একি?
ঠিক রাত ন’টা। তিনটে ঘড়ি একসঙ্গে বাজছে। একটা দালানে, একটা দোতলায় ওঠার সিঁড়ির বাঁকে। আর একটা দোতলার হলঘরে। ঐতিহাসিক হলঘর। ভীষণ সজানো। বড় বড় সোফা, সেন্টার টেবল, কর্নার টেবল, ডিভান। এক দেয়ালে মূল্যবান কিছু বই। একটা অর্গান। এই ঘরেই আছে বিখ্যাত সেই গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক। ভারী গম্ভীর আওয়াজ। আমার দাদুর প্রাণের ধন। দাদুর ঘড়ির শখ বড়মামা পেয়েছেন। আর পেয়েছেন ডাক্তারি। দাদু খুব নামকরা বিলেত-ফেরত ডাক্তার ছিলেন। বড়মামাও ডাক্তার তবে দাদুর মতো হতে পারেননি। ভীষণ খেয়ালী। যখন যা মাথায় ঢুকবে সঙ্গে সঙ্গে তা করতে হবে নাওয়া-খাওয়া ভুলে। মাসিমা খুব রাগ করেন। করলে কি হবে! বড়মামা নিজের মতো চলবেন। মেজোমামা ভারী শান্তশিষ্ট, অধ্যাপক। লেখাপড়া নিয়েই থাকেন। মাঝে মাঝে খুব দুঃখ করে আমাকে বলেন, ‘তুই আমাদের একটাই ভাগনে, অসৎ সঙ্গে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছিস!’ অসৎ সঙ্গ মানে বড়মামা। আমি বড়মামার ডান হাত। বড়মামা সেটা ঘোষণা করে দিয়েছেন। আবার বলেছেন, ‘এই দুনিয়ায় ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই। ওকে আমি ভুবনবিখ্যাত ডাক্তার করব। রুগির ছায়া দেখে রোগ বলে দেবে।’ এই কথা শুনে মেজোমামা জোরে একটা শব্দ করেছিলেন ‘হুম’। বড়মামা খুব রেগে গিয়েছিলেন। আমাকে বললেন, ‘বুঝতেই পারছ! চতুর্দিকে আমাদের শত্রু। এই অবস্থায় তোমার নিজের ওপর নিজের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। আমার সঙ্গে কো-অপারেট কর। প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ো না। অনেকেই স্নেহ-ভালোবাসা দেখাবে—সে সব মেকি। তুমি বুদ্ধিমান, বুঝতেই পারবে—হোয়াট ইজ হোয়াট।’ মেজোমামা ঢেঁকুর তোলার মতো একটা শব্দ করেছিলেন।
বড়মামা বলেছিলেন, ‘বদহজম। এক চামচে সোডি বাইকার্ব। পরিশ্রম নেই, শুধু খাওয়া।’
মেজোমামা খুক খুক করে কাশলেন।
মাসিমা হেমেন্দ্রকুমার রায়ের যকের ধন পড়ছিলেন। সামনে চায়ের কাপ। মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছেন। বইয়ের পাতা থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন, ‘তোরা কোনওদিন বড় হবি না, তাই না? চিরকাল শুম্ভ-নিশুম্ভই থেকে যাবি?’
মেজোমামা বললেন, ‘ওর একার ভাগনে? ও আমারও ভাগনে। আমি দেখেছি ওর লিটারেচারে টেস্ট আছে। আমি ওকে প্রফেসার করব। অক্সফোর্ডে পাঠাব। নামকরা অধ্যাপক হবে। লেখক হবে, দ্বিতীয় শরৎচন্দ্র।’
বড়মামা তেড়েফুঁড়ে বলেছিলেন, ‘হি ইজ মাই ভাগনে, ওনলি ভাগনে, ও এফ আর সি এস হবে, হবে, হবে। ওর কঙ্কালে ইন্টারেস্ট আছে। অ্যানাটমি আয়ত্ত করে ফেলেছে। সবচেয়ে টাফ সাবজেক্ট। ডাক্তারের জীবন সেবার জীবন। মানব কল্যাণের ব্রত ধারণ।’
মাসিমা বললেন, ‘তোমরা থামবে? না আমি বেরিয়ে যাব? ভাগ্যিস! এ দুটো বিয়ে করেনি! বেশি দিন বাঁচত না। গলায় দড়ি দিত।’
মেজোমামা হঠাৎ সুর পালটে বললেন, ‘বড়দা! আমিও চাই ও ডাক্তার হোক, নোবল প্রফেশান।’
‘তুই বলছিস?’
‘হ্যাঁ, বলছি। মানবদরদী ডাক্তার। আমার ডেথ সার্টিফিকেট ও লিখবে। ও ডাক্তার না হওয়া পর্যন্ত আমি মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখব। মৃত্যু উইল ওয়েট ফর হিম।’
বড়মামার মুখটা থমথমে হয়ে গেল। ধরা ধরা গলায় বললেন, ‘তুই আমার আগে চলে যাবি? আমার আগে?’
বড়মামা মাথা নীচু করে ঘরের বাইরে বারান্দায় চলে গেলেন।
মাসিমা বললেন, ‘কাঁদালি তো! জানিস তো, ওর ভেতরটা কত নরম!’
মেজোমামাও বারান্দায় উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে দুজনে হাসতে হাসতে ঘরে ফিরে এলেন।
মাসিমা বললেন, ‘আমি একটা সার্কাস খুলব।’
বড়মামা ঘড়িঘরে শ’পাঁচেক বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কালের ঘড়ি। অদ্ভুত সব দেখতে। সব কটাই চলছে। কোনওটার আওয়াজ টকটক, কোনওটার খচখচ। কোনওটার খড়খড়। মেজোমামা বলছেন, ‘কালে এই ঘড়িঘর একটা বিস্ময়ের জায়গা হয়ে উঠবে।’ মেজোমামাও খুব উৎসাহী। আমাদের কাজে সাহায্য করেন। সাবধানে মুছতে হয়, দম দিতে হয়। এক একটা ঘড়ির কারুকার্য দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। মেজোমামা বললেন, ‘মানুষ কি-না পারে? মানুষই ভগবান, মানুষই শয়তান। বড় বড় যুদ্ধে এইরকম কত ঘড়ি, পিয়ানো, অর্গ্যান ভেঙে চুরমার করেছে। মিউজিয়াম, লাইব্রেরি শেষ করে দিয়েছে।’
মেজোমামা ভীষণ ভাবুক। মাথায় কোনও ভাবনা এলে চলে যান দোতলায় বারান্দার একেবারে পশ্চিম দিকে। ওখানে একটা গোল বেতের চেয়ার আছে। বসলে সারা শরীর ঢুকে যায়। বাইরে বড় বড় গাছ। ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে গঙ্গা, গঙ্গার জলের চিকিমিকি। একটা গাছ আছে—সুন্দর গন্ধ ছড়ায়। মন্দির-মন্দির, আরতি-আরতি। বসে থাকেন স্থির হয়ে, ভাবনা নিয়ে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একটা স্ট্যাচু। ফর্সা ধবধবে। বড় বড় চুল। এই সময়টায় মেজোমামাকে মনে হত একেবারে অন্য এক মানুষ—হিমালয়ের মুনি-ঋষি। চুপি চুপি এসে বসে থাকতুম তাঁর পায়ের কাছে। বড়মামা একদিন একটা কাণ্ড করলেন। মেজোমামার পা স্পর্শ করে বলতে লাগলেন, ‘তুই আমার ভগবান।’
মেজোমামা সঙ্গে সঙ্গে বড়মামাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলতে লাগলেন, ‘তুমি আমার মহাদেব, শিবশম্ভু।’ একসময় দেখা গেল দুজনেই মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছেন।
রাত নটা। মাসিমার কড়া হুকুম—এ একবার, সে একবার, এই নিয়ম চলবে না। ‘ডিনার অ্যাট নাইন’।
বড়মামা বলেছিলেন, ‘ঠিকই তো, ঠিকই তো। একটা নিয়ম অবশ্যই থাকা উচিত। সবাই মিলে গল্প করতে করতে খাবো। শিক্ষামূলক গল্প, জীবনে নানা অভিজ্ঞতার গল্প। তাছাড়া প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্লেটের দিকে নজর রাখব। কম-বেশি হচ্ছে কি-না, অবিচার। আমাকে ছোট মাছ, মেজোকে বড়। আমাকে হয়তো একটা আইটেম দেওয়াই হল না। এই তো সেদিন আমাকে আনারসের চাটনি দেওয়াই হল না।’ মাসিমা বললেন, ‘তার মানে? তোমাকে দুই দুই করা হয়?’
‘হতেই পারে। মেজোকে একটু বেশি ভালোবাসো। পণ্ডিত মানুষ! ভালোই খেতে পারে। গল্প-কবিতা লেখে। আমি তো মজদুর!’
‘এর মধ্যে আনারসের চাটনি কবে হল?’
‘রবিবার। লাস্ট সানডে।’
‘ওরে মুখপোড়া, ওটা আনারস নয় পেঁপে। পেঁপে তুই খাস না।’
বড়মামা মাসিমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, ‘এ তুই কি বললি রে! মা চলে যাওয়ার পর এই কথাটা আমাকে কেউ বলে না রে। বলার মতো কেউ নেই। তোর মধ্যে মা এসেছেন। মা এসেছেন।’
মাসিমা বললেন, ‘মা চলে যাওয়ার পর থেকে তোরা এনে বাড়াবাড়ি শুরু করেছিস, আমি আর সামলাতে পারছি না। ভাবছি দিনকতকের জন্যে কোথাও চলে যাব।’
‘আমরাও যাব।’
‘তাহলে তো হয়েই গেল।’
‘তুই চলে গেলে আমরা কোথায় থাকব, কে দেখবে আমাদের, বাপ-মা মরা দুটো অসহায় অনাথ। কি বল মেজো?’
‘আমাদের এই ভবিষ্যৎ আমি ভাবতেই পারছি না।’
‘কোনও অনাথাশ্রমে চলে যাবি?’
‘এই বয়েসে নেবে না রে!’
ন’টা বেজে পনেরো মিনিট। বড়মামা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন। ‘লেট, লেট। উপায় ছিল না। যমে-মানুষে টানাটানি। মানুষের যত পয়সা বাড়ছে, ততই শরীর খারাপ হচ্ছে। সব এক একটা রোগের ডিপো। ওষুধ খেয়ে ক’দিন বাঁচা যাবে! আচ্ছা, তোমরা সবাই আসন গ্রহণ করো, অত্যন্ত কিছু জরুরি কিছু কথা আছে।’
মেজোমামা বললেন, ‘আমরা তো আসনেই বসে আছি লাস্ট হাফ অ্যান আওয়ার।’
বড়মামা ভুরু কুঁচকে জলের গেলাসের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের মনেই এই সব কথা বলতে লাগলেন, ‘ক্রিস্ট্যাল, ক্রিস্ট্যাল, ফেথ, ফেথ, অবিশ্বাসী, অবিশ্বাসী।’
কিছুক্ষণের নীরবতা। এরপর হাতে একটা চামচে তুলে নিয়ে বললেন, ‘ভাবছি, তোমাদের বলব কি বলব না! তোমরা অবিশ্বাসী, নাস্তিক। সন্দেহবাদী। পামর!’
মেজোমামা বললেন, ‘যাঃ, হয়ে গেল। দু’দিন কি তিনদিন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনেছিল, আমি দেবতা, তুই দেবী, চোখে জল, নাক ফোঁস ফোঁস, আবার যে কে সেই। আরও এক ধাপ এগিয়ে, আজ বললে, পামর নতুন শব্দ। কোথা থেকে শিখে এল কে জানে? যাক গে, এখন ডিনার সার্ভ করতে বল, খেয়ে-দেয়ে দুর্গা বলে শুয়ে পড়ি।’
মাসিমা বললেন, ‘সত্যি বলছি, আমার আর ভালো লাগছে না, আমি বৃন্দাবনে চলে যাই।’
মেজোমামা বললেন, ‘অসম্ভব মশা। ম্যালেরিয়া। তুই বরং কাবুলে যা। ওখানে কাবলি ছোলা দিয়ে সুন্দর ঘুগনি করে, আমার এইরকম ধারণা, তাছাড়া খেজুর, খুবানি, মেওয়া, বড় বড় কাবলি কলা, বেদানা।’
বড়মামা এতক্ষণ যেন একটা ঘোরে ছিলেন। চটকা ভাঙল। বললেন, ‘হ্যাঁ, কি বলছিলুম?’
‘কি আর বলবে? আমাদের ঝাড়ছিলে?’
‘তোমাদের নয়। আমি আমাকে ঝাড়ছিলুম। আমি একটা বাঁদর।’
‘এটা তোমার অনেকদিনের দুর্বলতা, নিজেকে যা-তা বলা। কবে কোথায় কার কাছে শুনেছ, মহান ব্যক্তিরাই আত্ম-সমালোচনা করে। সেই ছেলেবেলায় পড়েছ, ‘আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়’। এও এক ধরনের অহঙ্কার!’
‘সে তুই আমাকে যা বলতে চাস বল, আমি কিচ্ছু মনে করব না। কেন বাঁদর বলছি জানিস, আমি আজ একটা কলাবাগানে গিয়েছিলুম, যেখানে শুধু কলা। আমি এক-নাগাড়ে বারোটা কলা খেয়েছি। খেয়েই যাচ্ছি, খেয়েই যাচ্ছি।’
‘একসঙ্গে অত কলা খেলে কেন?’
‘আরে মর্তমান কলা। একটা কাঁদি গাড়ির ডিকির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কাল সকালে খাবি। এখন কাজের কথা। খুব মন দিয়ে শোন। আমি গত একমাস ধরে রোজই এক স্বপ্ন দেখছি। একেবারে স্পষ্ট। স্বপ্নটা হল—এই বাড়িটা ছাড়াও আমাদের আর একটা বাড়ি আছে। সেটা আরও সুন্দর। এই স্বপ্নটা আমার বিশ্বাসে ঢুকে গেছে।’
মেজোমামা বললেন, ‘কি আশ্চর্য! আমিও তো ওই একই স্বপ্ন দেখছি। বাড়িটা একটু মিস্টিরিয়াস।’
‘রাইট। বেশ একটু ছমছমে। একটা ঢালু রাস্তা দিয়ে নেমে যেতে হয়। বড় রাস্তা থেকে বাড়িটা দেখতে পাওয়া যায় না। বড় বড় ইউক্যালিপটাস, দেবদারু, অর্জুন গাছ দিয়ে ঘেরা। সামনের দিকে চার্চের মতো চূড়া। সদর দরজা বেশ বড়। দামি কাঠের। একসময় ঝকঝকে পালিশ ছিল। পেতলের পাটি লাগানো। হালকা সবুজ রঙ।’
‘আর বলতে হবে না। সেম বাড়ি। ভেতরে ঢুকেছ?’
‘ঢুকেছি বলেই তো বলছি। বাড়িটার ভেতরে অনেক রহস্য।’
‘কি ভাবে ঢুকলে? সামনের দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ!’
‘পেছন দিক দিয়ে ঢুকলুম।’
‘রাইট। বিরাট একটা নিম গাছ।’
‘হ্যাঁ। নিম গাছ।’
‘আরে বাবা, একই বাড়ি। তুমি বলো না। আমি তো রোজই যাচ্ছি। আজও হয় তো যাব।’
‘আমার সঙ্গে তোর দেখা হচ্ছে না কেন?’
‘ঠিক বলেছ। দুজনে একই সময় একই জায়গায় যাচ্ছি, দেখা হচ্ছে না কেন?’
মাসিমা বললেন, ‘এদের দুটোরই মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
মেজোমামা বললেন, ‘আজ তুমি একটা নীল রঙের জামা পরে যাবে; আর আমি লাল।’
বড়মামা বললেন, ‘এই সেরেছে। আমার তো নীল রঙের জামা নেই, সব সাদা।’
‘ঠিক আছে সাদাই পরো।’
মাসিমার বেশ মজা লেগেছে মনে হয়। মাসিমা বললেন, ‘তোমরা কটার সময় বেরোবে?’
বড়মামা বললেন, ‘এই বারোটা নাগাদ। তবে ট্রেন লেট করলে, দু-দশ মিনিট এদিক-ওদিক হতে পারে।’
‘কোন ট্রেন?’
‘ড্রিম এক্সপ্রেস, সিলভার লাইন, বেড প্ল্যাটফর্ম।’
বড়মামা বললেন, ‘নাও আই অ্যাম সিরিয়াস, অ্যাজ সিরিয়াস অ্যাজ এ গোট।’
মেজোমামা বললেন, ‘এই যে মাঝে মাঝে তুমি এক একটা ইংরিজি বলো, পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে যায়।’
‘কেন, গ্রামার তো ঠিকই আছে।’
‘গোট বললে কেন? গোট কি সিরিয়াস?’
‘কি জানি! মুখে এল বলে দিলুম।’
‘এবার থেকে মুখে এলে বলবে না, মন দিয়ে যাচাই করে নেবে।’
‘ওকে, ওকে। এখন আমার সিরিয়াসলি একটু বসব। আমার মনে হচ্ছে, বাড়িটা কোথাও আছে। বাবা দেশভ্রমণ করতেন। সঙ্গী হতেন মাস্টারমশাই। একবার যেন মাকে এইরকম একটা বাড়ির কথা বলছিলেন। সবটা শোনার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। বিষয়-সম্পত্তি বোঝার বয়েস তখনো আমার হয়নি। এখনো হয়নি। আর বাবাও খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন। কোথায় কি করছেন, না করছেন কারোকে বলতেন না। কেউই আর বেঁচে নেই। এখন এসো স্বপ্ন আমাদের কি ক্লু দিচ্ছে দেখা যাক। বড় রাস্তাটা খুব উঁচু। কেন? নিশ্চয় ওটা বাঁধের রাস্তা! তুমি কি বল?’
‘সে কি! পাহাড়ে ওঠার রাস্তা নয়; কারণ পাহাড়ের রাস্তা থেকে শাখা রাস্তা বেরোতে পারে না।’
‘রাইট। এইবার বাঁধ মানে, হয় ডানদিকে, না হয় বাঁদিকে একটা নদী থাকবে। আমরা বাঁদিকের ঢালু রাস্তা দিয়ে নামি। তাহলে নদীটা আছে ডানদিকে।’
‘ঠিক। এখন নদীটার নাম কি? কোথায় আছে? বাঙলা, বিহার, উড়িষ্যা!’
‘ঘাটশিলা ছিল বাবার খুব প্রিয় জায়গা। নদীর নাম সুবর্ণরেখা। কি মনে হয়?’
‘একদম।’
‘তাহলে একটা এক্সপিডিশান করে দেখলে হয়! কিছু না হোক বেড়ানো তো হবে। আবহাওয়াটা সুন্দর যাচ্ছে। বর্ষা চলে গেছে। শরৎ। ঝলমলে রোদ।’
মাসিমা বললেন, ‘আমিও যাব।’
‘অবশ্যই! তুই তো আমাদের গুডলাক। আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিস। আর এই শয়তানটাও যাবে।’
আমি কখনো শয়তান, কখনো ভগবান। শৈলী ওপাশে সব গোছগাছ করছিল, বললে, ‘আমাকে তো যেতেই হবে। চা, কফি, পকোড়া—কে খাওয়াবে?’
মাসিমা বললেন, ‘আমি গেলে তুইও যাবি।’
বড়মামা বললেন, ‘তা হলে শঙ্করকে বলে দাও, ওর বড় গাড়িটা আমাদের চাই, আর ও চালাবে। কবে? কাল ভোরে পারবে?’
মাসিমা বললেন, ‘আমাকে এখনই বললে এখনি।’
‘এখন দেখতে হবে শঙ্কর গাড়িটা দিতে পারবে কি না?’
বড়মামা আমাকে বললেন, ‘ভুতো বোম্বাই ফোন লাগা।’
ফোন বাজছে, ‘শঙ্করকাকু! তুমি কোথায়?’
‘তোমাদের বাড়ির গেটে।’
‘সে কি গো? কি করছ ওখানে?’
‘ডাক্তারবাবুকে চাই। আমার বোনের পেট ব্যথা করছে।’
বড়মামা বললেন, ‘দেখেছিস, একেই বলে, মেঘ না চাইতেই জল।’
শঙ্করকাকু সবসময় ফিটফাট। দারুণ দেখতে। ব্যায়াম করা শরীর। পেঁয়াজি খেয়ে পেট ব্যথা। বড়মামা একগাদা ওষুধ বের করে হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘কাল ভোরবেলা পারবে?’
‘আমি পারব, নো প্রবলেম, একটাই সমস্যা, আমার বোনের পেঁয়াজি।’
‘জানি, তোমার বোন তোমার প্রাণ। তা কালকের দিনটা দেখ। উদ্বেগ নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না।’
‘বড়দা, আমি আবার ভাবছি, যদি অনুমতি করেন ওকেও নিয়ে যাব। একটু বেড়িয়ে আসবে।’
‘খুব ভালো। ওকে আমরা ভীষণ ভালোবাসি। বড় ভালো মেয়ে। ওষুধ খেয়ে কেমন রইল আমাকে জানাবে।’
বড়মামার ঘুম নেই। ছটফট, ছটফট। মেয়েটা কেমন রইল। দুটোর সময় শঙ্করকাকুর ফোন, ‘ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে।’
সকাল আটটা। শঙ্করকাকুর ঝকঝকে নতুন গাড়ি। আমরা একবারে সেট হয়ে গেছি। বড়মামা সামনের আসনে। গলায় ঝুলছে বাইনোকুলার। মাসিমা আর শৈলীদি প্রচুর খাবার-দাবার সঙ্গে নিয়েছেন। ফ্লাস্কে চা। কাগজের গেলাস। প্লেট। ছোট ছোট তোয়ালে। শঙ্করকাকুর বোন উমা মাসিমার পাশে। খাবারের গন্ধে ভেতরটা ভরে গেছে। আমি আর মেজোমামা একেবারে পেছনে। মেজোমামার একটু বেশি জায়গা লাগবে। আরাম করার জন্যে মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক কাত হবেন। আর একটা কথা বলছি, বলাটা ঠিক হবে না হয়তো, তবু বলছি, সকলের পেছনে লাগার জন্যে পেছনে বসাই ভালো। উপযুক্ত স্থান।
উমার খুব আনন্দ। মুখ-চোখ ঝলমল করছে। বলছে, ‘আমাকে কেউ কখনো বেড়াতে নিয়ে যায় না। এই প্রথম। আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে।’
বড়মামা বললেন, ‘নাচটা এখন চেপে রাখ। পরে লাগবে।’
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘জানি না রে।’
‘সে আবার কি?’
‘আমরা একটা অভিযানে যাচ্ছি।’
আমি উমার দিকে তেমন তাকাচ্ছি না। লজ্জা করছে। এই তিন-চারদিন আগে ওদের বাড়ির সামনে পা পিছলে ধপাস। ও বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। দৌড়ে এসে আমাকে হাত ধরে তুলল। ইটের টুকরোয় হাঁটুটা কেটে গিয়েছিল। বাইরের ঘরে চেয়ারে বসিয়ে ড্রেস করে ব্যান্ড-এড লাগিয়ে দিল। শুধু জিগ্যেস করেছিল, ‘শুকনো ডাঙায় পড়লে কি করে?’
মেয়েদের সামনে পড়ে যাওয়াটা ভীষণ লজ্জার; কিন্তু উমা কি ভালো মেয়ে! হাসেনি। মুখ টিপেও না। বরং বলেছিল, চটিটা পাল্টাও। তলাটা ক্ষয়ে গেছে। উমা আবার এখন না বলে বসে, তোমার পা কেমন আছে? না, মাসিমার সঙ্গে গল্পে মত্ত। কত রকমের গল্প। দু’পাশের দৃশ্য গোগ্রাসে গিলছে। মেজোমামা সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর কতদূরে সেই স্বপ্নের জায়গাটা!
রূপনারায়ণের ব্রিজটা পেরোতেই বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। জায়গাটার নাম মনে পড়েছে—গা, গা, প্রথম অক্ষর গা। গা দিয়ে কতকগুলো নাম বল না!’
‘গান্ধার।’
‘ধুস, সে তো অনেক উঁচুতে। মহাভারতের গান্ধারীর বাপের বাড়ি।’
‘তা হলে গাড়ুলিয়া।’
‘সে আবার কোথায়? আর একটু ভাব। আসছে, আসছে, এসে গেছে, গালুডি, গালুডি।’
শঙ্করকাকু গোঁৎ করে গাড়িটা বাঁদিকের একটা হোটেল ধাবায় ঢুকিয়ে দিলেন, ‘এইবার লাঞ্চ।’
বড়মামা বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে তো প্রচুর খাবার-দাবার।’
‘এই ধাবার মালিক আমার অনেকদিনের বন্ধু। এখানে টয়লেট আছে।’
উমা আমার পাশে এসে বসল। আমার হাঁটুর ওপর একটা হাত রেখে নিচু গলায় জিগ্যেস করল, ‘কেমন আছে?’
‘তুমি যে ব্যান্ড-এড লাগিয়ে দিয়েছিলে, সেটা লাগানোই আছে।’
‘চটি বদলেছ?’
‘ফেলে দিয়েছি।’
‘লক্ষ্মী ছেলে। বড়দের কথা শুনতে হয়।’
‘কে বড়?’
‘আমি, আবার কে?’
‘আমার চেয়ে এক বছরের ছোট।’
‘শোন, একটা হিসেব শোন। ছেলেদের একবছর, মেয়েদের দু’বছর। শুনিসনি, মেয়েদের বাড় কলাগাছের বাড়। ওই লম্বা সুন্দর গাছটা কি গাছ রে?’
‘স্বর্ণচাঁপা।’
‘চল না, ওদিক থেকে একটু ঘুরে আসি।’
ঘোরা আর হল না। খাবার এসে গেল।
সূর্যাস্তের একটু আগেই আমরা সেই স্বপ্নে দেখা জায়গায় এসে গেলুম। বড়মামা মেজোমামাকে বললেন, ‘তুই শুধু একবার মিলিয়ে নে। এই দেখ রাস্তাটা ঢালু হয়ে নীচের দিকে নামছে। বাঁদিকে একটা দোকান। সাইনবোর্ড। অস্পষ্ট হলেও পড়া যাচ্ছে। গালুডি।’
‘বাড়িটা চিনবি কী করে?’
‘কেন? মনের ছবি!’
‘কতটা ঢুকতে হবে?’
‘দাঁড়া। ঢালু রাস্তাটা সমতলে এলে আমাদের ডানদিকে যেতে হবে। বাড়িটা বাঁদিকে। সাদা ফুলে ভরা টগর গাছ। গন্ধরাজ।’
শঙ্করকাকু ধীর গতিতে চলেছিলেন। জোরে যাওয়ার উপায় নেই। ফালি রাস্তা। পাথর পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। শঙ্করকাকু বলছেন, ‘বেশ মজা লাগছে।’ বড়মামা বসে আছেন খাড়া হয়ে। এপাশে, ওপাশে কয়েকটা বাড়ি। লোক নেই। লতাপাতা ঝুলছে। বাঁদিকে প্রাচীন একটা পাঁচিল শুরু হল। রাস্তাটা একটু পরেই ছোটখাটো একটা জঙ্গলে ঢুকে যাবে।
বড়মামা বললেন, ‘শঙ্কর! গাড়িটা তুমি একপাশে রাখ। মেজো আর ভ্যাবলা নেমে আয়। মনে হচ্ছে আমরা ঠিক জায়গায় এসে গেছি। এরপরেই জঙ্গল, বিরাট একটা তেঁতুল গাছ। মেয়েরা গাড়িতেই থাকো। আমরা একবার দেখে আসি।’
আপাতত আমার নাম ভ্যাবলা। উমা বললে, ‘ওর এই সুন্দর নামটা তো জানতুম না।’
মাসিমা বললেন, ‘আমিও না। ওর থেকে থেকে নাম পাল্টায়। দেবতাদের ব্যাপার।’
বড়মামা বললেন, ‘মেজো! মিলিয়ে নে। ওই দেখ চার্চের মতো চুড়ো। মেহগনি কাঠের প্যানেল দরজা। চারধাপ পাথরের সিঁড়ি। ঢালাই গেট। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ; অর্থাৎ কেউ আছেন।’
মেজোমামা বললেন, ‘খটখটাব?’
‘আস্তে। টুক টুক টুক। জাস্ট তিনবার।’
দরজা খুলল। দাঁড়িয়ে আছেন মুনি-ঋষির মতো এক মানুষ। ধবধবে ফর্সা। সাদা চুল, সাদা দাড়ি। সাদা ধুতি, সাদা চাদর। ঘরের ভেতর একটা লণ্ঠন জ্বলছে। ঝকঝকে পরিষ্কার লাল মেঝে। মিষ্টি ধূপের গন্ধ। তিনি অদ্ভুত একটি কথা বললেন, ‘যাক, তোমরা শেষ পর্যন্ত এলে!’
বড়মামা আমাকে বললেন, ‘ওদের নিয়ে এস।’
বাড়ির বাইরে শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা ‘ব্রজধাম’। ছোট্ট একটা আশ্রম। ঠাকুরঘরে অপূর্ব সুন্দর রাধাগোবিন্দের মূর্তি। কার্পেটের মতো মোটা একটা শতরঞ্চিতে আমরা বসেছি। বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। তিনিও বসেছেন।
বড়মামা বললেন, ‘ব্যাপারটা কি বলুন তো! আমরা কিছুই জানি না।’
‘শোনো ব্রজরঞ্জন তোমাদের পিতামহ। নামকরা চিকিৎসক। তাঁর পুত্র কুমুদরঞ্জন তোমাদের পিতা। ডাক্তার। আমি কুমুদের সতীর্থ। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লুম স্বদেশী আন্দোলনে। ধরতে পারলে অবধারিত ফাঁসি অথবা আন্দামান। আত্মগোপনের একটা জায়গা চাই। কুমুদ বললে, ‘দাঁড়া, তোকে লোপাট করে দি।’ খুঁজে খুঁজে এই জায়গাটা বের করলে। ঘন জঙ্গলের কিনারায়। ও বললে, অত্যাচারী, বিধর্মীদের চোখে ধুলো দিতে ধর্মের আড়ালে চলে যা। তখন চতুর্দিকে গোয়েন্দা ঘুরছে ছদ্মবেশে। ভাই ভাইকে ধরিয়ে দিচ্ছে, বাপ ছেলেকে। এখানে একটা আশ্রম তৈরি হল—ব্রজধাম। ও এক বৈষ্ণবসাধককে নিয়ে এল। প্রকৃত সাধক। বলতে পার, সিদ্ধ মহাপুরুষ। আমার জীবনটা একেবারে বদলে দিলেন তিনি। অলৌকিক সব শক্তি এল। আমার অবাক হওয়ার পালা। সম্প্রতি আমার মনে হল তোমাদের কথা। আচ্ছা শোনো, ভয়ে পালিও না। ওই দেখ কয়েকটা চাবি, সবটা তোমরা এখনো ঘুরে দেখোনি। দেখবে। এ সবই তোমাদের। লোকে চিঠি পাঠায়, আমি তোমাদের স্বপ্ন পাঠিয়েছিলুম। এইবার আসল কথা আমি কিন্তু নেই। শরীরটা ফেলে দিয়েছি। এই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা যায় না। আমি তোমাদের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবো। আর আসব না। এটা রক্ষা কোরো। আমি আশীর্বাদ করে গেলুম।’
লণ্ঠনটা দপদপ করে নিবে গেল। পাতলা চাদরের মতো কালো অন্ধকার। একসঙ্গে অনেক শাঁখ বেজে উঠল। শৈলীদি মাসিমাকে জড়িয়ে ধরে অজ্ঞান হয়ে গেল। উমা আমাকে প্রবল শক্তিতে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে। বড়মামা মৃদু মৃদু স্বরে হরি হরি বলছেন। মেজোমামা ধর্ম, অলৌকিক মানেন না। তিনি স্তম্ভিত। ওদিকে গভীর জঙ্গলে পুরুষ হাতিদের চিৎকার। আর একটা কি জন্তু মানুষের মতো কাশছে। মনে হয় হায়না। শঙ্করকাকুকে দেখতে পাচ্ছি না। লণ্ঠনটা আপনি আবার জ্বলে উঠল। ওপরে সম্ভবত ছাতে পায়ের শব্দ। পেছনে কোথাও জল পড়ছে। শতরঞ্চির যে জায়গাটায় তিনি বসেছিলেন, সেখানে পড়ে আছে পাট পাট করা লম্বা একগুচ্ছ কাগজ, লাল দড়ি দিয়ে বাঁধা। দেখলেই বোঝা যায় দলিল। আমরা যেন একসঙ্গে দলা পাকিয়ে গেছি।
এরপরে এল ঠান্ডা কনকনে বাতাস। দরজায়, বন্ধ জানলায় ধাক্কা মারছে। দোতলার ঘরের মেঝেতে ধাতব একটা কিছু পড়ে গড়িয়ে গেল। শব্দটা রইল অনেকক্ষণ। পূজারী নেই, কেউ নেই। অথচ আরতি শুরু হল। শঙ্খ-ঘণ্টা। পঞ্চপ্রদীপ ছাড়াই পাঁচটি শিখা শূন্যে দুলতে লাগল ছন্দে ছন্দে। চামর ছাড়াই দুধের মতো সাদা একটা ধোঁয়ার জটলা ঝাপটা মারতে লাগল বাতাস। শঙ্খ-ঘণ্টার শব্দ আকাশে-বাতাসে। সাদা একটা ফুল তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। উমা আমার বুকে মুখে গুঁজে দিয়েছে। পিঠ ঢেকে গেছে ঘন কালো চুলে। ফুলটা ভাসতে ভাসতে এসে সাদা নরম পাখির পালকের মতো আটকে গেল উমার চুলে। হাত দিতে ভয় করছে। ফুল না তুলো! বিন্দু বিন্দু জল এসে পড়ল আমাদের গায়ে। অপূর্ব সুগন্ধ। শান্তির জল। আকাশে চাঁদ। বাইরের অন্ধকার ক্রমশ পাতলা হচ্ছে।