1 of 2

একলা বৈশাখ

একলা বৈশাখ

সুমি রবিবারের নাটক শুনছিল রেডিয়োর। রাঘবকে আসতে দেখেই বন্ধ করে দিল।

সারাসপ্তাহটা দুজনেই ব্যস্ত। সুমি স্কুলে পড়ায়, রাঘব ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। পোদ্দার কোর্টে ওর অফিস। সুমির আজ ছ-বছর থেকে যেকোনো দিনই ওর স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস হয়ে যাবার কথা হচ্ছে। রাঘবও অফিসারের পরীক্ষা পাস করে বসে আছে পাঁচ বছর। যেকোনো দিনই ও অফিসার হতে পারে। কিন্তু আজ অবধি হয়নি। দুজনেরই এই অবস্থা।

কুশলই একমাত্র সন্তান, ওদের ভবিষ্যৎ, সাধ-আহ্লাদ, ওদের দুজনের জীবনে যা কিছুই হয়নি, সেইসব শূন্যতাই পূর্ণ করতে চায় ওরা কুশলের মধ্যে। নিজেদের বঞ্চিত করেও কুশলের জন্যে কিছুমাত্র করতে ত্রুটি করে না।

কুশল রবিবার পাশের ঘরে বই-টই পড়ে, নইলে একা একা ক্যারাম খেলে। বয়েস নয় হল। ও জেনে গেছে যে, মা-বাবা রবিবার দুপুরটাতেই একটু একসঙ্গে থাকে। নানা কথাবার্তা বলে। রাতে ও মায়ের সঙ্গেই শোয়।

কুশলের যেটা জানার কথা নয় সেটা হচ্ছে এই-ই যে, কথাবার্তা তো বটেই, প্রতিরবিবার দুপুরেই, মাঝেমধ্যে সুমি ও রাঘব একটু আদর-টাদরও করে এবং খায়।

জীবন এখন এতই ঝামেলার, ক্লান্তির এবং একঘেয়েমির হয়ে গেছে যে, কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না ওদের। মানুষ কেন বিয়ে করে, সংসার করে, কেনই বা ছেলে-মেয়ে হয়, কেনই বা এই বুড়োবয়েসের পুতুল খেলাতে নিজেরা জীবনগুলো এমন করে মাটি করে ফেলল এসব কথা প্রায়ই ওদের দুজনের মনে হয়, কিন্তু এ নিয়ে ভাবার মতো সময়টুকু পর্যন্ত ওদের নেই।

অন্য লক্ষ লক্ষ দম্পতিরই মতো, ওদেরও জীবনে একদিন অনেক সুখ, সাধ, কল্পনা, ভালোবাসাও ছিল। সবই যেন এখন মরে গেছে। তবু দুজনে সাত তাড়াতাড়ি তৈরি হয় প্রতিসকালে সপ্তাহে ছ-দিন। নাকে-মুখে খেয়ে দুজনেই বেরিয়ে পড়ে। কুশলকে রাঘব স্কুলে পৌঁছে দিয়ে মিনি ধরে অফিসে যায়। নিয়ে আসে সুমি স্কুল ছুটির পর। বিয়ের সময় ওরা দুজনে মিলে যা রোজগার করত, এখন রোজগার তার চেয়ে বেড়েছে অনেকই। কিন্তু তবু আগের থেকে অনেকই গরিব ওরা এখন। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এমনই অবস্থা। টাকা কাগজ হয়ে গেছে।

অ্যাই! বালিশটা দাও তো।

রাঘব পান চিবোতে চিবোতে বলল।

সুমি একহাতে বালিশটা ছুড়ে দিয়ে বলল, বেশ লোক। একটা পান তো আমার জন্যেও আনতে পারতে?

সিগারেট কিনতে গিয়েই পয়সা ফুরিয়ে গেল। ঠাকুরটা নেই পানের দোকানে। ওর মামা না কাকা কে জানে, সবে এসেছে ঢেনকানল থেকে, বাংলাও শেখেনি এখনও, আমাকে চেনেই না। ধারে দিল না। চেয়েছিলাম।

সুমি কিছু বলল না।

পাখাটা ঘুরছিল মাথার ওপরে কিচিক কিচিক একটানা শব্দ করে। কার্বনটা বোধ হয় ক্ষয়ে গেছে। নীলচে আগুন বেরোয় সব সময়। কিন্তু আগুনটা ঠাণ্ডা মেজাজের, স্নিগ্ধ। রাগী আগুনের মতো নয়।

সুমি বেডকভারের ওপর পা দুটি টানটান করে মেলে দিল। ওর এই পা-টানটানের একটা বিশেষ রকম আছে। আদর খাওয়ার ইচ্ছে হলে বেড়ালনিরা যেমন করে।

ঘরের পর্দা সব টানাই ছিল। ধূপকাঠি জ্বেলে দিয়েছিল সুমি। আয়নাও ঢেকে দিয়েছিল লেসের ঢাকনাতে। ঘরের মধ্যে বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা, আধো অন্ধকার। রোমান্টিক। আদর করা এবং খাওয়ার মতোই পরিবেশ।

রাঘব বলল, হবে নাকি? ইচ্ছে?

সুমির মাথাটা বালিশের এককোনায় নেমে এসেছিল। মুখটা তির্যকভাবে রাঘবের দিকে ফিরিয়ে উদাসীন নিরুত্তাপ চোখে চেয়েছিল ও। হারের লকেটটা বুকের বাইরে এসে বালিশের প্রান্তে ঝুলে ছিল। সুমি একবার চোখ দুটি বন্ধ করে আবার চোখ মেলে দেখল রাঘবের মুখ। তার পর বলল, না:।

কেন? না কেন? গত রবিবারেও তো…

ভালোই লাগে না।

কেন?

অত্ত বলতে পারব না। আজকাল এসব ভালোই লাগে না।

বলো, আমাকে ভালো লাগে না, অন্য কেউ হলে, পরেশ হলে…

সুমি চোখের চকিত চাবুক মেরে বলল, যা মনে করো তাই। হয়তো, সত্যিই তোমাকে আর ভালো লাগে না। অনেকদিন তো হল। একজনকে আর কতদিন ভালো লাগে?

আমারও তো সেরকম মনে হতে পারে? কখনো।

হতে তো পারেই। আমি কি বলেছি যে, পারে না? হয় না যে কেন, সেইটা ভেবেই আশ্চর্য লাগে। আচ্ছা, এই বিয়ে ব্যাপারটা কোন খারাপ লোক চালু করেছিল বলো তো?

গলায় একটু অভিমানের সুর লাগল রাঘবের। বলল, বেশ তা! বেলা তো যায়নি। পরেশের সঙ্গেই না হয়… আমি ডিভোর্স দিয়ে দেব। চাইলেই। এককথায়।

না। আমি জানি তুমি খুব উদার। অন্তত দেখাতে চাও যে তাই।

তবুও না। আমার দরকার নেই। জীবনের আর বাকিটা আছে কী?

এই ভগ্নাংশ নিয়ে কাকে পূর্ণ করতে যাব? নিজেও কি হব?

কেন? না কেন?

কাউকেই ভালো লাগে না আমার। মানে, লাগে। কিছুক্ষণের জন্যে, কিছুদিনের জন্যে। বেশিক্ষণ, বেশি দিন কোনো পুরুষকেই ভালো লাগে না।

এসব হয়েছে তোমাদের আর্থিক স্বাধীনতার জন্যে। যেই-ই তোমরা রোজগার শুরু করেছ, স্বাবলম্বী হয়েছ; অমনি তোমাদের যত খারাপ-লাগা শুরু হয়েছে। এত বছরের পরাধীনতার পর স্বাধীনতা! তা নিয়ে কী যে করবে, তা ভেবে উঠতে পাচ্ছ না পর্যন্ত। আমার মা অথবা তোমার মায়ের কথা একবার ভাবো তো! কত সুখী ছিলেন তাঁরা।

সুমি হাসল। শ্লেষের হাসি। বলল, তা বটে। আমার বাবা ও তোমার বাবাও বোধ হয় এই ভেবেই খুশি থাকতেন। তাঁরা ছিলেন মেল শভিনিজম-এর শেষ ধ্বজাধারী। নিজেদের চোখকে চোখ ঠাওরাতেন। ভন্ড ছিলেন ওঁরা। আমার মা কি তোমার মা মানুষের জীবনযাপন করেছেন কি? কলুর বলদরাও তো ওঁদের চেয়ে স্বাধীন ছিল। সব কালে।

কিন্তু যাই-ই বলো, কখনো দুঃখী দেখিনি। ওঁদের কাউকেই। এটা কি কম কথা?

দেখার চোখ নেই পুরুষদের! তাই-ই দেখোনি। হাজার হাজার বছর ধরে চোখ ব্যবহার না করায় তোমাদের চোখই খারাপ হয়ে গেছে। তা ছাড়া দুঃখবোধের ব্যাপারটাও একটা মিনিমাম শিক্ষা এবং কিছুটা ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি ভালোবাসা থেকে হয়তো জন্মায়। যাকগে। তাঁদের জীবন তাঁদেরই ছিল। আমার কী?

এ রবিবারটাও কি ঝগড়াই করবে? রাঘব বলল।

করতে তো চাই না। হয়ে যায়।

এবারে নববর্ষে কী হবে? আর তো পাঁচদিন মাত্র বাকি! কাল অফিস থেকে বেরিয়ে ভাবছি তোমার জন্যে একটা শাড়ি কিনে আনব।

একদম না।

কেন?

তোমার কেনা শাড়ি আমার পছন্দই হয় না। কত নতুন ডিজাইনের, কতরকম শাড়ি বেরিয়েছে আজকাল। কত যেন খোঁজ রাখো!

অ! তা হলে আনব না। ঠিক আছে। তা হলে না হয় কুশলের জন্যেই আমাদের অফিসের কাছেই একটা দোকানে রিডাকশন সেল হচ্ছে, সেখান থেকে সস্তায় ভালো জিনিস নিয়ে আসব।

সারাটা জীবনই তুমি সস্তায় ভালো জিনিস খুঁজে মরলে। এই-ই তোমার জীবনের ট্র্যাজেডি! সস্তায়, ভালো কিছু পাওয়ার নয় যে এ সংসারে, এই সোজা কথাটা তোমার মগজে ঢুকল না। বরং নিজের একটা পায়জামা-পাঞ্জাবি কিনে এনো। নববর্ষের দিনে চন্দনার বাড়িতে একবার যাবে তো সেজেগুজে, নাকি? এত ভালোবাসে তোমাকে!

রাঘব বিরক্ত হল। বলল, যেতেও পারি। না যাওয়ার কী! তা ছাড়া ভালো যে বাসে, সেটা তো মিথ্যে নয়।

সুমি চুপ করেই রইল। তারপর রেডিয়োটা খুলল আরেকবার। খুলেই বন্ধ করে দিল। বলল, দুসস…

কার নাটক?

কে জানে? নাটকের দোষ নয়। দোষটা আমার। মাঝে মাঝেই এরকম হয়। কোনো কোনো দিন। কিছুই ভালো লাগে না।

টেবিলঘড়িটা টিক টিক করছিল টেবিলের ওপর।

রাঘব বলল, মিলিকে কালই একটা মানিঅর্ডার করে দেব ভাবছি। দেরি হয়ে গেছে অনেক। আসানসোলে। কমপক্ষে এক-শো টাকা পাঠানো উচিত, কী বলো? মিলির শাড়ি আর চুমকির ফ্রকের জন্যে?

আমাকেই যদি জিজ্ঞেস করো তো বলব পাঠানোর কোনোই দরকার নেই। তোমার ভগ্নীপতি অত বড়ো কোম্পানির পারচেজ ম্যানেজার, অমন দারুণ ফ্ল্যাটে থাকে, বছরে দু-বার করে ফ্যামিলি নিয়ে রাজার হালে বেড়াতে যায়, সবই বলতে গেলে নিখরচায়, তুমি কে বড়োলোক এসেছ তাদের প্রত্যেকবার নববর্ষে প্রেজেন্ট দেবার? তা ছাড়া তারা কি তোমার ছেলেকে কি আমাকে কোনোবারই কিছুমাত্রও দেয়? গত পনেরো বছরে তো অনেকই করলে। পেলে কী?

নাই-ই বা দিল! রাঘব স্বগতোক্তির মতো বলল, এ তো বিনিময় নয়। কাউকে দেওয়ার মতো আনন্দ আর কীই-বা আছে? কাউকেই দিতে মানা কোরো না। যতদিন পারি, দিই। ওরা বদলে কী দেবে, তা ভেবে তো দিই না ওদের। ছোটোবোন! সংসারে টাকাটাই তো সকলে বোঝে। কিন্তু টাকার চেয়েও বড়ো অনেক ব্যাপার আছে। এবং আছে বলেই, এই নোংরা, কালি-ঝুলি মাখা, ঘুণধরা পৃথিবী চলছে। ওঃ ভালো কথা। রুমিকে কি পাঠানো যায়? তোমার একমাত্র বোনকে?

না। একদম না। প্রভিডেণ্ড ফাণ্ড থেকে টাকা উঠিয়ে বোনের বিয়ে দিলাম। তারাই এখন বড়োলোকি দেখায় আমার কাছে। বাকি জীবনে কারো জন্যে কিছুই করব না আমি। সত্যি বলছি, কারো জন্যেই না। পৃথিবীর চেহারা আমি দেখেছি।

রাঘব হেসে ফেলল। বলল, ঈশশ, জীবনানন্দ বাংলার মুখ দেখেছিলেন, আর তুমিও দেখলে! একটু উঁচু হও সুমি, আকাশের দিকে চেয়ে দেখো।

রাখো তো তোমার কবিত্বর কথা। কবিতা, অবিবাহিত ছেলে-মেয়েদেরই জন্যে! না, আমি তোমাকেও করতে দেব না। দেখি, তুমি কী করে করো! আর কিছু দিয়ে দেখোই একবার! তোমাকে যে সকলেই কত বোকা ভাবে, তোমার এই বোকা-বোকা বড়োলোকি নিয়ে যে হাসিঠাট্টা করে তোমার পেছনে তা বোঝার মতো ক্ষমতা তোমার থাকলে তো হয়েই যেত। কী আমার বড়োলোক এসেছেন! বড়োলোকির রকম আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি!

রাঘবের গলায় দুঃখ লাগল।

বলল, সকলেই হাসিঠাট্টা করে? আমাকে নিয়ে? কেন? হবে হয়তো! আজকাল ভালোবাসা ব্যাপারটা তো একটা ঠাট্টা হয়ে গেছে। দাদার ভালোবাসা, জামাইবাবুর ভালোবাসা বোধ হয় আর ভালোবাসার ক্যাটেগরিতেই পড়ে না। যাই হোক, তা হলে এবার নববর্ষে কী করবে? নতুন বছরটা যে আসবে, তা তো বোঝাই যাবে না। নতুন তাঁতের শাড়ির গন্ধ, সন্দেশের প্যাকেট হাতে, সকালে উঠে চান করে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া, এসব না থাকলে তো…। দিনকাল সব কেমন বদলে গেল, না?

মোড়ের ফুটপাথে একটা ফুলুরির দোকান দাও। দিলে, খেরো-খাতা নিয়ে সাতসকালে কালীবাড়ি যেতে পারবে, পুজো দিতে, হালখাতার। তা হলে মনে হবে, কিছু একটা করলে। আমদানিও ভালো হবে। বাণিজ্যে বসতে লক্ষী:! ঘুস না খেলে আজকাল সরকারি চাকরিতে আছেটা কী? তোমার মতো লোকের বাঁ-হাতে পক্ষাঘাত হওয়া উচিত। আকাট মূর্খ তুমি!

রাঘব কথা ঘোরাল। বলল, কী খাওয়াবে? এই নববর্ষে আমাদের? মানে, আমাকে আর কুশলকে? রুমি আর চাঁদুকেও খেতে বলে দেবে নাকি?

না। না। না। একেবারেই না।

তা হলে, আমাদেরই।

পোলাও, মাংস, রুইমাছের কালিয়া, রাবড়ি, গিরিশের আম-সন্দেশ আরও যা বলবে। হিরে, মুক্তো সব খাওয়াব। বাজার তো দিনে হয় দশ টাকার।

ঠাট্টা করছ? সেদিন নববর্ষের দিন না হয় কুড়ি টাকাই দেব। একটাই দিন।

ঠাট্টা! ঠাট্টা কেন করব? তোমার বাড়ি। তোমার টাকা। তুমি খাবে। আমি ঠাট্টা করার কে? যা দেবে, তার মধ্যে যা হবে, তাই খাবে। তা দিয়ো না। জগুর মা বলছিল, পটলের কেজি নাকি বাহান্ন টাকা। কারা খায় বলো তো? তীর্থে না গিয়ে একবার সেই লোকগুলোকে দেখতে যাওয়া উচিত মানুষের।

ঠাট্টাই করছ। বছরে একটা দিন—তাও এরকম করো? সত্যি। অনেক অনেক বছর হয়ে গেল তেল-কই খাইনি।

মিথ্যে কথা বোলো না। গতবছরই জামাইষষ্ঠীতে খেয়েছিলে। আর খাবে কি না কখনো তা অবশ্য বলতে পারছি না। মাই-ই চলে গেল। বাড়িটাই অন্যরকম হয়ে গেছে। দাদারা ব্যস্ত; বড়োলোক।

হঠাৎই গলা ধরে এল সুমিতার। বলল, ওরা কেমন মানুষ সব বলো তো?

তুমি কী না করেছ ওদের জন্যে। সবই ভুলে গেল? লজ্জা করে বড়োই আমার।

কই-এর কথা বলছ, মানে, আমার মা যেমন করে রাঁধতেন?

না, না তোমার মা তো পোস্ত আর সরষে দিয়ে রাঁধতেন। তা নয়। তেল-কই। বেশ বড়ো, বুঝলে এই ইয়া বড়ো বড়ো কই, স্রেফ সরষের তেলে কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা দিয়ে। সঙ্গে সামান্য ধনেপাতা। আঃ।

রাঁধবে কে? আমি ওসব রাঁধতে জানি না। অত জম্পেশ করে রান্না। যেসব মেয়েদের কোনো বাইরের কাজ করতে হয় না, তাদের পক্ষেই পোষায়। আমাদের পক্ষে ওসব সম্ভব নয়। তা ছাড়া, কইমাছ অত্যন্ত খারাপ মাছ। এই সময়ে খেলে চিকেন-পক্স বা মিজলস হতে পারে কুশলের। ও অন্যভাবে মানুষ। ইমিউনিটি কম। আর কাঁটা? অমন মাছ ভদ্রলোকে খায় না। ভদ্রলোকে খাবে রুই, কাটা-পোনা, বড়ো মাগুর, গলদা কি বাগদা চিংড়ি। ম্যাক্সিমাম চলতে পারে, পাবদা। একটাই কাঁটা তো। কুশল তো কোনো মাছ খেতেই পারে না। মাছ খেতে চায়ও না। বোনলেস চিকেন শুনে শুনে বলে, মা বোনলেস ফিশ দাও।

বোনলেস ফিশ! রাঘব আজব গলায় বলল।

রাঘবের মাঝে মাঝে সবই গোলমাল হয়ে যায়। ওদের ছোটোবেলায় সব কিছুই কত অন্যরকম ছিল। ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের বাসিন্দাদের হেদোর ছেলেরা খ্যাপাত: ‘ড্যাডি। ড্যাডি। ছাপ্পর-পর পিজন বৈঠে বৈঠে।’ ‘কান্ট, শান্ট’ করে সে ছোঁড়ারা ইংরিজি বলত। আজ তার একমাত্র ছেলে কুশলও প্রায় সেই ‘ছাপ্পর-পর পিজন বৈঠে’র সংস্কৃতিরই হয়ে গেল। বইমেলায় তিন দিন ওকে নিয়ে গেছিল রাঘব। পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও, একটিও বাংলা বই কিনল না। রাঘবের ছেলে, বাংলা বই পড়ে না, কইমাছ খেতে পারে না…। দুশশ শালা। এমন সাহেব ছেলের দৌলতে নিজেই বিএনজিএস হয়ে গেল। কী পরিহাস ভাগ্যের। ছোটোবেলায় ওরা বলত বিএনজিএস। অর্থাৎ বিলেত-না-গিয়ে সাহেব!

রাঘবের খুবই রাগ হল হঠাৎ। কুশলের ওপর। কিন্তু আসলে দোষটা তো ওদেরই। দোষ তো বাবা-মায়েরই। তাদের ছাড়া আর কার? যে ছেলে-মেয়েরা মাতৃভাষায় ভালো করে কথা বলতে পারে না, মাতৃভাষার সাহিত্য সম্বন্ধে যারা কোনো খোঁজই রাখে না, যারা বাংলা গান পর্যন্ত ভালোবাসে না সেইসব কলকাতাবাসী বঙ্গসন্তানদের বাবা-মা হিসেবে ওদের তো লজ্জা রাখার সত্যিই জায়গা নেই। বড়জামদা, ভুবনেশ্বর, ভোপাল, চেন্নাই, এটাওয়া, ইতারসিতে যেসব বাঙালি বাবা-মা অত্যন্ত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সুযোগের অভাবে ছেলে-মেয়েদের হাতে বাংলা বই তুলে দিতে পারেন না, পারেন না দিতে বাংলা খবরের কাগজ, সাপ্তাহিক বা মাসিক; তাঁদের কথা আলাদা। তাঁদের দোষ ক্ষমা করা যায়। দোষটা তাঁদের আদৌ নয়। দোষ কলকাতার বাঙালিদেরই, যাঁরা তাঁদের হাতে বাংলা পত্র-পত্রিকা, খবরের কাগজ পৌঁছে দেওয়ার কোনো চেষ্টাই করেন না। কিন্তু রাঘব আর সুমির দোষ?

এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। বিশেষ কারণ না থাকলে দুপুরে দরজাতে খিল তোলে না ওরা।

সুমি বলল, কে রে? জগুর মা? কুশল?

হ্যাঁ মা। কুশল বলল। মে আই কাম ইন?

আয়!

আই হ্যাভ আ প্রবলেম।

কী?

একলা বৈশাখ মানে কী মা? অ্যাণ্ড হোয়াট ইজ বৈশাখ? তিনরা আষাঢ় মানেই বা কী?

সুমি একবার রাঘবের দিকে তাকাল।

রাঘব মুখ ফিরিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করল।

সুমি বলল, একলা নয়, কুশু, কথাটা পয়লা। মানে প্রথম। লেখা হয় ওইভাবে। মাসের প্রথম তারিখকে বলে পয়লা। তিনরাও নয়। ওটা বাংলায় লেখা হয় ৩রা করে, কিন্তু উচ্চারণ হবে তেসরা। অর্থাৎ তিন তারিখ। আষাঢ়ের তিন তারিখ।

ফানি!

বলল, কুশল। তার পর বলল, হোয়াট ইজ বৈশাখ মা?

বৈশাখ একটা মাসের নাম বাবা। আমাদের বাংলা ক্যালেণ্ডারের প্রথম মাস হচ্ছে বৈশাখ। এবং পয়লা বৈশাখ হচ্ছে আমাদের নববর্ষ, মানে নিউ-ইয়ার।

ডোন্ট বি সিলি, মা! নববর্ষ তো ফার্স্ট জানুয়ারি। তুমি আমাকে মিছিমিছি বলছ!

না কুশু। মিছিমিছি বলিনি।

আমি যাচ্ছি। অধৈর্য গলায় কুশল বলল।

তুমি কী করছিলে?

হুইজ-বিজ পড়ছিলাম দ্য টেলিগ্রাফের। দারুণ লাগে আমার টেলিগ্রাফ। শুধু রবিবারে না রেখে রোজই রাখোনা কেন মা? তোমাদের আনন্দবাজারের নামটাই কেমন বাজার বাজার। বন্ধ করে দাও।

রাঘব বলল, কুশু, আনন্দবাজার, শুধু একটা খবরের কাগজই নয়, আমাদের দেশ যখন পরাধীন ছিল তখন এই কাগজ অন্য আরও কিছু কাগজের সঙ্গে, আমাদের স্বাধীন করতে সাহায্য করেছে। আনন্দবাজার বাঙালির জীবনের সঙ্গে মিশে রয়েছে। ছাপা ঝকঝকে বা কাগজ সাদা হওয়ার চেয়েও আরও বড়ো ব্যাপার থাকে কুশু। তুমি বড়ো হয়ে বুঝবে। জানি না বুঝবেই কি না। হয়তো বুঝবে।

কুশল চলে যেতে, রাঘব সুমির মুখের দিকে চাইল।

বলল, তোমাদের স্কুলের সব ছেলে-মেয়েও কি এরকম?

তা কেন হবে? বাড়িতে আমরা যদি একটুও ওকে নিয়ে না বসি, আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের গান সম্বন্ধে ছোটোবেলা থেকেই ইন্টারেস্টেড না করে তুলতে পেরে থাকি, তা হলে দোষটা কার? ওর? না আমাদের?

তুমি কি বসতে পারতে না ওকে নিয়ে? নিজে টিচার হয়েও? দু-দিন পর অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস হবে তুমি।

না। আমার স্কুলের বকবকানির পর রান্নাবান্নাতেও কিছু সাহায্য তো করতে হয়। রান্না ছাড়াও অনেকই কাজ থাকে। তুমিই একমাত্র পারতে! তা নয়, অফিস থেকে এসে তাস পিটতে যাবে। ইংরেজি, জার্মান, আমেরিকান আর্টফিলম দেখতে হবে। ছেলের জন্যে দেওয়ার সময় কোথায় তোমার? তুমিও তো একজন ইন্টারন্যাশনাল পার্সোনালিটি! ছেলে বাঙালি হল না বলে তোমার দুঃখ করা মানায় না।

রাঘব উত্তর না দিয়ে উঠে বসল বিছানাতে। অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বলল, আমি যা দেখছি, এইভাবে চলতে থাকলে, পঞ্চাশ বছর পরে বাঙালি বলে কোনো জাতই বোধ হয় আর থাকবে না। যে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি এতদিন আমাদের সংস্কৃতি সাহিত্য, সংগীত সব কিছুকেই বাঁচিয়ে রেখেছে, তারা একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

যাবে। সুমি ওর হারের লকেটটা চিবোতে চিবোতে বলল। যারাই ছেলে-মেয়েদের ভালো চাকর বানাতে চায়, বেশি টাকা রোজগারের মেশিন করতে চায়; ব্রিফকেস হাতে, টাই-পরা চাকর, মেয়েদের বেশি রোজগেরে ছেলেদের সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়, তারাই ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে ছেলে-মেয়েকে পড়তে পাঠাবে। তারা বাংলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে না কখনোই। বাবা মা যথেষ্ট ইন্টারেস্ট না নিলে।

রাঘব বলল, ইংরিজির মতো রিচ ভাষা তো হয় না। আমাদের বাপ-ঠাকুরদা কি আমাদের চেয়ে কম ভালো ইংরিজি জানতেন? কিন্তু ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলে পড়লেই যে ইংরিজিয়ানা শিখতে হবে একথা আমি বিশ্বাসই করি না। তোমরা যে শিক্ষা ছেলে-মেয়েদের দিচ্ছ, তাতে কাঁটাচামচে নিখুঁতভাবে খেতে পারা আর শিক্ষিত হওয়া ব্যাপারটা সমার্থক হয়ে যাচ্ছে। এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার।

সাংঘাতিকই। কিন্তু তোমার এই হঠাৎ কনশাসনেস, হঠাৎ জ্ঞান, ভালো লাগছে না আর। বলিনি, শরীরটা ভালো নেই আমার।

হ্যাঁ।

নববর্ষর দিন মাছ খাবে বলো। জগুর মাকে বলে রাখব। পটলাকে বলে আগের দিনই…

চৈত্র-সংক্রান্তির দিন সব বাড়িঘর পরিষ্কার-টরিষ্কার করবে না? মনে আছে, মা ও বাবা প্রতিবছর ওইদিন বাজার করতে বেরুতেন? দাদুর ফতুয়া, বাড়ির পাপোশ, কুকুরের বকলস। নতুন বছর, নববর্ষ যে আসছে, বেশ বোঝা যেত। আমাদের সকলের জন্যে নতুন জামা।

নববর্ষের দিন কী মাছ খাবে বলো?

ঠাণ্ডা নৈর্ব্যক্তিক গলায় সুমি আবার বলল। কইমাছ?

না। থাক। রাঘব বলল, বৈশাখ সত্যিই একলা হয়ে গেছে। একলা বৈশাখে কিছুই করার দরকার নেই। যা কিছু করার সব একলা-জানুয়ারিতে কোরো।

সুমি তখনও লকেট চিবোচ্ছিল।

ননশালান্টলি বলল, যা তোমার ইচ্ছে। তাই-ই হবে। রাঘবের মনে হল, সুমি যেন বেঁচে গেল একলা বৈশাখ, কাঁটাওয়ালা কই এবং তারও ওপর কালো জিরে, কাঁচালঙ্কা ধনেপাতা দেওয়া তেল-কইয়ের অত্যাচার থেকে। ক্লোরোস্ট্রোল, বাজে খরচা। ঝামেলা…

রাঘব জানে যে, ‘একলা বৈশাখ’-এর দুপুরে হয় সসেজ এবং পাউরুটি, নয় ভাত এবং পোর্ক-ভিন্দালু, রাঁধবে জগুর মা। সুমির অর্ডারমতো। ইদানীং বিফও আনাচ্ছে মাঝে মাঝে। কারণ অকাট্য। সুমি বলছে, ফাস্ট-গ্রোয়িং ছেলে কুশলের জন্যে চিপেস্ট প্রোটিন। দিনকাল যা পড়েছে! উপায়ই বা কী? একলা একলা থেকেও এই-ই অবস্থা সকলের।

বৈশাখ, পয়লা বৈশাখ হয়তো সব বছরই আসবে ঘুরে ঘুরে, কিন্তু সকালে স্নান-করা কোরা তাঁতের শাড়ির গন্ধে-মোড়া, উজ্জ্বল মরুকেতনের মতো ঢলঢলে মুখের, ভেজা চুলের বাঙালি মেয়েদের আর বেশিদিন দেখা যাবে না। গুরুজনদের বাড়ি সন্দেশের প্যাকেট হাতে করে প্রণাম করতেও যাবে না কেউ। কাঁটাওয়ালা মাছ এবং তেল-কই রান্না হবে না কারোর বাড়িতে।

বোনলেস চিকেন, বোনলেস ফিশেরই মতো, বাঙালি জাতটাই একটি বোনলেস জাত হয়ে গেছে, যার কোনো নিজস্বতা আর অবশিষ্ট নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *