1 of 3

একটু চেষ্টা

একটু চেষ্টা

জীবনে একটা কিছু ধরতে হয়, কোন একজনকে ধরতে হয়, কিংবা কোন একটা বিশ্বাসকে। একটা আলো, যা আমাদের পথকে আলোকিত করবে। জীবনের শূন্যতা ভরে দেবে। যখন দিশা হারাব তখন এসে হাত ধরবেন। কি সেই বিশ্বাস! কার সেই হাত! মানুষের! বিশ্বাস! সে কি ভগবৎ-বিশ্বাস! মানুষ জীবনে প্রবৃত্তির তাড়নায় অনেক কিছু ধরতে ছোটে অনেক সময়। বাল্যে ছুটেছি লোভের পিছনে, যৌবনে ভোগের পিছনে, বার্ধক্যে হতাশা এসে হাত ধরেছে। তখন সেই করুণ সঙ্গীত—জীবন আমার বিফলে গেল, লাগিল না কোন কাজে।

আমাদের চোখের সামনে দিয়ে এইভাবেই ভেসে চলেছে শত-সহস্ৰ জীবন। মাঝে মাঝে খোঁচা মারছে প্রশ্ন, কেন এলুম, কি করতেই বা এলুম, এখানের পাট চুকিয়ে যাবই বা কোথায়। মানুষের শেষটা কি? প্রশ্ন আসে কিন্তু দাঁড়াবার জমি পায় না। প্রাত্যহিকতায় ভেসে চলে যায়। আমরা দুই আর দুইয়ে চার, সাত আর দুইয়ে নয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। চাকরি, প্রমোশন, ছেলের এডুকেশন, মেয়ের বিয়ে, বাতের ব্যথা, তিন কামরার ফ্ল্যাট, ইনকাম ট্যাক্স, ওয়ার্ল্ড কাপ, এইসব নিয়ে এমন মেতে যাই, কোন কিছুই আর খেয়াল থাকে না। হয়তো পুরীতে গেলাম। ফিরে এসে প্রভু জগন্নাথের কথা না বলে, বলতে থাকি ভোগের কথা, মহাপ্রসাদের কথা। গেলাম দেওঘর, সাতকাহন করে শুরু করলাম প্যাঁড়ার সমালোচনা, আগে কি ছিল, এখন কি হয়েছে!

যে ভেবেছিল, পৃথিবীতে টাকাটাই বুঝি সব, গাড়ি, বাড়ি, মোটা ব্যাঙ্ক ব্যালান্স হয়ে যাবার পর দেখলে, নাঃ, কি যেন একটা নেই, শান্তি। কি যেন একটা নেই, বৈচিত্র্য! সেই একদিন, একরাত। মনে হতে থাকে, বড় নিঃসঙ্গ আমি। মনে হয়, সবই আছে, নেই প্রেম। নিঃস্বার্থ ভালবাসার বড়ই অভাব, সর্বত্র দেহি দেহি। চারপাশে যারা আছে তারা সকলেই উমেদার। সংসারে যতক্ষণ দিতে পারা যায় ততক্ষণই খাতির। স্বার্থের সুতোয় টান পড়লেই সব মুখোশ খুলে যায়, স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে। এই উপলব্ধি থেকেই আসে হাহাকার—”আমি কোথায় পাব তারে?” কারে? যে আমাকে নিঃস্বার্থ ভালবাসতে পারে। এই হাহাকারই দেয় সেই বোধ—ওরে আমি বদ্ধজীব! অষ্টপাশ আমায় বেঁধেছে।

ওই ভাবনাটুকুই সার। কারণ ঠাকুর সংসারী জীবের ধরনধারণ খুব ভাল বুঝতেন। এই ব্যাপারে তাঁর সুন্দর সেই গল্প : “উট কাঁটাঘাস বড় ভালবাসে। কিন্তু যত খায় মুখ দিয়ে রক্ত দরদর করে পড়ে; তবুও সেই কাঁটাঘাসই খাবে, ছাড়বে না। সংসারী লোক এত শোক-তাপ পায়, তবু কিছুদিনের পর যেমন তেমনি। স্ত্রী মরে গেল, কি অসতী হলো, তবু আবার বিয়ে করবে। ছেলে মরে গেল কত শোক পেলে, কিছুদিন পরেই সব ভুলে গেল। সেই ছেলের মা, যে শোকে অধীর হয়েছিল আবার কিছুদিন পরে চুল বাঁধল, গয়না পরল। এরকম লোক মেয়ের বিয়েতে সর্বস্বান্ত হয়, আবার বছরে বছরে তাদের মেয়েও হয়। মোকদ্দমা করে সর্বস্বান্ত হয়, আবার মোকদ্দমা করে। যা ছেলে হয়েছে তাদেরই খাওয়াতে পারে না, পড়াতে পারে না, ভাল ঘরে রাখতে পারে না, আবার বছরে বছরে ছেলে হয়। আবার কখনো কখনো যেন সাপে ছুঁচো গেলা হয়! গিলতেও পারে না, আবার উগরাতেও পারে না। বদ্ধজীব হয়তো বুঝেছে যে, সংসারে কিছুই সার নেই; আমড়ার কেবল আঁটি আর চামড়া। তবু ছাড়তে পারে না। তবুও ঈশ্বরের দিকে মন দিতে পারে না।“

এই ‘সাপের ছুঁচো গেলা’ সংসারীদের তাহলে কি হবে! যারা বুঝেছে অথচ বেরোতে পারছে না। দেহে বেরনোর প্রশ্নই আসছে না। লাইন দিয়ে পাড়াকে পাড়া সব সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, “এমন দিন কি হবে মা তারা!” মনে বেরনো। মনে মুক্ত হওয়া। মনটাকে বের করে আনা। বের করে এনে সঁপে দেওয়া। তাঁর হাতে। আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী, তুমি যেমন করাও তেমনি করি। আমি জানি, ঠাকুর বলে গেছেন : “বদ্ধজীবের আরেকটি লক্ষণ আছে। তাকে যদি সংসার থেকে সরিয়ে আনা হয়, ভাল জায়গায় রাখা যায়, তাহলে হেদিয়ে হেদিয়ে মারা যাবে। বিষ্ঠার পোকা বিষ্ঠাতেই বেশ আনন্দ। ঐতেই বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়। যদি সেই পোকাকে ভাতের হাঁড়িতে রাখ, তাহলে মরে যাবে।”

আমি তাহলে কাকে ধরব? ঠাকুরকেই ধরব। ঈশ্বর অনেক দূরে। আমার সেই পদ্মলোচন পণ্ডিতের অবস্থা। বিচারসভায় বিচার হচ্ছে—শিব বড়, না ব্রহ্মা বড়। পদ্মলোচনকে প্রশ্ন করলেন পণ্ডিতরা। ঠাকুর বলছেন : “পদ্মলোচন এমনি সরল, সে বললে, আমার চৌদ্দপুরুষ শিবও দেখে নাই, ব্ৰহ্মাও দেখে নাই।” আমারও সেই একই অবস্থা, আমি ঈশ্বরের কথা শুনেছি, দেখিনি কোনদিন। আমার মতো অপদার্থকে দেখা দেবেনও না কোনদিন। এই সৃষ্টি কার, তাও জানি না। বিজ্ঞান বলে এক, পরাবিজ্ঞান বলে আরেক। এইটুকু বুঝি, জীবন জ্বলছে, পুড়ছে। রোগ, শোক, জরা, ব্যাধিতে ধামসাচ্ছে। যত মার খাচ্ছি ততই সরে আসছি আমার করুণাময় ঠাকুরের দিকে। দেরি হয়ে গেছে ঠিকই, তবু এখনো সময় আছে। চীনা প্রবাদে বলে, সুপুত্রের পরিচয় মেলে পিতার প্রয়াণের পর। তখন দেখতে হয়, সে পিতার পথ কতটা ধরে রাখতে পারছে। আমিও সেই সুপুত্র হতে চাই। ঠাকুরের পথ ধরে। সহসা সরব না। শত প্রলোভনেও না। তিনি আমাকে দিয়েছেন বিশ্বাস। তিনি আমাকে পূর্ব ও পরজন্মের বিশ্বাস দিয়েছেন। চুলোয় যাক বিজ্ঞান। ঠাকুর বলছেন : “পূর্বজন্মের সংস্কার মানতে হয়। শুনেছি একজন শবসাধনা করছিল; গভীর বনে ভগবতীর আরাধনা করছিল। কিন্তু সে অনেক বিভীষিকা দেখতে লাগল। শেষে তাকে বাঘে নিয়ে গেল। আরেকজন বাঘের ভয়ে নিকটে একটা গাছের ওপর উঠেছিল। সে শব আর অন্যান্য পূজার উপকরণ তৈয়ার দেখে নেমে এসে, আচমন করে শবের ওপর বসে গেল! একটু জপ করতে করতে মা সাক্ষাৎকার হলেন ও বললেন—’আমি তোমার উপর প্রসন্ন হয়েছি, তুমি বর নাও।’ মার পাদপদ্মে প্রণত হয়ে সে বললে—’মা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমার কাণ্ড দেখে অবাক হয়েছি। যে ব্যক্তি এত খেটে, এত আয়োজন করে, এতদিন ধরে তোমার সাধনা করছিল, তাকে তোমার দয়া হলো না। আর আমি কিছু জানি না, শুনি না, ভজনহীন, সাধনহীন, জ্ঞানহীন, ভক্তিহীন আমার উপর এত কৃপা হলো!’ ভগবতী হাসতে হাসতে বললেন, ‘বাছা! তোমার জন্মান্তরের কথা স্মরণ নেই, তুমি জন্ম জন্ম আমার তপস্যা করেছিলে, সেই সাধনবলে তোমার এরূপ জোটপাট হয়েছে, তাই আমার দর্শন পেলে।’”

জন্মান্তরে বিশ্বাস ঠাকুরই আমাকে দিয়েছিলেন। সেই বিশ্বাসেই এজন্মের বেচাল আমার নিয়ন্ত্রিত। যতটা পারা যায় নিজেকে সৎ রাখা, বিষয়-বিমুখ করে রাখা, সতর্ক দৃষ্টি রাখা ইষ্ট থেকে মন যেন না সরে যায়। এজন্মে না পাই, পরের জন্মে, পরের জন্মে না হলে তার পরের জন্ম। কোন এক জন্মে পাব নিশ্চয়। ঠাকুর বলেছেন : “বাঘ যেমন কপ্ করে জানোয়ার খেয়ে ফেলে, তেমনি অনুরাগের বাঘ কাম-ক্রোধ এইসব রিপুদের খেয়ে ফেলে। ঈশ্বরে একবার অনুরাগ হলে কামক্রোধাদি থাকে না।”

এজীবনে অনুরাগটাও যদি হয়। ঠাকুর বলেছিলেন : “যারা কেবল কামিনী- কাঞ্চন নিয়ে আছে—ঈশ্বরকে একবারও ভাবে না, তারা বদ্ধজীব। তাদের নিয়ে কি মহৎ কাজ হবে? যেমন কাকে ঠোকরানো আম ঠাকুরসেবায় লাগে না, নিজের খেতেও সন্দেহ।”

কাকে ঠোকরানো আম তিনি অপছন্দ করতেন! আমাকে যাতে কাম-কাঞ্চন না ঠোকরায়, সতর্ক হবার চেষ্টা করতে হবে আপ্রাণ। “সংসারী জীব, এরা যেমন গুটিপোকা।” আমি সেই গুটিপোকা হব না। ঠাকুর বলেছেন : “মনে করলে কেটে বেরিয়ে আসতে পারে; কিন্তু নিজের ঘর বানিয়েছে, ছেড়ে আসতে মায়া হয়। শেষে মৃত্যু।” না গুটিপোকার মৃত্যু আমার কাম্য নয়। “যারা মুক্ত জীব, তারা কামিনী-কাঞ্চনের বশ নয়। কোন কোন গুটিপোকা অত যত্নের গুটি কেটে বেরিয়ে আসে। সে কিন্তু দু-একটা।” সেই দু-একটার একটাও কি আমি হতে পারব না!

কিভাবে! “একটু কষ্ট করে সৎসঙ্গ করতে হয়। বাড়িতে কেবল বিষয়ের কথা। পাখি দাঁড়ে বসে রামরাম বলে। বনে উড়ে গেলে আবার ক্যা-ক্যা করবে।” আমাকে যেমন করেই হোক দাঁড়ে বসতে হবে। এই দেহমন্দির অন্ধকার রাখতে নেই। জ্ঞানদীপ জ্বেলে দিতে হয়। সেই দীপ জ্বালাবার চেষ্টা করতে হবে।

জীবনটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে যাবার আগে অনুরাগের আঠা মাখাতে হবে। ধরব তাঁকে, যিনি আমার হাত কোনদিন ছাড়বেন না। তিনি কে? আমার অটল বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের ফোয়ারা কে খুলবেন? আমার ঠাকুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *