জরাবদ্ধ হইয়া আকুলিত হই নাই। যত দূর বুঝিয়াছি-বলিয়াছি। আমার ভ্রম দর্শাইয়া ইহা অপেক্ষা শতগুণ শাস্তি দিলেও ক্ষোভের কারণ ছিল না। উচিত কথায় আহাম্মক রুষ্ট, এ কথা নূতন নহে। প্রকাশ্য দরবারে মত জিজ্ঞাসা করায়, বুদ্ধি-বিবেচনায় যাহা আসিয়াছে, বলিয়াছি! ইহাই তো অপরাধ, ইহাতেই বন্দি, ইহাতেই পি রে আবদ্ধ। কিছুমাত্র দুঃখ নাই, কারণ মূর্খ, স্বার্থপর, মিথ্যাবাদী, পরশ্রীকাতর, পরস্ত্রী-আকাঙ্খী, স্বেচ্ছাচারী এবং রোষপরবশ রাজার নিকট ইহা অপেক্ষা আর কি আশা করা যাইতে পারে? প্রাণদণ্ডের আদেশ হয় নাই, ইহাই শত লাভ, সহস্র প্রকারে ঈশ্বরে ধন্যবাদ।”
“ভাল কথা, ওমর আলী বন্দি হওয়ার কথাই শুনিলাম, প্রাণবধের কথা তো শুনিলাম না। শূলে জয়নাল আবেদীনের প্রাণদণ্ড হইবে, ঘোষণার কথাই কানে প্রবেশ করিল, শেষ কথাটা আর কেহ বলিল না। সংবাদ কি? এ অন্যায় যুদ্ধের পরিণাম কি? কী হইতেছে, কী ঘটিতেছে, কোন্ বীর কেমন তরবারি চালাইতেছে, বর্শা উড়াইতেছে, তীর চালাইতেছে, কই-কেহই তো কিছুই বলে না। আমাদের পক্ষের অতি সামান্য সামান্য শুভ সংবাদ লোকের মুখে ক্রমে অসামান্য হইয়া উঠে। কই-এ কয়েক দিন ভাল-মন্দ কোন সংবাদই তো শুনিতে পাই না। মন্দ কথা কানে আসিবার কথা নহে-ভাল কথার যখন একটা বর্ণও প্রকাশ হইতেছে না, তখন আর কী বলি।”
“যুদ্ধকাণ্ড বড়ই কঠিন! সামান্য বিবেচনার ত্রুটিতে সর্বস্ব বিনাশ। লক্ষ প্রাণীর প্রাণ মুহূর্তে ধ্বংস? বড়ই কঠিন ব্যাপার! দামেস্করাজ্যের যে সময় উপস্থিত, এ সময় যুদ্ধ করাই অন্যায়। যুদ্ধের কারণ দেখিতে হইবে, লাভালাভের প্রতিও লক্ষ্য রাখিতে হইবে, আপন আপন ক্ষমতার পরিমাণও বুঝিতে হইবে, ধনাগারের অবস্থাও ভাবিতে হইবে। আত্মীয়, স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পুরবাসী, প্রতিবেশী, সমকক্ষ, সমশ্রেণী জ্ঞাতিকুটুম্ব এবং রাজ্যের গণ্য, মান্য, ধনী ও সাধারণ প্রজার মনের ভাব, বিশেষ করিয়া অতি গোপনে কৌশলে পরীক্ষা করিতে হইবে। কেবল ধনভাণ্ডার খুলিয়া দিয়াই চক্ষু শীতল করিলে চলিবে না। আহার্য সামগ্রী কেবল মানুষের নয়, গরু-ঘোড়া ইত্যাদি পালিত জীবজন্তু সহ নগরস্থ প্রাণী মাত্রের কত দিনের আহার মজুত, প্রাণীর পরিমাণ, আহার্য সামগ্রীর পরিমাণ, আনুমানিক যুদ্ধকালের পরিমাণ করিয়া সমুদয় সাব্যস্ত, বন্দোবস্ত, আমদানি, রপ্তানি, পানীয় জলের সুবিধা পর্যন্ত করিয়া-তবে অন্য কথা।”
“এ যুদ্ধে এ কথাটা অগ্রেই ভাবা উচিত ছিল। মহাবীর মোহাম্মদ হানিফা বহুদূর হইতে আক্রমণ আশায় আসিয়াছেন। ভিন্ন দেশ, তাঁহার পক্ষে সহসা প্রবেশই দুঃসাধ্য। ইহার পর নগর আক্রমণে আশা। রাজবন্দিগৃহ হইতে পরিজনগণকে উদ্ধারের আশা-এজিদ্ বধ করিয়া দামেস্ক-সিংহাসন অধিকার করিবার আশা-এক-একটি আশা কম পরিমাণের আশা নহে। কথাচ্ছলে আমি ইহাকে এক প্রকার দুরাশাও বলিতে পারি, কারণ রাজ্যের সীমাই যুদ্ধের সীমা। সে সীমা অতিক্রম করিয়া নগরের প্রান্তভাগের প্রান্তরে এজিদের মহাকাল স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত। এক গাজী রহমানের বুদ্ধিকৌশলে সকল বিষয় সুন্দর বন্দোবস্ত। যাহা তাহাদের পক্ষে কঠিন ছিল, তাহাও তাহারা অনায়াসেই সুসিদ্ধ করিয়াছে। রাজ্য-সীমায় প্রবেশ দূরে থাকুক, নগরের প্রান্তসীমায় রঙ্গভূমি,-আর আশা কি!”
“অন্যায় সমরে রাজা স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে! কী পরিতাপ! যে রাজা রাজনীতির বাধ্য নহে, সমরনীতির অধীন নহে, স্বেচ্ছাচারিতাই যাহার মস্তিষ্কের বল, তাহার কী আর মঙ্গল আছে? প্রণয়, প্রেমে যে রাজা আসক্ত তাহার কি আর শ্রীবৃদ্ধি আছে? যুদ্ধবিগ্রহে পীরিত প্রণয়ের প্রসঙ্গ আসিতেই পারে না; মূল কারণ হওয়া দূরে থাকুক, সে নামেই সর্বনাশ। রাজনীতি সমরনীতি, এই দুইটি নীতির অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া যত জ্ঞানলাভ হইবে যত অভিজ্ঞতা জন্মিবে, ততই বুঝিতে পারা যাইবে যে, ইহার মধ্যে কি না আছে। জগতের সমুদয় ভাব স্বভাব, ব্যবহার, কার্যপ্রণালী, সমুদয় ঐ দুই নীতির মধ্যগত, কিন্তু ব্যবহারের ক্ষমতা, পরিচালনার বল, কার্যে পরিণত করিবার অধিকার সম্পূর্ণরূপে জগতে কোন প্রাণীর মস্তকে আছে কি না সন্দেহ।”
“এ ধর্মনীতির কথা নহে যে ঘাড় নোয়াইয়া বিশ্বাস করিতেই হইবে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত নহে যে কালে হইবেই হইবে। এ প্রসূতির প্রসব বিষয়ে চিন্তা নহে যে, দশ মাস দশ দিন পরে যাহা হয়, একটা হইবেই হইবে। এ অদৃষ্টলিপির প্রতি নির্ভরের কার্য নহে যে, যাহা কপালে লেখা আছে, তাহাই ঘটিবে। এ রাজ-চক্র, ইহার মর্ম ভেদ করা বড়ই কঠিন। বিশেষ সমর কাণ্ড যেমন কুটিল, তেমনি জটিল। যখনই প্রশ্ন তখনই উত্তর, যে মুহূর্তে চিন্তা সেই মুহূর্তেই কার্য, তখনই কার্যফল দ্রুতগতি সময়ের সহিত সমরকাণ্ডের কার্য-সম্বন্ধ। বুদ্ধির কৌশল, বিবেচনার ফল। জয়-পরাজয়ের সময় অতি সংক্ষেপ। দক্ষিণ চক্ষু দেখিল, বীরবরের হস্তস্থিত তরবারি বিদ্যুৎ-লতায় চমকিতেছে-বাম চক্ষু দেখিল, ঐ মহাবীরের রঞ্জিত দেহ ভূতলে গড়াইতেছে, রঞ্জিত হস্তে রঞ্জিত তরবারি বদ্ধমুষ্টিতে ধরাই রহিয়াছে। বর্তমান যুদ্ধে যে কি ঘটিবে তাহা ভগবানই জানেন। আমার সময় মন্দ। কাহারো নিকট কিছু জিজ্ঞাসা করিতে সাহস হয় না, কাহারো মুখে কিছু শুনিতে পাই না। মহারাজ আজ্ঞা করিয়াছেন-বন্দি হইয়াছি। লৌহশৃঙ্খল গলায় পরিতে হুকুম দিয়াছেন, হুকুম তামিল করিয়াছি। দুঃখ মাত্র নাই, অন্তরেও বেদনা বোধ করি নাই। তবে বেদনা লাগিয়াছে যে, এই সঙ্কট সময়ে অকারণ যুদ্ধে অগ্রসর-স্বয়ং রাজা অগ্রসর, স্বয়ং অস্ত্র ধারণ! বড়ই দুঃখের কথা! এ যুদ্ধের পরিণাম ফল কি হইল? কে হারিল, কে জিতিল? সন্ধি-অসম্ভব। যুদ্ধ অনিবার্যরূপে চলিতেছে, সমর-গগনে লোহিত নিশান বায়ুর সহিত এখনো খেলা করিতেছে। সন্দেহমাত্র নাই। আমার তো বিশ্বাস যে, দামেস্ক সৈন্য-শোণিতে দামেস্ক প্রান্তরই রঞ্জিত হইতেছে। দামেস্কভূমি দামেস্ক-বীর শিরেই পরিপূর্ণ হইতেছে। এ অবৈধ সমরে সন্ধির নামই আসিতে পারে না। এজিদ্ হানিফার রণক্ষেত্রে শুভ্র-নিশান উড়াইতে পারে না। বড়ই শক্ত কথা!”
মন্ত্রীপ্রবর হামান মনের কথা এইরূপে অকপটে মুখে প্রকাশ করিতেছেন, এমন সময় দ্বাররক্ষক দ্রুতপদে মন্ত্রীপ্রবরের নিকট আসিয়া চুপে চুপে কি কথা বলিতে লাগিল। বন্দিসচিব-তাহার মুখে কোন কথাই প্রকাশ হইল না। দেখিবার মধ্যে দেখা গেল চক্ষের জল, আর শুনিবার মধ্যে শুনা গেল দীর্ঘ নিশ্বাস। পাঠক! চুপি চুপি কথা আর কিছু নহে, আমাদের জানা কথা-গত কথা, যুদ্ধের বিবরণ এবং এজিদের পলায়ন, এই সংবাদ।
চলুন, অন্যদিকে যাওয়া যাক্। শুনিতেছেন? শুনিতে পাইতেছেন? স্ত্রী-কণ্ঠ। বুঝিতে পারিতেছেন? কি কথা, একটু অগ্রসর হইয়া শুনুন।
“বাবা জয়নাল! তুই যে বন্দিখানা হইতে পলাইয়াছিস-বুদ্ধির কাজ করিয়াছিস বাপ্! আর দেখা দিস না। কখনোই কাহারো নিকট দেখা দিস না! তুই যে আমার প্রাণের প্রাণ! তোকে বুকে করিলে বুক শীতল হয়! চক্ষু জুড়ায়! তুই আমাকেও দেখা দিস না! বনে, জঙ্গলে, পশুদিগের সহিত বাস করিস্! বাপ্ রে! এজিদ বাঁচিয়া থাকিতে কখনোই লোকালয়ে আসিস্ না। কাহাকেও দেখা দিস্ না। (উচ্চৈঃস্বরে) জয়নাল! তুই আমার-তুই আমার কোলে আয়। এ বন্দিখানায় কী অপরাধে অপরাধী হইয়া বন্দি হইয়াছি-দয়াময় ঈশ্বর জানেন। কতকাল এভাবে থাকিতে হইবে, তাহাও তিনিই জানেন। জয়নাল! তোর মুখখানির প্রতি চাহিয়াই এত দিন বাঁচিয়া আছি! তুই ইমাম বংশের একমাত্র সম্বল, মদিনার রাজরত্ন! তোর ভরসাতেই আজ পর্যন্ত দামেস্ক বন্দিগৃহে তোর চিরদুঃখিনী মা প্রাণ ধরিয়া বাঁচিয়া আছে! পবিত্র ভূমি মদিনা পরিত্যাগ করিয়া যে দিন কুফায় গমন করিতে পথে বাহির হইয়াছি, সেই দিন হইতে সর্বনাশের সূচনা হইয়াছে। কত পথিক দূর দেশে যাইতেছে, কত রাজা সৈন্যসামন্তসহ বন, জঙ্গল, মরুভূমি অতিক্রম করিয়া, গিরিগুহা অনায়াসে পার হইয়া নির্দিষ্ট স্থানে নির্বিঘ্নে যাইতেছে। ভ্রম নাই-পথ-ভ্রান্তি নাই-স্বচ্ছন্দে যাইতেছে, আসিতেছে-কোনরূপ পথ-বিঘ্ন নাই, বিপদ নাই, কোন কথা নাই! হায় আমাদের কি দুর্ভাগ্য! দিনে দুই প্রহরে ভ্রম! মহাভ্রম! কোথায় কুফা! কোথায় কারবালা! সেখানে যাহা ঘটিবার ঘটিল। আত্মঘাতী হইলাম না, প্রাণও বাহির হইল না,-কেন হইল না? বাপ্! তোর মুখের প্রতি চাহিয়া-বন্দিখানাতেও তোরই মুখখানি দেখিয়া কিছুই করি নাই। তুই দুঃখিনীর ধন! দুঃখীর হৃদয়ের ধন! অঞ্চলের নিধি! বাপ্! তোর দশা কী ঘটিল? হায়! হায়! কেন তুই ওমর আলীর প্রাণবধের ঘোষণা শুনিয়া বন্দিগৃহ হইতে বাহির হইলি? আমার মন অস্থির-বিকারপ্রাপ্ত। কি বলিতে কি বলি তাহার স্থিরতা নাই। বন্দিখানায় থাকিলে দুর্দান্ত পিশাচ মারওয়ানের হস্ত হইতে তোকে কখনোই রক্ষা করিতে পারিতাম না, আমার ক্রোড় হইতে কাড়িয়া লইয়া যাইত। হায়! হায়!! সে সময় তোর মুখের দিকে চাহিয়া আমার কী দশা ঘটিত বাপ্! তুমি বুদ্ধির কাজ করিয়াছ। এজিদ্ জীবিত থাকিতে লোকালয়ে আসিয়ো না। বনে, জঙ্গলে, গিরিগুহায় লুকাইয়া থাকিয়ো। বনের ফল, মূল, পাতা খাইয়া জীবনধারণ করিয়ো। কখনো লোকালয়ে আসিয়ো না। আর না হয়, যে দেশে এজিদের নাম নাই, তোমার নাম নাই-সে দেশে যাইয়া ভিক্ষা করিয়া জীবন কাটাইয়ো। তাহাতে সাহারবানুর প্রাণ শীতল থাকিবে!”
এ কী! প্রহরিগণ ছুটাছুটি করে কেন? প্রহরিগণ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়াছে! যে যেখানে ছিল, সে সেই স্থান হইতে ছুটিয়াছে! পরস্পর দেখা হইতেছে, কথা হইতেছে,-কিন্তু বড় সাবধানে, চুপে চুপে। কথা কহিতেছে-পরামর্শ করিতেছে-সাবধান হইতেছে,-আত্মরক্ষার উপায় দেখিতেছে। কেন? কী সংবাদ? দেখুন-আশ্চর্য দেখুন! একজন প্রহরী ছুটিয়া আসিয়া বৃদ্ধ মন্ত্রী হামানের কানে কানে চুপি চুপি কি কহিয়া, ঐ দেখুন কি করিল! দ্রুতহস্তে লৌহশৃঙ্খল কাটিয়া ফেলিল এবং হোসেন-পরিবার ব্যতীত অন্য অন্য বন্দিগণকে কারাগার হইতে মুক্ত করিয়া সত্বর বাহির করিয়া দিল। বন্দিগণ অবাক্! কেহ কোন কথা কহিতেছে না। সকলেই যেন ব্যস্ত। পলাইতে পারিলেই রক্ষা!-জীবনরক্ষা!