এগিয়ে চল
যে যত পায় সে তত চায়, এই হলো সংসারের কথা। সংসারী মানুষের চাহিদার শেষ নেই। নিবৃত্তি নেই। কথাটা যদি উলটে নিই, যে যত চায় সে তত পায়, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল ধর্মের কথা, সাধনজগতের কথা। এই জগতে যে যত চাইবে সে তত পাবে। অফুরন্ত! নিয়ে শেষ করা যাবে না। কিভাবে? সেও খুব মজার। যত ছাড়বে তত পাবে। জাগতিক জিনিস যত ছাড়বে, যত রিক্ত হবে তত পূর্ণ হবে অন্যভাবে। ভোগে নয় ত্যাগেই আছে পূর্ণতা।
এ আবার কি কথা! সব যদি ছেড়েই দিলুম, তাহলে আমার রইলটা কি? রইলে তুমি! আমার মা আছেন আর আমি আছি সংসারে। মাঝখানে আর কিছু নেই। ঠাকুর বলছেন : “লোকে ছেলের জন্য, স্ত্রীর জন্য, টাকার জন্য একঘটি কাঁদে। কিন্তু ঈশ্বরের জন্য কে কাঁদছে? যতক্ষণ ছেলে চুষি নিয়ে ভুলে থাকে, মা রান্নাবান্না বাড়ির কাজ সব করে। ছেলের যখন চুষি আর ভাল লাগে না—চুষি ফেলে চিৎকার করে কাঁদে, তখন মা ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে দুড়দুড় করে এসে ছেলেকে কোলে লয়।”
চুষি ফেলে দিতে হবে। চুষি কি? স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, টাকা, যশ-খ্যাতি, প্রতিপত্তি। নিশ্ছিদ্র একটা বাতাবরণ। তার মধ্যে বসে শৌখিন ভগবত-স্মরণ। একটু চোখ বুজে বসে রইলুম, মনে করলুম খুব ধ্যান হলো। এক রাউণ্ড কর গুণলুম, হয়ে গেল জপ। তিনবার গম্ভীর গলায় ‘ঠাকুর ঠাকুর’ করলুম। ঠাকুর অমনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। এসে গেছি, আমার নিষ্কাম ভক্ত! তোমার ডাকের কি জোর ছোকরা, যেন ফেরিওয়ালা হাঁকছে, স্টিলের বাসন। ঐ মোড়ের মাথা থেকে শোনা যাচ্ছে। বৎস, মুখের ডাকে কিছু হবে না। মনে ডাক। সাধন মানে স্লোগান নয়। ধারাপাতের নামতা পড়া নয়। দু এককে দুই, দুই দুগুণে চার সাধন মানে সার্কাস নয়। মন-মুখ এক করাই হচ্ছে প্রকৃত সাধন। নতুবা মুখে বলছি——হে ভগবান! তুমি আমার সর্বস্ব ধন’ এবং মনে বিষয়কেই সর্বস্ব জেনে বসে রয়েছি—এরূপ লোকের সকল সাধনাই বিফল হয়।
ছুঁচের মতো সূক্ষ্ম সেই মহিমময়ের রাজত্বের প্রবেশপথ। সেখানে প্রবেশ করতে হবে মন দিয়ে। সেই মনটি কেমন হওয়া চাই? ঠাকুর বলছেন : “বাসনার লেশমাত্র থাকতে ভগবানলাভ হয় না। যেমন সুতোতে একটু ফেঁসো বেরিয়ে থাকলে ছুঁচের ভিতর যায় না। মন যখন বাসনারহিত হয়ে শুদ্ধ হয়, তখনি সচ্চিদানন্দ লাভ হয়।”
বাসনা ত্যাগ করতে হবে। মুখে ত্যাগ করা খুব সহজ। বলে দিলুম ত্যাগ। হয়ে গেল ত্যাগ। ভিতরে কিন্তু সব গজগজ করছে মটরের দানার মতো। ঠাকুরের সেই বিখ্যাত উপমা–-”পায়রার ছানার গলায় হাত দিলে যেমন মটর গজগজ করে, সেইরকম বদ্ধজীবের সঙ্গে কথা কইলে টের পাওয়া যায়, বিষয়বাসনা তাদের ভিতর গজগজ করছে। বিষয়ই তাদের ভাল লাগে, ধর্মকথা ভাল লাগে না।” এমনও হয়, ধর্মের মধ্যে আছি, মহাপুরুষের সঙ্গে দিনাতিপাত করছি, তিনি আমাকে কৃপা করতে চাইছেন, আমাকে জ্যোতির্ময় লোকের সন্ধান দিতে চাইছেন, তবু আমার হচ্ছে না। আমার আসছে না। আমি মজে আছি অন্য রসে।
ঠাকুরের অন্তরঙ্গ জমায়েতে আসতেন কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়। ঠাকুরের কৃপাধন্য গৃহী-শিষ্যদের অন্যতম। আদি নিবাস ছিল ঢাকায়। সেখান থেকে এসে বসবাস শুরু করেন হালিশহরে। তিনি ঢাকার সরকারি অফিসে অ্যাকাউন্টেন্টের কাজ করতেন। ১৮৮০-তে ঠাকুরের দর্শনলাভ করেন। তাঁর এই পথের আকাঙ্ক্ষা ছিল, সংস্কার ছিল। অনেক কিছু করেছিলেন। প্রথম জীবনে ব্রাহ্মসমাজ, কর্তাভজা, নবরসিক প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ে যোগদান করেন। অবশেষে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের শরণাগত। তিনি যখন ঢাকায় ছিলেন, সেইসময় বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সঙ্গে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বিষয়ে তাঁর আলোচনা হতো। ঢাকা থেকে কলকাতায় এলেই ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে দর্শন করতে ছুটতেন। ঠাকুর নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে কেদারনাথের তর্ক বাঁধিয়ে দিয়ে বেশ মজা পেতেন।
সেই কেদারনাথ সম্পর্কে ঠাকুর বলছেন সাঙ্ঘাতিক কথা : “কেদারকে বললুম, কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকলে হবে না। ইচ্ছা হলো, একবার তার বুকে হাত বুলিয়ে দিই, কিন্তু পারলুম না। ভিতরে অঙ্কট-বঙ্কট। ঘরে বিষ্ঠার গন্ধ, ঢুকতে পারলাম না। যেমন স্বয়ম্ভূ লিঙ্গ কাশী পর্যন্ত জড়। সংসারে আসক্তি— কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থাকলে হবে না।”
এই যে ‘অঙ্কট-বঙ্কট’, এ যাবে কি করে! মানুষ বড় কিছু পাবার জন্যে ছোট জিনিস ত্যাগ করে। নিজেকে প্রস্তুত করে। হীরে পাবার আশা থাকলে কাঁচ ফেলে দেয়। অঙ্কট-বঙ্কট সরাতে পারলে কি লাভ হবে? সমাধি লাভ হবে। ঠাকুর বলছেন : “সমাধি মোটামুটি দুইরকম। জ্ঞানের পথে, বিচার করতে করতে অহং নাশের পর যে-সমাধি, তাকে স্থিতসমাধি বা জড়সমাধি (নির্বিকল্প সমাধি) বলে। ভক্তিপথের সমাধিকে ভাবসমাধি বলে। এতে সম্ভোগের জন্য আস্বাদনের জন্য, রেখার মতো একটু অহং থাকে। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থাকলে এসব ধারণা হয় না।”
কি সুন্দর কথা, রেখার মতো, সোনার সুতোর মতো একটু অহঙ্কার!
কি তাহলে সেই বড় প্রত্যাশা? ভাব। ভাবে আমি সমাহিত হব। তার আগে জানতে হবে মনের সাতটি ভূমি কি কি? ঠাকুরই আমাকে বুঝিয়ে দেবেন। “বেদে ব্রহ্মজ্ঞানীর নানারকম অবস্থা বর্ণনা আছে। জ্ঞানপথ—বড় কঠিন পথ। বিষয়বুদ্ধির—কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তির লেশমাত্র থাকলে জ্ঞান হয় না। এ-পথ কলিযুগের পক্ষে নয়। এই সম্বন্ধে বেদে সপ্তভূমির কথা আছে। এই সাতভূমি মনের স্থান।
“যখন সংসারে মন থাকে—তখন লিঙ্গ, গুহ্য, নাভি মনের বাসস্থান। মনের তখন ঊর্ধ্বদৃষ্টি থাকে না—কেবল কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকে।
“মনের চতুর্থভূমি—হৃদয়। তখন প্রথম চৈতন্য হয়েছে। আর চারিদিকে জ্যোতিঃ দর্শন হয়। তখন সে-ব্যক্তি ঐশ্বরিক জ্যোতিঃ দেখে অবাক হয়ে বলে, ‘একি! একি!’ তখন আর নিচের দিকে (সংসারের দিকে) মন যায় না।
“মনের পঞ্চমভূমি—কণ্ঠ। মন যার কণ্ঠে উঠেছে তার অবিদ্যা অজ্ঞান সব গিয়ে ঈশ্বরীয় কথা বই অন্য কোন কথা শুনতে বা বলতে ভাল লাগে না। যদি কেউ অন্য কথা বলে, সেখান থেকে উঠে যায়।
“মনের ষষ্ঠভূমি—কপাল। মন সেখানে গেলে অহর্নিশ ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন হয়। তখনো একটু ‘আমি’ থাকে। সে-ব্যক্তি সেই নিরুপম রূপদর্শন করে, উন্মত্ত হয়ে সেই রূপকে স্পর্শ আর আলিঙ্গন করতে যায়, কিন্তু পারে না। যেমন লণ্ঠনের ভিতর আলো আছে, মনে হয়, এই আলো ছুঁলাম ছুঁলাম, কিন্তু কাঁচ ব্যবধান আছে বলে ছুঁতে পারা যায় না।
“শিরোদেশ—সপ্তমভূমি—সেখানে মন গেলে সমাধি হয় ও ব্রহ্মজ্ঞানীর ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ দর্শন হয়। কিন্তু সে-অবস্থায় শরীর অধিক দিন থাকে না। সর্বদা বেহুঁশ, কিছু খেতে পারে না, মুখে দুধ দিলে গড়িয়ে যায়। এই ভূমিতে একুশ দিনে মৃত্যু।”
তাহলে সেই বৃহৎ প্রত্যাশাটা কি—যার জন্যে আঁষচুবড়ির মতো এই সংসারকে ছাড়ব? এ তো ঠাকুরেরই সেই পথিকের গল্প—’এগিয়ে যাও।’ দেহ- পথে মন-পথিকের ভ্রমণ। এক কাঠুরে বন থেকে কাঠ এনে কোনরকমে দুঃখে কষ্টে দিন কাটাত। একদিন জঙ্গল থেকে সরু সরু কাঠ কেটে মাথায় করে আনছে, হঠাৎ একজন লোক সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে তাকে ডেকে বললে, ‘বাপু, এগিয়ে যাও।’ পরদিন কাঠুরে সেই লোকের কথা শুনে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে মোটা মোটা কাঠের জঙ্গল দেখতে পেলে; সেদিন যতদূর পারলে কেটে এনে বাজারে বেচে অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি পয়সা পেলে। পরদিন আবার সে মনে মনে ভাবতে লাগল, তিনি আমায় এগিয়ে যেতে বলেছেন; ভাল, আজ আরেকটু এগিয়ে দেখি না কেন। সে এগিয়ে গিয়ে চন্দন কাঠের বন দেখতে পেলে। সে সেই চন্দনকাঠ মাথায় করে নিয়ে বাজারে বেচে অনেক বেশি টাকা পেলে। পরদিন আবার মনে করলে, আমায় এগিয়ে যেতে বলেছেন। সে সেদিন আরো খানিক দূর এগিয়ে গিয়ে তামার খনি দেখতে পেলে। সে তাতেও না ভুলে দিন দিন আরো যত এগিয়ে যেতে লাগল—ক্রমে ক্রমে রূপা, সোনা, হীরার খনি পেয়ে মহা ধনী হয়ে পড়ল। ধর্মপথেরও ঐরূপ। কেবল এগিয়ে যাও। একটু আধটু রূপ, জ্যোতিঃ দেখে বা সিদ্ধাই লাভ করে আহ্লাদে মনে করো না যে, আমার সব হয়ে গেছে।
শুধু এগিয়ে যাও, যত চাইবে ততই পাবে। ‘যতই না পাবে তত পেতে চাবে, ততই বাড়িবে পিপাসা তাহার।’ এখন প্রশ্ন হলো, কি করে এগুব! মনের তো পা নেই। ডানা আছে। স্বভাবে মাছি। অথবা বানরের মতো চঞ্চল। বিচারের বেড়া দিয়ে তাকে আটকাতে হবে। ঠাকুরের নির্দেশ :
১। বিষয়ের কথা একেবারে ছেড়ে দেবে। ঈশ্বরীয় কথা বই অন্য কোন কথা বলো না। বিষয়ী লোক দেখলে আস্তে আস্তে সরে যাবে।
২। ভাববে, ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। ঈশ্বরই সত্য, আর সব দুদিনের জন্য। সংসারে আছে কি?
৩। একটু নির্জন দরকার। নির্জন না হলে মন স্থির হবে না। তাই বাড়ি থেকে আধপো অন্তরে ধ্যানের জায়গা করতে হয়।
৪। আর আন্তরিক ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে হয়। আন্তরিক ডাক তিনি শুনবেনই শুনবেন।
৫। অভ্যাসযোগ। রোজ তাঁকে ডাকা অভ্যাস করতে হয়। একদিনে হয় না; রোজ ডাকতে ডাকতে ব্যাকুলতা আসে।
৬। সব কাজ ফেলে সন্ধ্যার সময় তোমরা তাঁকে ডাকবে। অন্ধকারে ঈশ্বরকে মনে পড়ে; সব এই দেখা যাচ্ছিল! কে এমন করলে! মুসলমানেরা দেখ সব কাজ ফেলে ঠিকসময়ে নামাজটি পড়বে। জপ থেকে ঈশ্বরলাভ হয়। নির্জনে গোপনে তাঁর নাম করতে করতে তাঁর কৃপা হয়। তারপর দর্শন। যেমন জলের ভিতর ডুবানো বাহাদুরি কাঠ আছে—তীরেতে শিকল দিয়ে বাঁধা। সেই শিকলের এক এক পাব ধরে ধরে গেলে, শেষে বাহাদুরি কাঠকে স্পর্শ করা যায়। পূজার চেয়ে জপ বড়। জপের চেয়ে ধ্যান বড়। ধ্যানের চেয়ে ভাব বড়। ভাবের চেয়ে মহাভাব প্রেম বড়। প্রেম হলে ঈশ্বরকে বাঁধবার দড়ি পাওয়া গেল।
৭। গুরুবাক্যে বিশ্বাস। তাঁর বাক্য ধরে ধরে গেলে ভগবানকে লাভ করা যায়। যেমন সুতোর খি ধরে ধরে গেলে বস্তুলাভ হয়।
৮। শুদ্ধাভক্তিই সার, আর সব মিথ্যা। এই ভক্তি কিরূপে হয়? প্রথমে সাধুসঙ্গ করতে হয়। সাধুসঙ্গ করলে ঈশ্বরীয় বিষয়ে শ্রদ্ধা হয়। শ্রদ্ধার পর নিষ্ঠা, ঈশ্বর-কথা বই আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করে না।
৯। তাঁকে পেতে গেলে একটা ভাব আশ্রয় করতে হয়—বীরভাব, সখীভাব বা দাসীভাব আর সন্তানভাব।
১০। পিঁপড়ের মতো সংসারে থাক। এই সংসারে নিত্য অনিত্য মিশিয়ে রয়েছে। বালিতে চিনিতে মিশানো—পিঁপড়ে হয়ে চিনিটুকু নেবে। জলে-দুধে একসঙ্গে রয়েছে। চিদানন্দরস আর বিষয়রস। হংসের মতো দুধটুকু নিয়ে জলটি ত্যাগ করবে। গোলমালে মাল আছে—গোল ছেড়ে মালটি নেবে।
১১। তাঁকে পেতে গেলে বীর্যধারণ করতে হয়। শুকদেবাদি ঊর্ধ্বরেতা। এঁদের রেতঃপাত কখনো হয় নাই। আরেক আছে ধৈর্যরেতা। আগে রেতঃপাত হয়েছে, কিন্তু তারপর বীর্যধারণ। বার বছর ধৈর্যরেতা হলে বিশেষ শক্তি জন্মায়। ভিতরে একটি নতুন নাড়ি হয়, তার নাম মেধানাড়ি।
১২। তিন টান এক কর—সতীর পতির ওপর টান, মায়ের সন্তানের ওপর টান, বিষয়ীর বিষয়ের উপর টান—এই তিন টান যদি একত্র হয়, তাহলে ঈশ্বরদর্শন হয়।
১৩। তাঁর নাম গুণকীর্তন সর্বদা করতে হয়।
১৪। খুব রোখ চাই। তবে সাধন হয়। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আমি আর আমার অজ্ঞান। বিচার করতে গেলে যাকে ‘আমি আমি’ করছ, দেখবে তিনি আত্মা বই আর কেউ নয়। বিচার কর, তুমি শরীর না মাংস, না আর কিছু? তখন দেখবে, তুমি কিছু নও।
১৫। ভগবান মন দেখেন। কে কি কাজে আছে, কে কোথায় পড়ে আছে তা দেখেন না। ভাবগ্রাহী জনার্দন। কর্তাভজারা মন্ত্র দেবার সময় বলে, এখন ‘মন তোর’ অর্থাৎ এখন সব তোর মনের ওপর নির্ভর করছে। তারা বলে, ‘যার ঠিক মন তার ঠিক করণ, তার ঠিক লাভ।’
১৬। যতক্ষণ অহঙ্কার ততক্ষণ অজ্ঞান। অহঙ্কার থাকতে মুক্তি নেই। নিচু হলে তবে উঁচু হওয়া যায়। চাতকপাখির বাসা নিচে, কিন্তু ওঠে খুব উঁচুতে।
১৭। একটু কষ্ট করে সৎসঙ্গ করতে হয়।
১৮। সকলেরই জ্ঞান হতে পারে, প্রার্থনা কর। রোজ অভ্যাস করতে হয়। সার্কাসে দেখে এলাম ঘোড়া দৌড়াচ্ছে তার ওপর বিবি একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কত অভ্যাসে ঐটি হয়েছে। এই দুটি উপায়—অভ্যাস আর অনুরাগ।
১৯। তমোগুণ ছাড়তে হবে—নিদ্রা, কাম, ক্রোধ, অহঙ্কার এইসব। সত্ত্বগুণের সাধনা করতে হয়। যে-ভক্তের সত্ত্বগুণ আছে, সে ধ্যান করে অতি গোপনে। সে হয়তো মশারির ভিতর ধ্যান করে। সবাই জানছে, ইনি শুয়ে আছেন, বুঝি রাত্রে ঘুম হয়নি, তাই উঠতে দেরি হচ্ছে। এদিকে শরীরের ওপর আদর কেবল পেটচলা পর্যন্ত। শাকান্ন পেলেই হলো। খাবারের ঘটা নেই। পোশাকের আড়ম্বর নেই। বাড়ির আসবাবের জাঁকজমক নেই। আর সত্ত্বগুণী ভক্ত কখনো তোষামোদ করে ধন লয় না।
২০। কেঁদে নির্জনে প্রার্থনা করবে। বলবে, হে ঈশ্বর, আমার বিষয়কর্ম কমিয়ে দাও। কেননা ঠাকুর, দেখছি যে বেশি কর্ম জুটলে তোমায় ভুলে যাই। মনে করছি, নিষ্কাম কর্ম করছি, কিন্তু সকাম হয়ে পড়ে। ব্যাকুলতা থাকলেই তাঁকে লাভ করা যায়। ভক্তিই সার।
২১। জপের সময় অন্যমনস্ক হবে না। ষোল আনা মন দিতে হয়।
২২। ধ্যান করবে মনে, কোণে ও বনে। আর সর্বদা সদসৎ বিচার করবে। ঈশ্বরই সৎ—কিনা নিত্যবস্তু, আর সব অসৎ—কিনা অনিত্য। এই বিচার করতে করতে অনিত্য বস্তু মন থেকে ত্যাগ করবে। কামিনী-কাঞ্চন অনিত্য। ঈশ্বরই একমাত্র বস্তু। টাকায় কি হয়? ভাত হয়, ডাল হয়, কাপড় হয়, থাকবার জায়গা হয়—এই পর্যন্ত। টাকাতেই বা কি আছে, আর সুন্দর দেহেই বা কি আছে। তাই নির্জনে সাধনা দ্বারা আগে জ্ঞানভক্তিরূপ মাখন লাভ করবে। সেই মাখন সংসারজলে ফেলে রাখলেও মিশবে না, ভেসে থাকবে।
এইভাবে ধীরে ধীরে সাবধানে, সন্তর্পণে। মানুষ যখন বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় তখন কি করে? যা-যা সঙ্গে যাবে, সব গোছগাছ করে একটা বেডিং তৈরি করে। হোল্ডঅল, সুটকেস একপাশে রেখে অপেক্ষা করে ট্রেনের। প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া আর কিছুই নেয় না। কামরায় উঠে বাঙ্কের ওপর সব গুছিয়ে রেখে আসনে বসে পড়ে। ঠিক সেইরকম সাধনার মেল-ট্রেনে মন যাত্রী। তার লাগেজে সত্ত্বগুণ। সংসারের স্টেশনে স্টেশনে গাড়ি ভিড়ছে— রোগ, শোক, বিপদ, আপদ, জরা, ব্যাধি। হকারের হইচই। পাওনাদার- ব্যবসাদার। আত্মীয়স্বজনের ওঠা-নামা। যাত্রী-মন বসে আছে। বৈঠিয়ে আপনা ঠাম–হাঁ জী, হাঁ জী করছে। আর মেখেছে কি? না বিবেক-হলদি। “সংসার সমুদ্রে কামক্রোধাদি কুমির আছে। হলুদ গায়ে মেখে জলে নামলে কুমিরের ভয় থাকে না। সদসৎ বিচারের নাম বিবেক।” বহু ভেন্ডার লোভনীয় অখাদ্য, কুখাদ্য নিয়ে উঠছে। মন প্রলোভিত হচ্ছে। কিন্তু মনের হাত ধরে আছেন পিতা। সঙ্গে আছে টিফিন বক্স। বাইরের খাবার চলবে না। “সঙ্গেতে সম্বল আছে পুণ্যধন।” মন চলেছে নিজ-নিকেতনে। সংসার-বিদেশ ছেড়ে।
“সংসার দুঃখজলধৌ পতিতস্য কাম- ক্রোধাদিনক্রমকরৈঃ কবলীকৃতস্য। দুর্বাসনানিগড়িতস্য নিরাশ্রয়স্য রামকৃষ্ণ মম দেহিপদাবলম্বম্।।”