এক প্রধানের গল্প
শ্রীযুক্ত বটেশ্বর প্রধানের উপাধিই শুধু প্রধান নয়, তিনি গ্রাম প্রধানও বটেন। খলিলপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তিনিই প্রধান।
এত জায়গা থাকতে কেন খলিলপুর নামক একটি সাধারণ গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানকে নিয়ে এই গল্প লিখছি। সে প্রশ্ন যেকোনও পাঠক করতে পারেন।
আশা করি এই গল্পটি পাঠ করার পরে তাঁদের কারও মনে আর এরকম কোনও প্রশ্ন থাকবে। তার কারণ বটেশ্বরবাবু কোনও সামান্য ব্যক্তি নন, তাঁর মতো স্থিতধী, ঠান্ডা মাথার বুঝমান লোক খুব বিরল। কোনও রকম ছল-চাতুরী বা চালাকি করে বটেশ্বরবাবু গ্রাম প্রধান হননি। গ্রামবাসী প্রায় প্রত্যেকেই তাকে প্রধান বলে মেনে নিয়েছেন, তার বুদ্ধি ও বিবেচনার কথা স্মরণে রেখে।
বেশি নয়, মাত্র একটা উদাহরণ দিয়ে বটেশ্বরবাবুর বিবেচনাবোধ প্রমাণ করছি।
খলিলপুর গ্রামের চক্রবর্তীরা সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন। বিরাট একান্নবর্তী পরিবার ছিল তাদের। এখন ভাই-ভাই ঠাই ঠাই হয়েছে। খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাইয়েরা সব ভিন্ন হয়ে গেছে। উঠোনে কোনাকুনিভাবে কঞ্চির বেড়া টেনে যে যার এলাকা ভাগ করে নিয়েছে। পুরনো বড় একতলা পৈতৃক দালানের বারান্দাতেও দেয়াল গাঁথা হয়েছে।
কিন্তু এত করেও খিটিমিটি, গোলমাল বন্ধ হয়নি। রাতদিন কলহ লেগেই আছে।
সে কলহ কখনও ফসলের ভাগ নিয়ে, কখনও গাছের ফল নিয়ে, কখনও বা এজমালি মানে যৌথ পুকুরের মাছের অংশ নিয়ে।
যেমন হয় পাড়াগাঁয়ের সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ি। একটা বড় কোঠাদালান, কয়েকটা ইতস্তত টিনের ঘর। অনেক ফলবান বৃক্ষ। একটা বড় পুকুর, যার জলে বাসনমাজা, কাপড় কাঁচা থেকে স্নান সবই হয়। আবার যথেষ্ট মাছও পাওয়া যায়।
সবাই জানেন এসব জিনিস কখনও চুলচেরা ভাগ করা যায় না, পুকুর ভাগ করা তো অসম্ভব। তা ছাড়া কোনও ভাগ-বাঁটোয়ারাই সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে না।
গল্পে নামধাম গোপন রাখতে হয়। না হলে একেক সময় খুবই গোলমালে পড়তে হয়।
দুঃখের বিষয় এই গল্পে ধাম গোপন রাখতে পারিনি। খলিলপুরের চক্রবর্তী বাড়ি বলে ফেলেছি। তবে নামগুলো গোপন করছি।
বেশি নয় খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো পরস্পর সংগ্রামী ভাইদের চারজনকে ধরছি। তাদের নাম ধরা যাক নরেনবাবু, সুরেনবাবু, ধীরেনবাবু, বীরেনবাবু।
সেদিন এই চার পরিবারের মধ্যে তুলকালাম কাণ্ড হয়েছে, যাকে বলে এলাহি কাজিয়া। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, পুকুরের মাছ নিয়ে। সাধারণ পুকুর থেকে জাল দিয়ে যে মাছ ধরা হয় সেটা চারভাগে ভাগ করা হয়, যদিও ভাগ নিয়ে, সমান অংশ নিয়ে গোলমাল যথেচ্ছই হয়।
এবার গোলমালটা একাধিক কারণে খুবই জটিল আকার ধারণ করেছে। সকলের চেয়ে বড় ভাই নরেনবাবুর ছেলে কলকাতায় কলেজে পড়ে। তার নাম বরেন। সেই বরেন গত শনিবার দিন কলকাতা থেকে চার-পাঁচজন বন্ধু সঙ্গে করে বাড়ি ফেরে, বরেন এবং বন্ধুদের সকলের সঙ্গে এক বা একাধিক ছিপ। বোঝা গেল বরেন নিজেদের বাড়ির পুকুরের কথা বন্ধুদের বলেছে এবং তারই উৎসাহে বন্ধুরা সবাই খলিলপুর চক্রবর্তীবাড়ির প্রাচীন পুকুরে মাছ ধরতে এসেছে।
এবং মাছ তারা ভাল ধরেছে, পাকা মৎস শিকারী প্রত্যেকে, একেকজন এক কেজি, দেড় কেজি ওজনের নোনা মাছ তিন-চারটে করে ধরেছে। এর মধ্যে একজন আবার বেশ কয়েক কেজি ওজনের একটা অতিকায় বোয়াল মাছও ছিপে গেঁথে তুলেছে।
আজ জাল দিয়ে মাছ ধরার পর মাছ ভাগাভাগির সময় প্রথমে সুরেনবাবু, নরেনবাবুর ছেলে। বরেনের বন্ধুদের মাছ ধরার কথা তুললেন। না হলেও সাকুল্যে পনেরো কেজি মাছ এরা সেদিন বড়শি দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে। সুরেনবাবু প্রস্তাব করলেন আজকের মাছের ভাগ থেকে ওই পনেরো কেজি মাছের দাম বড়দার মানে নরেনবাবুর অংশ থেকে বাদ দিয়ে হিসেব ধরতে হবে।
বলা বাহুল্য এই প্রস্তাবে বাকি দুই জ্ঞাতি ভ্রাতা ধীরেনবাবু এবং বীরেনবাবু সায় দিলেন। সেই সঙ্গে একটা উপরি দাবি করলেন ধীরেনবাবু। বছর তিনেক আগে পুকুরে চারাপোনা ছাড়া হয়েছিল। তখন নানা অজুহাতে সুরেনবাবু চারাপোনার দাম দেওয়া এড়িয়ে গেছেন। ফলে অন্য তিন শরিককে এই ব্যয়ভার বহন করতে হয়েছে।
আজ ধীরেনবাবুর বক্তব্য হল যে মেজদা মানে সুরেনবাবু যখন মাছের চারার দাম দেননি এখন গোটা মাছেও তার কোনও অধিকার নেই। মাছ তিনভাগ হবে, সেই সঙ্গে হিসেবে বড়দার ভাগ থেকে পনেরো কেজি বাদ দিয়ে, তাকে এবং বীরেনবাবুকে সাড়ে সাত কেজি করে বেশি দিতে হবে। মাছ বেচার টাকার হিসেবটা এইভাবে করতে হবে।
এই সময়ে বাদ সাধলেন ওই বড়দা নরেনবাবু। তিনি বললেন, তিনি পনেরো কেজি মাছ ছাড় দিতে রাজি আছেন। কিন্তু গত বছর বন্যার সময় নিজের উঠোনে জল দাঁড়াচ্ছে দেখে বীরেন পুকুরের ধার কেটে নালা দিয়ে জল ঢুকে পুকুর ভাসিয়ে দেয় এবং সব বড় মাছ বেনোজলে ঢুকে বেরিয়ে যায় পুকুর থেকে। সেই জরিমানা তাকে দিতে হবে। আর বোধহয় বেশি বাড়িয়ে লাভ নেই। সবাই বুঝতে পারছেন এ গোলমাল মেটে না, মেটবার নয়।
এদিকে চক্রবর্তী বাড়ির মাছের ভাগ করতে গিয়ে আমরা এই গল্পের নায়ক শ্রীযুক্ত বটেশ্বর প্রধানকে বিস্মৃত হয়েছি। যে সকালে মাছের ভাগ নিয়ে চক্রবর্তী বাড়িতে জ্ঞাতি ভাইদের বিবাদ সেদিনের বিকালের কথায় যাই। ৫৯২
নিজের বাড়ির বারান্দায় একটা তক্তাপোশের শতরঞ্জির ওপর বসে আছেন বটেশ্বরবাবু, ভেতরে ঘরের মধ্যে বটেশ্বর গৃহিণী সুপুরি কুচোচ্ছেন আর সাংসারিক কথাবার্তা বলছেন।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে চক্রবর্তী বাড়ির জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নরেনবাবু এলেন।
সকালবেলায় মাছের ভাগ নিয়ে গোলমালের ব্যাপারটা ইতিমধ্যেই বটেশ্বরবাবুর কানে উঠেছিল, সুতরাং তিনি প্রস্তুত ছিলেন।
এখন নরেনবাবু এসেই গজগজ করে জ্ঞাতি ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে লাগলেন। সোনার টুকরো ছেলে বরেন তার কলেজের বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে পিতৃপুরুষের পুকুরে মাত্র দুচারটে মাছ ধরেছে, তার জন্যে খেসারত দিতে হবে। এদিকে বীরেন এই করেছিল, ধীরেন ওই করেছিল, নানারকম কঁদুনি গাইতে লাগলেন নরেনবাবু, তারপর বললেন, আমি যা যা বললাম সবই তো শুনলেন, আমি কি ভুল বললাম।
গম্ভীর চিন্তান্বিত মুখে বটেশ্বরবাবু বললেন, না। না নরেনদা, আপনি ঠিকই বলেছেন।
গ্রাম প্রধানের অভিমত পেয়ে নরেনবাবু এবার উঠলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উদয় হলেন সুরেনবাবু। তারও বলবার কথা কিছু কম নয়। তিনি আবার কৈশোরে একই স্কুলে বটেশ্বরবাবুর সহপাঠী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বটেশ্বরবাবুর তুই-তোকারির সম্পর্ক। তিনি সুরেনবাবুর সব কথা শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর চিন্তান্বিত মুখে থেকে তারপর তাঁকে বললেন, তুই ঠিকই বলেছিস।
অতঃপর সন্ধ্যার দিকে এবং তারপরে একটু রাতের দিকে এলেন যথাক্রমে ধীরেনবাবু ও। বীরেনবাবু। তাঁদের কথাও খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনলেন বটেশ্বরবাবু এবং সব শোনার পরে আলাদা করে দুজনকেই বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ।
বটেশ্বর গৃহিণী এতক্ষণ ঘরের মধ্যে কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে স্বামীর কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার শেষ ভাই মানে বীরেনবাবু চলে যাওয়ার পরে গৃহিণী বারান্দায় এসে স্বামীকে বললেন, ওরা চার ভাই, চাররকম কথা বলল। আর তুমি সবাইকে বললে, ঠিকই বলেছ। এতে চক্রবর্তী বাড়ির গোলমাল আরও বেড়ে যাবে। এটা তুমি মোটেই ভাল করলে না। অন্ধকার বারান্দায় তক্তপোশে বসে একটা বিড়ি খাচ্ছিলেন শ্রীযুক্ত বটেশ্বর প্রধান। শেষ সুখটান দিয়ে বিড়িটা উঠোনে ফেলে দিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে নির্বিকার কণ্ঠে তিনি গৃহিণীকে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ।