একদা এক বাঘের গলায়
এক
মেজোমামা আর মাসিমা পেছনের আসনে। আমি সামনে বড়মামার পাশে। গাড়ি চলেছে। বড়মামার হাত বেশ তৈরি হয়ে গেছে। এই সেদিন গাড়ি থেকে ‘এল’ প্লেটটা খোলার অনুমতি মিলেছে।
‘বাঃ তোমার হাত তো বেশ তৈরি হয়ে গেছে হে।’
মেজোমামা পেছন থেকে নাকিসুরে বললেন। সুর নাকি হবার কারণ আছে। মেজোমামা পুরীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন একা একা। হঠাৎ টেলিগ্রাম এল, ‘কাম শার্প। ব্রাদার ইল’। বড়মামা ছুটলেন, সঙ্গে গেলেন কম্পাউন্ডার দাদা। পরের পরের দিন ফিরে এলেন মেজোমামাকে নিয়ে। খুব কাহিল অবস্থা মেজোমামার। কোমরভাঙা দ হয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলেন। মুখে লেগে আছে করুণ বীরের হাসি। কারুর বারণ না শুনে সমুদ্রে চান করতে নেমেছিলেন। ঢেউ এসে তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে। ডুবেই যেতেন। চ্যাম্পিয়ান সাঁতারু পিনাকী রুদ্র সেই সময় পুরীতেই ছিলেন। সমুদ্রে চান করছিলেন সুইমিং কস্ট্যুম পরে। মেজোমামার নড়া ধরে ডাঙ্গায় তুলে এনেছিলেন। তুলতে তুলতেই নোনা জল খেয়ে মেজোমামার ভুঁড়িটি গণেশঠাকুরের মতো হয়ে গিয়েছিল। সেই নোনাজলের চুবুনিতে সুর নাকি হয়ে গেছে। বড়মামা বলেছেন, ‘সারতেও পারে, না-ও সারতে পারে।’
মেজোমামা বললেন, ‘আহা, হাত আর দুটো পা তোমার বেড়ে সুরে বলছে, যেন কনসার্ট।’
মাসিমা বললেন, ‘অ্যাতো আস্তে চালাচ্ছে কেন? এর চেয়ে বেশি স্পিড দেওয়া যায় না?’
মেজোমামা বললেন, ‘গাড়িটা বৃদ্ধ হয়েছে তো, তাই ধীরে ধীরে চলছে। সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি। চলছে যে এই না কত! না, না, ধড়ফড় করে দরকার নেই, তুমি ধীরেই চলো। খরগোশও গন্তব্যে পৌঁছোবে, কচ্ছপও গন্তব্যে পৌঁছোবে। একদিন আগে আর পরে।’
আড়চোখে বড়মামার দিকে তাকালুম। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘খরগোশ পৌঁছোতে পারেনি, কচ্ছপই পৌঁছেছিল। স্লো অ্যান্ড স্টেডি উইনস দি রেস।’
মাসিমা বললেন, ‘পেছন থেকে অন্য সব গাড়ি হুশ হুশ করে চলে যাচ্ছে। যাবার সময় আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে। হাসছে। আমার ভীষণ অপমান লাগছে।’
‘তুমি চোখ বুজে থাকো। চোখ খুলো না। চিড়িয়াখানা এলে আমি বলে দোব।’ মেজোমামা মুচকি হেসে বললেন।
‘দাদা, তোমার ভয় করছে বুঝি?’ মাসিমা ভালোমানুষের মতো বড়মামাকে প্রশ্ন করলেন।
বড়মামা বললেন, ‘একটা অ্যাকসিডেন্ট হোক, এই বোধহয় চাইছিস কুসি!’
মেজোমামা বললেন, ‘সে-ভয় নেই বড়দা। তুমি তো একপাশ দিয়ে হেঁটে-হেঁটে চলেছ। তোমার মার নেই। অ্যাকসিডেন্ট হবে কী করে? একে বলে ওয়াকিং-স্পিডে গাড়ি চালানো।’
বড়মামা শাঁত করে গাড়িটাকে রাস্তার বাঁ পাশে গাছতলায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘কী হল, গাড়ির জলতেষ্টা পেয়েছে?’
বড়মামা হাতজোড় করে বললেন, ‘আপনারা দয়া করে নেমে যান। পেছনে বসে বসে আরাম করে কাছা ধরে টানা চলবে না, চলবে না। যেখানে একতা নেই, সেখানে গতিও নেই। ইউনাইটেড উইস্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল। সেই পতনই এইবার হবে, দয়া করে আপনারা দুজনে নেমে যান।’
মেজোমামা বললেন, ‘কী হবে রে কুসি। বড়বাবু যে খেপে গেছে।’
‘তুমি কান ধরে ক্ষমা চাও মেজদা। বলো, আর করব না। অন্যায় হয়ে গেছে।’
‘আমি একা কেন? যত দোষ নন্দ ঘোষ। তুইও কিছু কম যাস না। তুইও ক্ষমা চা।’
‘আমার সঙ্গে বড়দার অন্য সম্পর্ক, স্নেহের সম্পর্ক। তুমি মেজদা চিরটাকাল সুযোগ পেলেই বড়দাকে খোঁচা মারো।’
বড়মামা বললেন, ‘তোমরা কেউই কম যাও না। মিটমিটে শয়তান। গাড়িটা কেনার আগে তুই কুসি সবচেয়ে বিরোধিতা করেছিলিস। ঠ্যালাগাড়ি, ছ্যাকরাগাড়ি, যার পাঁঠা সেই বুঝুক, এই সব অনেক চ্যাটাং চ্যাটাং বুলি ঝেড়েছিলে। একে রামে রক্ষে নেই, দোসর লক্ষ্মণ। মেজো তখন তালে তাল বাজিয়ে গিয়েছিল। তোমাদের আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি। সব এক-একটি ধানি-লঙ্কা।’
দুজনে একই সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘বড়দা, আমাদের ক্ষমা করে দাও। তোমার দয়ার শরীর। সাক্ষাৎ মহাদেব। বাবা ভোলানাথ মাইনাস জটাজুট। ক্ষমা করে দাও প্রভু!’
‘না, সম্ভব নয়। এ তো ক্ষমা চাওয়া নয়, এ এক ধরনের ব্যঙ্গ।’
মাসিমা বললেন, ‘তুমি আর-একবার আমাদের চানস দিয়ে দ্যাখো বড়দা, এবার আমরা একেবারে চুপচাপ থাকব।’
‘চুপ করে থাকলেই হবে! ভেতরে সব ব্যঙ্গবিদ্রূপ পুষে রাখবে, বাইরেটা সব সাজানো-গোছানো, চকচকে, চমৎকার। ওতে আমি আর ভুলছি না ভাই। তোমরা নেমে ট্যাকসি-ম্যাকসি ধরে বাড়ি চলে যাও। আমি আর আমার ভাগনে, পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কেউ নেই।’
‘কেন, তোমার ঈশ্বর!’
‘আঃ, চুপ করো না মেজদা। তোমার স্বভাবটা বড় বিশ্রী হয়ে যাচ্ছে।’
‘ক্ষমা চাইলে যে-মানুষ ক্ষমা করতে জানে না, সে কেমন মানুষ?’
বড়মামা বললেন, ‘বনমানুষ। তোমরা হলে সব শহর-মানুষ, আমি একটা শিমপাঞ্জি।’
‘শুধু শুধু তোমরা কেন ঝগড়া করছ বলো তো। দিন-দিন তোমাদের বয়েস বাড়ছে না কমছে? বড়দা, তুমি স্টার্ট দেবে কি-না বলো, এবার কিন্তু আমি নিজ-মূর্তি ধরব। লোক জড়ো হয়ে যাবে। ভালো হবে?’
আড়চোখে মাসিমার দিকে তাকিয়ে বড়মামা গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। চিউয়িংগাম খাবার মতো মুখ নড়ছে। তার মানে কিছু একটা বলতে চান। না বলতে পেরে চিবিয়ে গিলে ফেলছেন। এবার সব চুপচাপ। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। মেজোমামা হুঁহুঁ করে গানের সুর ভাঁজছেন। গানটা আমার চেনা। বিশেষ সুবিধের গান নয়। বাণীটা বড়মামার চেনা হলে গাড়ি আবার থেমে পড়ত।
মেজোমামার হুঁহুঁ ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। ভাব এসে গেছে। বড়মামা মেজোমমাকে চাপা দেবার জন্যে কার-স্টিরিওর দিকে হাত বাড়ালেন। মেজোমামা গান থামিয়ে বললেন, ‘তুমি কি টেপ চালাচ্ছ? তাহলে কীর্তন নয়, ইংরিজি কিছু চালাও।’
মাসিমা বললেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত নেই?’
আমি বললুম, ‘বড়মামা, আধুনিক আছে?’
বড়মামা হাত টেনে নিতে নিতে বললেন, ‘আমার কাছে কিছুই নেই।’
মেজোমামা বললেন, ‘অ, ওটা তাহলে তোমার ডামি-স্টিরিও। খোলস আছে, ভেতরে মাল নেই, ফর শো। কত কায়দাই জানো তুমি! তোমার গাড়িতে ইঞ্জিন আছে তো?’
মাসিমা বিরক্তির গলায় বললেন, ‘আঃ, মেজদা, কেন বকবক করছ। এই একটু আগে চুক্তি হল, চুপচাপ বসে থাকবে, ফ্যাচর ফ্যাচর করবে না। এরই মধ্যে ভুলে গেলে!’
বড়মামা বললেন, ‘স্বভাব কুসি, স্বভাব। স্বভাব সহজে পালটানো যায় না। দোয়েল কি কোয়েলের মতো ডাকতে পারবে? ছাগল কি ভেড়ার মতো গুঁতোতে পারবে। ঘোড়া কি হাতির মতো স্থির ধীর হতে পারবে?’
‘শুনছিস কুসি, শুনছিস? গাড়িধারী বড়লোকের বোলচাল শুনছিস?’
মাসিমা বললেন, ‘বড়দা, তুমি গাড়ি থামাও, আমি নেমে যাই। অষ্টপ্রহর গজকচ্ছপের লড়াই আমার অসহ্য লাগে।’
মেজোমামা বললেন, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, এই আমি চুপ করছি। স্পিকটি নট। তবে আমিও বলে রাখছি, গাড়ি আমি কিনবই। নতুন গাড়ি, ধ্যাদ্ধেড়ে সেকেন্ড-হ্যান্ড নয়। তখন কিন্তু আমি এই গাড়িতে পা দোব না। এই ত্রিসীমানায় আসব না। সাধলেও না।’
‘যখন কিনবে তখন দেখা যাবে, আগেই এত আস্ফালন ভালো নয়। তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে, আমার জানা আছে। তোমার পাসবই তো আমার কাছে।’
‘ধার করব।’
‘কে তোমাকে ধার দেবে?’
‘ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্ক দেবে।’
বড়মামা হঠাৎ বললেন, ‘কে গ্যারাণ্টার হবে?’
‘কেন, তুমি। তুমি হবে। তুমি ছাড়া আমার কে আছে?’
বড়মামা হাহা করে হেসে উঠলেন, ‘এই জন্যেই তোকে আমি এত স্নেহ করি। বুদ্ধিশুদ্ধি তোর একদম পাকেনি। বুড়োখোকা।’
মাসিমা বললেন, ‘আমি বুঝি তোমার কেউ নই?’
মেজোমামা বললেন, ‘কেন অভিমান করছিস, তুই ছাড়া আমার জগৎ অন্ধকার।
ঠ্যাং ঠ্যাং, ঠ্যাং ঠ্যাং ঘণ্টা বাজিয়ে উলটো দিক থেকে একটা দমকল আসছে। বড়মামা বাঁ পাশে সরতে সরতে বললেন, ‘সেরেছে, দমকল যে রে বাবা!’
মেজোমামা বললেন, ‘ভয় পেও না বড়দা, দমকল আগুন নিবিয়ে ফিরছে। যতই ঘণ্টা বাজাক সে, তাড়া নেই। স্টিয়ারিং সোজা রাখো।’
বড়মামা শব্দ করে হেসে, গাড়িটাকে ঠেলে রাস্তায় তুললেন। ডান দিক দিয়ে ঝড়ের বেগে একটা দৈত্য-লরি বেরিয়ে গেল। বড়মামা চমকে বাঁ পাশে আমার দিকে কাত হয়ে পড়লেন। মেজোমামা পেছন থেকে বলে উঠলেন, ‘জয় ঠাকুর, প্রাণে বাঁচলে হয়।’
মাসিমা বললেন, ‘ভয় পেও না, রাখে কেষ্ট মারে কেন, মারে কেষ্ট রাখে কে?’
বড়মামা বললেন, ‘ঘাবড়াও মাত। তোমরা শুধু লরিগুলোকে একটু কনট্রোলে রাখো।’
মেজোমামা প্রশ্ন করলেন, ‘কীভাবে?’
‘পেছনে যারা আছ, তারা পেছনে তাকিয়ে থাকো। লরি এলেই আমাকে জানাবে।’
‘তোমার মাথার ওপর একটা আয়না আছে। কী জন্যে আছে?’
‘আয়না দেখে বোঝা যায় না, আসছে না যাচ্ছে। গুলিয়ে যায়।’
গাড়ি চলেছে, গুড়গুড় করে। আর কতদূর! ভীষণ ভয় করছে। বড়মামা গাড়ি চালাচ্ছেন, না কোদাল চালাচ্ছেন, বোঝা শক্ত।
দুই
বড়মামার গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে বাঁক নিল। রাস্তাটা তেমন চওড়া না হলেও, পাকা। নতুন পিচ পড়েছে। দু’পাশে বিশাল দুই কারখানার জেলখানার মতো পাঁচিল। বাঁ পাশের দেয়ালে একটা সাইনবোর্ড। আমরা যেদিকে চলেছি সেই দিকে তীর-চিহ্ন। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ফুলবাগানের ঝিল। উদয়াস্ত মাছ ধরার ব্যবস্থা। পাশের জন্যে যোগাযোগের ঠিকানা, বোকুবাবু, ছোকোন ঘোষের চায়ের দোকান, কুলতুলি। দশটা-পাঁচটা। পাশের হার, দশ টাকা।
স্টিয়ারিং নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে, বড়মামার নজরে সাইনবোর্ডটা পড়ে গেল। গাড়ি আড় হয়ে ঢুকেছিল। স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। বাঁ দিকে হেলে, আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বড়মামা বললেন, ‘পড় তো, পড় তো। কী লেখা আছে পড় তো!’
গাড়ির পেছন দিকে দুম করে কী একটা ধাক্কা মারল। সামান্য একটু দুলে উঠলুম আমরা। দুমদাম করে নানা রকমের জিনিস পড়ে যাবার শব্দ হল। শুধু, পড়ল না, পড়ে ছড়াতে শুরু করল। মাছ ধরার নোটিশ আর পড়া হল না। সব কটা মাথা ঘুরে গেল পেছন দিকে। একটা সাইকেল-রিকশা। পেছনের কাঁচে ভাসছে রিকশা-চালকের মুখ। আরোহী আসছিলেন একগাদা বিভিন্ন মাপের অ্যালুমিনিয়ামের কৌটো নিয়ে। ধাক্কার ঝাঁকুনিতে সব ছিটকে পড়েছে। গড়গড়িয়ে কিছু চলে গেছে নর্দমায়। কালো জলের ওপর ভাসছে সাদা চকচকে কৌটো।
বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে নেমে পড়লেন। গাড়ির গায়ে চোট লেগেছে, আর রক্ষা আছে? গাড়ি হল বড়মামার প্রাণ। বড়মামা নামার সঙ্গে সঙ্গে আমিও নামলুম। পেছন দিকে তাকিয়ে মাসিমা আর মেজোমামা বসে রইলেন।
বড়মামা ঝুঁকে পড়ে পেছনের বাম্পারটা দেখে বললেন, ‘এটা কী হল?’
রিকশাচালক বললেন, ‘আমার কী দোষ, আপনি হঠাৎ থামলেন কেন?’
‘সামনের গাড়ি থামলে পেছনের গাড়িকেও থামতে হয়। গাড়ি চালাবার ব্যাকরণ না শিখেই সিটে উঠে বসেছ?’
‘আপনিও ব্যাকরণ তেমন জানেন বলে মনে হচ্ছে না। জানলে এমন দুম করে মোড়ের মাথায় থেমে পড়তেন না।’
রিকশার আরোহী নামার জন্যে হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করছেন। পারছেন না। অ্যালুমিনিয়ামের হাজার হাজার কৌটো নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কৌটো-মানব। মুখটি শুধু জেগে আছে। কৌটো-মানব বললেন, ‘আপনার আর কী হয়েছে! রিকশার ধাক্কায় মোটর-গাড়ির কিছু হয় না। ক্ষতি হল আমার। নর্দমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমার এত দামের কৌটো খানায় ভাসছে।’
বড়মামা ঢুলুঢুলু চোখে খানার দিকে তাকালেন। কারুর ক্ষতি হলে বড়মামার বুক মুচড়ে ওঠে। মেজোমামা নেমে এসেছেন। অবাক হয়ে আরোহীকে দেখেছেন। থাকতে না পেরে প্রশ্ন করলেন, ‘কী করে আপনি অমন হলেন?’
‘কী রকম?’
‘অমন কৌটোময়, কৌটোসমৃদ্ধ! কে আগে উঠেছে! আপনি আগে, না কৌটো আগে?’
‘এটা একটা প্রশ্ন হল? দেখলেই তো বোঝা যায়। আগে আমি, তারপর কৌটো।’
‘কী করে নামবেন?’
‘হ্যাঁ, এটা একটা প্রশ্ন। সে এক সমস্যা মশাই। আমাকে না নামালে, আমার ক্ষমতা নেই নামার।’
‘কেউ যদি না নামায়, সারা জীবন ওইভাবে বসে থাকতে হবে? আপনার তো মশাই আচ্ছা লোভ!’
‘লোভের কী দেখলেন?’
‘কৌটোর লোভ অবশ্য আমারও আছে, তবে আপনার চেয়ে অনেক কম। আপনি একেবারে গোটা একটা কৌটো-কারখানা কিনে এনেছেন!’
‘উঁহু, উঁহু, বর্তমান কাল নয়, অতীত কাল হবে। কিনেছিলুম, এখন চলেছি ফেরত দিতে।’
‘এত কৌটো কিনে সব আবার ফেরত দেবেন? বড় দুঃখ হচ্ছে।’
‘দুঃখ! আপনি একটা কৌটোরও ঢাকনা খুলতে পারবেন না। যদি পারেন, আমার কান কেটে ফেলে দোব।’
‘সে কী? কোথা থেকে কিনেছিলেন?’
‘কে এক মশাই, ডাক্তার সুধাংশু মুখোপাধ্যায়, কুলতুলিতে দুঃস্থ মহিলা সমিতি খুলেছেন, এ হল সেই সমিতির কারখানায় তৈরি ডিফেকটিভ মাল। মহিলা সমিতির নামে চালাতে চেয়েছিল। কৌটোর ধর্ম কী?’
‘আজ্ঞে টানলেই ঢাকনা খুলবে।’
‘এ সব হল বিধর্মী কৌটো।’
‘ডাক্তার সুধাংশু মুখোপাধ্যায় এই মুহূর্তে আপনার সামনে দণ্ডায়মান।’
‘অ্যাঁ, তাই নাকি? আপনিই সেই পরোপকারী ডাক্তারবাবু?’
বড়মামা লাজুক-লাজুক মুখে বললেন, ‘নমস্কার, নমস্কার।’
‘আমাকে নমস্কার করে আর লজ্জা দেবেন না, আপনাকে আমার শত কোটি প্রণাম করা উচিত। কী জিনিস বানিয়েছেন ডাক্তারবাবু, মানুষের প্রাণ ভরে রাখলে, যমেও ছুঁতে পারবে না। দেখা হয়ে ভালোই হয়েছে। রিকশাটাকে ছেড়েই দি। মাল সব গাড়ির পেছনে ভরে দেওয়া যাক। নর্দমায় যে কটা ভাসছে, নিজেই গুনে নিন। আমার এদিককার হিসেব ঠিক আছে।’
মোটাসোটা চৌকো ধরনের ভদ্রলোক কৌটোর স্তূপ ঠেলে রিকশা থেকে নেমে এলেন। মালকোঁচা মারা ধুতি। গায়ে শার্ট। বুক-পকেটে অ্যাতো কাগজপত্র ঠেসেছেন, ফেটে বেরিয়ে না যায়। গায়ের রঙ মিশকালো। দু’পাটি ঝকঝকে সাদা নিম-দাঁতন করা দাঁত। হাসিটা সেই কারণেই বড় স্পষ্ট।
বড়মামার গাড়ির বুটে একে একে সব ঢুকে গেল। ভদ্রলোক পিছনের আসনে জাঁকিয়ে বসলেন। এমন ভাবে বসেছেন, যেন নিজের গাড়ি। মেজোমামা মাঝখানে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ বিরক্ত হয়েছেন।
ভদ্রলোক হাত জোড় করে মাসিমা আর মেজোমামার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমার নাম শ্রীআশুতোষ দাস। মোল্লারচকে আমার মিষ্টির দোকান। এই রিসেণ্টলি বেলের মোরব্বার কারবারে নেমেছি। ভেরি গুড মার্কেট। মিডল ইস্ট, জাপান, হংকং, হনলুলু, কামস্কাটকা, ফ্রানস, আমেরিকা, জার্মানি, কোথায় না, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, এ দাসস বেঙ্গলকুইন ইন থিক সিরাপ।’
কথা শেষ করে হাত খুললেন। মেজোমামার মুখের চেহারা পাল্টে গেল ভদ্রলোকের মুখে পরিষ্কার ইংরেজি শুনে। বেশ শিক্ষিত বলেই মনে হচ্ছে, অথচ মিষ্টির কারবারি! বড়মামার গাড়ি চলেছে ফুরফুর করে। ইঞ্জিনের শব্দ শুনলে মন হবে বড়দাদু ভুড়ুক ভুড়ুক করে তামাক খাচ্ছেন।
মেজোমামা সুদ্ধ বাংলায় জিগ্যেস করলেন, ‘মশায়ের শিক্ষাদীক্ষা?’
আশুবাবু খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘যৎসামান্য। বায়ো-কেমিস্ট্রিতে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট করার পর কিছুকাল একটা ফার্মে চাকরি। ভালো লাগল না দাসত্ব। কী করি, কী করি? পিতার মৃত্যুর পর বসে পড়লুম দোকানে। ইনস্টিট্যুট অব কেটারিং টেকনোলজি থেকে একটা ডিপ্লোমা বাগিয়ে আনলুম। শিক্ষার কি শেষ আছে। মিষ্টির জগতেও যে কত কী দেবার আছে!’
‘মিষ্টির জগৎকে কী আর দেবেন? সবই তো দেওয়া হয়ে গেছে। রসগোল্লা, সন্দেশ, ক্ষীরমোহন, রাজভোগ, লেডিকেনি, সীতাভোগ, মিহিদানা, চমচম, দধি, পয়োধি। নতুন আর কী দেবার আছে?’
‘আছে, আছে মুকুজ্যেমশাই। সব বিভাগেই রিসার্চের প্রয়োজন আছে। দুব্বোঘাসের কচুরি খেয়েছেন?’
‘দুব্বোঘাসের কচুরি? জীবনে শুনিনি।’
‘দয়া করে আমার দোকানে একদিন পায়ের ধুলো দেবেন। দুব্বোর মতো খাদ্যগুণে ভরপুর জিনিস আর দুটো নেই। গোরুরা জানে। সেই দুব্বোকে আমি বাঙালির নোলায় ফেলেছি।’
‘নোলা শব্দটা পাল্টানো যায় না আশুবাবু?’
‘কেন বলুন তো? নোলা কি খুব খারাপ শব্দ। নোলা শব্দটা মনে হয় ইংরেজি নলেজ থেকে এসেছে।’
‘প্লিজ, আপনি আর ভাষাতত্ত্ব নাড়াচাড়া করবেন না। মিষ্টান্নতত্ত্বেই আপনার নলেজকে ধরে রাখুন। আজেবাজে কথা শুনলে আমার ভীষণ ইরিটেশন হয়। সারা গা লাল-লাল চাকা হয়ে ফুটে ওঠে।’
‘অ্যাঁ, সে কী? অ্যালারজি! ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে এক দাগ ওষুধ খেয়ে নিলেই তো সেরে যায়!’
‘খেয়ে দেখেছি। কিস্যু হয় না।’
‘কিসে সারে তা হলে?’
‘গোটা-দুই চড় কষাতে পারলেই সেরে যায়।’
‘তা হলে থাক, ভাষাতত্ত্ব না আলোচনা করাই ভালো। গায়ে লাল-লাল চাকা-চাকা হয়েছে।’
‘না, এখনও তেমন হয়নি।’
‘জয় গুরু!’
‘হ্যাঁ, জয় গুরু। আপনার ওই খাবার নিয়ে রিসার্চের কথা বলুন। শুনতে বেশ ভালো লাগছে।’
‘খেতে আরও ভালো লাগবে। কচুরিপানা দিয়ে একটা আইটেম বানিয়েছি। ক্ষীরকচুরি, অসাধারণ জিনিস। এক সপ্তাহ খেলে তিন কেজি ওজন বাড়বে। বাড়বেই বাড়বে। কেউ ঠেকাতে পারবে না।’
‘ওজন কমাবার কিছু নেই?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, কাগজের সন্দেশ।’
‘সে আবার কী?’
‘উঃ, সে এক অসাধারণ জিনিস। ছানার কোনও ব্যপার নেই। কাগজের মণ্ড চিনি দিয়ে ভালো করে পাক করে ছাঁচে ফেলে সন্দেশ। একটা খেয়ে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল চালিয়ে দিন। ধীরে ধীরে পেট ফুলতে শুরু করবে। এক সময় জয়ঢাক। বুকে আর পেট এক হয়ে যাবে। কম-সে-কম দু’দিন আর হাঁ করতে হবে না।’
‘বাঃ, বেশ ভালো জিনিস বানিয়েছেন তো!’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। একেবারে আমাদের দেশের উপযোগী। এই আক্রা-গণ্ডার বাজারে সংসার চালাতে প্রাণান্ত। যে বাড়ির দশ-বিশটা মুখ কেবল হাঁ-হাঁ করছে, সেখানে একটি করে এই সন্দেশ আর এক গেলাস কলের জল। দু-দিন সব ঠাণ্ডা।’
‘খেতে কেমন হয়েছে?’
‘অতি সুস্বাদু। একটা খেলে আর একটা খেতে ইচ্ছে করবে, তবে দুটো না খাওয়াই ভালো।’
‘এক-একটার দাম কত?’
‘মাত্র এক টাকা।’
বড়মামা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন আর সেই হাসিই হল সর্বনাশের কারণ। স্টিয়ারিং বাঁ দিকে বেমক্কা মোচড় খেল। গাড়ির সামনের বাঁ দিকের চাকা গোঁত করে পড়ে গেল পথের পাশের খানায়। স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। বেশ বড় রকমের ম্যাজিক দেখাবার পর ম্যাজিশিয়ান দুটো হাত যেভাবে আকাশের দিকে তোলেন, বড়মামা সেই ভাবে হাত দুটো ওপরের দিকে তুলে চুপ করে বসে রইলেন।
আশুবাবু জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিয়ে বললেন, ‘কী হল স্যার?’
বড়মামা হালকা সুরে বললেন, ‘অধঃপতন, পদস্খলনও বলা চলে।’
মাসিমা বললেন, ‘এবার তা হলে কী হবে?’
বড়মামা বললেন, ‘কিছুই না। কী আবার হবে। স্টার্ট তো অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেছে। আমার গাড়ি কত ভদ্র দেখেছিস কুসি! যেই দেখলে ভুল পা পড়েছে, অমনি চলা বন্ধ হয়ে গেল। একেই বলে জেণ্টলম্যান।’
মেজোমামা বললেন, ‘তোমার লেকচার বন্ধ করে গাড়িটা ব্যাক করে তোলার চেষ্টা করো।’
‘অতই যদি সোজা হত ব্রাদার! এ তো আর মানুষ নয়, এ হল গাড়ি। পতন আছে, উত্থান নেই।’
‘তুমি এখন তা হলে কী করবে?’
‘তোমাদের সকলকে নামাব। তারপর ঠেলে তোলাব।’
‘আমরা একটা সভা করতে যাচ্ছি। আমি হলুম গিয়ে সেই সভার সভাপতি। সভাপতি গাড়ি ঠেলবে?’
‘কেন, যে রাঁধে সে চুল বাঁধে না! তুমিই না থেকে থেকে বলো, সেলফ হেলপ ইজ বেস্ট হেলপ। নাও, মেজাজ খারাপ না করে লক্ষ্মী ছেলের মতো আশুবাবুকে নিয়ে নেমে পড়ো। কিছুই না, একটু পেছন দিকে ঠেলে দিলেই রাস্তা উঠে পড়বে।’
‘আর তুমি কী করবে?’
‘আমাকে তো স্টিয়ারিং-এ বসতেই হবে ভাই। আমি যে কাণ্ডারী।’
‘এমন জানলে তোমার গাড়িতে কে উঠত বড়দা! তোমার মতো এমন ব্যাড ড্রাইভার কী করে লাইসেন্স পেল কে জানে! ঘুষের খেলা।’
‘আমি খুব একটা খারাপ ড্রাইভার নই ব্রাদার। আশুবাবুর হাজারখানেক কৌটো গাড়িকে বেটাল করেছে। গাড়ি কাত হওয়ামাত্রই গড়িয়ে ডান দিকে বাঁ দিকে চলে গেছে। দোষ আমার নয়, দোষ গাড়ির নয়, দোষ হল কৌটোর। আর দোষ হল তাদের, যারা পথের পাশে গাড়ি ধরার জন্যে নর্দমা পেতে রাখে।’
পেছনের আসন থেকে মেজোমামা, আশুবাবু নেমে পড়লেন। মেজোমামা সমানে গজগজ করে চলেছেন। আশুবাবুর মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। এমন মুখ দেখলে তবেই মনে হয়, জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।
মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘আমি ঠেলব বড়দা?’
‘না, তোকে আর ঠেলতে হবে না, তুই নেমে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা পরিচালনা কর। তোর ভূমিকা হল, ডিরেকটার অপারেশন।’
সামনের আসন থেকে আমিও নেমে পড়লুম। আমাকেও তো একটা কিছু করতে হয়। সামনের দিক থেকে ঠেলেঠুলে গাড়িটাকে পেছোতে হবে। একটা পাশ নর্দমায় ভেতরে গেছে। ডানপাশ উঁচু হয়ে আছে। মেজোমামা দেখেশুনে বললেন, ‘অসম্ভর ব্যাপার। ইমপসিবল। সামনে দাঁড়াবার জায়গা নেই। ঠেলব কী করে?
আশুবাবু বললেন, ‘অসম্ভব বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। সবই সম্ভব। ইচ্ছে থাকলেই উপায় বেরোবে।’
‘আমার ইচ্ছেও নেই, উপায়ও দেখতে পাচ্ছি না। আপনি তাহলে একাই ঠেলুন। অনেক রকম মিষ্টির ফিরিস্তি তো শোনালেন, সে সব নিজেও নিশ্চয় খেয়েছেন। ভেতরে অনেক হর্স-পাওয়ার জমা হয়েছে। আজ তার পরীক্ষা হয়ে যাক।’
আশুবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘তবে তাই হোক। আমি এক হাতে পেছনের বাম্পার ধরে টেনে তুলে দোব। এটা গাড়ির ওজন আর কত হবে? বিশ-বাইশ মণ!’
‘আমি আমার ওজন জানি মশাই। গাড়ির ওজন জানা নেই।’
‘ওই বিশ-বাইশ মণই হবে।’
আশুবাবু ঘুরে পেছনের দিকে চলে গেলেন। আজ আশুবাবুর কপালে গভীর দুঃখ লেখা আছে। ব্যায়ামবীরের কাজ কী সাধারণ মানুষে পারে? হেরে ভূত হয়ে যাবেন। আর মেজোমামা তালি বাজাবেন।
আশুবাবু প্রথমে মালকোঁচা মেরে নিলেন। তারপর চোখ বুজে হাত জোড় করে নমস্কার করতে করতে বললেন, ‘জয় মহাবীরজি কি জয়!’
চোখ খুলে বললেন, ‘আপনার সেই মন্ত্রটা সমস্বরে, তালে তালে, সুর করে পড়তে পারবেন?’
মেজোমামা বললেন, ‘কোনটা?’
‘ওই যে, সেই শক্তিসঞ্চারী মন্ত্র, ঘাস-বিচুলি হেঁইও, আউর থোড়া হেঁইও, বয়লট ফাটে হেঁইও।’
‘ওসব আমার দ্বারা হবে না।’
‘খোকাবাবু, তুমি পারবে?’
খোকাবাবু বলায় ভীষণ রাগ হলেও বললুম, ‘হ্যাঁ পারব!’
‘দেন স্টার্ট।’
‘ঘাস-বিচুলি হেঁইও, আউর থোড়া হেঁইও, বয়লট ফাটে হেঁইও।’
আশুবাবু ডান হাত বাম্পারে, বাঁ হাত কোমরে। ধীরে ধীরে টানছেন। গাড়ি দুলছে ‘আউর থোড়া হেঁইও, বয়লট ফাটে হেঁইও।’ ভদ্রলোকের মুখ জবাফুলের মতো লাল হয়ে উঠেছে। গলার শিরা ফুটে উঠেছে।
হঠাৎ কী হল কে জানে! বড়মামার গাড়ি ঘোঁত ঘোঁত করে দু’বার শব্দ করে উঠল। সামনের চাকা দুটো ফরর ফরর করে দুবার ঘুরে গেল অকারণে। একই সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটে গেল। চরকির মতো নর্দমার থকথকে কাদা ছিটকে উঠে মেজোমামাকে স্প্রে-পেণ্ট করে দিলে। সাদা-জামা কাপড় আর সাদা রইল না। হরিণের মতো চাকা-চাকা কালো দাগ সারা শরীরে। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। ফর্সা মুখে খাড়া উঁচু নাক। চোখে ব্রহ্মতেজ। পারলে গাড়িটাকে ভস্ম করে দেন। ওদিকে গাড়িটা ঝিঁকি মেরে হাতখানেক পেছিয়ে গেছে। আচমকা। আশুবাবু উলটে পড়ে আছেন মাটিতে। করুণ সুরে বলছেন, ‘আর করব না কক্ষনো করব না। দোহাই মহাবীর, মাপ করো মহাবীর।’ মাসিমা গাড়ির আড়ালে ছিলেন বলে বেঁচে গেছেন ছেটকানো কাদার হাত থেকে। মাসিমা ছুটে গিয়ে আশুবাবুকে ভূমিশয্যা থেকে টেনে তুললেন। গাড়ি অবশ্য দুধাপ পেছিয়ে থেমে পড়েছে। নর্দমা থেকে চাকাও উঠে পড়েছে।
‘জয় মহাবীরের জয়’ বলতে বলতে আশুবাবু উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঠেকিয়ে আবার প্রণাম করলেন। মেজোমামা ধীরে ধীরে বড়মামার দিকে এগোতে লাগলেন। দাঁত কিড়িমিড়ি করছে।
‘এটা কী হল বড়দা?’
বড়মামা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোকে অসাধারণ দেখাচ্ছে রে! অনেকটা ভালমেশিয়ানের মতো, সাদার ওপর কালোর স্পষ্ট।’
‘তোমার রসিকতা রাখো। এটা কী করলে তুমি?’
‘আমি কেন করব রে বোকা। করেছে আমার গাড়ি।’
সাইকেলে রাগী-রাগী চেহারার এক ভদ্রলোক আসছিলেন। হঠাৎ থেমে পড়ে বললেন, ‘কী হল, কী? ভিড়িয়ে দিয়েছে বুঝি! বেশ ভালো করে চাবকে দিন মশাই। হাতে স্টিয়ারিং পড়লে কাপ্তেনদের আর জ্ঞান থাকে না।’
আশুবাবু বললেন, ‘আরে না না, এ আমাদের নিজেদের ব্যাপার। আপনি যেখানে যাচ্ছেন যান। মাথা গরম করবেন না।’
‘অ; তাই নাকি, সেমসাইড হয়ে গেছে!’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বড় ভাই আর মেজো ভাইয়ে হচ্ছে। এখুনি মিটমাট হয়ে যাবে।’
‘অ, ভাইয়ে ভাইয়ে হচ্ছে। সহজে মিটমাট হয়ে যাবে ভেবেছেন? কোথায় আছেন আপনি? কোর্ট অবদি গড়াবে। বছরের পর বছর চলবে। ভিটেতে পাঁচিল পড়বে। গাড়ির নাট-বল্টু খুলে খুলে ভাগাভাগি হবে। আছেন কোথায় মশাই? শোনেননি, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই।’
মেজোমামা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ধ্যার মশাই। বাজে কথা না বলে যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যান। বাঙালির স্বভাবই হল সব ব্যাপারে না গলানো।’
ভদ্রলোক তড়াক করে সাইকেল থেকে নেমে পড়লেন, ‘কী হল? কথাটা কী হল? খুব মেজাজ লিচ্ছেন মনে হচ্ছে। প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে খুব বড়ছোট কথা হচ্ছে? জানেন আমি কে?’
মেজোমামা রাগের মাথায় বলে ফেললেন, ‘জানি জানি, লাটসাহেবের নাতি।’
‘মুখ সামলে। খুব সাবধান।’
‘আরে মশাই যান, সব করবেন আপনি!’
‘দেখবেন তা হলে?’
‘হ্যাঁ দেখব।’
বড়মামা নেমে এলেন, ‘কী হচ্ছে কী? তিল থেকে তাল।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘তিল মানে? এটা তাল। তালকে আমি তাল-তাল করে ছাড়ব।’
আশুবাবু দু’ধাপ এগিয়ে এসে বললেন, ‘নাঃ, আর সহ্য হচ্ছে না। এবার একটু হাত লাগাতে ইচ্ছে করছে।’
বড়মামা বুদ্ধদেবের মতো হাত তুলে আশুবাবুকে থামিয়ে বললেন, ‘মুখটা খুব চেনা-চেনা মনে হচ্ছে! হ্যাঁ, চেনাই তো! তোমার নাম সরোজ মাইতি না! আজ থেকে বছর-তিনেক আগে মাঝরাতে তোমার অ্যাপেনডিক্স ফাটো-ফাটো হয়েছিল, মনে পড়ে? তোমার মা এসে কেঁদে পড়েছিলেন। সেই রাতেই তোমাকে অপারেশান করেছিলুম। অপারেশান না করলে মরে ভূত হয়ে যেতে এত দিনে! অপারেশনের ফি-টা অবশ্য এখনও বাকি আছে! তোমার বোলচাল তো বেশ ফুটেছে কার্তিক!’
লোকটি কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। মুখে আর কথা সরছে না। নাকি সুরে বললে, ‘কে, ডাক্তারবাবু? চিনতে পারিনি স্যার। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আছেন তো, চেহারাটা কেমন যেন পালটে গেছে। ক্ষমা করবেন স্যার। বড় কষ্টে আছি।’
‘কষ্টে কেন?’
‘ব্যবসাটা লাটে উঠে গেল স্যার।’
‘কী ব্যবসা ছিল তোমার?’
‘আজ্ঞে, তেলেভাজার দোকান।’
‘তেলেভাজা! আহা, বড় ভালো জিনিস। একেবারে উঠে গেল! একটুও নেই?’
‘আজ্ঞে না। এমনকি উনুনটাও ভেঙে গেছে।’
‘উনুনটা ভাঙলে কী করে?’
‘পাওনাদারে লাথি মেরে ভেঙে দিয়ে গেছে।’
‘দোকানঘরটা আছে?’
‘তা আছে। তালাবন্ধ পড়ে আছে।’
‘কী কী তেলেভাজা হত? আলুর চপ হত?’
‘ওইটাই তো আমার স্পেশাল আইটেম ছিল স্যার। বনগাঁ, বসিরহাট থেকেও খদ্দের আসত গাড়ি চেপে কার্তিকের লড়াইয়ের চপ খেতে!’
‘লড়াইয়ের চপ! বলো কী? লড়াইয়ের চপ! কত টাকা হলে আবার দোকানটা চালু করা যায়?’
মাসিমা বড়মামার হাত খামচে ধরলেন। বড়মামা ঝটকা মেরে মাসিমার হাত সরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘বেড়ালের মতো আঁচড়াচ্ছিস কেন কুসি? খিদে পেয়েছে?’
মাসিমা ফিসফিস করে বললেন, ‘আবার টাকা পয়সার মধ্যে ঢুকছে কেন বড়দা?’
কার্তিকবাবু শুনতে পেয়েছেন ঠিক, বললেন, ‘ওঁর যে দয়ার শরীর দিদি। দু’হাতে যেমন রোজগার করছেন, দু’হাতে তেমনি গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়েও যাচ্ছেন। জানেন যে, যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে।’
আশুবাবু বললেন, ‘আরে মূর্খ, সেটা টাকা নয়, বিদ্যে। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে।’
‘মূর্খ আপনি।’
‘আবার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। এ দেখি ধরলে চিঁ চিঁ করে। ছেড়ে দিলে তুড়ি লাফ মারে!’
বড়মামা বললেন, ‘আহা বেচারার মাথার ঠিক নেই। হ্যাঁ, কত টাকা হলে দোকান আবার চালু করা যায়?’
‘সে অনেক টাকা বড়বাবু। অত টাকা কি আপনি দিতে পারবেন? আপনি দিতে চাইলেও এঁরা কি দিতে দেবেন? হাত চেপে ধরবেন।’
ইলেকট্রিক শখ খেলে যেমন হয়, বড়মামা চমকে উঠলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আমার টাকা, আমি তোমাকে দোব, কে তাতে বাধা দেবে! হু আর দে! তুমি, আমি আর আমাদের তেলেভাজার দোকান। বলো কত টাকা?’
‘আজ্ঞে তা প্রায় হাজার-তিনেক টাকা। হাজার খানেকের মতো দেনা আছে। একটা বড় কড়াই কিনতে হবে। উনুনটাকে ফের বানাতে হবে। তারপর তেল, ব্যাসন, আলু, বেগুন।’
‘বেগুন? বেগুন কী হবে? তুমি তো বানাবে আলুর চপ!’
‘আজ্ঞে স্যার, বেগুনী ছাড়া তেলেভাজার দোকান জমে না।’
‘না, না, বেগুন-ফেগুন চলবে না। বেগুনে আমার অ্যালার্জি আছে।’
‘আপনার অ্যালার্জি থাকলে কী হবে স্যার। চিরকাল লোকে চেয়ে আসছে, আলুর চপ, বেগুনি।’
আশুবাবু বললেন, ‘লাইই ব্রেড অ্যাণ্ড বাটার, মিল্ক অ্যাণ্ড হানি, রো অ্যাণ্ড থর্ন, সাবজেক্ট অ্যাণ্ড প্রেডিকেট।’
বড়মামা বুদ্ধদেবের মতো হাত তুলে বললেন, ‘ব্যাস, ব্যাস, হয়েছে, হয়েছে। বেগুনি হলে আমি একটা ফার্দিংও দোব না। আমি হলুম গিয়ে এক কথার মানুষ। বেগুনের গুণ নেই।’
‘তা হলে স্যার পটুলি কি কুমড়ি?’
‘হ্যাঁ, তা চলতে পারে। এমনকি ফুলুরিও অ্যালাউড।’
আশুবাবু বললেন, ‘ফুলুরি খুব টেস্টফুল, তবে কিনা উচ্চারণটা বড় গোলমেলে। মাঝে মাঝে ফুরুলি বেরিয়ে যায়। যেমন বাতাসটা মাঝে মাঝেই বাতাসা হয়ে যায়। যেমন পুঁটি মাছ। সেদিনও বাজারে গিয়ে কিছুতেই আর মুখ দিয়ে বেরোল না, কেবলই বলি পুঁচি মাট। যেমন ফুলে ঢোল। হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় ঢুলে ফোন! যেমন হাউসফুল আর হাউল ফুস। কী যে সব ডেনজারাস ডেনজারাস মুশকিলের ব্যাপার।’
মেজোমামা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে ছিলেন। এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ধ্যাত তেরি কা। পাগলের পাল্লায় পড়ে জীবনটা গেল। চল কুসি, আমরা চলে যাই।’
‘আমি তো যাবার জন্যে পা বাড়িয়েই আছি। শুনলে না, একটু আগেই বলেছে, হু আর দে।’
‘ঠিক ঠিক। আমরা হলুম গিয়ে ঠ্যালার লোক। নর্দমায় গাড়ি পড়লে ঠেলে তুলে দিতে হবে।’
বড়মামা একগাল হেসে দু’জনের দিকে তাকালেন। ‘কেন রাগ করছিস পাগল? ইউনাইটেড উই স্ট্যাণ্ড। দেখলি না সকলের চেষ্টায় গাড়ি কেমন গাড্ডা থেকে উঠে পড়ল। গাড়ির শিক্ষা আমাদের জীবনের শিক্ষা। ঐকতান মাস্টার, ঐকতান। অনৈকতানে বাঙালি জাতটাই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে।’
‘তোমার লজ্জা করে না বড়দা, এই কাদামাখা অবস্থায় আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছো! লোকে কী ভাবছে?’
‘লোকভয়! এখনও এই বয়েসে তোর লোকভয়! অশ্বিনী দত্ত মশাইয়ের লেখাটা আর-একবার পড়িস। জীবনে জ্ঞানের আলো ফেল পাগলা, জ্ঞানের আলো ফেল। নে, গাড়িতে উঠে পড়। ওখানে গিয়ে তোর জামাকাপড় পালটে দোব। তোরটা আমি পরব, আমারটা তুই পরবি।’
‘আহা! কী কথাই বললে! তুমি আমার চেয়ে আধহাত লম্বা। তোমার পাঞ্জাবি তো আমার গায়ে লটরপটর করবে।’
‘হাতার বাড়তি অংশটা কাঁচি দিয়ে ছেঁটে দেব। লোকে বলে হাতে পাঁজি মঙ্গলবার, আমি বলি হাতে কাঁচি হাতা লটরপটর। নে, উঠে পড়। অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেল। টাইম ইজ মানি।’
‘তোমাকে দেখে তা মনে হয় না বড়দা। তোমার কাছে টাইম ইজ গানি।’
‘তার মানে? গানি মানে কী?’
‘গানি হল চট। তোমার কাছে সময় হল চটের মতোই মূল্যহীন।’
‘ওরে পাগলা, চটের দাম জানিস? জানলে আর মানির সঙ্গে গানি মেলাতিস না। চট সায়েবদের দেশে চালান যায়।’
বড়মামা বীরের মতো স্টিয়ারিং-এ বসলেন। আমরা সুড়সুড় করে যে যার আসনে। মাসিমা সিঁটিয়ে বসেছেন মেজোমামার স্পর্শ বাঁচিয়ে।
মেজোমামা বললেন, ‘তুই অমন সিঁটিয়ে আছিস কেন কুসি?’
‘তুমি নর্দমা ছুঁয়েছ মেজদা। গায়ে গঙ্গাজল না ছিটোলে শুদ্ধ হবে না।’
‘অ, তাই নাকি? অদ্ভুত বিচার!’
‘ছোঁয়াছুঁয়ি মানতে হয় মেজদা। তুমি এখন অপবিত্র।’
‘আমি না তোর মেজদা!’
‘হতে পারো মেজদা, তবে অপবিত্র মেজদা।’
বড়মামা গাড়িতে স্টার্ট দেবার চেষ্টা করছেন। ঘুরর ঘুরর আওয়াজ হচ্ছে, গাড়ি মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে স্টার্ট কিন্তু ধরছে না। বড়মামা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন।
আশুবাবু বললেন, ‘কী হল, গড়বড় করছে মনে হচ্ছে?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে। সেলফটা কাজ করছে না। আমাদের মধ্যে কেউ একজন অপয়া আছে।’
পেছনের আসন থেকে তিনজনে সমস্বরে বললেন, ‘কে, কে, কে অপয়া?’
‘সেইটাই তো বুঝতে পারা যাচ্ছে না।’
আশুবাবু বললেন, ‘আমি অপয়া নই তো?’
মাসিমা বললেন, ‘অপয়াদের চেনার কোনও উপায় আছে? চেহারা দিয়ে বোঝা যায়?’
আশুবাবু বললেন, ‘যেমন ধরুন, আমি দৈর্ঘ্যে সামান্য খাটো, প্রস্থে একটু বিশাল, মুখটা কেমন?’
মেজোমামা বললেন, ‘গোল আলুর মতো। একটু লালচে রঙ।’
‘লালচে? বলেন কী, লালচে? তা হলে রক্ত। শরীরে রক্ত বেড়েছে।’
বড়মামা বললেন, ‘আনন্দের কিছু নেই। এই বয়েসে বেশি রক্ত ভালো নয়। হাই প্রেশারে মরবেন। মাথার মাঝখানে টাক আছে?’
মেজোমামা বললেন, ‘হ্যাঁ আছে। চিকচিক করছে।’
‘আমি কি তাহলে অপয়া?’
‘সকালে আপনার নাম করলে হাঁড়ি চড়া বন্ধ হয়? শুনেছেন কিছু?’
না, তেমনি অভিযোগ তো কানে আসেনি।
‘আচ্ছা আপনি একবার নেমে দাঁড়ান তো, দেখি স্টার্ট নেয় কি না!’
আশুবাবু নেমে দাঁড়ালেন। বড়মামার কেরামতি শুরু হ’ল সেলফ নিয়ে। কোথায় কী গাড়ি স্টার্ট নিল না। আশুবাবু বড়মামার পাশে সরে এসে বললেন, ‘কী মনে হচ্ছে, আমি কি তাহলে অপয়া?’
বড়মামা বললেন, মনে হচ্ছে না।’
‘তা হলে উঠে বসি ডাক্তারবাবু?’
‘আর উঠে কী হবে! এবার ঠেলতে হবে। ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে হবে। কতটাই বা পথ। বড় জোর এক মাইল!’
মেজোমামা বললেন, ‘আমি ঠেলতে পারব না। আমার ক্ষমতা নেই।’
‘ছিঃ মেজো। সবে মিলে করি কাজ, হারিজিতি নাহি লাজ। এটু হাত লাগাও ভাই। মানুষ তো চিরকালই গাড়ি চেপে এল, গাড়ির যদি একদিন মানুষ চাপার শখ হয় তাতে মেজাজ খারাপ করলে চলে? একদিনের তো মামলা রে ভাই। ইংরেজ হলে হাসিমুখে নেমে আসত, আমায় কিছু বলতে হত না।
‘আমি বাঙালি, ইংরেজ নই।’
‘তা বললে চলে? সব সময় ইংরেজির খই ফুটছে মুখে। নাও, নেমে পড়ো। দুর্গা বলে যাত্রা শুরু করা যাক। অনেক দেরি হয়ে গেল রে পাগলা!’
‘পাগলা বলে যতই আদর করো, গাড়ি আমি ঠেলছি না। দিস ইজ টু মাচ।’
‘এই তো ইংরিজি এসেছে, তার মানে ইংরেজ ভর করেছে। নাও, নেমে পড়ো। ঠেলতে শুরু করলেই দেখতে কী মজা! গাড়ি-ঠেলার যে কত আনন্দ! তখন থামতে বললেও আর থামতে ইচ্ছে করবে না। ঠেলে দ্যাখ, বয়েস তিরিশ বছর কমে যাবে।’
‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি বড়দা, জীবনে আর কোনও দিন তোমার গাড়িতে মরে গেলেও পা দেব না।’
‘ছিঃ, প্রতিজ্ঞা করতে নেই মেজো। বাঙালির প্রতিজ্ঞা জানিস তো মেজো, এই করে এই ভাঙে। কাচের বাসনের মতো। তিন দিন পরেই তোমার গাড়ির দরকার হবে ভাই। মনে নেই, হাওড়ায় যাবে। প্রফেসার চিদাম্বরম আসছেন সকাল আটটা দশ মিনিটে। নাও, নেমে পড়ো। একটু ব্যায়ামও হবে। শরীরটা দিন-দিন বেঢপ হয়ে যাচ্ছে।’
দু’পাশের দরজা খুলে পেছনের আসন থেকে তিনজন নেমে পড়লেন। তেলেভাজার-দোকান-ফেলে সরোজবাবু এগিয়ে এলেন, ‘আমিও একটু হাত লাগাই স্যার!’
মেজোমামা খ্যাঁক করে উঠলেন, ‘তুমি হাত না লাগালেও টাকা পাবে। এখন বুঝছি অপয়া কে? কাল সকালে উঠেই তোমার নাম করে দেখব, কপালে অন্ন জোটে কি না!’
‘ঠিক ধরেছেন স্যার। এতক্ষণ বলিনি কিছু, চুপচাপ ছিলুম। সবাই আমাকে অপয়া বলে। নাম করলে হাঁড়ি ফেটে যায়।’
বড়মামা সামনের আসন থেকে বললেন, ‘তুমি তাহলে ত্রিসীমানায় আর দয়া করে থেকো না। সরে পড়ো। আর সকালের দিকে দয়া করে বাড়িতে যেও না।’
সরোজ মাইতি সাইকেল নিয়ে সরে পড়লেন। ধীরে গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। আশুবাবু আর মেজোমামা প্রাণপণে ঠেলছেন। মাসিমা আসছেন পায়ে পায়ে ইন্দিরা গান্ধীর মতো গম্ভীর চালে। বড়মামা গান ধরেছেন :
মুক্তির মন্দির সোপান-তলে
কত প্রাণ হল বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে।
আমি বনেটে টুকুস টুকুস করে তাল বাজাচ্ছি। বেশ জমে গেছে ব্যাপারটা।
তিন
বিরাট সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। কুলতলি দুঃস্থা মহিলা সমিতি। হলদের ওপর কালো অক্ষরে লেখা। তলায় ছোট ছোট করে লেখা, ‘প্রতিষ্ঠাতা : ডাক্তার সুধাংশু মুখোপাধ্যায়’। ফুল দিয়ে সাজানো গেট। মোটা মোটা গাঁদার মালা ঝুলছে। একপাশে একটা বাছুর, আর একপাশে একটা ছাগল মনের সুখে চিবিয়ে যাচ্ছে। মাইকে স্তোত্র পাঠ হচ্ছে, যা দেবী সর্বভূতেষু। কিছুই তেমন বোঝা যাচ্ছে না। ক্যাড়ক্যাড় শব্দ হচ্ছে। গেটের ভেতরে মাঠে একদল মহিলা লালপাড় সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রত্যেকের হাতে শাঁখ।
বেশ স্বাস্থ্যবান এক ভদ্রলোক গাড়ি দেখে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এসে গেছেন, এসে গেছেন। স্টার্ট।’
সঙ্গে সঙ্গে শাঁখ বেজে উঠল। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। ভদ্রলোক দু’হাত তুলে বড়মামাকে জানালেন, ‘এইখানে স্যার, এইখানে স্যার। পার্ক করুন।’
সামনে থেকে বোঝার উপায় নেই, গাড়ি নিজের জোরে আসছে না, আসছে ঠেলার জোরে। গলদঘর্ম দুটি মানুষ লেগে আছে পেছনে।
বড়মামা চিৎকার করছেন, ‘স্টপ, স্টপ, নো মোর, নো মোর।’
ভদ্রলোক চিৎকার করছেন, ‘ব্রেক মারুন, ব্রেক মারুন।’
মেজোমামাদের ঠেলার নেশায় পেয়ে গেছে। মাথা নিচু। ঠেলছেন তো ঠেলছেন। গেট ছেঁচড়ে, মালাফালা ছিঁড়ে গাড়ি ভেতরে ঢুকে গেল। তবু থামার নাম নেই। মহিলারা দৌড়ে সমিতির রকে। শাঁখ কিন্তু থামেনি, সমানে বেজে চলেছ। আরও জোরে। যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হচ্ছে।
মাসিমা বলছেন, ‘ও মেজদা, থামো থামো।’
মেজোমামা বললেন, ‘আমি কি আর ঠেলছি। আমি তো শুরু থেকেই থেমে আছি। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চলেছি। ঠেলছেন আশুবাবু।’
মাসিমা বললেন, ‘আশুবাবুকে থামতে বলো।’
‘নিজের ইচ্ছেয় আর থামেন কী করে! উনি তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। নাক ডাকছে আর গাড়ি না থামলে আমি সোজা হই কী করে! মুখ থুবড়ে পড়ে যাব যে!’
সমিতির উঁচু রকে গাড়ি গিয়ে ঠেকল। মেয়েরা চিৎকার করে উঠল, ‘যাঃ, রকটা বোধহয় ভেঙে গেল!’ ভাঙল না, একটা কোণ শুধু থেঁতলে গেল। গাড়ি থেমেছে। মেজোমামা সোজা হলেন। আশুবাবু গাড়ির গায়ে ঢলে পড়লেন। গভীর ঘুম। ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকছে। বড়মামা হাসিমুখে নেমে এলেন, ‘এই যে আমার মেজোভাই। অধ্যাপক শান্তি মুখোপাধ্যায়। আপনাদের স্প্রে পেন্ট করা সভাপতি। আশুবাবু কোথায় গেলেন? আমাদের এক নম্বর পেট্রন। কোথায় তিনি?’
‘তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।’
‘সে কী, বিছানা পেলেন কোথায়?’
‘বিছানার দরকার হয়নি। গাড়ির পেছনে শুয়ে পড়ছেন।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। পরিশ্রম হয়েছে। একটু বিশ্রাম করে নিক।’
আশুবাবু ঠিক এই সময় স্বপ্ন দেখে ডুকরে উঠলেন, ‘মা মা, আমি কোথায়।’
মাসিমা বললেন, ‘খুব হয়েছে, এবার উঠে পড়ুন।’
‘অ্যাঁ, ভোর হয়ে গেছে! চা হয়ে গেছে!’ ভদ্রলোক তড়বড় করে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলেন।
‘আরে মশাই, ওদিকে চললেন কোথায়?’
‘যাই, দাঁতটা মেজে আসি।’
বড়মামা হাত চেপে ধরলেন, ‘ধ্যাত মশাই, চোখ মেলে দেখুন কোথায় আছেন।’
কথা শেষ হতে না-হতেই শাঁখ বেজে উঠল।
ফট ফট করে গোটা দশ-বারো পটকা ফাটল। আশুবাবু বললেন, ‘কী রে বাবা, কালীপুজো শুরু হয়ে গেল নাকি?’
রকের একধারে মঞ্চ তৈরি হয়েছে। বড় বড় চেয়ার। লম্বা একটি টেবিল। সাদা টেবিল ক্লথ। বড় দুটো ফুলদানি। নানা রঙের ফুল। পেছনে সাদা কাপড় ঝুলছে। তার ওপর বাসন্তী-রঙে সমিতির নাম। তার তলায় লেখা, প্রথম প্রতিষ্ঠা-বার্ষিকী। বড়মামা বলতে লাগলেন, ‘আহা, কী আয়োজন! একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে। সুহাস একেবারে সুযোগ্য সেক্রেটারি…।’
বাকি কথা আর শোনা গেল না। মাইক ঘ্যাড়ঘ্যাড় করে উঠল, ‘হ্যালো, হ্যালো টেস্টিং। ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর।’
সুহাসবাবু বড়মামার কানে কানে কী বললেন। বড়মামা বললেন, ‘কোথায় সে, কোথায় সে?’
‘আজ্ঞে পেছন দিকের ঘরে বসে আছে।’
‘চলো, চলো, কী বিপদ, কী বিপদ!’
পেছনের ঘরে এক মহিলাকে ঘিরে আরও অনেক মহিলা বসে আছেন। সকলেই বলছেন, ‘একটু খোলার চেষ্টা করো। নীচেরটা নীচের দিকে ওপরেরটা ওপরের দিকে, জোরে ঠেলো না। অমন করে বসে থাকলে চলে!’
মাসিমা দু’পা সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘কী হয়েচে, কী হয়েচে?’
‘দাঁতে দাঁত লেগে গেছে।’
‘মৃগী আছে বুঝি?’
সুহাস বললেন, ‘আজ্ঞে মৃগী নয় দিদিমনি। ক্যাণ্ডি-ফ্লস টেস্ট করতে গিয়ে দাঁতকপাটি লেগে গেছে।’
‘সে আবার কী? ক্যাণ্ডি-ফ্লস জিনিসটা কী?’
‘দেখবেন? আমাদের তৈরি।’ কাঁচের বয়াম থেকে ভদ্রলোক পাতলা কাগজে মোড়া চৌকোমতে কী একটা বের করে মাসিমার হাতে দিলেন।
‘এ তো লজেনসি দেখছি।’
‘আজ্ঞে ঠিক লজেনস নয়। লজেনস কড়মড় করে চিবিয়ে খাওয়া যায়। এ জিনিস আঠা-আঠা, চটচটে। সর্বক্ষণ চুষতে হবে। দাঁত দিয়ে কেরামতি করতে গেলেই ওপর পাটি, নীচের পাটি জুড়ে যাবে, ওই সীমার যেমন হয়েছে।’
‘ট্রাই করে দেখব?’
চারপাশ থেকে সমস্বরে আর্তনাদের মতো শোনা গেল, ‘না, না, খবরদার না। এখুনি আটকে যাবে।’
‘কী এমন জিনিস মশাই, দাঁতে ভাঙা যায় না!’ আশুবাবু মাসিমার হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। ‘এ কী গীতার সেই আত্মপুরুষ। অস্ত্রে ছেদন করা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না, জলে গলে না! কী করে বানালেন এমন জিনিস?’
‘করতে, করতে হয়ে গেছে। তেমন কিছু চেষ্টার দরকার হয়নি। এটা মুখে ফেললে এক মাস কেন, মনে হয় সারা জীবন চলে যাবে!’
‘ভালো করে প্রচার করুন। এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার!’
সুহাসবাবু সবিনয়ে বললেন, ‘সবই তাঁর ইচ্ছা। মানুষ নিমিত্তমাত্র।’
বড়মামা হাঁটু মুড়ে মহিলার পাশে বসেছেন। চামচ এসেছে নানা মাপের। সাহায্য করার জন্যে তিন-চার জন হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। বড়, ছোট সব চামচেই ব্যর্থ হল। দাঁতকপাটি খোলা গেল না। বড়মামার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। চারপাশে তাকিয়ে বললেন, খুন্তি লে আও।’
‘খুন্তি। যে খুন্তি দিয়ে বেগুন ভাজে?’
চারজন চার দিকে ছুটলেন। বড় ছোট চার-পাঁচ রকমের খুন্তি এসে গেল। বড়মামা বললেন, ‘শুইয়ে দাও।’
আশুবাবু বললেন, ‘এখানে সবই দেখছি না-খোলার কেস। কৌটোর ঢাকনা খোলে না, দাঁত থেকে দাঁত খোলে না।’
‘আপনি চুপ করুন।’ মেজোমামা ধমকে উঠলেন।
রুগিকে চার-পাঁচজনে শুইয়ে ফেললেন। মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘এবার তোমার কায়দাটা কী হবে শুনি বড়দা?’
‘ভেরি সিম্পল। ঝিনুকের মুখ ফাঁক করে যেভাবে মুক্তো বের করে আনে সেই কায়দায়…।’
‘সেই কায়দায়? ইনি মানুষ। সামুদ্রিক ঝিনুক নন। ঠোঁট দুটো আস্ত থাকবে?’
‘তা হলে কী করব? এমন কেস তো জীবনে আমার হাতে আসেনি!’
মাসিমা বললেন, ‘একটু মোটা সুতো আর মোম আছে।’
সুহাসবাবু বললেন, ‘অবশ্য আছে, অবশ্য আছে।’
মোম আর সুতো এসে গেল। বড়মামাকে সরিয়ে দিয়ে মাসিমা চিকিৎসায় লেগে গেলেন। প্রথমে মোটা সুতো জলে ভিজিয়ে দু’সার দাঁতের ফাঁকে ধরে ধীরে ধীরে ঘষতে লাগলেন। সকলে হাঁ করে দেখছেন। বড়মামা বলছেন, ‘জয় বাবা বিশ্বনাথ, খুলে দাও বাবা। হ্যাঁ রে, চিচিং ফাঁক বললে কোনও কাজ হবে?’
মাসিমা বললেন, ‘তুমি চুপ করো।’
বেশ কিছুক্ষণ কেরামতি চলার পর ভদ্রমহিলার দাঁত খুলে গেল। সকলে আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, ‘খুল গিয়া, খুল গিয়া।’
মাসিমা দ্রুত হাতে মোমের টুকরোটা দু দাঁতের ফাঁকে গুঁজে দিলেন।
বড়মামা বললেন, ‘ও আবার কী হল?’
‘দাঁতে দাঁত ঠেকলেই আবার জুড়ে যাবে। যে সাংঘাতিক জিনিস তৈরি করেছ! যে কটা আছে সব গঙ্গাজলে ফেলে দিয়ে এসো।’
সুহাসবাবু বললেন, ‘এঁকে সারা জীবনই কি তাহলে মোমের টুকরো দাঁতে দিয়ে ঘুরতে হবে?’
‘তা কেন? এইবার বেশ করে ছাই দিয়ে দাঁত মেজে আসুন। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
বড়মামা বললেন, ‘কুসি, তোর এই চিকিৎসাটা মেডিকেল জার্নালে প্রকাশ করতে হবে।’
‘থাক, এমন ঘটনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার ঘটবে বলে মনে হয় না।’
মেজোমামা বললেন, ‘এইবার আমার একটা ব্যবস্থা করো। এই কাদামাখা জামা পরে সভাসমিতি করা যায়?’
বড়মামা চনমন করে উঠলেন, ‘ঠিক ঠিক। এক কাজ কর, তুই আমার এই ধুতি-পাঞ্জাবিটা পর।’
‘আবার তোমার সেই এক কথা। তোমার জামা আমার গায়ে বড় হবে।’
বড়মামা সুহাসবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চুন আছে, চুন?’
‘চুন কী করবেন ডাক্তারবাবু?’
‘হোয়াইট ওয়াশ। দেয়াল যদি চুনকাম করা যায়, ধুতি-পাঞ্জাবি কেন করা যাবে না। আলবাদ যাবে।’
মেজোমামা বললেন, ‘থাক বড়দা, খুব হয়েছে। তোমার চিকিৎসা যেমন উদ্ভট, পরিকল্পনাও তেমনি উদ্ভট। আমি আর সভাপতি হতে চাই না। যা পারো তাই করো।’
বড়মামা বললেন, ‘তা বললে চলে রে পাগলা! এই সভার প্রধান আকর্ষণ তো তুই। তোর ওই কাতলা মাছের মতো মাথা থেকেই তো পথের নির্দেশ বেরোবে। তোর যা মাথা, একদিন তুই এম.এল.এ. হবি। এম.এল.এ. থেকে মন্ত্রী। তখন আমাদের জোর কত বেড়ে যাবে।’
মেজোমামা বললেন, ‘আমার মাথায় সাংঘাতিক এক আইডিয়া এসেছে বড়দা।’
‘আসবেই তো, আসবেই তো, তুই যে আমারই ভাই। আমার মাথাটা দেখেছিস, আইডিয়ার পিন-কুশন। বল তোর কী আইডিয়া?’
‘কাপড়ের কাদামাখা অংশটা তো টেবিলের তলায় থাকবে, কেউ দেখতে পাবে না। সমস্যা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিটা উলটে পরলেই সব সমস্যার সমাধান। কী বলো?’
‘বাহা, বাহা, একেই বলে মাথা। কার মাথা দেখতে হবে তো! আমার ভাইয়ের মাথা। এ-সব মাথা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখতে হয়।’
‘তা হলে পরে ফেলি সেইভাবে?’
‘অবশ্যই, অবশ্যই। আর দেরি নয়।’
মেজোমামা সমস্যা সমাধানের আনন্দে গান গেয়ে উঠলেন, ‘আমার আর হবে না দেরি, আমি শুনেছি ওই ভেরি।’
মাসিমা বললেন, ‘পাগলামির একটা সীমা আছে, বুঝলে? যা বাড়িতে চলে, তা সভায় চলে না। উলটো পাঞ্জাবির পকেট দুটো দু’পাশে জপের মালার ঝুলির মতো ঝুলবে, কী সুন্দর দেখাবে, তাই না!’
বড়মামা দরাজ হেসে বললেন, ‘ডাক্তারের কাছে ওটা কোনও সমস্যাই নয়। অ্যাম্পুটেট করে দোব। পরিষ্কার অস্ত্রোপচার। কাঁচি দিয়ে কুচকুচ করে ছেঁটে ফেলে দোব।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ছেঁটে ফেলে দাও। ও তো একটা কাঁচির ব্যাপার।’ কথা বলতে বলতে মেজোমামা পাঞ্জাবিটা উলটো করে পেরে ফেললেন। তারপর বোতাম আটকাতে গিয়ে গভীর চিন্তায় মাথা নিচু হয়ে গেল, ‘দাদা বোতাম!’
‘বোতাম?’
‘হ্যাঁ গো, বোতাম লাগাব কী করে?’
‘কেন? যেভাবে সবাই লাগায়! বোতাম ঘরের মধ্যে খুস করে বোতাম ঢুকিয়ে দিবি।’
‘তুমি একেবারে গবেট হয়ে গেছ দাদা।’
‘কেন, কেন? জানিস আমি ডাক্তার, তোর মতো ছেলেঠ্যাঙানো অধ্যাপক নই!’
‘ওই রুগি-মারা ডাক্তারিটাই জানো, উলটো জামায় বোতাম লাগাবার কিস্যুই জানো না। বোতাম আর ঘর দুটোই যে ভেতর দিকে চলে গেছে। বুকে খোঁচা মারছে।’
‘মারছে মারুক। সহ্য করো। সবই কি আর সুখের হয় ভাই রে! জীবন দুঃখময়। যে কারণে রাজার ছেলে গৌতম সংসার ছেড়ে বুদ্ধ হলেন।’
আমি গৌতমও নই, বুদ্ধও নই, বোতাম না লাগিয়ে বুক খোলা অবস্থায় অসভ্য ইয়ারের মতো সভায় যেতে পারব না। আমার এক মানসম্মান আছে।’
‘ওরে মূর্খ, সংস্কৃত জানিস! বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য, নির্বোধেস্তু কুতঃ বলং! চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়। ভাগ্নে আমার হামা দিয়ে পাঞ্জাবির ভেতর ঢুকে বোতাম লাগিয়ে দিক। ভেরি সিম্পল, ভেরি সিম্পল।’
‘তা কী করে হয়?’
‘খুব হয় রে ভাই, খুব হয়। গাড়ি কী করে মেরামত হয় দ্যাখোনি? মিস্ত্রি তলায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ে, তারপর ওপর দিকে তাকিয়ে খুটুস খুটুস করে তারমার জুড়েজাড়ে দেয়।’
মেজোমামা একটু চিন্তা করে বললেন, ‘তা হলে শুয়েই পড়ি।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুয়েই পড়ো। একেবারে চিত হয়ে শুয়ে পড়ো।’
মাসিমা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এইবার বললেন, ‘তোমরা বাড়ি চলো, বাড়ি চলো, তোমাদের আর সভা করে দরকার নেই, খুব হয়েছে।’
দু’জনে সমস্বরে বললেন, ‘বাড়ি চলে যাব? এ তুই কী বসছিস কুসি?’
সুহাসবাবু বললেন, ‘আমার একটা বিনীত নিবেদন আছে।’
‘বলে ফেলো, বলে ফেলো।’
‘খুব সহজ সমাধান আমার মাথায় এসেছে।’
‘এসেছে? এসেছে নাকি? নিবেদন করো, নিবেদন করো। নিবেদনমিদং।’
‘আমাদের তাঁত বিভাগ থেকে একটা সাদা চাদর নিয়ে আসি, সেইটি গায়ে দিয়ে…’
বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘সুহাস, তোমার আইনস্টাইন হওয়া উচিত ছিল। তুমি আলেকজেণ্ডার দি গ্রেট। তুমি চেঙ্গিজ খান।’
মেজোমামা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আঃ, উচ্চারণটা ঠিক করো বড়দা। চেঙ্গিজ নয়, জিঙ্গিজ।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সারা জীবন চেঙ্গিজ বলে এলুম। ম্যাট্রিক ইতিহাসে লেটার পেলুম। তুই এখন উচ্চারণ শেখাতে এলি! জানিস সায়েবরা আমার নাম কী ভাবে উচ্চারণ করে, সু-ড্যাংশু।’
‘করো, তাহলে ভুল উচ্চারণই করো। শেখালে যখন শিখবে না, অশিক্ষিতই থেকে যাও।’
দু’জনের ঝগড়া আর তেমন এগোল না। পাড় বসানো সুন্দর একটা সাদা চাদর এসে গেল। উলটো করে পরা পাঞ্জাবির ওপর চাদর ফেলে মেজোমামা হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘চলুন তাহলে শুরু করে দেওয়া যাক। এদিকে যত রাত হবে ওদিকে তত দিন হবে।’
মাসিমা বললেন, ‘তোমারও মাথাটা গেছে। কী বলতে কী যে বলছ? বলো, এদিকে যত দেরি হবে ওদিকে তত রাত হবে।’
বড়মামা বললেন, ‘তা হলে একটা গল্প শোন।’
‘এখন আর গল্প শোনার সময় নেই। তোমার গল্প ভীষণ বড় বড় হয়।’
‘এটা খুব ছোট। সত্যি ঘটনা কি না!’
‘কাল শোনা যাবে।’
‘না, আজই শুনতে হবে। তা না হলে এই সভা আমি হতে দোব না।’
মেজোমামা বললেন, ‘যাঃ-ব্বাবা। বেশ মজার লোক তো! নিজের সভা নিজেই পণ্ড করবে?’
‘আমার পাঁঠা আমি যেদিকে খুশি কাটতে পারি। ন্যাজেও পারি, মুণ্ডুতেও পারি।’
সহাসবাবু বললেন, ছোট্ট যখন শুনেই নিন না!’ ঝামেলা চুকে যাক।’
‘বেশ, বলো তাহলে।’
‘এক দিন সকালে চেম্বার বসে আছি।’
‘কত সকালে?’
সহাসবাবু মুচকি হেসে বললেন, ‘কেন বাগড়া দিচ্ছেন মেজোবাবু!’
‘আচ্ছা, আচ্ছা। তুমি বলে যাও।’
‘একটি ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললে, ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু, শিগগির চলুন, মা আবার ঢুলে ফোল হয়ে গেছে। বলেই বেরিয়ে চলে গেল। আমি হাঁ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটি ফিরে এল। সেই একই ভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে, ডাক্তারবাবু, ঢুলে ফোল নয়, ফুলে ঢোল! ছুটতে ছুটতে চলে গেল।’
বড়মামা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘কই, তোমরা হাসলে না?’
‘হাসব কেন? এটা একটা গল্প হল?’
‘গল্প হল না! তা হলে কী হল?’
‘ঘোড়ার ডিম হল।’
‘এটা গল্পের মতো সত্য।’
‘সে আবার কী? বলো সত্যের মতো গল্প।’
‘দাঁড়া, দাঁড়া, সব গুলিয়ে গেল। গল্পের মতো সত্য, সত্যের মতো গল্প। ট্রু স্টোরির ইংরেজি কী হবে?’
সুহাসবাবু বললেন, ‘সত্য গল্প।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্য গল্প। সত্য হাসির গল্প।’
মেজোমামা বললেন, ‘ভেরি সরি। আমাদের কিন্তু হাসি পেল না।’
‘তার মানে তোমরা সমঝদার নও। তোমাদের মন তেমন সরল নয়। শিশুর মতো সরল মন না হলে প্রাণ খুলে হাসা যায় না রে পাগলা!’
সুহাসবাবু বললেন, ‘আপনি লক্ষ করেননি, আমি কিন্তু ফিকফিক করে হেসেছি।’
‘লক্ষ্মী ছেলে। লক্ষ্মী ছেলে।’ বড়মামা পিঠ চাপড়ালেন।
‘তবে আর বোধহয় দেরি করা ঠিক হবে না বড়বাবু। অনেক সব প্রবলেম আছে।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার স্টার্ট।’
চার
ফুল, লতা, পাতা, রঙিন কাগজ, লাল নীল পতাকা। সভা একেবার জমজমাট। লাউডস্পিকার কাসছে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে একজন চিৎকার করছেন, ‘টেস্টিং টেস্টিং। বড়মামা বললেন, ‘টেস্ট করে আর কী পাবে! এ তো ব্রংকাইটিসের কাসি। বুকে সর্দি জমেছে।’
যে ভদ্রলোক টেস্ট করছিলেন তিনি যেই ওয়ান, টু, থ্রি, বলতে গেলেন, মাইক চ্যাঁ করে চিৎকার করে উঠল। বড়মামা বললেন, ‘ফেলে দাও, ফেলে দাও। মাচান থেকে নামিয়ে দাও। অসুস্থ, অসুস্থ। হাসপাতালে পাঠাও।’
ফোর, ফাইভ, সিকস। সেভেনে এসে মাইক সুস্থ হল। স্বাভাবিক স্বর বেরোল। বড়মামা বুদ্ধদেবের মতো হাত তুললেন। মাইক নিয়ে ধস্তাধস্তি শেষ হল। সভা একেবারে লোকে লোকারণ্য। পুরুষ, মহিলা, ছেলে মেয়ে, কেমন একটা গজর-গজর, ভজর-ভজর শব্দ হচ্ছে। একসঙ্গে অনেক মাছি উড়লে যেমন হয়।
সুহাসবাবু বললেন, ‘সাইলেনস। সাইলেনস! সাইলেনস!’ প্রায় ধমকে উঠলেন, ‘একদম চুপ, একদম চুপ।’ ঠিক যেন আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার! এখুনি পড়া ধরবেন। না পারলে মাথায় ডাস্টার।
সুহাসবাবু বললেন, ‘আজ আমাদের বড় আনন্দের দিন। আজ আমাদের বড় আনন্দের দিন।’
গুনুর গুনুর গোলমাল তখনও চলেছে। ছুঁচ পড়লে আওয়াজ হয় এমন নিস্তব্ধ তখনও হয়নি। একেবারে সামনের সারিয়ে দুটো বাচ্চা, এ ওর কান, ও এর কান ধরে কান-টানাটানি খেলা খেলছে। সুহাসবাবু মাইক ছেড়ে লাফিয়ে সভায় নামলেন। প্রথমেই দু’হাতে দুই থাপ্পড়। তারপর দুটোকেই বেড়াল-ছানার মতো নড়া ধরে তুলে ঝোলাতে ঝোলাতে সভার বাইরে ছেড়ে দিয়ে এলেন। এসেই আবার মাইক ধরলেন, ‘আজ আমাদের অতিশয় আনন্দের দিন। গত বছর ঠিক এমনি দিনে এই সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।’
পেছনের সারি থেকে একসঙ্গে অনেকে বলে উঠলেন, ‘এবার উঠে যাবে।’
বড়মামা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘কে বললে? কে বললে উঠে যাবে? কার এত সাহস? উঠে যাবে কেন?’
পেছনের সারিতে পরপর দশ-বারোজন উঠে দাঁড়ালেন, ‘আমরা বলেছি স্যার। আজ আমাদের আনন্দের দিন নয়, দুঃখের দিন স্যার।’
‘কেন, কেন? দুঃখের দিন কেন? কোনও কিছু জন্মালে কেউ কি দুঃখ করে, না আনন্দ করে? আমি যখন জন্মেছিলুম তখন আমার বাড়ির সবাই হেসেছিল না কেঁদেছিল? আমি অবশ্য ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছিলুম। সে তো ভাই তুলসীদাসজি বলেই গেছেন—তুমি যখন এসেছিলে, জগৎ হেসেছিল, তুমি কেঁদেছিলে। তুমি যখন যাবে, জগৎ কাঁদবে আর তুমি হাসবে।’
‘ডাক্তারবাবু, আমরা সে জন্ম বা মৃত্যুর কথা বলছি না, আমরা এই কুলতুলি মহিলা সমিতির কথা বলছি স্যার।’
‘অবশ্যই, অবশ্যই, সেই কথাই তো বলবেন। সেই কথা বলারই তো দিন আজ।’
‘তা হলে বলেই ফেলি।’
‘উঁহু, আপনারা তো শুনবেন। আমরা আজ বলব। সভাপতি বললেন, প্রধান অতিথি বলবেন। আপনারা শুধু কান খাড়া করে শুনবেন। শোনা শেষ হলে চটাপট পটাপট হাততালি দেবেন।’
‘সবই বুঝলুম। তবে আপনারা বলার আগে, আমরা যা বলতে চাই শোনা দরকার। অনেক টাকার ব্যাপার তো।’
‘ও, এই প্রতিষ্ঠানকে আপনারা অর্থ দান করতে চান? বাঃ বাঃ, অতি মহৎ প্রস্তাব। পৃথিবীতে দাতা তাহলে এখনও অছেন!’
‘ভালো করে শুনুন। আমরা নিতে এসেছি, দিতে আসিনি। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই।’
‘ক্ষতিপূরণ! সে আবার কী রে ভাই! আমরা তো কারুর কোনও ক্ষতি করিনি। আমরা তো মানুষের উপকার করার জন্যেই বাজারে নেমেছি।’
‘ওই আনন্দেই থাকুন। এদিকে আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।’
‘কী রকম, কী রকম?’
‘বলছি, বলছি। একে একে বলছি। আমিই প্রথমে বলি, তারপর এরা বলবে।’
বড়মামা ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, ‘সুহাস, সব যে বেসুরে বাজছে গো!’ মাইকে বড়মামার আস্তে মন্তব্য বড় হয়ে সভায় ছড়িয়ে পড়ল।
মেজোমামা বললেন, ‘তা তো একটু বাজতেই পারে। সব সময় সবকিছু কি সুরে বাজে?’
মেজোমামার মন্তব্যও সবাই শুনে ফেলল।
সুহাসবাবু মাইক টেনে নিয়ে বললেন, ‘আজ আমাদের জন্মদিন, বড় আনন্দের দিন, আজ কোনও গণ্ডগোল করা কি ঠিক কবে? আসুন আমরা হাতে হাত মেলাই।’
সঙ্গে সঙ্গে পেছনের সারি থেকে মন্তব্য হল, ‘জন্মদিন আর মৃত্যুদিন একই তো হয়ে যেতে পারে।’
‘মৃত্যুর কথা আসছে কেন ভাই। এই তো সবে এক বছর আমরা জন্মেছি।’
‘তা হলে শুনুন, আপনাদের কীর্তিকাহিনী শুনুন। আপনাদের সেই প্যাকেটে ভরা মুড়কি, যার নাম রেখেছিলেন হরিভোগ। সেই মুড়কি আমার দোকানের কী সর্বনাশ করেছে!’
‘ভাই, হরিভোগ তো সত্যিই হরির ভোগ। আমরা নিজেরা টেস্ট করে তবে বাজারে ছেড়েছি। ওতে বাদাম আছে, জিবেগজার সুস্বাদু টুকরো আছে, নকুলদানা আছে, আদার কুচি আছে। ভাবলেই আমার জিভে জল এসে যাচ্ছে রে ভাই!’
‘আপনার জিভে জল, আর আমার চোখে জল। যা মাল তুলেছিলুম দু-চার প্যাকেট মাত্র বেচতে পেরেছি। এ বাজারে ওসব বৈষ্ণব-পথ্য চলে না মশাই। এ হল মাটনরোল, ফিশরোল, মোগলাইয়ের যুগ। আপনাদের হরিভোগ সব ধেড়ে-ইঁদুর-ভোগ হয়ে গেছে। তাও ইঁদুরে ভোগ করে ছেড়ে দিলে বাঁচতুম। হরিভোগ খেয়ে, ধেড়েরা এমন খেপে আছে, আমার দোকানে সব কাঁচের জার তো ভেঙে চুরমাদ্দর করছেই, আমাকেও দোকান খুলতে দিচ্ছে না, তেড়ে তেড়ে আসছে। কামড়েও দিয়েছে পায়ের বুড়ো আঙুলে। তলপেটে এখন ইনজেকশান নিতে হচ্ছে?’
বড়মামা হাসতে হাসতে বললেন, ‘এই ব্যাপার! আপনি আমাদের এই সমিতির তৈরি গোটাকতক আগমার্কা ইঁদুরকল ওই হরিভোগ দিয়েই পেতে রাখুন, সব ব্যাটা ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
‘আগমার্কা ঘি হয় শুনেছি, ইঁদুরকলও হয় নাকি?’
‘আরেব্বাপু রে, সেরা জিনিস মানেই আগমার্কা। আমাদের ইঁদুরকল বাজারের এক নম্বর। নাম্বার ওয়ান। লিকপ্রূফ। ইঁদুর এদিক দিয়ে পড়ে ওদিক দিয়ে ফুড়ুত করে বেরিয়ে যাবে, সে আর হচ্ছে না। আমরা সব জিনিস টেস্ট করে তবে বাজারে ছাড়ি।’
‘ইঁদুরকল কী করে টেস্ট করবেন স্যার? ওটা তো খাদ্য নয়। কেক নয়, রুটি নয়।’
‘ওই কেক আর রুটির কথা যখন উঠল, তখন বলেই ফেলি।’ এবার দ্বিতীয় আর এক ভদ্রলোক। সুন্দর চেহারা। একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। বড়-বড় চোখ।
বড়মামা বললেন, ‘আপনার আবার কী অভিযোগ? এ দেখছি আমদরবার বসে গেল। অ্যাতো অভিযোগ সামলাই কী করে?’
‘আপনাদের ওই কেক আর রুটি স্যার আমার এতকালের ব্যবসার একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। ও দুটোই কি টেস্ট করে ছেড়েছিলেন স্যার?’
‘অবশ্যই, অবশ্যই। আমি খাইনি, তবে এরা অবশ্যই খেয়েছে। খাবার জিনিস, না খেয়ে পারে?’
‘আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ খিদে পেয়েছে। আমাদের সামনে দয়া করে একটু চাখুন না।’
‘তা চাখতে পারি। আমার আবার খাওয়ার ব্যাপারে তেমন লজ্জাটজ্জা নেই।’
‘তা হলে সভাপতি, প্রধান অতিথি দু-জনেই একটু একটু টেস্ট করুন। আমরা দেখি।’
মেজোমামা লজ্জা-লজ্জা করে বললেন, ‘কী যে বলেন?’
সুহাসবাবু কেক আর রুটি নিয়ে এলেন। দেখেই মনে হল বেশ গরম গরম। সুন্দর গন্ধ নাকের পাশ দিয়ে ভেসে চলে গেল। যেন ডাকছে—আয়, আয় কপাকপ খেয়ে যা। বড়মামা এক টুকরো কেক ভেঙে মুখে পুরলেন। মুখে পোরার সঙ্গে চটাপট, পটাপট হাততালি। দেখতে দেখতে বড়মামার চোখ কপালে উঠে গেল। কী রে বাবা, এখুনি ফিট হয়ে যাবে নাকি।
সেই সুন্দরমতো ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ‘কী বুঝলেন স্যার? নুনে যবক্ষার। জিভ হেজে গেল। তাই না।’
বড়মামা ঢোক গিলেন ডাকলেন, ‘সুহাস।’
‘বলুন স্যার। পাশেই আছি।’
‘পাশেই আছ। আমি যে চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’
‘তা হতে পারে স্যার। অন্য কাজে ব্যস্ত রয়েছেন তো!’
‘আজ্ঞে না। সেজন্যে না। এমন বিদঘুটে স্বাদ হল কী করে? অমানুষিক টেস্ট।’
‘হতে পারে স্যার। খুব ভালো কারিগরের তৈরি কিনা!’
‘ছাঁটাই করো, ছাঁটাই করো। সব পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে, হাতে পায়ে ধরে আজই বিদায় করো!’
সেই সুন্দরমতো ভদ্রলোক বললেন, ‘তা হলে, আমার হাজার-পাঁচেক টাকা পাওনা হল। দোকান নতুন জায়গায় তুলে না নিয়ে গেলে, যেখানে আছি সেখানে আর ব্যবসা করে খেতে হবে না। সব খদ্দের ভয়ে সরে পড়েছে।’
বড়মামা বললেন, ‘মিথ্যে কথা। এমন কিছু খারাপ খেতে হয়নি।’
‘তা হলে আর-একটুকরো খান। আমরা বসছি।’
বড়মামা একটু ঘাবড়ে গিয়ে মেজোমামা আর মাসিমার মুখের দিকে করুণ মুখে তাকালেন।
মাসিমা বললেন, ‘পাঁচ হাজারের চেয়ে জীবন অনেক দামী বড়দা।’
বাইরে একটা হইচই শোনা গেল। ‘কোথায়, কোথায় সেই ডাক্তারবাবু? আমি তাঁকে একবার দেখে নিতে চাই।’
বড়মামা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘ওরে কুসি; আবার কে আসছে রে তেড়ে?’
মেজোমামা বললেন, ‘নাও এবার পরোপকারের ঠ্যালা বোঝো।’
মারমার করে রাগী চেহারার এক বৃদ্ধ সভায় এসে ঢুকলেন। ‘ডক্টর মুখার্জী নাকি এসেছেন। তিনি কোথায়?’
পেছনের সারির ভদ্রলোকরা একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘ওই যে, ওই যে মঞ্চে বসে আছেন। বসে বসে কেক খাচ্ছেন।’
‘হ্যাঁ, সকলকে দেখিয়ে দেখিয়ে কেক তো খাবেনই! কারুর সর্বনাশ, কারুর পোষ মাস। ডক্টর মুখার্জী।’
ভদ্রলোক বুক চিতিয়ে পা দুটো ফাঁক করে সামনে এসে দাঁড়ালেন। যেন যুদ্ধ করবেন!
বড়মামা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনার কী সর্বনাশ হয়েছে?’
‘কী সর্বনাশ হয়েছে দেখতে চাও ছোকরা? তোমাদের কৌশল কি আমি বুঝি না ভাবছ। সামনের চৈত্রে আমার বয়েস হবে সত্তর। দাঁতের ডাক্তারদের সঙ্গে ষড় করে তোমরা বাজারে টফি ছেড়েচ। ছেড়েচ কি না?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, টফি আমরা ছেড়েচি, তবে দাঁতের ডাক্তারের সঙ্গে কোনও ষড় নেই।’
‘তাই যদি হবে মানিক, তাহলে এই বুড়োর বাঁধানো দাঁত দু’পাটির এ-হাল হবে কেন?’
পকেট থেকে খবরের কাগজের একটা মোড়ক বের করে টেবিলে মেলে ধরলেন। খিঁচিয়ে আছে দু’পাটি দাঁত। বাঁধানো সারি থেকে গোটা-দুই খুলে পড়ে গেছে।
বড়মামা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে টফি তো শিশুদের জন্যে, আপনি কেন খেতে গেলেন?’
‘এটা কী কথা তুমি বললে হে ডাক্তার! তুমি কি জানো না, আমার এখন দ্বিতীয় শৈশব চলেছে। টফি আমার নাতিও খায়, আমিও খাই। তুমি কি আইন করে আমার টফি খাওয়া ঠেকাবে? এ তো মজা মন্দ নয়!’
‘আমাদের টফি একটু কড়াপাক ধরনের। বেশ পাকলে-পাকলে ধৈর্য ধরে না খেলে দাঁত আপনার ভাঙবেই। এ আপনার নকল দাঁতের জিনিস নয়, আসল দাঁত চাই।’
‘দ্যাখো বাপু, শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকতে চেও না। আমি এই দাঁতে এখনও মাংসের হাড় চিবোই বৎস। যৌবনে সত্তর-আশি পাউণ্ড ওজনের বারবেল তুলতুম। এখনও নেমন্তন্ন বাড়িতে গিয়ে ছাপান্ন খানা লুচি মেরে দি। কী উলটোপালটা বোঝাতে চাইছ আমাকে? শোনো ডাক্তার, পাঁচশোটি টাকা আমি গুনে নিয়ে এখান থেকে যাব। আমাকে তুমি চেনো না। আমার নাম চিদানন্দ বণিক। আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা সিপাহী বিদ্রোহের সময় ঘোড়ার পিঠে চড়ে তলোয়ার দিয়ে ইংরেজদের মুণ্ডু উড়িয়েছিল ক্যাচাক্যাচ।’
বড়মামা ঢোঁক গিলে মেজোমামার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালেন। মেজোমামা চোখের ইশারা করলেন। কী তার মানে কে জানে। বড়মামা আজ বেজায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। সুহাসবাবু কোন ফাঁকে সরে পড়েছেন।
হঠাৎ আশুবাবু এগিয়ে এলেন। মরেছে, ইনি আবার কৌটো-সমস্যা তুলবেন নাকি? আশুবাবু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘ভদ্র-মহোদয়গণ, আপনারা এইভাবে আজকের অনুষ্ঠান পণ্ড করবেন না। যার যা পাওনা, ডাক্তারবাবু সবই মিটিয়ে দেবেন। আপনারা একটা করে দরখাস্ত পেশ করুন।’
‘দরখাস্ত? তার মানে? এ কি সরকারি দপ্তরে ডোলের আবেদন নাকি? আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনা আগে বুঝে নোব, তারপর আমাদের অন্য কথা। ফেলো কড়ি মাখো তেল।’
দাঁতভাঙা বৃদ্ধ বললেন, ‘অ্যাঃ, সব উলটোপালটা বকছ। এ-কথায় ওই কথা আসে কী করে? ফেলো কড়ি মাখো তেল। এর পরেই মূর্খরা বলবে, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।’
পেছনের সারির ওঁরা তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন, ‘তার মানে? আমরা মূর্খ! কী আমার জ্ঞানী, মহাপণ্ডিত বৃদ্ধ রে! দাঁত ভেঙেছে, দাঁত! প্রমাণ কী, টফি খেয়ে দাঁত ভেঙেছে! ডাক্তারের সার্টিফিকেট কোথায়?’
‘ওরে মূর্খের দল। এর আবার সার্টিফিকেট কী?’
‘বাঃ, মানুষ মরলে পোড়াবার আগে সার্টিফিকেট লাগে না!’
‘আরে গাধা, মানুষ মরা আর মানুষের দাঁত ভাঙা এক হল?’
‘মানুষের দাঁত কেমন করে হল মানিক? ও তো ছাঁচে ঢালাই নকল দাঁত। তাঁর জন্যে পাঁচশো। টাকা যেন খোলামকুচি রে।’
‘যা না ব্যাটারা, একবার খবর নিয়ে দেখ না, দু পাটি দাঁত বাঁধাবার খরচ কত? এ তোদের খাতা বাঁধানো নয়, ছবি বাঁধানো নয়, গবেটের দল।’
‘যা তা গালগাল তখন থেকে চলেছে। এবার আমরা আর চুপ করে থাকব না। অ্যাকশান নিয়ে নোব।’
‘একবার চেষ্টা করে দ্যাখ না চামচিকের দল।’
‘তবে রে!’
মহা গোলমাল শুরু হয়ে গেল। আশুবাবু বড়মামার কানে কানে বললেন, ‘পেছনের দরজা দিয়ে সরে পড়ুন। হাওয়া খুব ভালো নয়। এলোমেলো বইছে।’
পাঁচ
পেছনে ঝোপঝাড়, জঙ্গল, দেবদারু, ইউক্যালিপটাস, জোড়া পুকুর। ভাগ্য ভালো, সূর্য অনেক আগেই ডুবে গেছে। আকাশে যেন ঘোর লেগে গেছে। কোথা দিয়ে কোথায় যাচ্ছি কে জানে! চোরের মতো। ছোট চোর, বড় চোর। আমার তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। ঝোপেঝাড়ে বল খোঁজার অভ্যাস আছে। অসুবিধে হচ্ছে মেজোমামা আর মাসিমার। মাসিমার শাড়ির আঁচল। মেজোমামার চাদর। কেবলই জড়িয়ে যাচ্ছে ডালপালায়। ওদিকে খুব হইচই হচ্ছে। ভাগ্যিস দাঁতভাঙা বৃদ্ধ এসেছিলেন।
বড়মামা ফিসফিস করে বললেন, ‘টাকা তো আমাকে দিতেই হবে আশুবাবু! ক্ষতি যখন হয়েছে!’
‘কারুর কিস্যু ক্ষতি হয়নি। সব হল ধান্দাবাজ। বেড়ালের জাত মশাই। নরম মাটি দেখেছে কি অমনি আচড়াও।’
মাসিমা বললেন, ‘দেখেশুনে মনে হল, কম-সে-কম হাজার-দশেক টাকার ধাক্কা।
মেজোমামা বললেন, ‘আজ তোমার মহিলা সমিতি আর পরোপকারের শেষ দিন। আজ ওরা সব একখানা একখানা করে ইট খুলে নিয়ে যাবে।’
আশুবাবু বললেন, ‘আপনার সেক্রেটারি সুহাসবাবু কোথায় গেলেন বলুন তো?’
আমগাছের মোটা গুঁড়ির আড়াল থেকে উত্তর এল, ‘আজ্ঞে আমি এখানেই আছি। মশাই সর্ব অঙ্গ জ্বলিয়ে দিয়েছে ডাক্তারবাবু।’
‘তুমি আমাদের ফেলে রেখে পালিয়ে এলে সুহাস?’
‘আর যে কোনও পথ ছিল না দাদা! জানেনই তো কথায় আছে—চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।’
বড়মামা বললেন, ‘এ জায়গাটা তোমার কী রকম মনে হয়, বেশ নিরাপদ? এক কাপ চা পেলে হত।’
‘চা? চা এখানে পাবেন কোথায়। সাপখোপ পেতে পারেন।’
‘আমরা এখন তাহলে যাই কোথায়?’
‘আমি একটা ভালো কাজ করেছি স্যার। কাজের কাজ। ওই ধোবিডাঙার মাঠে আপনার গাড়িটা এনে রেখেছি।’
‘সে কী হে! আমার গাড়ি তো বিগড়ে বসে অছে। স্টার্ট নিচ্ছে না।’
‘সে আমি ঠিক করে এনেছি। এক ফুঁয়ে সব ঠিক হয়ে গেছে। কারবুরেটারে ময়লা জমেছিল।’
‘লক্ষ্মী ছেলে, সোনা ছেলে। একবার গাড়িতে উঠে বসতে পারলে আর আমাদের পায় কে! চলো চলো, তাড়াতাড়ি পা চালাও।’
ঝোপঝাড় ভেঙে আমরা ধোবিডাঙার মাঠে এসে উঠলুম। একফালি চাঁদ মুচকি হাসছে আকাশে। গোটাকতক তারা এলোমেলো ছড়িয়ে আছে। আমার তেমন কোনও ভয় লাগছে না। মাঝে-মাঝে আমার কেবল হাসি পাচ্ছে। কী থেকে কী হয়ে গেল! এ যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ।
সুহাসবাবু বললেন, ‘এ হল ওই ঘোষালের কাজ। ভালো কিছু হতে দেখলেই লোক লাগিয়ে সব পণ্ড করে দেয়!’
‘অ, তাই বলো, ঘোষাল কলকাঠি নেড়েছে! ওকে আর কিছুতেই ঢিট করা গেল না!’
‘যাবে না কেন? সহজেই যায়। ওকে যদি প্রেসিডেন্ট করে দেন!’
‘বেশ তো! এ আর এমন শক্ত কী! আজই করে দাও না।’
‘আজ কী করে করবেন। প্রথমে টাকা দিয়ে ওকে সভ্য হতে হবে। তারপর নির্বাচন। সব ব্যাপারেরই তো একটা ইয়ে আছে। অজ ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করুক। আপনি দিনকতক বরং গা-ঢাকা দিয়ে থাকুন।’
‘গা-ঢাকা দোব কেন? আমি কি কাপুরুষ? তা ছাড়া আমার কোনও শত্রু নেই।’
‘এখন আপনার অনেক শত্রু। সমাজসেবা অত সহজ নয় ডাক্তারবাবু! বেড অব রোজেস।’
‘ভুল বললে। বেড অব থর্ন।’
‘আজ্ঞে কাঁটা ছাড়া কি গোলাপ হয়!’
কথায় কথায় আমরা গাড়ির কথায় এসে পড়েছি। ফিকে চাঁদের আলোয় চকচক করছে। আমরা উঠে বসলুম। আশুবাবুও উঠলেন। বড়মামা বললেন ‘সুহাস, তুমি?’
‘আজ্ঞে, আমি বেশ আছি।’
‘বেশ আছি মানে! এই বললে, চাচা আপনা প্রাণ বাঁচা। ওরা তোমাকে একা পেলে তো ঠেঙিয়ে শেষ করে দেবে।’
‘এই তো পাশের আমার দিদির বাড়ি। সেইখানেই গা-ঢাকা দোব।’
‘দেখো মার খেয়ে মোরো না। তুমি আমার রাইট-হ্যান্ড।’
স্টার্ট দিতেই গাড়ি স্টার্ট নিয়ে নিল। গোল একটা বৃত্ত তৈরি করে, সোজা রাস্তায় গিয়ে উঠল। আশুবাবু জিগ্যেস করলেন, ‘সুহাসবাবু আপনার কত দিনের চেনা স্যার?’
বড়মামা স্টিয়ারিং-এ পাক মারতে মারতে বললেন, ‘এই বছরখানেক হবে।’
‘লোক মোটেই সুবিধের নয়, বুঝলেন বড়বাবু? এ হল গিয়ে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘোষালের নিজের লোক। ভেতর থেকে সব চুরমার করতে চাইছে।
‘কী আশ্চর্য। আমি তো খারাপ কিছু করতে চাইনি। আমি তো সকলের উপকার করতেই চেয়েছি।’
‘সেই অপরাধেই তো আপনার বাঘের পেটে যাওয়া উচিত। মনে নেই নবকুমারের কী হয়েছিল।’
‘এবার আমি সব ছেড়ে দোব। এমনকি ডাক্তারিও। এ দেশেই আর থাকব না।’
ফাঁকা রাস্তা ধরে বড়মামার গাড়ি ফরফর করে চলেছে। এটা আবার কোন রাস্তা কে জানে। মেজোমামা বললেন, ‘আজ যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলুম। মনে হয় কুসির মুখ দেখে।’
মাসিমা বললেন, ‘আমি যে তোমার মুখ দেখে উঠেছিলুম সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’
বড়মামা বললেন, ‘আমি তাহলে কার মুখ দেখে উঠেছিলুম?’
‘রোজ যা করো। নিজের মুখ দেখেই উঠেছিলে।’
আমি বললুম, ‘আমি তাহলে কার মুখ দেখে উঠেছিলুম?’
মেজোমামা বললেন, ‘তুমি উঠেছিলে বড়মামার মুখ দেখে। ও মুখ দেখলে সারাদিন বড় আনন্দে কাটে।’
আশুবাবু হইহই করে উঠলেন, ‘ডানদিক, ডানদিকে চলুন। বাড়ি যাবেন তো।’
‘বাড়ি যাব কেন? বাড়ি গেলে আর গা-ঢাকা দেওয়া হল কী?’
মেজোমামা বললেন, ‘সে কী! তুমি তাহলে কোথায় চললে?’
‘সোজা মধুপুর।’
মাসিমা বললেন, ‘মধুপুরে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল বড়দা?’
‘কবে আর ভালো ছিল বোন?’
আশুবাবু বললেন, ‘সত্যি মধুপুর?’
‘আমি বড় একটা মিথ্যে বলি না আশুবাবু। আমার মন্ত্রই হল করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।’
মেজোমামা বললেন, ‘এতে তোমার মরার মতো কী করা হল? তুমি যেখানে খুশি যাও, আমাদের নামিয়ে দাও।’
‘এক যাত্রায় পৃথক ফল কি হয় ভাই! আমরা সদলে মধুপুর যাব।’
আশুবাবু বললেন, ‘কোথায় থাকবেন?’
‘সেখানে আমাদের ফাস্টক্লাস বাগানবাড়ি আছে। বড় বড় গোলাপ।
‘কী মজা।’ আশুবাবু আনন্দে আটখানা।’
মাসিমা বললেন, ‘গাড়ি থামাও। আমরা নেমে যাই।’
আশুবাবু বললেন, ‘মাঈজি আপনাদের আনন্দ হচ্ছে না? কী সুন্দর আমরা চেঞ্জে যাচ্ছি!’
মেজোমামা বললেন, ‘বাড়ির কথা ভেবেছ?’
‘খুব ভেবেছি, দশ দশটা কুকুর পাহারা দেবে। কাকাতুয়া ধমকাবে।’
‘ওদের দেখবে কে?’
‘লক্ষ্মী আছে, জনার্দন আছে, শামুকাকা আছে।’
‘না ফিরলে ওরা ভাববে না?’
‘সখি ভাবনা কাহারে বলে, সখি যাতনা কাহারে বলে…।’ বড়মামা গান ধরলেন। গাড়ির গতি বাড়ল।
আশুবাবুও হুঁ-হুঁ করছেন। খুব ফুর্তি! হুঁ-হুঁর মাঝেই সুরে বললেন, ‘এইবার একটু চা হলে ভালো হত। ওই দেখা যায় দোকান দূরে।’
বড়মামা গানের সুরে উত্তর দিলেন, ‘গাড়ি থামলেই। গাড়ি থামলেই। ওরা নেমে পালাবে। পালাবে, পালাবে, পালাবে। গাড়ি থামালেই।’
মেজোমামা বললেন, ‘আমরা চেঁচাব। চিল চেল্লান চিল্লে লোক জড়ো করে তোমাকে ছেলেধরার ধোলাই খাওয়াব। তোমাদের আহ্লাদ তখন বেরোবে।’
‘ছেলেধরা?’ বড়মামা অট্টহাসি। ‘বল বুড়োধরা। তোরা নিজেদের এখনও ছেলে ভাবিস?’
আশুবাবু বললেন, ‘ছোড়দা, কেন বাগড়া দিচ্ছেন? কী মজা করে কেমন কোথায় চলেছি। এখন একটু বেশ ছেলেমানুষ হয়ে যান না। একেবারে শিশু।’
‘হ্যাঁ মশাই। শিশু হব বললেই শিশু হওয়া যায়? খুব তো লাফাচ্ছেন। ওদিকে আপনার দোকানের সব মিষ্টি তো পচে ভ্যাট হয়ে যাবে।’
‘সেই আনন্দেই থাকুন মেজোবাবু। আমার মিষ্টি পচে না। সবই তো কাগজের তৈরি।’
হুহু করে গাড়ি ছুটছে। বড়মামা বলেন, ‘ব্যাণ্ডেল ছাড়ালাম। বুঝলি মেজো। শান্ত হয়ে বোস। বেশি ছটরফটর করিসনি। দুর্গাপুর আসার আগে দুর্গানাম জপ কর। ডাকাতের হাতে না পড়ে যাই। তার আগে শক্তিগড়ে পেট ভরে ল্যাংচা খাব। জয় বাবা তারকেশ্বর।’
মেজোমামা বললেন, ‘তাহলে আমরা চেল্লাই।’
‘চেল্লাও বসে। আমিও গান ছেড়ে দিচ্ছি।’
বড়মামা টোপ ছাড়লেন, ‘প্রেমদাতা নিতাই বলে গৌর হরি হরি বোল।’
সঙ্গে আশুবাবু চটাস চটাস হাততালির। ভোঁ ভোঁ গাড়ি ছুটছে। বড়মামার হাত খুলেছে। গাড়িটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। ভটাস করে একটা শব্দ।
‘যাঃ, টায়ার গেল।’
গাড়ি ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পথের বাঁ পাশে একটা বটগাছের তলায়। আশুবাবু গেয়ে উঠলেন, ‘বল মা তারা দাঁড়াই কোথা!’
এরপর যা হল সে আর এক গল্প।