একূল ওকূল
চল্লিশ বৎসর বয়সে সাধুচরণ যেদিন হঠাৎ কাহাকেও কিছু না বলিয়া সংসার ত্যাগ করিয়া গেলেন, সেদিন গাঁয়ের সকলে একবাক্যে বলিল, ইহা যে ঘটিবে তাহা কাহারও অবিদিত ছিল না, বরং সাধুচরণ প্রাণের মধ্যে এতখানি বৈরাগ্য পুষিয়া এতদিন সংসার করিল কি করিয়া, ইহাই আশ্চর্য। কিন্তু সাধুচরণের স্ত্রী সৌদামিনী চারিদিক অন্ধকার দেখিলেন।
সৌদামিনীর বয়স তখন আটাশ। বড় ছেলে নিমাই সবে চৌদ্দ বছরে পা দিয়াছে; তখনও পাঠশালা ছাড়ে নাই। তাহার নীচে তিনটি বোন। জমিজমা সামান্য যাহা আছে, তাহাতে সাধুচরণের বৈরাগ্যলিপ্ত চিত্ত কোনক্রমে গ্রাসাচ্ছাদন জোগাড় করিয়া চলিতেছিল। কিন্তু এখন তাহাও ঘুচিয়া গেল। কারণ সংসারের একমাত্র সমর্থ পুরুষ যদি বিনা বাক্যব্যয়ে গৃহত্যাগ করে, তবে সংসার চলে কি করিয়া?
পাঁচ বৎসর সৌদামিনীর চোখের জল শুকাইল না।
কিন্তু সংসারে একটা অলঙ্ঘনীয় নিয়ম আছে, দিন কাটিয়া যায়। চাকা-ভাঙ্গা পারিবারিক যন্ত্রটা—যাহা আর কোনদিন চলিবে না বলিয়া মনে হইয়াছিল—আবার নড়িতে আরম্ভ করিল। দেখা গেল, সাধুচরণের অভাবে সেটা গুরুতর রকম জখম হইয়াছিল বটে, কিন্তু একেবারে অচল হয় নাই।
ক্রমে সৌদামিনীর চোখের জলও শুকাইল। জমিদার ভাল লোক, সৌদামিনীর অবস্থা বুঝিয়া তিনি আর কয়েক বিঘা জমি তাঁহাকে দিয়াছিলেন, খাজনাও কমাইয়া নামমাত্র রাখিয়াছিলেন। পাড়াগাঁ হইলেও নিঃস্বার্থ লোক দু’ একজন ছিল; তাহারা ক্ষেতখামার দেখিয়া দিত, যাহাতে চাষারা অসহায়া স্ত্রীলোকের যথাসর্বস্ব লুটিয়া লইতে না পারে। মাথায় গুরুভার পড়িলে দেখা যায়, ভারটা যত দুর্বহ মনে করা গিয়াছিল, ততটা নয়। সৌদামিনীরও তাহাই হইল। ক্রমে তিনি নিজেই কাজ চালাইয়া লইতে শিখিলেন। এদিকে নিমাইও বড় হইয়া উঠিতে লাগিল।
ধীরে ধীরে সাধুচরণের সংসারে তাঁহার শূন্য স্থানটা ভরাট হইয়া আসিতে লাগিল। তাঁহার প্রথমা কন্যা সাবিত্রীর বিবাহ যেদিন স্থির হইয়া গেল, সেদিন সৌদামিনী আবার সেই প্রথম দিনের মতো কাঁদিলেন। কিন্তু বেশীক্ষণ কাঁদিবার অবসর কই? চোখ মুছিয়া তাঁহাকে আবার মেয়ের বিবাহের কাজে লাগিতে হইল।
সামান্য ঘরে সামান্য বরে বিবাহ। তবু প্রথম মেয়ের বিবাহ; আয়োজন যথাসাধ্য ভাল করিতে হইল। পাড়ার মোড়ল হারু মুখুজ্যে দেখিয়া শুনিয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ—একলা মেয়েমানুষ, কিন্তু বুকের পাটা আছে বলতে হবে।’ বলিয়া গাঁয়ের অন্যান্য প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে গোপনে এই প্রশ্নটাই আলোচনা করিতে চলিলেন যে, সাধুচরণের বৌ নিতান্ত অসহায় হইয়াও এত আয়োজন করিতে সমর্থ হইল কিরূপে।
বিবাহের দিন প্রাতঃকালে সমস্যা উঠিল, বর ও বরযাত্রীদের বসিবার ব্যবস্থা হইবে কোথায়। চণ্ডীমণ্ডপের ঘরটা সাধুচরণের অন্তর্ধানের পর হইতে এ কয় বৎসর সৌদামিনী তালা লাগাইয়া রাখিয়াছিলেন, কাহাকেও ব্যবহার করিতে দেন নাই। তাঁহার মনে হয়তো আশা ছিল, সাধুচরণ যদি কখনও ফিরিয়া আসেন, তবে ঐ ঘর আবার ব্যবহার করিবেন। এখন সৌদামিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সেই ঘরের চাবি বাহির করিয়া দিলেন। বলিলেন, ‘ঐ ঘরেই আসর কর্ নিমাই। তাঁর নিজের ঘর ছিল, সব সময় বসে শাস্তর-পুঁথি পড়তেন; ঐ ঘরেই জামাই এসে বসুক। মেয়ে জামায়ের কল্যাণ হবে।’ বলিয়া ঘন ঘন চোখের জল মুছিতে লাগিলেন।
যাহোক, মেয়ের বিবাহ হইয়া গেল। সাধুচরণের সাবেক ঘরে কিন্তু আর তালা পড়িল না। নিমাই বড় হইয়াছিল, আঠার-উনিশ বছর বয়স। ঘরটা সে ব্যবহার করিতে লাগিল। সন্ধ্যার পর দু’চার জন বন্ধু আসিত, তাহাদের সহিত গল্প-গুজব, লুকাইয়া দু’ একটা বিড়ি খাওয়া চলিতে লাগিল।
নিমাই আগে ঘোষেদের বাড়িতে আড্ডা দিতে যাইত; এখন নিজের চণ্ডীমণ্ডপে বসিতে লাগিল দেখিয়া সৌদামিনী চাবি লাগাইবার কথা আর বলিতে পারিলেন না। হাজার হোক, নিমাই এখন বাড়ির কর্তা, বাহিরে একটা ঘর না হইলে তাহার অসুবিধা হয়। তা ছাড়া এখন জামাই হইয়াছে, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি হইতে সর্বদা লোকজন আসিতেছে; বাহিরে একটা ঘর না হইলে চলিবে কেন?
সুতরাং বাহিরের যে ঘরটা এতদিন সাধুচরণের শোক-স্মৃতির তাজমহল হইয়া বিরাজ করিতেছিল, তাহা আবার নিত্যব্যবহার্য সাধারণ বৈঠক হইয়া পড়িল।
নিমাই ছেলেটি বেশ বুদ্ধিমান। কুড়ি বছর বয়স হইতেই সে নিজের দায়িত্ব বুঝিয়া লইল। শুধু তাই নয়, নানা বুদ্ধি খাটাইয়া সে জমিজমা বৃদ্ধি করিতে লাগিল। একুশ বছর বয়সে সৌদামিনী তাহার বিবাহ দিলেন।
নিমাইয়ের বিবাহের দিনও সৌদামিনী আবার চোখের জল ফেলিলেন। কিন্তু বেশী চোখের জল ফেলিতেও সাহস হইল না, ছেলের অকল্যাণ হইতে পারে। নিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে বলিলেন, ‘কপাল! যার ঘর, যার সংসার, সে-ই ভোগ করতে পেলে না!’
ছেলের বিবাহের পর সৌদামিনী ধর্ম-কর্মের দিকে অধিক মন দিলেন; গুরুর নিকট মন্ত্র গ্রহণ করিলেন। সাধুচরণ চলিয়া যাইবার পর শাঁখাসিঁদুর রাখিয়া ছিলেন বটে, কিন্তু হবিষ্য আহার করিতেন এবং অন্যান্য বিষয়েও ব্রহ্মচারিণীর কঠোর নিয়ম পালন করিতেন। এখন বধূর হাতে সংসারের অধিকাংশ কাজ তুলিয়া দিয়া তিনি জপতপের দিকে মনোনিবেশ করিলেন। ছেলে কোনদিন পর হইয়া যাইবে এ ভাবনা তাঁহার ছিল না, তাই বধূর হাতে সংসার ছাড়িয়া দিতে তিনি দ্বিধা করিলেন না।
তারপর আরও দু’ তিন বছর গেল।
সাধুচরণের সন্ন্যাস গ্রহণের পর এগারো বছর কাটিয়া গেল। দ্বাদশ বৎস স্বামী নিরুদ্দেশ থাকিলে কুশপুত্তলি দাহ করিয়া রীতিমত বৈধব্য আচার গ্রহণ করিতে হয়; পুরোহিত মহাশয়ের সঙ্গে এই সব বিধিবিধান সম্বন্ধে কথাবার্তা আরম্ভ হইয়াছে, এমন সময় হঠাৎ একদিন সাধুচরণ নিজের গৃহে ফিরিয়া আসিলেন।
২
কার্তিক মাসের প্রভাত। তখনও ঘাসে ও গাছের পাতায় শিশির শুকায় নাই; পুঁটু সদর দরজায় জলছড়া দিতেছিল, এমন সময় এক সন্ন্যাসী আসিয়া দাঁড়াইলেন। পুঁটুর মুখখানি ভাল করিয়া দেখিয়া প্রশ্ন করিলেন, ‘পুঁটু না?’
পুঁটু চমকিয়া মুখ তুলিল। সন্ন্যাসীর গায়ে একটা ময়লা ছেঁড়া আলখাল্লা, মাথায় রুক্ষ চুল, কাঁচাপাকা গোঁফ-দাড়ি, মুখে একটু করুণ হাসি। তাঁহাকে দেখিয়া পুঁটু হাতের ঘটি নামাইয়া থতমতভাবে বলিল, ‘আপনি কে?’
সন্ন্যাসী দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘আমি তোমার বাবা।’
সাধুচরণ যখন বিবাগী হইয়া যান, তখন পুঁটুর বয়স ছিল দেড় বছর; কিন্তু সে মায়ের কাছে গল্প শুনিয়া সব কথা জানিত। কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া থাকিয়া সে চিৎকার করিতে করিতে ভিতরের দিকে ছুটিল, ‘ওমা—ও মেজদি—কে এসেছে দ্যাখ,—বাবা—বাবা এসেছেন—ওমা—’
মুহূর্ত মধ্যে বাড়িতে হৈ চৈ পড়িয়া গেল। সৌদামিনী ছুটিতে ছুটিতে বাহিরে আসিয়া স্বামীকে দেখিয়া একেবারে তাঁহার পা জড়াইয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন, ‘ওগো, এতদিন পরে তুমি ফিরে এলে—’
সাধুচরণের চোখেও জল গড়াইয়া পড়িল, তিনি বলিলেন, ‘হাঁ লক্ষ্মী, আমি এসেছি। ওঠ।’
সৌদামিনী পা জড়াইয়া থাকিয়াই বলিলেন, ‘আর চলে যাবে না, বল।’
সাধুচরণ বলিলেন, ‘না, আর যাব না। সংসার ছেড়ে যাওয়াই আমার ভুল হয়েছিল, লক্ষ্মী। যা খুঁজতে বেরিয়েছিলুম তা তো পেলুম না। এখন ঘরেই থাকব।’
দেখিতে দেখিতে গ্রামের লোক জড় হইয়া গেল। প্রবীণ ব্যক্তিরা সাধুচরণকে আশীর্বাদ ও প্রীতিজ্ঞাপন করিতে লাগিলেন। হারু মুখুজ্যে বলিলেন, ‘সাধুচরণ, তুমি যে ফিরে এসেছ বাবা, এ শুধু তোমার সহধর্মিণী আর ছেলে-মেয়ের পুণ্যে। সন্ন্যাসী হওয়া কি চাট্টিখানি কথা, বাবা, বাপ-পিতামো’র পুণ্যের জোর চাই। এই দ্যাখ না, আমার তিন কুড়ি আট বয়স হল, এখনো সংসারে জড়িয়ে আছি! চেষ্টা করলে কি আমি বৈরাগী হতে পারতুম না? এই তো সেবার জমিদারবাবুকে বলেছিলাম, রাধা-গোবিন্দ মন্দিরের সেবায়েৎ করে দিন, দেখুন সংসার ত্যাগ করতে পারি কি না—ঘরে তৃতীয় পক্ষ আছে তো কি হয়েছে। তা সে যাহোক, এখন ফিরে এসেছ, ছেলেপুলে নিয়ে মনের সাধে ঘর সংসার কর, আমরা দেখে চোখ জুড়োই।’ উপস্থিত ছেলেবুড়ো সকলেই মুখুজ্যের এই সদিচ্ছার সমর্থন করিল।
নিমাই ক্ষেতখামার পরিদর্শন করিতে প্রতূষ্যেই বাহির হইয়া গিয়াছিল, মাঠে পিতার আগমন-সংবাদ শুনিতে পাইয়া ছুটিতে ছুটিতে ফিরিয়া আসিল। জটাজূটধারী বাপকে দেখিয়া সে ক্ষণেক থতমত খাইয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, তারপর সঙ্কুচিতভাবে প্রণাম করিল। সাধুচরণ তাহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিলেন।
তারপর কয়েকদিন ধরিয়া সাধুচরণের গৃহে যেন উৎসব লাগিয়া গেল। তাঁহার প্রত্যাবর্তন-বার্তা চারিদিকে রটিয়া যাইবার পর, আশেপাশের গ্রাম হইতেও পরিচিত-অপরিচিত নানা লোক তাঁহাকে দেখিতে আসিতে লাগিল। সাধুচরণ এই এগারো বৎসর ধরিয়া ভারতবর্ষের নানাদেশ ভ্রমণ করিয়াছিলেন; সাধু, যোগী, অলৌকিক ব্যাপারও বোধ করি অনেক প্রত্যক্ষ করিয়া থাকিবেন; তাঁহার গল্প সকলে চমৎকৃত হইয়া শুনিতে লাগিল। চণ্ডীমণ্ডপে লোক ধরে না। দিবারাত্রির অধিকাংশ সময়ই সাধুচরণ বহুজনপরিবৃত হইয়া তাঁহার সন্ন্যাসী-জীবনের কাহিনী শুনাইতেছেন। বাড়ির ভিতরেও আনন্দের সীমা নাই। দলে দলে গাঁয়ের মেয়েরা আসিতেছে; সৌদামিনীর চোখে কখনও জল, কখনও হাসি—জপতপও এক প্রকার বন্ধ আছে। বিবাহিতা মেয়ে সাবিত্রী সংবাদ পাইয়া বাপকে দেখিতে আসিয়াছে। দুই অনূঢ়া মেয়ে, কালী পুঁটু মুহুর্মুহুঃ বাহিরে গিয়া বাপকে দেখিয়া আসিতেছে। বিশেষত পুঁটু তো আহ্লাদে ও গর্বে আটখানা, কারণ সে-ই প্রথমে পিতাকে আবিষ্কার করিয়াছে।
মোটের উপর একটা কল্পনাতীত উত্তেজনা ও বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়া এই পরিবারের সাতটা দিন কাটিয়া গেল।
তারপর ধীরে ধীরে নূতনত্বের জৌলুষ যখন কাটিয়া আসিল, তখন আবার স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাত্রা চালাইবার চেষ্টা হইল। সাধুচরণ বাহিরের ঘরটাই অধিকার করিয়া রহিলেন; বাড়ির অন্দরের সহিত তাঁহার বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হইল না। দীর্ঘকাল পরিব্রাজকের জীবন যাপন করিয়া তাঁহার নূতন অভ্যাস যাহা কিছু জন্মিয়াছিল, তাহা তিনি নিজের মধ্যেই রাখিলেন। সন্ন্যাসীর জীবনে আধ্যাত্মিক উন্নতি কিছু হোক না হোক, একটা স্বাবলম্বনের ভাব ও বিলাসবিমুখতা জন্মে। সাধুচরণেরও তাহা জন্মিয়াছিল। তাই তাঁহার আগমনে পরিবারের একজন লোক বাড়িল বটে, কিন্তু দায়িত্ব বা অসুবিধা কিছু বৃদ্ধি হইল না।
এইভাবে কার্তিক মাসটা কাটিয়া গেল।
অগ্রহায়ণ মাসের গোড়ায়, একদিন সন্ধ্যার পর তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দেখাইয়া সৌদামিনী ছোট মেয়েকে বলিলেন, ‘পুঁটু, বাইরে দেখে আয় তো কেউ আছে কি না।’
পুঁটু এইমাত্র দেখিয়া আসিয়াছিল, বলিল, ‘না মা, কেউ নেই। বাবা একলা বসে আছেন।’
সৌদামিনী তুলসীমূলে প্রদীপ রাখিয়া বধূকে রান্না চাপাইবার আদেশ দিয়া ধীরে ধীরে বাহিরে গেলেন। সাধুচরণের সঙ্গে তাঁহার নিভৃতে সাক্ষাৎ ঘটিবার সুযোগ বড় একটা হয় না, সন্ধ্যাকালে দু’ একজন বাহিরের লোক সর্বদাই তাঁহার কাছে আসিয়া বসে। আজ নিরিবিলি পাইয়া সৌদামিনী স্বামীর ঘরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। ঘরে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বালা হইয়াছিল, সাধুচরণ একটা রুক্ষ কম্বল দুই কাঁধের উপর তুলিয়া দিয়া স্থির হইয়া বসিয়া ছিলেন; স্ত্রী প্রবেশ করিলে একটু নড়িয়া চড়িয়া বসিয়া বলিলেন, ‘এস, লক্ষ্মী।’
সৌদামিনী মাদুরের একটা কোণে বসিয়া বলিলেন, ‘নিশ্চিন্দি হয়ে তোমার কাছে দু’ দণ্ড যে বসব তা আর হয় না। এখনি হয়তো কে এসে পড়বে।’
সাধুচরণ বিমনাভাবে বাহিরের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘না, এখন আর কে আসবে! নিমাইকে সন্ধ্যাবেলা দেখি না, সে কোথাও যায় না কি?’
সৌদামিনী কহিলেন, ‘সারাদিন খেটে খুটে সন্ধ্যের পর বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দুটো গল্পগুজব করতে যায়। আগে তো এই ঘরেই বসত—’ বলিয়া সৌদামিনী থামিয়া গেলেন।
সাধুচরণ অল্প হাসিয়া বলিলেন, ‘আমি এসে ওর বসবার জায়গাটা কেড়ে নিয়েছি—না?’
জিভ কাটিয়া সৌদামিনী বলিলেন, ‘সে কি কথা!’ তারপর তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘নিমুকে কি কোনও দরকার আছে?’
‘না, দরকার এমন কিছু নয়। তবে সন্ধ্যেবেলা আমার কাছে এসে বসত, দুটো ধর্মকথা শুনত—এই আর কি।’
পুত্র পিতার কাছে বসিয়া ধর্মোপদেশ শুনিবে, ইহার চেয়ে আনন্দের কথা আর কি থাকিতে পারে! তবু সৌদামিনীর বুকের ভিতর ছাঁৎ করিয়া উঠিল। তিনি একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘ও ছেলেমানুষ, ওর এখন আমোদ আহ্লাদের বয়স, আর ধর্মকথার ও বুঝবেই বা কি!—তার চেয়ে আমাকেই দুটো ধর্মকথা শোনাও না গো! দেশসুদ্ধ লোক শুনলে, কেবল আমিই শুনতে পেলুম না।’
সাধুচরণ প্রসন্ন স্বরে বলিলেন, ‘বেশ। কি শুনতে চাও বল।’
সৌদামিনী বিশেষ কিছুই শোনেন নাই, তিনি গোড়া হইতে সব কথা শুনিতে চাহিলেন। তখন সাধুচরণ ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিলেন। গৃহত্যাগ করিবার পর হইতে কোথায় কোথায় গিয়াছেন, বনে জঙ্গলে পর্বতে কোথায় কোন্ মহাপুরুষের দর্শন লাভ করিয়াছেন, কবে কোন্ তীর্থে স্নান করিয়াছেন ইত্যাদি অনেক গল্প বলিলেন। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কষ্ট সহ্য করিবার ক্ষমতাও কেমন করিয়া অল্পে অল্পে কমিয়া আসিল, তাহাও গোপন করিলেন না। একবার অসুখে পড়িয়া তাঁহার কিরূপ দুরবস্থা হইয়াছিল, তাহা সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া শেষে বলিলেন, ‘বুঝতে পারলুম ঘর ছেড়ে এসে ভুল করেছি। সদ্গুরুর দর্শন পেলুম না; তা ছাড়া জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিঃসম্বলভাবে পথে পথে ঘুরে বেড়াবার মতো বৈরাগ্যের জোরও আমার নেই। তাই শেষ পর্যন্ত তোমাদের কাছেই ফিরে এলুম, লক্ষ্মী। ভাবলুম, সাধন ভজন যা করবার ঘরে বসেই করব।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সৌদামিনী বলিলেন, ‘ভগবানের অসীম দয়া।’
কিছুক্ষণ উভয়ে চুপ করিয়া রহিলেন। তারপর সৌদামিনী আস্তে আস্তে বলিলেন, ‘আমি বলছিলুম কি, ভগবানের অসীম দয়ায় যখন ঘরে ফিরে এলে, তখন ওই কম্বল-টম্বল ছেড়ে আগেকার মতো—’
মাথা নাড়িয়া সাধুচরণ বলিলেন, ‘না লক্ষ্মী, ওই কথাটি বল না। এতদিন পরে আর তা পারব না, অভ্যাস ছেড়ে গেছে।’ ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন, ‘আমি এই ঘরটিতে পড়ে থাকব আর দুটি করে খাব। আমাকে আর সংসারে টেন না,—মনে করো তোমাদের বাড়িতে একজন অতিথি এসেছে।’ বলিয়া একটু হাসিলেন।
সৌদামিনী বলিয়া উঠিলেন, ‘ও আবার কি কথা! তুমিই তো সব। তবে তুমি যদি আবার আগেকার মতো হয়ে বসতে পারতে, তাহলে ছেলের বুকে সাহস হত। হাজার হোক, ছেলেমানুষ বই। তো নয়।’
‘না লক্ষ্মী, এ বয়সে নতুন করে বিষয় আশয় দেখা আর পেরে উঠব না, তাতে কাজ নেই। তুমি তো জান, চিরদিনই আমি খোলাভোলা লোক। তার চেয়ে নিমাই যেমন করছে করুক, ওর দ্বারাই হবে। দেখেছি, কাজে কর্মে ওর খুব মন আছে।’
তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া সৌদামিনী বলিলেন, ‘তা আছে। ও-ই তো ক’ বছর ধরে সব করছে। এরই মধ্যে ও—’
এই সময় বাহিরে পদশব্দ শুনা গেল। সৌদামিনী গলা বাড়াইয়া দেখিলেন—হারাণ দত্ত। হারাণ লোকটা নিষ্কর্মা, পরের বৈঠকে আড্ডা দিয়া বেড়ানই তাহার পেশা। সৌদামিনী বিরক্ত হইলেন, গাত্রোত্থান করিয়া বলিলেন, ‘খাবার এতক্ষণে তৈরি হল, পুঁটুকে দিয়ে খবর পাঠাব। দেরি করো না যেন।’
‘আচ্ছা। —কে, হারাণ না কি? এস, হারাণ।’
‘আজ্ঞে কর্তা। জমিদার-বাড়ি গিয়েছিলুম, সেখানে শুনে এলুম—’
শুনিতে শুনিতে সৌদামিনী অন্দরে প্রবেশ করিলেন।
৩
শনিবারে নিমাই শহরে গিয়াছিল।
বেলা একটার সময় ফিরিয়া আসিয়া স্নানাদির পর আহারে বসিলে সৌদামিনী তাহার সম্মুখে বসিয়া বলিলেন, ‘কি হল?’
নিমাই অন্নের গ্রাস মুখে তুলিয়া বলিল, ‘কাল তারা মেয়ে দেখতে আসবে।’
সৌদামিনী উৎসুক স্বরে বলিলেন, ‘তারপর, ছেলেটিকে কেমন দেখলি? কালীর সঙ্গে মানাবে তো?
‘বেশ মানাবে। একটু রোগা কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না।’
‘বয়স কত হবে?’
‘হবে ঊনিশ কুড়ি। এই সবে চাকরিতে ঢুকেছে, এখনো পাকা হয়নি। তার ভগ্নীপতি ডেপুটি পোস্টমাস্টার কি না, তিনিই চেষ্টা করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। শুনলুম শিগ্গির চাকরিতে পাকা হবে।’
সৌদামিনী খুশি হইয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ রে, ছেলের বাপ নেই বুঝি?’
‘না, বাপ নেই মা আছে। বড় দুই ভাই আছে, তারা কাটা কাপড়ের দোকান করে। তিন ভাই একান্নবর্তী, অবস্থা বেশ ভাল। এই ছেলেটি বংশের মধ্যে বিদ্বান, এন্ট্রেস পাস করেছে।’
সৌদামিনী তৃপ্ত হইয়া বলিলেন, ‘বেশ হবে। একটা মেয়ে যদি চাকুরের ঘরে পড়ে তো মন্দ কি? শহরে একজন আপনার লোক রইল। তা হ্যাঁ রে, কি বুঝলি? টাকার কামড় খুব বেশী হবে না কি?’
‘এখনও তো দেনা-পাওনার কোনও কথাই হয়নি। দেখা যাক, কি চায়।’
‘হ্যাঁ, সে পরের কথা পরে, আগে মেয়ে দেখে পছন্দ তো করুক। কালী অবিশ্যি অপছন্দর মেয়ে নয়—”
অন্যান্য আরও অনেক সাংসারিক কথার পর, আহার শেষ করিয়া উঠিবার সময় নিমাই বলিল, ‘মা, একটা খারাপ খবর আছে।’
শঙ্কিতভাবে সৌদামিনী বলিলেন, ‘কি রে?’
নিমাই গলা খাটো করিয়া বলিল, ‘রাধা-গোবিন্দ মন্দিরের জন্য জমিদারবাবু একজন ভাল সেবায়েৎ খুঁজছিলেন; বাবার কথা তাঁকে বলেছিলুম। একরকম ঠিকও হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু মাঝে থেকে একজন গিয়ে তাঁর কাছে চুকলি খেয়েছে।’
সৌদামিনী কিছু জানিতেন না; নিমাই কথাটা যথাসম্ভব গোপন করিয়াছিল, মাকে পর্যন্ত বলে নাই। কিন্তু তিনি নিমেষ মধ্যে সমস্ত বুঝিয়া লইয়া বলিলেন, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কি—ফস্কে গেল। —কে চুকলি কেটেছে জান? ঐ হিংসুটে বুড়ো হারু মুখুজ্যে! ওর নিজের লোভ ছিল কিনা।’ বলিয়া নিমাই সক্রোধে মুখখানা বিকৃত করিল।
সৌদামিনী ঠোঁটে ঠোঁটে চাপিয়া কয়েক বার ঘাড় নাড়িলেন। পাড়াগাঁয়ে কে কিরূপ চরিত্রের লোক সকলেই জানে, অথচ পরস্পরকে দাদা খুড়ো জ্যেঠা বলিয়া আত্মীয়তায় জীবন কাটাইয়া দেয়, ইহাতে নিজেদের কপটতার কথা ভাবিয়া তিলমাত্র লজ্জিত হয় না। সৌদামিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি লাগিয়েছে মুখুজ্যে খুড়ো?’
আসন ছাড়িয়া উঠিয়া নিমাই বলিল, ‘সে আর শুনে কি হবে! কুচুটে বুড়ো রাজ্যির মিথ্যে কথা লাগিয়েছে।’
‘তবু কি বলেছে শুনি না।’
‘শুনবে?—বলেছে বাবা গাঁজাখোর।’
সৌদামিনী উঠিয়া দাঁড়াইয়া তীব্র স্বরে বলিলেন, ‘কি বলেছে?’
‘বাবা নাকি রোজ রাত্তিরে হারাণ দত্তর সঙ্গে বসে গাঁজা খান। আরো কত কি বলেছে কে জানে। এত বড় মিথ্যেবাদী ঐ বুড়ো—’
আরক্ত মুখে সৌদামিনী বলিলেন, ‘যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। মুখুজ্যে খুড়ো নিজের বুকে হাত দিয়ে কথা বলে না? ওর নাতনীকে ভাতারে নেয় না কেন? কেউ জানে না বুঝি!—’ বলিয়া তিনি ছেলের কাছে ঘেঁষিয়া আসিয়া ক্রুদ্ধ চাপা গলায় মুখুজ্যের নাতনীর অতি গুহ্য জীবন-বৃত্তান্ত বর্ণনা করিতে লাগিলেন। নিমাই এঁটো হাতে দাঁড়াইয়া এই পরম রুচিকর কাহিনী শুনিল, তারপর বলিল, ‘হুঁ। ও-বুড়োকে আমি ছাড়ব না, মা। কিন্তু এখন গোলমাল করে কাজ নেই, কালীর বিয়েটা আগে ভালয় ভালয় হয়ে যাক। তুমি ভেব না, একদিন না একদিন ও-বুড়ো আমার হাতে এসে পড়বেই—তখন—’ বলিয়া নিমাই দাওয়ার পাশে মুখ ধুইতে বসিল। পিতাকে গাঁজাখোর বলায় তাহার যত না রাগ হইয়াছিল, এই সূত্রে অমন লাভের চাকরি ফসকাইয়া যাওয়ায় সে আরও আগুন হইয়া উঠিয়াছিল।
পর দিন দ্বিপ্রহরে শহর হইতে কালীকে দেখিতে আসিল—পাত্র ও তাহার দুই জন বন্ধু। মেয়ে দেখানো হইল। কালী চলনসই মেয়ে; পনের বছর বয়স, বাড়ন্ত গড়ন। মেয়ে দেখা হইলে পাত্র তাহার এক বন্ধুর কানে কি বলিল। বন্ধু হাসিমুখে জানাইল, মেয়ে বেশ ভাল, তাহাদের পছন্দ হইয়াছে।
সাধুচরণ সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন; তিনি পাত্রটিকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। পাত্র বন্ধুদের পানে একবার তাকাইয়া মুচ্কি হাসিয়া উত্তর দিল। এই সাধুটি যে তাহার সঙ্কল্পিত শ্বশুর, তাহা সে বুঝিতে পারে নাই।
জলযোগ শেষ করিয়া পাত্রের দল পুনশ্চ কন্যা সম্বন্ধে তাহাদের পরিতোষ জ্ঞাপন করিয়া প্রস্থান করিল। বাড়িতে সকলেই হৃষ্ট, সৌদামিনী আড়াল হইতে পাত্রকে দেখিয়াছিলেন; তাঁহার বেশ পছন্দ হইয়াছিল। ছেলেটি একটু রোগা বটে কিন্তু চট্পটে। শহরের ছেলে কিনা—কথায় বার্তায় দিব্যি চোস্ত।
সন্ধ্যার সময় সাধুচরণ নিমাইকে নিজের ঘরে ডাকিয়া পাঠাইলেন। পিতাপুত্রে কিয়ৎকাল কথা হইল; তারপর নিমাই ক্ষুব্ধ মুখে বাড়ির ভিতর গিয়া সৌদামিনীকে বলিল, ‘মা, বাবার ছেলে পছন্দ হয়নি, সম্বন্ধ ভেঙে দিতে বললেন।’
সৌদামিনী তরকারি কুটিতেছিলেন, বঁটি ফেলিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন, বলিলেন, ‘সে কি রে!’
হ্যাঁ—ছেলে নাকি ট্যারা।’
‘ট্যারা! কই, আমি তো কিছু দেখিনি।’
নিমাই বলিল, ‘একটু চোখের দোষ আছে হয়তো, তাকে ট্যারা বলা চলে না। আর, অত দেখতে গেলে তো ঠক বাছতে গাঁ উজোড় হয়ে যাবে। ময়ূরছাড়া কার্তিক এখন কোথায় পাওয়া যায় বল।’ বলিয়া হতাশভাবে হাত উল্টাইয়া প্রস্থান করিল।
সাধুচরণের প্রত্যাবর্তনের পর হইতে যে জিনিসটি তলে তলে এই পরিবারের মধ্যে সৃষ্টি হইতেছিল, তাহা বুদ্ধিমতী সৌদামিনী জোর করিয়াই চোখের সম্মুখ হইতে সরাইয়া রাখিয়াছিলেন। যে-মানুষ চলিয়া যাওয়ায় একদিন সংসার ছন্নছাড়া হইয়া গিয়াছিল, সে ফিরিয়া আসিলে যে আবার একটা নূতন সমস্যার সৃষ্টি হইবে, তাহা কেহ ভাবিতে পারে নাই। কিন্তু যখন তিল তিল করিয়া তাহাই দেখা দিতে আরম্ভ করিল, তখন সৌদামিনী অন্তরে শঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। এখন তাঁহার এক সুরে বাঁধা সংসারের অবিচ্ছেদ্য ঐক্য নষ্ট হইয়া যায় দেখিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। হাত ধুইয়া তিনি স্বামীর ঘরের অভিমুখে চলিলেন।
ঘরে প্রবেশ করিয়া সৌদামিনী শান্ত স্বরেই বলিলেন, ‘হ্যাঁগা, ছেলে পছন্দ হল না?’
সাধুচরণ কম্বলের উপর অর্ধশয়ান অবস্থায় ছিলেন, ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, ‘তোমার কি রকম মনে হল?’
সৌদামিনী নিজের মতামত প্রকাশ করিতে আসেন নাই, ঈষৎ অধীর কণ্ঠে বলিলেন, ‘আমার কি মনে হল না-হল তাতে তো কিছু আসে যায় না, আমি মেয়েমানুষ। কিন্তু তোমার অপছন্দ হল কেন?’
সাধুচরণ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘আর তো কিছু নয়, ছোকরা একটু ট্যারা।’
সৌদামিনী বলিলেন, ‘কি জানি বাপু, আমি তো কিছু দেখিনি। আর, তা যদি একটু হয়ই তাতে দোষ কি? আর সব দিক দিয়ে তো ভাল।’
সাধুচরণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কালীর অমত হবে না?’
‘ও আবার কি কথা! কালী গেরস্তর মেয়ে, যে বরে আমরা তাকে দেব, সেই বর নিয়েই ঘর করতে হবে। আর অপছন্দই বা হবে কেন? ভাল ঘর, লেখাপড়া-জানা ছেলে—একটু চোখের দোষ যদি থাকেই। কানা-খোঁড়া তো আর নয়।’
অল্প হাসিয়া সাধুচরণ বলিলেন, ‘খোঁড়া বা নুলো হলে বরং ভাল ছিল লক্ষ্মী। কিন্তু এ পাত্রের হাতে মেয়ে দিতে আমার মন সরছে না।’
‘কেন?’ সৌদামিনীর কণ্ঠে একটা অনিচ্ছাকৃত তীব্রতা আসিয়া পড়িল।
সাধুচরণ আবার কিছুক্ষণ নীরব রহিলেন; বোধ হয় নিজের আপত্তিটাকে ভাষায় রূপ দিবার চেষ্টা করিলেন। শেষে বলিলেন, ‘যোগসাধনের কথা তোমাকে তো বোঝাতে পারব না, কিন্তু যে-ছেলে ট্যারা—ভ্রূমধ্যে যার দৃষ্টি স্থির হবার উপায় নেই—তাকে যে ভগবান মেরেছেন। সে যে কোনও কালেই ধর্ম-কর্ম করতে পারবে না।’
সৌদামিনী স্তম্ভিত হইয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিলেন। সাধুচরণের আপত্তির মর্ম হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন না বলিয়া নয়, হঠাৎ তাঁহার একটা বিভ্রম জন্মিল। মনে হইল, তাঁহার এই স্বামী তাঁহার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, কোথাও তাঁহাদের মনের সাদৃশ্য পর্যন্ত নাই, এবং একদিন যে এই লোকটির সঙ্গে নিবিড় দাম্পত্য-বন্ধনের ভিতর দিয়া জীবন যাপন করিয়াছেন, তাহাও অসম্ভব বলিয়া মনে হইল। অজ্ঞাতসারে তাঁহার একটা হাত মাথার কাপড়ের দিকে অগ্রসর হইয়া গেল।
সাধুচরণ বলিলেন, ‘ধর্মের অধিকার থেকে স্বয়ং ভগবান যাকে বঞ্চিত করেছেন, জ্ঞানত হোক অজ্ঞানত হোক, সে যে মহা পাষণ্ড। জেনেশুনে তাকে জামাই করি কি করে? বুঝছ না?
সৌদামিনী বুঝিলেন না, বুঝিবার বৃথা চেষ্টাও করিলেন না। তিনি স্বামীকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিবাণে বিদ্ধ করিয়া বলিলেন, ‘না, বুঝতে পারলুম না। আমি মুখ্যু মেয়েমানুষ, কিন্তু ট্যারা হলেই যে পাষণ্ড হয় এমন কথা বাপের জন্মে শুনিনি। তাহলে ওখানে মেয়ের বিয়ে দেবে না? অমন পাত্র হাতছাড়া হয়ে যাবে?’
সাধুচরণ বলিলেন, ‘তা আর উপায় কি, বল।’
সৌদামিনী ফিরিয়া দ্বারের দিকে যাইতে যাইতে বলিলেন, ‘বেশ, যা ভাল হয় কর। সাবিত্রীর বিয়ের সময় কিন্তু এসব হাঙ্গামা হয়নি।’
সৌদামিনী দ্বার অতিক্রম করিয়া যাইবার পর সাধুচরণ তাঁহাকে ফিরিয়া ডাকিলেন। সৌদামিনী মুখ ফিরাইয়া বলিলেন, ‘কি বলবে বল, আমার ছিষ্টির কাজ পড়ে রয়েছে।’
সাধুচরণ একটু বিষন্নভাবে বলিলেন, ‘আমি সন্ন্যাসী, সংসারের বড় কিছু বুঝি না; আমার যা মনে হল বললুম। তোমরা যদি মনে কর ওখানে বিয়ে দিলেই ভাল হবে, তাই দাও। এসব বিষয়ে তুমি আর নিমাই আমার চেয়ে ভাল বোঝ, তোমাদের কাজে আমি ঝগড়া বাধিয়ে উৎপাত করতে চাই না।’ বলিয়া চক্ষু বুজিয়া আবার কম্বলের উপর দেহ প্রসারিত করিলেন।
সৌদামিনী কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলেন। তারপর নীরস স্বরে বলিলেন, ‘তা আর কি করে হবে। তুমি হলে বাড়ির কর্তা, ভাল হোক মন্দ হোক, তোমার হুকুমই মেনে চলতে হবে।’ বলিয়া অসন্তোষপূর্ণ মেঘাচ্ছন্ন মুখে প্রস্থান করিলেন।
৪
কয়েক দিন কাটিয়া গেল। কালীর বিবাহের কথাটা আপাতত ধামাচাপা পড়িয়া গিয়াছিল বটে, কিন্তু নানা খুঁটিনাটির ভিতর দিয়া সংসারে অসন্তোষ ও চিত্তক্ষোভ ক্রমে বাড়িয়া চলিয়াছিল। সাধুচরণের সেবাযত্ন লইয়াও একটু আধটু ত্রুটি হইতে আরম্ভ করিয়াছিল।
বাড়িতে একমাত্র পুঁটু তাহার বাবার প্রতি ভালবাসা ও অনুরাগ অক্ষুন্ন রাখিতে পারিয়াছিল। সে ছেলেমানুষ, সাংসারিক ভালমন্দের জ্ঞান তাহাকে আক্রমণ করে নাই বলিয়াই বোধ করি সে নিরপেক্ষ রহিয়া গিয়াছিল।
বেলা এগারোটার সময় পুঁটু বাহির হইতে আসিয়া বলিল, ‘মা, বাবার চান হয়ে গেছে, ভাত বাড়ো।’ বলিয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় একটা আসন পাতিতে প্রবৃত্ত হইল।
সৌদামিনী বলিলেন, ‘আসন তুলে রাখ পঁটু, এখনও ভাত নামেনি।’
‘ভাত নামেনি!’ পুঁটু সোজা হইয়া বলিল, ‘বা রে! বাবা চান করে বসে থাকবেন! কখন তোমাদের বলে গেছি—’
সৌদামিনী ধমক দিয়া বলিলেন, ‘তুই থাম। যা বলছি কর, ভাঁড়ার থেকে দুটো বাতাসা আর এক ঘটি জল এখন দিয়ে আয়। ভাত নামতে দেরি হবে।’
পুঁটু রাগিয়া বলিল, ‘কেন দেরি হবে! বাবার জন্যে একটু আগে ভাত চড়াতে পার না?’
‘পুঁটু!’
‘বুঝেছি গো বুঝেছি। দাদার মাঠ থেকে ফিরতে দেরি হয় তাই বেলা করে ভাত চড়ানো। দাদাই সব আর বাবা কেউ নয়।’ পুঁটুর ক্রুদ্ধ দুই চোখ জলে ভরিয়া উঠিল।
কথাটা সত্য। ধান কাটা চলিতেছিল, তাই প্রত্যহ নিমাইয়ের ফিরিতে দেরি হইত। সে খাটিয়া খুটিয়া আসিয়া ঠাণ্ডা ভাত খাইবে, এই বিবেচনায় সৌদামিনী বিলম্বে রান্না চড়াইতেছিলেন। পুঁটুর সত্য কথায় তিনি জ্বলিয়া উঠিলেন। কিন্তু কোনও কথা বলিবার পূর্বেই পুঁটু দুপ্ দুপ্ করিয়া পা ফেলিয়া প্রস্থান করিল। সৌদামিনী অন্ধকার মুখ করিয়া রান্নাঘরে প্রবেশ করিলেন।
ইহার কিছুক্ষণ পরেই বাহিরে একটা হৈ চৈ ও কান্নার শব্দ উঠিল।
বাড়িসুদ্ধ লোক ছুটিয়া বাহিরে গিয়া দেখিল কৈবর্ত বিধু হাজরা সাধুচরণের পা দু’টা ধরিয়া ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিতেছে, এবং সেই সঙ্গে চিৎকার করিয়া যাহা বলিতেছে, তাহার একবর্ণও বুঝিতে না পারিয়া সাধুচরণ পা দুটির আশা ছাড়িয়া দিয়া হতভম্ব হইয়া বসিয়া আছেন। গণেশ বাড়ির একমাত্র ভৃত্য; সে সাধুচরণের বিপদ দেখিয়া তাড়াতাড়ি বিধু হাজরাকে সরাইয়া আনিয়া বলিল, ‘কাঁদছ কেন বিধু, কি বলবে কর্তাবাবুকে পষ্ট করে বল না।’
বিধু হাজরার ক্রন্দন কিন্তু বন্ধ হইল না, তাহার কাঁচা-পাকা দাড়ি বহিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। তবু অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার স্বরে সে বলিল, ‘গরিবের মুখের গেরাস কর্তা! ঐ দেড় বিঘে জমির ওপরেই সারা বছরের ভরসা। আপনি সাধু সন্নিস্যি লোক তাই আপনার পায়েই ছুটে এলুম; আপনি না রক্ষে করলে গরিবকে আর কেউ রক্ষে করতে পারবে না।’
সাধুচরণ বিপন্নভাবে চারিদিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘কি হয়েছে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
তখন অনেক যত্নে অনেক সওয়াল করিয়া কথাটা বিধু হাজরার নিকট হইতে উদ্ধার হইল। নিমাইয়ের জমির আলে বিধু হাজরার জমি; বিধু অন্যান্য বারের মতো এবারও জমি চাষ-আবাদ করিয়াছে। কিন্তু ধান কাটিতে গিয়া দেখিল নিমাইবাবু তাহার ধান কাটিয়া লইতেছেন। বিধু ওজোর করায় নিমাইবাবু বলিয়াছেন যে, জমি তাঁহার, তিনি নীলামে উহা খরিদ করিয়াছেন। বিধুর জমি অবশ্য কানাই মণ্ডলের কাছে বন্ধক ছিল; কিন্তু কবে যে কানাই মণ্ডল মোকদ্দমা করিয়াছে এবং তারপর আদালতের ডিক্রির জোরে জমি হস্তান্তরিত হইয়া গিয়াছে, বিধু কিছুই জানে না। সে নিশ্চিন্ত মনে জমি চাষ করিয়াছে, কিন্তু এখন দেখা যাইতেছে যে ধান রোপাই হইবার বহু পূর্বে জমি নিমাইবাবুর দখলে চলিয়া গিয়াছিল। এখন ধান পাকিয়াছে দেখিয়া তিনি জোর করিয়া ধান কাটিয়া লইতেছেন।
ব্যাপারটা আগাগোড়া হৃদয়ঙ্গম করিয়া সাধুচরণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। পাড়াগাঁয়ে এরূপ ঘটনা বিরল নয়। গরিব মূর্খ চাষা মহাজনের নিকট জমি বাঁধা দিয়া টাকা ধার করে। তারপর কয়েক বৎসর নিরুপদ্রবে কাটিয়া যায়। হঠাৎ একদিন চাষা দেখে আদালতের ডিক্রি জারি হইয়াছে, এমন কি আর একজন আসিয়া দখল লইয়া বসিয়া আছে—অথচ সে কিছুই জানে না। সে যখন জানিতে পারে তখন হাহাকার করা ছাড়া আর কোনও উপায়ই থাকে না।
বিধু আবার সাধুচরণের পায়ের উপর আছড়াইয়া পড়িয়া বলিল, ‘মরে যাব কর্তা, সগুষ্ঠি না খেতে পেয়ে মরে যাব। ঐ দেড় বিঘেই ভরসা, আর কোথাও এককাঠা জমি নেই—গাঁসুদ্ধ লোককে ডেকে জিজ্ঞাসা করুন। আপনি আমার বাপতুল্যি, নিমাইদাদা আমার বাপের ঠাকুর—আপনারা গরিবকে মাথায় পা দিয়ে ডুবিয়ে দেবেন না।’
এই সময় নিমাই মাঠ হইতে ফিরিল। চণ্ডীমণ্ডপের দিকে একবার তাকাইয়া সে ভিতরে প্রবেশ করিতেছিল, সাধুচরণ তাহাকে ডাকিলেন। নিমাই মুখ কালো করিয়া আসিয়া দাঁড়াইল।
সাধুচরণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বিধু যা বলছে তা সত্যি? তুমি ওর জমি নীলামে খরিদ করে নিয়েছ।’
সংক্ষেপে নিমাই বলিল, ‘হ্যাঁ।’
সাধুচরণ একটু চুপ করিয়া বলিলেন, ‘কাজটা ওকে জানিয়ে করলেই ভাল হত না কি?’
নিমাই বলিল, ‘যার জমি মহাজনের কাছে বন্ধক আছে সে নিজে খোঁজ রাখে না কেন? আমি তো লুকিয়ে কিনিনি, সদর নীলেমে কিনেছি।’
সাধুচরণ ব্যথিত স্বরে বলিলেন, ‘সে কথা ঠিক, নিমাই। কিন্তু জমি যখন দখল করলে তখনও কি ওকে জানানো তোমার উচিত ছিল না? ও গরিব মানুষ, খরচপত্র করে পরিশ্রম করে ধান উবজেছে, সেই ধান তুমি কেটে নিচ্ছ—’
অবরুদ্ধ ক্রোধের স্বরে নিমাই বলিয়া উঠিল, ‘কে বলে ও ধান উবজেছে! আনুক দেখি একজন সাক্ষী।’ বলিয়া আরক্ত চক্ষে চারিদিকে চাহিল; সকলেই জানিত কে ধান উৎপন্ন করিয়াছে, কিন্তু মুখ ফুটিয়া বলিবার সাহস কাহারও হইল না।’
হতাশ সুরে সাধুচরণ বলিলেন, ‘সাক্ষীবাবুদ হয়তো বিধু আনতে পারবে না, কিন্তু সত্যি ও-ই তো জমি চাষ করেছে। জমি যদি তোমারই হয়, তবু যখন চাষ করেছে তখন অন্তত অর্ধেক ধান তো ওর প্রাপ্য—’
‘আমি পারব না! জমি আমার, আমি চাষ করেছি। বিধুর ক্ষমতা থাকে আদালত থেকে ধান আদায় করে নিক।’ বলিয়া নিমাই আর বাগ্বিতণ্ডা করিবার জন্য দাঁড়াইল না, ক্রোধবিকৃত মুখে দ্রুতপদে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিল।
রেলের ইঞ্জিনের মতো ধীরে ধীরে গতি সঞ্চয় করিয়া এতদিনে এই পরিবারের ঘটনাবলী হঠাৎ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতে আরম্ভ করিল। যেদিন মধ্যাহ্নে এই ব্যাপার ঘটিল, তাহার পরদিন হাটবার। গণেশ ভৃত্য বাড়ির কাজ সারিয়া হাটে যাইবার জন্য সৌদামিনীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; গ্রাম হইতে প্রায় ক্রোশ তিনেক দূরে হাট বসে, সপ্তাহে একবার করিয়া সেখান হইতে সংসারের বাজার-হাট, প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনিয়া আনা হয়।
সৌদামিনী বাজারের পয়সা গণেশকে বুঝাইয়া দিয়া চলিয়া যাইতেছিলেন, গণেশ কুণ্ঠিত স্বরে বলিল, ‘মা—’
‘কি রে—’ বলিয়া সৌদামিনী ফিরিলেন।
গণেশ ইতস্তত করিয়া বলিল, ‘মা, আর চার আনা পয়সা চাই।’
সৌদামিনী আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, ‘আর চার আনা পয়সা! কি হবে?’
লজ্জায় ঘাড় হেঁট করিয়া গণেশ আস্তে আস্তে বলিল, ‘বড়বাবু বললেন, হাট থেকে চার আনার গাঁজা কিনে আনতে।’
সৌদামিনী যেন পাথর হইয়া গেলেন। কিছুক্ষণ তাঁহার বাঙ্নিষ্পত্তি হইল না। তারপর সভয়ে একবার চারিদিকে তাকাইয়া আঁচল হইতে চার আনা পয়সা গণেশের হাতে ফেলিয়া দিয়া তিনি দ্রুতপদে নিজের শয়নঘরে প্রবেশ করিলেন; গণেশের মুখের দিকে চোখ তুলিয়া চাহিতে পারিলেন না। লজ্জায় ও ধিক্কারে তাঁহার সমস্ত অন্তর ছি ছি করিতে লাগিল।
সেদিন সৌদামিনী আর ঘর হইতে বাহির হইলেন না, শরীর অসুস্থ বলিয়া মেঝেয় একটা কম্বলের উপর পড়িয়া রহিলেন। রাত্রেও জলস্পর্শ করিলেন না। কালী ও পুঁটু তাঁহার সহিত একশয্যায় শয়ন করিত; তাহারা ঘুমাইয়া পড়িলে, রাত্রি প্রায় এগারোটার সময় তিনি শয্যা ছাড়িয়া উঠিলেন। নিঃশব্দে দরজা খুলিয়া বাহিরে স্বামীর ঘরে গেলেন।
সাধুচরণ তখন কম্বলের উপর যোগাসনে বসিয়া ছিলেন, রক্তনেত্ৰ মেলিয়া চাহিলেন।
দ্বার ভেজাইয়া দিয়া সৌদামিনী একবার ঘরের চারিদিকে চাহিলেন, ঘরে কেহ নাই। তখন তিনি দুইবার নিশ্বাস টানিয়া তিক্ত চাপা স্বরে বলিলেন, ‘মুখুজ্যে খুড়ো তাহলে মিথ্যে বলেনি!’
সাধুচরণের মৌতাত তখন জমাট বাঁধিয়াছে, তিনি গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, ‘কি বলেছে মুখুজ্যে খুড়ো?’
‘যা বলেছে তা সত্যি। বলেছে তুমি গাঁজা খাও।’
মাথাটি দুলাইতে দুলাইতে সাধুচরণ বলিলেন, ‘হ্যাঁ, খাই! গাঁজা খেলে সাধনমার্গের সুবিধে হয়।’ বলিয়া ফিক করিয়া হাসিলেন।
সৌদামিনী জ্বলিয়া উঠিলেন, ‘পোড়া কপাল তোমার সাধনমার্গের। ও কথা মুখে আনতে লজ্জা করে না! আর, সাধন করতে যদি চাও তবে ঘরে ফিরে এলে কেন?—উঃ, আমার সোনার সংসার দু’ দিনে উচ্ছন্ন গেল!’
সাধুচরণ ঈষৎ গরম হইয়া বলিলেন, ‘উচ্ছন্ন গেল কেন?’
‘কেন! তুমি এই কথা জিজ্ঞেস করছ! মেয়ের অমন চমৎকার সম্বন্ধ তুমি ভেঙে দিলে। ছেলে ঠাকুরমন্দিরে চাকরি জোগাড় করে দিলে, তাও তোমার গাঁজা খাওয়ার জন্যে ভেস্তে গেল। তারপর আবার জমিজমা নিয়ে ছেলের পেছনে লেগেছ, কোথাকার কে বিধু হাজরা, তার হয়ে ছেলের সঙ্গে লড়াই করছ। এখন আবার চাকর-বাকরকে দিয়ে গাঁজা আনিয়ে সদরে গাঁজা খাওয়া আরম্ভ করলে! উচ্ছন্ন যাওয়া আর কাকে বলে শুনি!’
সাধুচরণ হঠাৎ সপ্তমে চড়িয়া গেলেন, চিৎকার করিয়া বলিলেন, ‘বেশ করি গাঁজা খাই, আমার খুশি আমি খাব। এ সংসার কার? জমিজমা ঘরবাড়ি কার? আমার! আমি যা ইচ্ছে করব।’
সৌদামিনীর দুই চক্ষে আগুন ছুটিতে লাগিল, তীব্র অনুচ্চকণ্ঠে বলিলেন, ‘চেঁচিও না অত—সবাই ঘুমুচ্ছে। জমিজমা ঘরবাড়ি একদিন তোমার ছিল বটে, কিন্তু এখন আর নেই। জমিদারী সেরেস্তায়, খোঁজ নিলেই জানতে পারবে। এখন নিমাই মালিক, সে-ই এ বাড়ির কর্তা; তোমার উৎপাত করবার কোনও অধিকার নেই—বুঝলে?’
ভ্রূমধ্যে অকস্মাৎ হাতুড়ির ঘা খাইয়া যেন সাধুচরণের নেশা ছুটিয়া গেল। সৌদামিনীর এ রকম চেহারা তিনি পূর্বে কখনও দেখেন নাই; তিনি ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া রহিলেন। তারপর মূঢ়ের মতো বলিলেন, ‘আমার কোনও অধিকার নেই!’
‘না, নেই। এই কথাটা ভাল করে বুঝে নাও। তোমার ঐ সব লক্ষ্মীছাড়া বৃত্তি এ বাড়িতে চলবে না। এই আমি শেষ কথা বলে গেলুম।’ বলিয়া জ্বলন্ত মশালের মতো সৌদামিনী ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
অল্পমাত্র ভোর হইতে আরম্ভ করিয়াছে, তখনও কাক-কোকিল ডাকে নাই, এমন সময় সৌদামিনীর ঘরের দরজায় মৃদু টোকা পড়িল। সৌদামিনীর চোখে নিদ্রা ছিল না, তিনি শুষ্ক চক্ষু মেলিয়া শুইয়া ছিলেন, উঠিয়া দ্বার খুলিয়া দেখিলেন সাধুচরণ দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহার গায়ে সেই প্রথম দিনের আলখাল্লা, কাঁধে কম্বল, বগলে সেই পুরাতন ঝুলি।
সৌদামিনীকে হাতের ইসারায় একটু দূরে লইয়া গিয়া মৃদুকণ্ঠে সাধুচরণ বলিলেন, ‘লক্ষ্মী, আমি যাচ্ছি।’
সৌদামিনীর কণ্ঠ কে যেন চাপিয়া ধরিল, তিনি রুদ্ধনিশ্বাসে বলিলেন, ‘যাচ্ছ!’
‘হ্যাঁ লক্ষ্মী, সংসারে আর আমার মন টিকছে না।’
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া সৌদামিনী অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলিলেন, ‘আমার কথায় রাগ করে কি তুমি চলে যাচ্ছ?’
মাথা নাড়িয়া সাধুচরণ বলিলেন, ‘না, সেজন্যে নয়। কিন্তু তোমার কথা সত্যি। সংসারে আমার অধিকার নেই।’ একটু থামিয়া বলিলেন, ‘প্রথম যেদিন সংসার ছেড়ে গিয়েছিলুম, সেদিন ভুল করেছিলুম; আবার যেদিন ফিরে এলুম, সেদিন তার চেয়ে বড় ভুল করলুম। ভুলে ভুলেই জীবনটা কেটে গেল, সত্যিকার পথ চিনে নিতে পারলুম না—ললাট-লিখন।’
সৌদামিনীর নিকট হইতে কোনও জবাব আসিল না। সাধুচরণ তখন ঈষৎ হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন, ‘তোমাদের একটা কম্বল নিয়েছি, বোধ হয় সেজন্যে কোনও অসুবিধে হবে না। তাহলে চল্লুম লক্ষ্মী, আর দেরি করব না। অন্ধকার থাকতে থাকতে গ্রাম পেরিয়ে যেতে চাই।’
সাধুচরণ তবু একটু ইতস্তত করিলেন, হয়তো সৌদামিনীর নিকট হইতে একটা মৌখিক বাধানিষেধও প্রত্যাশা করিলেন। তারপর উদগত দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া নিরাশ্রয় আত্মীয়হীন পৃথিবীর পথে পা বাড়াইলেন। যাইবার সময় খোলা দরজা দিয়া পুঁটুর ঘুমন্ত মুখখানি একবার সতৃষ্ণ নয়নে দেখিয়া লইলেন।
সৌদামিনী কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাঁহার চোখ দিয়া নিঃশব্দে অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল বটে, কিন্তু একটা ‘না’ বলিয়াও তিনি স্বামীর গতিরোধ করিতে পারিলেন না।
তখন রোদ উঠিয়াছে। শয়নঘর হইতে বাহিরে আসিয়া সৌদামিনী ভারী গলায় সদ্যোত্থিতা বধূকে বলিলেন, ‘বৌমা, পুকুরে একটা ডুব দিয়ে এসে তাড়াতাড়ি রান্না চড়িয়ে দাও, নিমু আজ শহরে যাবে।’ বধুর চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টি দেখিয়া বলিলেন, ‘কালীর জন্যে যে পাত্রটি দেখা হয়েছিল তাদের সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করতে হবে তো। সামনেই আবার পৌষ মাস।’
৩ কার্তিক ১৩৪২