2 of 2

এক মুঠো হিরে – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

এক মুঠো হিরে – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

সবসুদ্ধ পঞ্চাশটি আসন। খুব ছোট হল। এমন জায়গায় যে হল আছে, বাইরে থেকে বোঝবার উপায় নেই।

মঞ্চও খুব বড় নয়। দামি মেরুন রঙের ভারী পরদা। সপ্তাহে মাত্র দুদিন অনুষ্ঠান হয়। শনিবার আর রবিবার।

অনুষ্ঠান বলতে শুধু নাচ। রাত দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত। প্রথমে মিস লাইটের নাচ। উগ্র বাজনার তালে-তালে হাত-পা ছুড়ে নাচ। এ-নাচ দেখতে সকলে আসে না। এটা অনেকটা মুখবন্ধ গোছের। আসল নাচ হয় রাত এগারোটায়। রাত এগারোটা থেকে সারা রাত।

মিস তুফানীর নাচ।

মন মাতাল করা দেহ। কোমল স্বচ্ছ আবরণ। পাতলা একটা ওড়না আর রঙিন ঘাগরা।

নাচের সঙ্গে-সঙ্গে তুফানী আবরণ ছুড়ে-ছুড়ে ফেলে। প্রথমে ওড়না। তারপর নাচতে-নাচতে অদ্ভুত কায়দায় ঘাগরার ফাঁস খুলে দেয়। রেশমের ঘাগরা পায়ের তলায় জড়ো হয়ে পড়ে থাকে।

তুফানীর শরীরে তখন আবরণ বলতে দুটি। পাতলা কাঁচুলি, আর কটিপ্রান্ত ঢাকা ছোট জাঙিয়া।

এইবার বাজনা আর নাচ দুই-ই উদ্দাম হয়ে ওঠে।

সামনে বসা পুরুষগুলোর শালীনতা, সম্ভ্রমবোধ সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বিস্ফারিত চোখ মেলে তারা নারীদেহের অপূর্ব সুষমা পান করে।

ধীরে-ধীরে আলোগুলো নিষ্প্রভ হয়ে যায়।

ম্লান থেকে ম্লানতর।

এই সময় তুফানী নাচতে-নাচতে বক্ষাবরণ খুলে ফেলে। নিটোল দুটি স্তন উন্মুক্ত হয়। যৌবনের পশরা। দৃঢ় অথচ পীবর।

তারপর আলো আরও কমতে থাকে।

ঠিক অন্ধকার হওয়ার আগের মুহূর্তে তুফানীর কটিবাসও খসে পড়ে। যৌবনের অবারিত সৌন্দর্য এক মুহূর্তের জন্য পুরুষদের চোখে কামনার আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

একটি আসনের মূল্য দুশো টাকা।

কিন্তু এ-দামে আসন পাওয়া যায় না। আসনের দাম পাঁচশো-ছশো টাকা পর্যন্ত ওঠে। এ-শহরের ধনীর দুলালেরা একটা টিকিটের জন্য জীবন পণ না করলেও, নিজেদের সঞ্চিত অর্থ অঞ্জলি দিতে উন্মুখ হয়ে থাকে।

তুফানীর কৌলীন্য সম্বন্ধে মতভেদ আছে। অনেকে অনেকরকম কথা বলে। যারা প্রচার করে তারা তুফানীকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানে, তারা বলে তুফানী জাতে ইরানি। অর্থাৎ ইরানের মেয়ে, আগে যাকে পারস্য বলত।

হয়তো নির্ভেজাল নয়। দু-পুরুষ আগে ভারতে এসে রক্তের পবিত্রতা হারিয়েছে। রক্তে কিছু ভারতীয় শোণিতের সংমিশ্রণ ঘটেছে।

তুফানী কোথায় থাকে, কোন হোটেলে—কেউ জানে না। জানার অনেকেই অনেক চেষ্টা করেছে। এর জন্য টাকা খরচ করতেও রাজি ছিল।

কিন্তু কোনও সূত্র থেকেই সন্ধান পায়নি।

এটুকু জানতে পেরেছে, নাচের শেষে তুফানী হোটেল থেকে বের হয় না। কখন যে বের হয়, জানা যায় না।

লোকেরা তো আর অনন্তকাল হোটেলের সামনে অপেক্ষা করতে পারে না। তবু অনেকে কিছুক্ষণ থাকে। নিজেদের মোটরের সামনে পায়চারি করে। যদি তুফানীকে দেখতে পায়।

কিন্তু না, কোনওদিন দেখেনি। ভগ্ন-মনোরথ হয়ে চলে গেছে।

দু-একজন হোটেলের ম্যানেজার ডি-মেলো সায়েবের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা করার চেষ্টা করেছে।

ডি-মেলো খুব মেজাজি লোক। কথায়-কথায় উচ্চহাস্য করে।

কিন্তু ওই পর্যন্ত। তুফানীর কোনও খবর তার কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারেনি।

শনিবারের বিকেল। হল জমজমাট। তখনও পরদা ওঠেনি। বিভিন্ন বর্ণের পানীয়ের গ্লাস লোকের হাতে। হলে ধোঁয়ার একটা আবরণ। প্রথমে মিস লাইটের নাচ।

সে-নাচ সম্বন্ধে লোকের বিশেষ আগ্রহ নেই।

লাইট চীনা মেয়ে। তার নাচও নিতান্ত মামুলি। তার কৃশ দেহ পুরুষের চিত্তে উন্মাদনা জাগায় না। তা ছাড়া লাইটের নাচ নিতান্তই স্তিমিতগতি।

পরদা কেঁপে উঠতেই হলের গুঞ্জন থেমে গেল। সবাই মঞ্চের দিকে চোখ রাখল। লাইট সামনে এসে দাঁড়াল।

পরনে টকটকে লাল পোশাক। হাতে ফুলের স্তবক।

নাচ শুরু করার আগেই ফুলের স্তবক চুম্বন করে সেটা হলঘরে ছুড়ে ফেলে দিল।

সেটা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য লোকেদের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ বা ব্যস্ততা দেখা গেল না। ফুলের স্তবক যার কাছে পড়ল, সে সেটা তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিল।

অর্কেস্ট্রার পটভূমিকায় লাইটের নাচ শুরু হল।

কোমর দুলিয়ে একঘেয়ে নাচ।

লাইটের নাচ এত নিরুত্তেজক, এত ঠান্ডা বলেই বোধহয় তুলনায় তুফানীর নাচ এতটা চাঞ্চল্যকর মনে হয়।

লাইটের নাচ শেষ হতে সবাই সোজা হয়ে বসল। ভাবটা যেন, এবারে বাঘের খেলা শুরু হবে।

কিন্তু হঠাৎ বিপর্যয়। সারা হলঘর অন্ধকারে ডুবে গেল।

লোডশেডিং? কিন্তু তা তো হওয়ার নয়! হোটেলে জেনারেটার আছে। কোনওদিন কোনও কারণেই অন্ধকারের রাজত্ব নামতে দেবে না।

কয়েকজন লোক ম্যানেজারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। কী ব্যাপার জানার জন্য।

বাকি সবাই গোল হয়ে জটলা করতে লাগল।

এরকম একটা নাচের আসর মাটি হলেই সর্বনাশ। শুধু যে টাকাই যাবে তাই নয়, ফুর্তিও বরবাদ হয়ে যাবে। টিকিটের দাম ম্যানেজার হয়তো ফেরত দিতে পারে, কিন্তু মেজাজ একেবারে মাটি।

তুফানী ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে বসে নিজের উন্মুক্ত বুকের ওপর সেন্ট স্প্রে করছিল। হঠাৎ বাতি নিভে গেল।

তুফানী দ্রুত হাতে পোশাকে নিজের শরীর ঢেকে নিল।

নিশ্চয় ট্রান্সফরমারে কোনও গোলমাল হয়েছে।

হোটেলেই ইলেকট্রিশিয়ান আছে, কিন্তু তারা মেরামতির কাজে হাত দিতে পারবে না। ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিকে খবর দিতে হবে।

বিরক্তিকর।

দরজায় ঠুকঠুক শব্দ।

তুফানী বুঝতে পারল, ম্যানেজার এসে দাঁড়িয়েছে।

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণ বলবে, কিংবা হয়তো মোমবাতির ব্যবস্থা করবে।

এ-কামরা তার খুবই চেনা। বহুদিন ধরে ব্যবহার করছে।

এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।

খোলার সঙ্গে-সঙ্গে দুটি কঠিন হাত সাঁড়াশির মতন এগিয়ে এসে তুফানীর মুখ চেপে ধরল।

তুফানী একটু শব্দও করতে পারল না।

একটু পরে তার মুখ থেকে হাত সরে গেল। নাকের ওপর একটা রুমাল এসে পড়ল।

উগ্র ঝাঁজালো একটা গন্ধে তুফানীর শরীর ঘিসঘিস করে উঠল।

তার দুটো চোখ বন্ধ হয়ে এল। ধীরে-ধীরে সে অচেতন হয়ে পড়ল।

আগন্তুক অবলীলাক্রমে তুফানীর দেহটা কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে এল।

পিছন দিকে একটা সরু পথ আছে। এই পথ দিয়ে হোটেলের বয়, বাটলাররা যাওয়া-আসা করে। শো-র শেষে তুফানীও এই পথ দিয়ে যায়।

হোটেলের মোটর তার জন্য অপেক্ষা করে। দ্রুত পায়ে সে মোটরে গিয়ে ওঠে। সেইজন্যই দর্শনলাভেচ্ছু লোকেরা তাকে দেখতে পায় না।

একটা কালো মোটর অপেক্ষা করছিল।

আগন্তুক অচেতন তুফানীকে নিয়ে সেই মোটরে উঠল। পিছনের সিটে তুফানীকে শুইয়ে দিয়ে, নিজে স্টিয়ারিং ধরল। সুদক্ষ হাতে শহরের যানবাহনের পাশ কাটিয়ে নক্ষত্রবেগে মোটর ছোটাল।

তিনতলায় তুফানীর ফ্ল্যাট। এ-ফ্ল্যাটে সে একলা থেকে। রান্নাবান্নার কোনও ঝামেলা নেই। মোড়ের হোটেল থেকে দু-বেলা খাবার আসে। শুধু ঝাড়পোঁছ করার জন্য একজন ঝি আছে। ঠিকে ঝি, দু-বেলা কাজ করে দিয়ে চলে যায়।

আগন্তুক তুফানীকে পাঁজাকোলা করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

দোতলার দরজা খুলে একজন মহিলা বের হয়ে এল।

কে?

আগন্তুক চাপা গলায় বলল, মিস তুফানী নাচতে-নাচতে অজ্ঞান হয়ে গেছে, তাকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিচ্ছি।

মহিলা কয়েক পা এগিয়ে এল।

আমি কোনও সাহায্য করতে পারি?

আগন্তুক মাথা নাড়ল।

দরকার হবে না। আমি নিজে ডাক্তার।

তিনতলায় তুফানীর ফ্ল্যাটের সামনে তাকে শুইয়ে রেখে আগন্তুক নিজের প্যান্টের পকেট থেকে চাবির গোছা বের করল।

পরপর গোটাতিনেক চাবি চেষ্টা করতেই দরজা খুলে গেল।

আগন্তুক ভিতরে ঢুকে বাতি জ্বালাল, তারপর আবার তুফানীকে তুলে নিয়ে খাটের ওপর শুইয়ে দিল।

দরজা বন্ধ করে আগন্তুক চারদিকে নজর বোলাল।

তুফানী যেমন রোজগার করে, ফ্ল্যাট অবশ্য সেই অনুপাতে সাজানো নয়।

বাইরের ঘরে সোফা গোটাতিনেক। বেশ পুরোনো। মনে হয়, কেনা নয়, ভাড়া করা। শোওয়ার ঘরে একটা সিঙ্গল খাট। একটা ওয়ার্ডরোব, একটা আলনা। কোণের দিকে ড্রেসিংটেবিল। খাটের কাছে ছোট একটা টিপয়ের ওপর লাল রঙের ফোন।

আগন্তুক ধীরপায়ে কোণের দিকে এগিয়ে গেল। পকেট থেকে ছুরি বের করে নিচু হয়ে ফোনের তার কেটে দিল।

তারপর আবার খাটের পাশে এসে দাঁড়াল।

তুফানী অচেতন। আরও আধঘণ্টার আগে তার জ্ঞান ফিরবে এমন আশা কম।

তুফানীর দেহে গোলাপি সিল্কের একটা আবরণ সরে গেছে। ব্রাও অটুট নেই। আনার সময় সম্ভবত ছিঁড়ে গেছে। দুগ্ধ ধবল একটি স্তন অবারিত। তার মাথায় গোলাপি মুকুট। সুডৌল ঊরু। ক্ষীণকটি। নিঃসন্দেহে সুগঠিত দেহ।

এ-দেহ মানুষের প্রথম রিপুকে উদ্দীপিত করে।

এই দেহই তুফানীর জীবিকার মূলধন।

আগন্তুক এদিক-ওদিক সন্ধান করতে-করতে বালিশের তলায় চাবির রিং পেয়ে গেল। তারপর ওয়ার্ডরোবের পাল্লা খুলল।

শাড়ির পর শাড়ি। নাইটি। কিছু সিল্কের পাজামা। তারপর ব্লাউজ আর অন্তর্বাস। মনে হল তুফানীর উপার্জনের সিংহভাগ ব্যয়িত হয় তার সাজপোশাকে।

কিংবা এসব হোটেল কর্তৃপক্ষের উপহারও হতে পারে।

তুফানীর জন্য হোটেলের আয় বড় কম নয়।

দ্রুত হাতে আগন্তুক শাড়ি-ব্লাউজ সরিয়ে ওয়ার্ডরোবের ভিতরে কী অনুসন্ধান করল। মুখ দেখে মনে হল, পেল না।

ওয়ার্ডরোব বন্ধ করে বাইরের ঘরে চলে এল। হাত দিয়ে টিপে-টিপে সোফাগুলো পরীক্ষা করল, হতাশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকল।

ছোট একটা খাওয়ার টেবিল। দু-দিকে দুটো চেয়ার। দেওয়াল-সেলফে কিছু কাপ-ডিশ।

রান্নার বালাই নেই বলেই বোধহয় রান্নাঘর পরিষ্কার।

হঠাৎ খুট করে শব্দ হতেই আগন্তুক চমকে উঠল। আওয়াজটা যেন শোওয়ার ঘর থেকেই আসছে।

তবে কি তুফানীর জ্ঞান ফিরে এসেছে?

আগন্তুক শোওয়ার ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়াল। তুফানী উপুড় হয়ে ফোন ডায়াল করার চেষ্টা করছে। গাউন মেঝেতে লুটোচ্ছে।

পরনে শুধু চিতাবাঘের ছাপের জাঙিয়া।

বৃথাই চেষ্টা করছ। ফোনের লাইন কাটা।

আগন্তুকের কণ্ঠে তুফানী চমকে মুখ ফেরাল। হাত দিয়ে গাউন খোঁজার চেষ্টা করল, পেল না।

আগন্তুক এগিয়ে গিয়ে মেঝে থেকে গাউনটা কুড়িয়ে নিয়ে তুফানীর দিকে ছুড়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মিনিট-দশেক পরে যখন ফিরে এল, দেখল তুফানী গাউন জড়িয়ে ভদ্রভাবে বসেছে।

আগন্তুককে দেখে জিজ্ঞাসা করল, কে আপনি?

আগন্তুক হাসল।

নাম বললেই চিনতে পারবে এমন নামি লোক নই।

কী চান আপনি আমার কাছে?

কী চাই তুমিই বলো?

সকলে যা চায়। আমার দেহ। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওভাবে আমি নাচি বটে, কিন্তু আমি সাধারণ অর্থে গণিকা নই।

তাহলে তুমি এভাবে নিজের নগ্ন দেহ সকলের সামনে তুলে ধরো কেন?

তুফানী দু-হাতে মুখ ঢাকল। তার স্পন্দমান দেহ দেখে মনে হল, সে কাঁদছে।

আগন্তুক অসহিষ্ণুভাবে নিজের হাতঘড়ির দিকে দেখল।

আমার সময় অত্যন্ত কম। যা বলার বলে ফ্যালো।

আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করবেন?

কথাটা তুমি কী বলো, তার ওপর নির্ভর করছে।

বলছি।

তাড়াতাড়ি বলো।

তুফানী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল।

আগন্তুকের মনে হল, তুফানী অযথা সময় কাটানোর চেষ্টা করছে। সে ভাবছে, দেরি হলে হোটেলের লোক তার ফ্ল্যাটে এসে উদ্ধার করবে তাকে।

আগন্তুক তাড়া দিল।

বলো, বলো, আমার হাতে বেশি সময় নেই।

আমার এক ভাই আছে, তাকে আমি দার্জিলিঙে রেখে পড়াচ্ছি। যা উপায় করি, তার বেশিরভাগই তাকে পাঠিয়ে দিতে হয়।

কিন্তু উপার্জনের জন্য আর-কোনও ভদ্র জীবিকা খুঁজে পেলে না?

বিশ্বাস করুন, অনেক চেষ্টা করেছিলাম, পাইনি। খুব সামান্য লেখাপড়া জানি। কোনও অফিসে কেউ নিল না। ছেলেবেলায় নাচ শিখেছিলাম, ভগবান সুঠাম দেহ দিয়েছিলেন। তাই কপাল ঠুকে এ-লাইনে এসে পড়লাম। এরপরও কি আপনি আমার দেহ উপভোগ করতে চান?

কোনও সময়েই তোমার দেহ ভোগ করার ইচ্ছে আমার ছিল না।

তবে?

তোমার কাছে আমি একটি জিনিস চাই।

কী?

আমার কিছু মূল্যবান হিরের প্রয়োজন। তাই দিতে হবে।

তুফানী চোখ কপালে তুলল।

হিরে! হিরে আমি কোথায় পাব?

কোথায় পাবে সেটা আমার বলার কথা নয়। আমার কাছে খবর, তোমার এই ফ্ল্যাটেই কিছু হিরে আছে।

কী বলছেন!

হ্যাঁ, যে-হিরে তিন দিন আগে প্লেনে এসেছে।

আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।

না পারলে আমি নাচার।

বেশ, আমার ফ্ল্যাট আপনি সার্চ করুন।

তা তো করবই, কিন্তু তুমি বলে দিলে আমার খাটুনি বাঁচত। অযথা আমাকে তোমার বিছানাপত্র, বালিশ, ছুরি দিয়ে ফালা-ফালা করতে হত না।

কিন্তু তার আগে আমি জানতে চাই আমার ফ্ল্যাট সার্চ করার আপনার কি অধিকার আছে?

আইনত কোনও অধিকার নেই। দুর্বৃত্ত আইন মানে না। আমার শক্তিই আমার আইন।

বেশ, তাহলে আমার কিছু বলবার নেই।

তোমার তো বলবার কিছু থাকতেই পারে না। কারণ তুমি নিজে বেআইনি কাজে লিপ্ত। চোরাকারবারে অংশীদার। চিরকালই চোরের ধন বাটপাড়ের ভোগে লাগে।

তুফানী একটি কথাও বলল না। একটা পায়ের ওপর আর-একটা পা রেখে চুপচাপ বসে রইল।

পকেট থেকে ছুরিটা বের করে আগন্তুক বাইরের ঘরে চলে এল। সোফার ওপর ছুরিটা বসানোর সঙ্গে-সঙ্গে থেমে গেল।

এ ছাড়া তার উপায়ও ছিল না।

পিছন থেকে তুফানী তাকে জাপটে ধরেছে। সে একেবারে নগ্ন। জাঙিয়াও খুলে ফেলেছে। আগন্তুকের পিঠে যৌবনের তাপ স্পর্শ করাতে-করাতে বলল, ওভাবে আমার সোফাগুলোকে আমি নষ্ট করতে দেব না। তুমি বিশ্বাস করো, যা খুঁজছ তা আমার কাছে নেই।

নিজেকে সামলাতে আগন্তুকের দু-এক মুহূর্ত লাগল। তারপর প্রাণপণ শক্তিতে তুফানীকে ঠেলে দিল।

তুফানী ছিটকে ঘরের এককোণে গিয়ে পড়ল। ঠিক দরজার পাশে।

সেই মুহূর্তে কলিং বেল বেজে উঠল।

‘ডং-ডং’।

আগন্তুক ওঠার আগেই তুফানী তড়িৎগতিতে উঠে দরজা খুলে দিল।

তখনও সে সম্পূর্ণ নগ্ন।

ঘরের মধ্যে দীর্ঘ বলিষ্ঠ এক চেহারা প্রবেশ করল। পরনে লাল গেঞ্জি, ফুলপ্যান্ট। মাথায় কদমছাঁট চুল। একটা চোখ কানা।

ঘরের মধ্যে ঢুকে পরিস্থিতিটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল, কী ব্যাপার?

ততক্ষণে তুফানী পরদার আড়ালে নিজের দেহ লুকিয়েছে।

কাঁদো-কাঁদো গলায় সে বলল, ইয়াকুব, এই লোকটা অযথা আমার ওপর হামলা করছে। হোটেল থেকে অজ্ঞান করিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। বলছে, আমার কাছে যেসব হিরে আছে, তা চায়।

ইয়াকুব বিরক্ত দৃষ্টি মেলে অনেকক্ষণ দেখে নিয়ে বলল, ব্যাটা পুলিশের চর নাকি?

জানি না।

কীরে, কে তুই, তোর মতলবটা কী?

আগন্তুকও উঠে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে খোলা ছুরি।

ইয়াকুব যে তাকে আক্রমণ করবে সেটা বুঝতে তার অসুবিধে হয়নি। সে-ও নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করল। কিন্তু সময় পেল না!

ইয়াকুব বিদ্যুৎবেগে পা ছুড়ল আগন্তুকের দিকে।

অব্যর্থ লক্ষ্য।

লাথি আগন্তুকের চোয়ালে লেগে ক্ষতের সৃষ্টি করল। দরদর করে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।

আগন্তুক হাতের ছুরিটা ছুড়ল।

ইয়াকুব মাথা নিচু করে ফেলতে ছুরিটা দেওয়ালে লেগে মেঝের ওপর পড়ে গেল।

এবার ইয়াকুব আগন্তুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুজনে জাপটাজাপটি, মুখোমুখি।

একসময়ে দেখা গেল আগন্তুক মেঝের ওপর ছিটকে পড়েছে।

যন্ত্রণায় উঁ-আঁ করে অচেতন হয়ে পড়ল।

তুফানী, তুফানী।

তুফানী ইতিমধ্যে পাশের ঘর থেকে গাউন জড়িয়ে নিয়েছে।

কী, বলো?

আমি ভালো বুঝছি না। আমাদের আস্তানা বদল করতে হবে। তুমি পোশাক পরে নাও।

তুফানী পাশের ঘরে চলে গেল।

মিনিট-পনেরোর মধ্যে তুফানী ফিরে এল। একেবারে সুসজ্জিত বেশে।

ইয়াকুব, চলো।

ইয়াকুব মাথা নাড়ল।

দাঁড়াও, মালগুলো সঙ্গে নিয়ে যাই।

ইয়াকুব দেওয়ালের কাছে গিয়ে পাখার একটা সুইচ টিপল। সঙ্গে-সঙ্গে যান্ত্রিক একটা শব্দ। মনে হল, পিছনের দেওয়াল যেন অল্প সরে যাচ্ছে।

ইয়াকুব দেওয়ালে টাঙানো একটা ফটো নামিয়ে ফেলল।

চৌকো একটা গর্ত।

আগন্তুক অচেতন হওয়ার ভান করে শুয়েছিল, কিছু মোটেই জ্ঞান হারায়নি।

ইয়াকুব আর তুফানী দুজনের মন যখন অন্যদিকে ব্যস্ত, তখন পকেট থেকে ছোট একটা রিভলভার বের করে ইয়াকুবের ঊরু লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল।

ঠিক ঊরুর মাঝখানে গুলি বিঁধল।

ও গড!—বলে ইয়াকুব মেঝের ওপর বসে পড়ল।

আগন্তুক আর তিলমাত্র সময় নষ্ট করল না। লাফিয়ে উঠে পরদা টেনে নামাল। তারপর সেই পরদা দিয়ে ইয়াকুবের দুটি হাত পিছমোড়া করে বাঁধল। জানলার পরদা ছিঁড়ে ইয়াকুবের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।

এত সব করার সময়ে আগন্তুকের নজর কিন্তু ছিল তুফানীর ওপর।

সব ব্যাপারটা দেখে তুফানী প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, তারপরই সামলে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল শোওয়ার ঘরে।

ইয়াকুবকে বাঁধার কাজ শেষ করে আগন্তুক দরজার একপাশে লুকিয়ে রইল। একটু পরেই তুফানী ঘরে ঢুকল। হাতে লোহার রড। বোধহয় পরদা থেকে খুলে নিয়েছে।

কিন্তু ঘরে পা দিয়েই আগন্তুককে না দেখে বিস্মিত হয়ে গেল।

তারপর ইয়াকুবের দিকে এগিয়ে গেল।

আগন্তুক পিছন থেকে সজোরে তাকে জাপটে ধরল।

আচমকা আক্রমণে তুফানীর হাত থেকে লোহার রডটা ছিটকে মেঝের ওপর পড়ে গেল।

তুলোর মতন নরম শরীর। যৌবন-পুষ্পিত দেহ।

দু-এক মুহূর্তের জন্য আগন্তুক মানসিক ভারসাম্য হারাল।

কিন্তু যখন তার মনে হল, তুফানী ইচ্ছে করেই যেন তার যৌবন-পশরার স্পর্শের সুযোগ দিচ্ছে, তখনই সে সাবধান হয়ে গেল। টানতে-টানতে তাকে শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেল। মুখে হাতচাপা দিয়ে। বিছানার চাদর দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধল। বালিশের একটা ঢাকা মুখের মধ্যে পুরে দিল। তারপর বিছানার ওপর শুইয়ে রাখল।

বাইরের ঘরে এসে দেয়ালের গর্তের মধ্যে দেখল।

কাঠের একটা ড্রয়ার। ড্রয়ারটা খুলতেই আগন্তুকের চোখ ঝলসে গেল। পাশাপাশি গোটাদশেক হিরে। ঔজ্জ্বল্যে আর আয়তনে অপূর্ব। এর যে কত দাম হতে পারে আগন্তুক আন্দাজ করতে পারল না।

একবার ইয়াকুবের দিকে চোখ ফেরাল। সে উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

হিরেগুলো কাগজে মুড়ে পকেটে ভরে ফেলল। তারপর বাইরে এসে দরজায় চাবি দিয়ে দিল।

নামার সময় আবার দোতলার সেই মহিলার সঙ্গে দেখা।

আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করল, ওপরে ইয়াকুব এসেছে বুঝি?

কী করে বুঝলেন?

আওয়াজ শুনে। ও এলেই হাঙ্গামা শুরু করে।

আগন্তুক হাসল। নামতে-নামতে বলল, মাতালের কাণ্ড তো!

আগন্তুক মোড়ের ডাক্তারখানায় গিয়ে ঢুকল।

ডাক্তারকে নিজের কার্ড দেখিয়ে বলল, একটা ফোন করব। কত লাগবে?

কার্ড দেখে ডাক্তার বিগলিত।

কী আবার দেবেন? কিছু নয়। যতগুলো ইচ্ছে ফোন করুন।

আগন্তুক ফোন তুলল।

লালবাজার? ডি সি অবনী লাহিড়ীকে দিন।

ফোনের ওপার থেকে অবনীর কণ্ঠ ভেসে এল, লাহিড়ী বলছি।

আমি পারিজাত বক্সি।

হ্যাঁ, বলুন।

আপনি একবার মতিলাল রায় লেনে আসতে পারেন? মোড়ে আমি অপেক্ষা করছি।

আধ-ঘণ্টার মধ্যে পুলিশের জিপ এসে হাজির। ভিতরে অবনী লাহিড়ী।

পারিজাত বক্সি জিপে উঠে বসলেন। যেতে-যেতে অবনী লাহিড়ী সব ঘটনা শুনলেন।

শুনে বললেন, আপনি তো কাজের কাজ করেছেন, স্যার। আমরা দলটাকে ধরতে নাজেহাল হয়ে গিয়েছি।

সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি পারিজাত বক্সি আর অবনী লাহিড়ী উঠলেন।

পিছনে-পিছনে দুজন পুলিশ।

পারিজাত বক্সি চাবি দিয়ে দরজা খুলতে-খুলতে বললেন, দুজনকে দুটো ঘরে বেঁধে রেখেছি। বাইরের ঘরে ইয়াকুব আর শোওয়ার ঘরে তুফানী। ওই দেখুন না।

দরজা খুলেই পারিজাত বক্সি চমকে উঠলেন। পরদার কাপড় পড়ে আছে, ইয়াকুব নেই।

তিনি ছুটে পাশের ঘরে গেলেন। একই ব্যাপার। তুফানীও উধাও।

আশ্চর্য কাণ্ড! দরজা বাইরে থেকে বন্ধ, কী করে এরা পালাল? বাইরে যাওয়ার আর তো কোনও পথ নেই।

অবনী লাহিড়ী মুচকি হাসলেন। তাঁর হাসিতে ব্যঙ্গের রেশ।

কী হল?

পারিজাত বক্সি চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

যেভাবে দুজনকে বাঁধা হয়েছিল, তৃতীয় ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া মুক্তি পাওয়া অসম্ভব।

পারিজাত বক্সি ছুটে রান্নাঘরে গেলেন। এর আগে রান্নাঘরে লক্ষ করেননি। একেবারে কোণের দিকে কাঠের একটা সিঁড়ি। ছাদে ওঠার।

পারিজাত বক্সি সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠলেন। ছাদে উঠতেই রহস্যের সমাধান হয়ে গেল।

একেবারে পাশাপাশি বাড়ি। একটা শিশুও বোধহয় এক ছাদ থেকে আর-এক ছাদে যেতে পারে। এই ছাদ দিয়ে কেউ এসে ওদের উদ্ধার করে নিয়ে গেছে।

পারিজাত বক্সি অবনী লাহিড়ীকে সেই কথাই বললেন।

অবনী লাহিড়ী জিজ্ঞাসা করলেন, হিরেগুলো কই?

পারিজাত বক্সি পকেট থেকে কাগজের মোড়ক খুলে দেখালেন।

ম্লান চাঁদের আলোয় হিরেগুলো জ্বলজ্বল করে উঠল।

অবনী লাহিড়ী বললেন, আমি অবশ্য জহুরি নই, কিন্তু তাহলেও মনে হচ্ছে হিরেগুলো খুব দামি। কোনও জুয়েলারকে দিয়ে যাচাই করে নিলেই ঠিক বোঝা যাবে। যাক, পাখি তো পালিয়েছে। আমরা ঘরদোর একবার সার্চ করে দেখি।

পারিজাত বক্সি সোফায় চুপচাপ বসে রইলেন। ব্যথাটা এবার চিনচিন করে উঠছে। উত্তেজনার মধ্যে এতক্ষণ টের পাননি।

অবনী লাহিড়ী পুলিশ নিয়ে ঘরগুলো তন্নতন্ন করে সার্চ করলেন। সেরকম কিছুই পাওয়া গেল না। কেবল কিছু কাপড়চোপড় ছাড়া। বোঝা গেল, টাকাপয়সা যা ছিল, সবই সঙ্গে নিয়ে গেছে।

পারিজাত বক্সি ভাবতে লাগলেন।

যে-হোটেলে তুফানী নাচত, তার ম্যানেজারের সঙ্গে একবার আলাপ করে দেখতে হবে। যদি তুফানী সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু জানা যায়।

লালবাজারে হিরেগুলো জমা দিয়ে পারিজাত বক্সি বাড়ি চলে গেলেন।

পরের দিন সকালেই তিনি হোটেলে গিয়ে হাজির।

ম্যানেজার প্রাতরাশ সেরে বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন, পারিজাত বক্সি সামনে গেলেন।

মিস তুফানীর ব্যাপারে এসেছি।

ম্যানেজার অতিমাত্রায় উৎফুল্ল।

তুফানীর কোনও খবর পেয়েছেন?

না।

তুফানীর কেউ খোঁজ করতে এসেছিল?

হ্যাঁ, ওর মামাতো ভাই ইয়াকুব এসেছিল। আমরা তো কিছু বলতেই পারলাম না।

ইয়াকুব মানে, লম্বা চেহারার কানা ভদ্রলোক?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

তিনিই পুলিশে খবর দিয়েছিলেন। তাই আমি এসেছি। ব্যাপারটা সব খুলে বলুন তো।

ম্যানেজার যা বললেন, কিছুই পারিজাত বক্সির অজানা নয়। বিশেষ করে তিনিই যখন সব কাণ্ডটার নায়ক।

কাল হোটেলের যা লোকসান হয়েছে! সব দর্শককে গুনে-গুনে টাকা ফেরত দিতে হল। তারপর মিস তুফানীকে না পাওয়া পর্যন্ত, সব শো বন্ধ।

কার ওপর আপনার সন্দেহ হয়?

কার কথা বলব? এ-শহরের ধনী যুবকদের মধ্যে অনেকেই আমার কাছে আসত মিস তুফানীকে রানি করে রাখার প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু মিস তুফানী ও-ধরনের নাচত বটে, কিন্তু এদিকে খুব চরিত্রবতী ছিল! আমাকে স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছিল, এ-ধরনের প্রস্তাব যেন তার কাছে না করি।

তুফানীকে জোগাড় করলেন কোথা থেকে?

ওই ইয়াকুব এনেছিল।

তুফানী কতদিন আছে এখানে?

তা বছর-দুয়েক হবে। আপনি একবার জোর তল্লাশি চালান, স্যার। ওকে না পেলে, আমার হোটেল একেবারে কানা হয়ে যাবে।

ইয়াকুবের ঠিকানা জানেন?

দুজনের একই ঠিকানা। তিনের দুই মতিলাল রায় লেন।

ধন্যবাদ। দেখি, কতদূর কী করতে পারি।

পারিজাত বক্সি বিদায় নিয়ে উঠে পড়লেন। হোটেল থেকে সোজা গিয়ে উঠলেন লালবাজারে।

অবনী লাহিড়ীর কামরায় ঢুকে বললেন, আমাকে একবার স্মাগলারদের অ্যালবামটা দেখান তো।

অবনী লাহিড়ী অ্যালবাম এনে দিলেন।

কীরকম চেহারার লোক খুঁজছেন বলুন তো?

বেশ বলিষ্ঠ দোহারা চেহারা, কদমছাঁট চুল, একটা চোখ কানা।

কোন চোখ?

একটু ভেবে পারিজাত বক্সি বললেন, বাঁ-চোখ।

বুঝেছি। গোমেজ। দুর্দান্ত স্মাগলার। আপনি যে বললেন, ইয়াকুব?

পারিজাত বক্সি হাসলেন : এইসব মহাপ্রভুদের তো শতনাম থাকে।

সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর একটা কথা মনে পড়ে গেল। আচমকা মার খেয়ে ইয়াকুব ‘ও গড’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘ইয়া আল্লা’ বলেনি। তাহলে ইয়াকুবই হয়তো গোমেজ।

অ্যালবামের পাতা ওলটাতে-ওলটাতে পারিজাত বক্সি থেমে গেলেন। একটা ফটোর ওপর হাত রেখে বললেন, এই যে, এই লোকটি।

অবনী লাহিড়ী ঝুঁকে পড়ে দেখলেন।

এই তো গোমেজ। সোনার বার চোরাচালান করার জন্যে সাত বছর জেলের ঘানি ঘুরিয়েছিল। আমার ধারণা ছিল, এখন এ-দেশ ছেড়ে বাইরে চলে গেছে।

কোথায় আর গেছে! এ-দেশে বহাল তবিয়তেই রয়েছে। পুরোনো ব্যবসাও করছে।

এই সময় একজন সাব-ইনস্পেক্টর এসে সেলাম করে একটা কাগজ অবনী লাহিড়ীর হাতে দিল।

অবনী লাহিড়ী কাগজের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে পারিজাত বক্সিকে বললেন, জহুরির ভ্যালুয়েশান রিপোর্ট এসে গেছে। ওই দশটা হিরের দাম লাখ-দেড়েক টাকার ওপর।

পারিজাত বক্সি সে-কথায় বিশেষ কর্ণপাত করলেন না। বললেন, সে তো হল, কিন্তু গোমেজ মহাপ্রভুকে ধরার কী বন্দোবস্ত করা যায়?

ওর একটা পুরোনো আস্তানার কথা আমার জানা আছে।

সে-আস্তানায় নিশ্চয় যাবে না। আমার মনে হয়, মতিলাল রায় লেনের বাড়িটার ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করুন। ও-বাড়িতে ওদের আরও কিছু থাকতে পারে। সেজন্যে হয়তো ফিরে আসবে।

ঠিক আছে, একজন পুলিশ আর একজন সাব-ইনস্পেক্টর মোতায়েন করে দিচ্ছি।

পারিজাত বক্সি চলে এলেন।

দিন-পনেরো পর খুব ভোরে ফোন বেজে উঠল।

পারিজাত বক্সি তখনও বিছানায়। হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিলেন।

মিস্টার বক্সি?

কথা বলছি।

আমি অবনী লাহিড়ী। একটা খবর আছে।

কী?

দিন-দুই হল মতিলাল রায় লেনের বাড়ির সামনে একটা অল্পবয়েসি ভিখারি বেহালা বাজিয়ে গান করছে বিকেলবেলা। তার সঙ্গে ওড়না ঢাকা একটি মেয়েছেলেও আছে।

মেয়েছেলেও আছে!

পারিজাত বক্সি এবার বিছানার ওপর উঠে বসলেন।

তারপর?

তারপর ওই ফ্ল্যাটের দোতলার একটি মহিলা নেমে এসে তাদের পাউরুটি, পয়সা এসব দিচ্ছে।

খুব ভালো খবর। আমি একটু পরেই যাচ্ছি আপনার কাছে।

দুপুরবেলা পারিজাত বক্সি সেই দোতলার ফ্ল্যাটের বেল টিপলেন।

মহিলাটি দরজা খুলেই দু-পা পিছিয়ে গেল।

সামনে পারিজাত বক্সি। হাতে উদ্যত রিভলভার।

একটু আওয়াজ করলেই খতম করে দেব। এসো আমার সঙ্গে।

মহিলা নীচে দাঁড়ানো পুলিশের গাড়িতে এসে উঠল।

পুলিশের গাড়ি থেকে একটি মহিলা নেমে পারিজাত বক্সির পিছন-পিছন ওপরে উঠল।

বিকাল হতেই অন্ধকার নামল। একে শীতের কুয়াশা, তার ওপর কাছাকাছি কোনও বাতিও নেই।

অন্ধকার ভেদ করে বেহালার করুণ সুর শোনা গেল। অব্যক্ত একটা কান্না যেন গুমরে-গুমরে উঠছে।

বেহালার শব্দ বাড়ির সামনে আসতেই পারিজাত বক্সি মহিলাকে ইশারা করলেন।

এই মহিলাটি দোতলার ফ্ল্যাটের মহিলার পোশাক পরে তৈরিই ছিল। ধীরে-ধীরে নেমে গেল। তার হাতে আস্ত একটা পাউরুটি।

পাউরুটিটা বেহালাবাদকের ঝুলিতে ফেলে দিতেই লোকটা ফিসফিস করে বলল, আজ পুলিশের পাহারা আছে নাকি?

মহিলা মাথা নাড়ল : না, নেই।

নর্তকী নীচেই রইল। লোকটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ফ্ল্যাটের কাছে গেল। চাবির গোছা বের করে পারিজাত বক্সির আঁটা তালা খুলে ফেলল। তারপর সোজা শোওয়ার ঘরে চলে গেল।

খাটের সঙ্গে লাগানো বেডসুইচটা বারদুয়েক টিপতেই খাটের পাশের কাঠ সরে গেল। লোকটা তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দুটো সোনার বিস্কুট বের করে আলখাল্লার ভিতরের পকেটে রেখে দিল।

গোমেজ, মাথার ওপর হাত তোলো।

গোমেজ চমকে মুখ ফেরাল।

একেবারে পিছনে পারিজাত বক্সি। হাতে রিভলভার।

গোমেজের দুটো চোখ বাঘের চোখের মতন জ্বলে উঠল। কিন্তু সে নিরুপায়।

পারিজাত বক্সি ছাড়াও আরও দুজন অফিসার তার দিকে পিস্তল উঁচিয়ে রয়েছে।

আবার পারিজাত বক্সির বজ্রকণ্ঠ শোনা গেল।

পালানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আগেরবার পা জখম করেছিলাম, এবার বুক লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ব।

মাথা নিচু করে গোমেজ ওরফে ইয়াকুব সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।

তার আগেই তুফানীকে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়েছে।

অবনী লাহিড়ী নিজের হাত প্রসারিত করে পারিজাত বক্সির একটা হাত আঁকড়ে ধরলেন।

আপনার ঋণ শোধ করব কী করে?

পারিজাত বক্সি হাসলেন।

শোধ করতে তো আমি বলছি না। একদিন বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ভুরিভোজে আপ্যায়িত করে দিন। আচ্ছা, আজ চলি। ইয়াকুবকে ভালোভাবে গার্ড করে নিয়ে যাবেন। পথে আত্মহত্যার চেষ্টা না করে।

পারিজাত বক্সির ড্রাইভার মোটরের দরজা খুলে অপেক্ষা করছিল। তিনি গাড়ির মধ্যে গিয়ে বসলেন।

অপরাধ

পুজো সংখ্যা, ১৯৭৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *