একটি সাক্ষাৎকার
পচা কুমড়োর ভূতির মতো মানুষের ভেতরটা ক্রমশ বেরিয়ে আসছে। মানুষ এখন শুধুই মানুষ। দেবতা হবার খুব একটা চেষ্টা আগের মতো চোখে পড়ে না। ধ্যার মশাই, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। বেশ জাঁকিয়ে গদীয়ান হয়ে বসি, নিজেকে, নিজের পরিবারকে একটু সামলাই, তারপর অন্যের কথা ভাবা যাবে। আপনার বাবা?—কেন? ফাদার তো বেশ সুখেই আছেন! রাতে একপো করে খাঁটি দুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। পিওর মিল্ক। এই পুরু সর পড়ে। বুড়োর গোঁফে কৃতজ্ঞতার মতো সাদা-সাদা সর লেগে থাকে। পারফেক্ট হ্যাপিনেস। দুধ খাবার পর মুখ দেখলে মনে হয়, হ্যাপিয়েস্ট ক্যাট, এভার বর্ন ইন দি ওয়ার্লড। বেশ-বেশ। তা মার জন্য কী করছেন?—কেন? গর্ভধারিণীকে দেড় টাকা দিয়ে বাজারের বেস্ট তুলসীর মালা কিনে দিয়েছি। সকাল সন্ধে জপ করেন। একবার বেনারস ঘুরিয়ে এনেছি। গুরু পূর্ণিমার দিন গুরুদেবকে দেবার জন্যে একখানা করে তাঁতের ধুতি কিনে দিই, প্লাস পাঁচ টাকার নরম পাক। শীতকালে এক কৌটো চ্যবনপ্রাশ। রোজ দশ পয়সার পান-দোক্তা। নীচের পাটির এক সেট দাঁত বাঁধিয়ে দিয়েছি। এ বছর বোনাস পাইনি। সামনের বছর পেলে ওপর পাটি বাঁধিয়ে দেব।
মার শাড়ির খোলটা তেমন সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না কেন? অথচ আপনার স্ত্রীর শাড়ি! আপনি কী বলছেন? স্ত্রী আর মা এক জিনিস হল? একটা যুগের তফাৎ। সাবেক আর আধুনিক। স্ত্রী পরেন রুবিয়ার ছ’ইঞ্চি ব্লাউজ। মাকে মানাবে? বলুন? তিনি পরবেন ঘটি হাতা লংক্লথ। মোটা শাড়ির আব্রুও যেমন, ইজ্জতও তেমন। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে, পৌনে দুশো টাকার নাইলন জর্জেট স্ত্রীকেই মানায়। বন্যেরা বনে সুন্দর, তাই না। তা ঠিক। তবে একটা গরদ কিংবা একশো কুড়ি সুতোর ধনেখালি চওড়া লাল পাড়, মার মাতৃত্বের গৌরব কি একটু বাড়াত না?—কী করব বলুন! বাপ-মাকে আমরা চার ভাই ভাগাভাগি করে নিয়েছি তো! ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক-একজনের কাছে এক-একজন তিন মাস করে কোয়ার্টরলি ট্যাক্সের মতো। মা-বাবার ঋণ কি সহজে শোধ করা যায়! তবু কারুর-কারুর ট্যাক্স ফাঁকি দেবারপ্রবণতা। ট্যাক্স ফাঁকির যুগ পড়েছে। সেলস ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, পেরেন্টাল ট্যাক্স। মেজো যদি ‘জনতা’ দিয়ে দায় সারে, ছোট যদি তা-না-না-না করে, বড় কেন মূর্খের মতো চৌষট্টি টাকার শাড়ি কিনে মরবে? মামদোবাজি! না? তাই বুঝি রাজার দুধপুকুরের অবস্থা। হ্যাঁ। তাই দাঁড়িয়েছে। এ ভাবছে ও, ও ভাবছে এ। যা শত্তুর পরে পরে।
আমারও কি মশাই ভালো লাগে, তিন মাস অন্তর ক্যাম্বিসের ব্যাগ আর ছাতা বগলে বাবা চলছে। কলকাতা থেকে দুর্গাপুর, দুর্গাপুর থেকে রামপুরহাট, রামপুরহাট থেকে জলপাইগুড়ি। মাকে অবশ্য মারামারি করে আমার একার দখলেই রেখেছি। ভাইয়েরা বলে, স্বার্থপর। ছেলেমেয়ে ধরার জন্যেই নাকি মাকে দাসী করে রেখেছি। নাতি-নাতনি নিয়ে বুড়ি একটু আনন্দে থাকে। তার মানেটা কুচুটেরা কী করেছে দেখুন। আরও শিশুসঙ্গে স্বর্গ সুখ, শাস্ত্রই বলেছে। তোরা শাস্ত্র-টাস্ত্র পড়বিনি, অজ্ঞানের অন্ধকারে হাবুডুবু খাবি, আর শাস্ত্রবিশ্বাসীদের সমালোচনা করবি। এই তো তোরা আধুনিক! ঘেন্না ধরে গেল দাদা।
বাবাকেও তো থ্রু আউট দি ইয়ার রাখতে চেয়েছিলুম। ভাইদের বললুম, এসো, বারোয়ারি পুজোর চাঁদা করে বাবাকে আমার কাছে রাখি। বিশ্বাস হল না বাবুদের। ভাবলে, লাভের বারোয়ারির মতো আমি লাভের বাবা-বারোয়ারি ফন্দি এঁটেছি। চাঁদার টাকার সিকি যাবে পিতৃসেবায়, বাকিটা আমার সেবায়। কত বোঝালুম, অ্যানুয়েল হিসেবটা হিসেব পরীক্ষক দিয়ে সই করিয়ে সাবমিট করব। বলে কিনা ম্যানিপুলেশান হবে। ফাদারকে দিয়ে কেউ বিজনেস করে। পৃথিবীতে এরকম চামার কেউ আছে? পিতা কি পাথরের বুড়ো শিবরে মূর্খ। তোলা মেরে প্রফিট করব! যত মত তত পথ! বৃদ্ধ এখন চার ঘাটের জল ঘোলা করে, ঘোলাটে চোখে ঘুরছেন।
বেকার ছোটো ভাইটার জন্যে প্রতিষ্ঠিত দাদারা কী করছেন?—কী আর করব বলুন? ছ-বেলা অন্ন ধ্বংস করছে আর ধর্মের ষাঁড়ের মতো ঘুরে-ঘুরে বেড়াচ্ছে। যত চাকরি কলকাতায়! কার সাধ্য তাকে কলকাতা থেকে হাটায়। এত করে বললুম, দুর্গাপুরে লাকট্রাই কর। বীরভূমে গিয়ে আদার চাষ কর, কি জলপাইগুড়িতে গিয়ে স্কুল টিচারি কর। চোরা না শুনে ধর্মের বাণী। কলকাতার মধুতেই আটকে আছে। আমার বউ মশাই একটু পুরুষকার জাগাবার জন্যে দুর্ব্যবহার করে। কিন্তু গণ্ডারের চামড়া! কুম্ভক করে বসে আছে। ভালো ট্যাকটিকস দাদার হোটেলে খাওদাও আর ঘুরে বেড়াও। এদিকে সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। সরকারি চাকরির বয়স চলে গেল, এখন কী করবে বাছাধন! বেশি কিছু বলার জো নেই। মার মুখ অমনি তোলা হাঁড়ি। তিন বেকারে গলায় গলায়। মা, বাবা, বেকার ভাই। ছোট ছেলের জন্যে স্নেহের ভাণ্ড উপচে পড়ছে। চাকরির দরখাস্ত আর পোস্টাল অর্ডারে মাসে অ্যাভারেজে তিরিশ টাকা খরচ। সাধে আমার বউ রেগে যায়! আজ পর্যন্ত একটা চাকরি জুটল না। বললেই বলবে, ফেভারিটিজম।
আইবুড়ো বোন ছিল না একজন? ছিল তো! আমার কাছেই ছিল। দু-বেলা বউদির সঙ্গে চুলোচুলি। বয়স্থা মেয়ে বিয়ে না হলে যা হয়। বিয়ে হবে বলেও মনে হয় না। মার মুখ কেটে বসানো। সামনের দুটো দাঁত উঁচু। এখনকার ছেলেরা তো আর আমার বাবার মতো অন্ধ নয়। তারা বাজিয়ে নেবে রূপ চাই, গুণ চাই, চাকরি চাই। কোনটাই তার নেই। এদিকে বাবা তাঁর প্রভিডেন্ড ফান্ডের পুরো টাকা মেয়েকে উৎসর্গ করে বসে আছেন। কারুর ভোগেই লাগছে না। ‘ডগ ইন দি ম্যানজার’ পলিসি। অতগুলো টাকা ন দেবায় ন হবিষ্যায়। এত লেদডুস মেয়ে তুই, একটা বর জোটাতে পারছিস না। যৌবন থাকতে-থাকতে চারে একটা ভেড়া। দেখা যাক কী হয়, দুর্গাপুরে গেছে। আইবুড়ো চাকরেদের আড়তে।
আপনার নিজের বৃদ্ধ বয়সটা কেমন যাবে বলে মনে হচ্ছে?—ও ফাইন! আমি তো আটঘাট বেঁধে কাজে নেমেছি। প্ল্যানড ফিউচার। প্ল্যানড ফ্যামিলি, ফিক্সড ডিপোজিট। ইনসিওরেন্স। পেনশান। প্রভিডেন্ট ফান্ড। নিজের বাড়ি। একটা অংশে ভালো ভাড়াটে। মোটা ভাড়া। একটি মেয়ে। অলরেডি ম্যারেজ পলিসি ওপন করে ফেলেছি। এখন থেকে ধান্দায় আছি অভিভাবকহীন, মালদার, ভালো চাকুরে ছেলের। আড়কাঠি লাগিয়ে রেখেছি। ঠিক বেরোবে। বিয়ে দিতে পারব কি না জানি না। মেয়ের মাথায় যদি আমার হেডের ছিটেফোঁটা থাকে, তাহলে আজকালকার মতো নিজের ব্যবস্থা নিজেই করবে; হয়তো করবেও না। মর্নিং শোজ দি ডে। এখন থেকেই তার যা চান-চলন! হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মতো। আমাদের স্বভাবই ডাইল্যুটেড হয়ে ক্রমশই পোটেনসি বাড়ছে। আত্মপরতা থার্টি থেকে থ্রি হান্ড্রেডে গিয়ে উঠবে। জামাইটা মনের মতো ধরতে পারলে আমার ভবিষ্যৎ আরও পাকা। বৃদ্ধ শ্বশুর হামেশাই জামাই বাবাজীবনের কেয়ারে একটু মেয়ের আদর পাবে। তোরা ছাড়া বুড়োর আর কে আছে বল? ঈশ্বর তোমাকে আরও উন্নতি দিন, অর্থ দিন (আমি তোমাদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙি, উহ্য) ভুলে যেওনা, মেয়ে আমার! তোমাকে আমি পারচেজ করেছি। তুমি এই বৃদ্ধের পালকি বেহারা। কোনওরকম বেচাল দেখলেই মেয়ে আমার দেবে টাইট দিয়ে। তখন ওসব সভ্যতা ভদ্রতা মানব না। পাশবিক জগতের সোজা নিয়মেই চলবে আচার আচরণ।
একটা ছেলে। মানুষ করে যাব। দেখবে ভালো, না দেখে কুছ পরোয়া নেই। নিজের ব্যবস্থা করেই রেখেছি। না দেখাটাই স্বাভাবিক। তার জন্যে প্রস্তুত হয়েই আছি। আর বুড়ি যদি বুড়োকে লাথি মারে! টাকা দিয়ে নয়া দিল কিনে নেব, ম্যান। ইওরোপ আমেরিকায় বুড়োর বুড়ো তস্য বুড়ো টাকার জোরে বিয়ে করে মিসট্রেস রাখে। লাইফ হচ্ছে ‘গিভ এন্ড টেক’ বার্টার সিসটেম।