একটি চিনে গল্প
একটি চৈনিক গল্প মনে পড়ছে। ভারতবর্ষের এই মনোরম প্রেক্ষিতে গল্পটি মনে হয় শোভন হবে। লোক কাহিনির এই গুণ, মানুষের সব কালেই প্রাসঙ্গিক। তার অর্থ, মানুষের সব কালই এক কাল। কালে কালে সেই একই মানুষের লীলা খেলা।
মিংরাজত্ব কালে শানডং প্রদেশে এক ধনী ব্যক্তি বাস করতেন। তাঁর একটি ছেলে ছিল। বাপ মায়ের অতি আদরে ছেলেটি বখে গিয়েছিল। লেখাপড়া কিছুই শিখল না। খায়দায় আর আড্ডা, ইয়ার্কি মেরে বেড়ায়। প্রতিদিনই সে পান ভোজন শেষ করে শহরের পথে চরতে বেরোয়। তার হাতে থাকে সুদৃশ্য একটি খাঁচা, আর সেই খাঁচায় একটি পাখি। তাকে তার আসল নামে আর কেউ ডাকে না। সবই বলে, ‘পাখি।’
একদিন শহরের রাজপথ ধরে সে চলেছে। নিষ্কর্মা, মূর্খ, সেই ধনীর সন্তান। পথের এক পাশে বসেছে এক জ্যোতিষী। রোজ যেমন বসে। দু, দশ টাকার বিনিময়ে মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ বলে দেয়। যথারীতি তাকে ঘিরে মানুষের জটলা। ‘পাখি’ ভাবলে, যাই দেখি, মজাটা কেমন জমেছে। ভিড় ঠেলে সামনে দাঁড়াতেই, গণকঠাকুর চিনে ফেলেছে। আরে এইত সেই বড়লোকের বেটা! সঙ্গে সঙ্গে গণক একটা মতলব ভেঁজে ফেললে—পাঁঠাটাকে আচ্ছাসে তোয়াজ করে কিছু পয়সা হাতিয়ে নেওয়া যাক। পাখিকে ডেকে গণক বলছে, ‘আরে, এসো-এসো, ভাই। এতদিন ছিলে কোথায়! তোমার কথা আমি যে রোজই ভাবি, যার এমন সুন্দর ধারাল দুটো চোখ, ধনুকের মতো দুটো মোটা ভুরু, তুমি তো ভাই রাজনীতিতে গেলে মার-মার, কাটকাট করে ফেলবে। কোথায় যে উঠে যাবে, তুমি নিজেই জান না। কোনোদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কপালটা দেখেছ ভাই! অত চওড়া, উঁচু কপাল কজনের হয়! এ তো রাজার কপাল! তুমি যদি বেজিং-এ গিয়ে রাজদরবারের পরীক্ষায় বসতে, তাহলে আমার বিচারে তুমি ফার্স্ট হতে আর সরকারের সবচেয়ে উঁচু পদটি হত তোমার! নিজের ভাগ্য নিজেই জানো না ভাই, ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছ অকাজে। তোমাকে আমি আমার আগাম অভিনন্দন জানিয়ে রাখছি, তখন তো এই অধমকে আর মনে রাখবে না!’
‘পাখি’ যদি গোমূর্খ না হত, লোকটির এই চাটুকারিতার জবাব দিত, দু গালে ঠাস ঠাস করে গোটা কতক চড় মেরে। যে পড়তে জানে না, একটা অক্ষরও লিখতে পারে না, সে বসবে রাজদরবারের পরীক্ষায়। শুধু বসবে না, স্বসম্মানে পাশ করে সর্বোচ্চ রাজপদ পাবে! পাখি এসব না ভেবে, ভাবলে যা, তা হল, বলা তো যায় না, কি থেকে কি হয়! আমার বাপের অনেক পয়সা। সেই অঢেল পয়সার ঠেলায় রাজপদে গিয়ে বসা এমন কী কঠিন ব্যাপার! পাখি মনে-মনে ভীষণ খুশি হয়ে বাড়ি চলে এল। আসার আগে জ্যোতিষীকে ভালো করে জিগ্যেস করে এল, ‘তুমি কি নিশ্চিত যে, আমার দ্বারা পরীক্ষা পাশ সম্ভব?’
—শুধু নিশ্চিত নই, প্রথম তিনজনের মধ্যে তোমার নাম থাকবেই থাকবে।’
—এখন তোমাকে আমি দুশো টাকা দিচ্ছি। যদি তোমার ভবিষ্যদ্বানী মেলে তাহলে আরও পাবে, আর যদি না মেলে ঠাকুর তাহলে সুদে আসলে তোমার সব-কটা দাঁত উপড়ে নেব।
জ্যোতিষী মনে-মনে ভাবলেন, যবে তুমি রাজা হবে, তখন আমি চিতায়—। কার দাঁত ওপড়াবি রে পাঁঠা!
পাখি লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরে এল। ব্যাগ গোছানো হয়ে গেল। টাকা পয়সা ভরে নিল গেঁজেতে। পাখি চলেছে কোথায়? বেজিং-এ। উচ্চ রাজপদের নির্বাচনী পরীক্ষায় বসবে। একবারও মাথায় এল না, তার মতো ‘ক অক্ষর গোমাংস এক মহামূর্খ কেমন করে পরীক্ষায় বসতে পারে!
বেজিং-এ পৌঁছতে-পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেল। আবার সেই দিনই পরীক্ষার শেষ দিন। রাজধানীতে প্রবেশের পশ্চিম সিংহ দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে। পাখি কিছুই জানে না। সে দেখলে সার-সার জলের গাড়ি চলেছে। মিং আর কিং ডাইনাস্টির রাজারা প্রস্রবণের জল পান করতেন স্বাস্থ্যের কারণে। দূরে একটা পাহাড় ছিল, সেই পাহাড়ে ছিল জেড স্প্রিং। জল আসছে সেইখান থেকে। পাখি আসছিল ঘোড়ায় চেপে। জলের গাড়ির পেছন-পেছন সে শহরে ঢুকে পড়ল। প্রহরীরা বাধা দিলে না, ভাবলে রাজপ্রাসাদের প্রহরী, জলের গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। শহরে তো ঢুকল, কিন্তু কিছুই জানে না, কোথায় কী আছে। পরীক্ষাকেন্দ্র কোথায়, কার সঙ্গে দেখা করতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরে বেড়াল। বেড়াতে-বেড়াতে এসে পড়ল শহরের চৌমাথায়। সেখানে এসে দেখছে লণ্ঠন হাতে এক দল লোক আসছে। তাদের মাঝখানে রয়েছেন স্বয়ং রাজকুমার। তারা বেরিয়েছে শহরে রাতের চৌকি দিতে। এত লোককে একসঙ্গে আসতে দেখে পাখির ঘোড়া ক্ষেপে গেল। লাগাম টেনেও বাগে রাখা গেল না। পাখির ঘোড়া গিয়ে পড়ল রাজকুমারের ঘোড়ার ঘাড়ে। এই রাজকুমার রাজার অতিশয় প্রিয়, ফলে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা এবং বদমেজাজি। ইচ্ছা করলে তখনই তরোয়ালের এক কোপে পাখিকে খতম করে দিতে পারত। কিন্তু রাজকুমারের কৌতূহল জাগল—মারার আগে জানা দরকার—এই উজবুকটা কে! রাজকুমার তার নিজের ঘোড়ার রাশ সংযম করে প্রশ্ন করল,
—এই যে ছোকরা বেঁচে থাকায় বিরক্তি ধরে গেছে বুঝি?
পাখি তো কিছুই জানে না কোন দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে কথা বলছে! ধড়, মুণ্ড আলাদা হল বলে। পাখি চিৎকার করে উত্তর দিলে—আমার সঙ্গে ওই ভাবে কথা বলবে না, সাবধান করে দিচ্ছি। জানো না, আমি একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি।
—কী কাজ মানিক?
—আমি সেই শানভং থেকে সারাদিন ঘোড়া ছুটিয়ে আসছি। আমাকে রাজদরবারের পরীক্ষায় বসতে হবে। যদি আমার দেরি হয়ে যায়, তাহলে প্রথম তিনজনের মধ্যে আমার নাম থাকবে না।
—প্রথম তিনজনের মধ্যেই যে তোমার নাম থাকবে, তুমি এতটাই নিশ্চিত?
—তা না হলে অত দূর থেকে আমি পরীক্ষা দিতে ছুটে আসব কেন?
—সে তো বুঝলুম, কিন্তু পরীক্ষার হলের দরজা তো এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে, তুমি ঢুকবে কী করে?
—আমি গিয়ে দরজায় টোকা মারব।
রাজকুমার মনে-মনে ভাবলে, বেটা ভাঁওতা মারছে, প্রথম তিনজনের একজন হবে, এতই পণ্ডিত তুমি! বেশ একটা চানস দেওয়া যাক। ধাপপা ধরা পড়লে কচুকাটা করতে কতক্ষণ! রাজকুমার তখন তার পার্ষদদের হুকুম করলে—এই, আমার একটা পরিচয়পত্র একে দিয়ে দে, যাতে বিনা বাধায় পরীক্ষাকেন্দ্র প্রবেশ করতে পারে। তোদের একজন গাইড হয়ে এই ছোকরার সঙ্গে যা।
পাখি তো মহাখুশি। গাইড আগে-আগে, পাখি তার পরিচয়পত্র দোলাতে-দোলাতে পিছে-পিছে। টোকা মারতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন দুই প্রধান শিক্ষক। পরিচয়পত্র দেখে দুই প্রধান শিক্ষকের একজন লাফিয়ে উঠলেন—ওরেব্বাবা এতো খোদ রাজকুমারের পরিচয়পত্র। নিশ্চয় তাঁর কোনও আত্মীয়। একে তো ঢুকতে দিতে হবেই। দ্বিতীয় পরীক্ষক বললেন, তা কী করে হয় আমাদের কোনও ঘরেই তো কোনও জায়গা নেই। শলা-পরামর্শে অবশেষে ঠিক হল, প্রধান পরীক্ষক দুজন তাঁদের ঘরটি পাখিকে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা বাইরে রাত কাটাবেন। রাজকুমারের আত্মীয়কে কী ফেরানো যায়, তাহলে ধড়ে মুণ্ড থাকবে না।
পাখি ঠাঁই পেল। প্রথম পরীক্ষক বললেন, তাহলে ওকে কাগজ আর প্রশ্ন দেওয়া যাক। দ্বিতীয় পরীক্ষক বললেন, দাঁড়াও, কোন বিষয়ের প্রশ্ন দেবে? ওর বিষয়টাই তো জানা হল না। জিগ্যেস করার সাহস হল না দুজনেরই। রাজকুমারের আত্মীয়। বিষয়টা তো তাদের আগে জানা উচিত ছিল। তখন দুজনে ঠিক করলেন, তাঁরাই সব উত্তর লিখে চিফ-এর কাছে খাতা জমা দেবেন। তাই হল। পাখি পড়ে পড়ে ঘুমলো, এদিকে তার খাতা জমা পড়ে গেল। পরীক্ষকরা তাকে প্রথমই করত। চক্ষুলজ্জার কারণে তাঁরা পাখিকে দ্বিতীয় স্থান দিলেন।
প্রথা অনুসারে ফল প্রকাশের দ্বিতীয় দিনে উত্তীর্ণরা সবাই পরীক্ষকদের সম্মান জানাতে গেল। সে দলে কিন্তু পাখি নেই, কারণ এসব ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। পরীক্ষকরা অবাক হয়ে নিজেরাই পাখির কাছে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। পাখি বোকার মতো যা হয় একটা উত্তর দিয়ে গুম মেরে বসে রইল। পরীক্ষকরা অবশ্য এর বেশি আর কিছু করার সাহস পেলেন না। তাঁরা ভাবলেন, এ হল রাজকুমারের বন্ধু অথবা কাছের আত্মীয়। শীঘ্রই উঁচু রাজপদে গিয়ে বসবে, তখন একেই তো আমাদের তেল মেরে চলতে হবে।
ইতিমধ্যে পাখি জানতে পেরেছে, যার পরিচয় পত্রের জোরে এতসব কাণ্ড হয়েছে সে হল এই রাজ্যের ক্ষমতাশালী রাজকুমার। পাখির আর কিছু না থাক কুচুটে বুদ্ধির অভাব ছিল না। দামি-দামি উপহার সামগ্রী নিয়ে সে রাজকুমারের বাড়িতে গিয়ে হাজির। পাখি প্রহরীর হাতে তার নামের কার্ড আর উপহারের একটা তালিকা ভেতরে পাঠিয়ে দিল। রাজকুমার মানুষটাকে ভুলে গেলেও উপহারের তালিকা দেখে বেজায় খুশি। প্রহরীকে বললেন, এক্ষুণি ভেতরে নিয়ে আয়। পাখি বললেন, সেদিন আপনি পরিচয়পত্র দিয়ে পরীক্ষায় বসতে সাহায্য না করলে আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতে পারতুম না। রাজকুমার ভাবলেন, বাবা, এ তো সত্যিই মহাপণ্ডিত তাই সেদিন অত বোলচাল মেরেছিল। আমি যখন সম্রাট হব, তখন তো একে আমার কাজে লাগবে। এর অনারে এখুনি একটা মহা ভোজের আয়োজন করো।
সাংঘাতিক পান ভোজনের পর পাখি বিদায় নিল। বিদায় জানাতে স্বয়ং রাজকুমার দরজা পর্যন্ত এল। যা অন্য কারও বেলায় সচরাচর করেন না। সারা বেজিং-এ এই সংবাদ ছড়িয়ে গেল। পাখির জয়জয়কার। রাজকর্মচারীরা এইবার একযোগে সম্রাটের কাছে একটি যৌথ আবেদন পাঠালেন—পাখির মতো একজন সুদক্ষ, মহাপণ্ডিতকে অবিলম্বে কোনও রাজপদে অভিষিক্ত করা হোক, দেশ তাতে উপকৃত হবে। সঙ্গে-সঙ্গে ইম্পিরিয়াল অ্যাকাডেমিতে পাখি একটি বড় পদ পেয়ে গেল। হিজ ম্যাজেস্টিজ সার্ভিস। না জানে লিখতে, না পড়তে। ড্রাফট, মেমোরেণ্ডম, আর্টিকাল যা আসে পাখি একবার দেখেই বলে, ‘বা:, বা:, খুব ভালো, তুলনা নেই।
এই কায়দায় বেশ চলছিল। এসে গেল রাজকুমারের জন্মদিন। সবাই সব নানা রকমের উপহার নিয়ে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ করতে যাচ্ছে। পাখিও রয়েছে সেই দলে। সে অনেক কিছু কিনেছে, সেই সঙ্গে কিনেছে বিশাল বড় একটা স্ক্রোল।
কে একজন জিগ্যেস করলে, মহাশয়, এটাও কী উপহার?
—অবশ্যই।
—তা কিছু একটা লিখুন। কিছুই তো লেখেননি। এই সুযোগ আপনার হস্তাক্ষর প্রথম দেখার সৌভাগ্য হবে আমাদের।
—আমার সব ভালো ভাই, কেবল হাতের লেখাটাই তেমন সুবিধের নয়! তুমিই লিখে দাও। রাজকর্মচারিটি মনে-মনে বললে, ‘দাঁড়া, ব্যাঁটা তোর মজা দেখাচ্ছি। সে বড়বড় করে লিখলে, ‘হে রাজকুমার! তোমার কীর্তিকাহিনি আমাদের জানা আছে। পুরাকালের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজকুমারের মতো, তুমিও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। হে নরাধম, তুমি সম্রাটকে হত্যা করে সিংহাসনে বসতে চাইছ! সিংহের আসনে শৃগাল! ধিক, ধিক!’ পাখি দেখে তার সেই এক পেটেন্ট মন্তব্য—বা:, বা:, বহুত সুন্দর!
রাজকুমারের ঘরের দেওয়ালে স্ক্রোলটা ঝুলে গেল। রাজকুমার লেখাটার দিকে তাকালেই না। অন্য সবাই পড়ছে, কিন্তু সাহস করে কেউ কিছু বলছে না। সবাই জানে, বললেই মুন্ডচ্ছেদ। ও লিখেছে, আর তুমি পড়েছ, দুজনেরই এক গতি। লেখাটা ঝুলেই রইল। এদিকে রাজকুমারের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেল। সার্চ করে তার ঘর থেকে বেরল, সম্রাটের পোশাক আর তরোয়াল। সম্রাট আদেশ দিলেন, সবকটা ষড়যন্ত্রীকে ঝুলিয়ে দাও। যেহেতু পাখি তার পেয়ারের লোক, পাখিরও প্রাণদণ্ড।
তখন এক রাজসভাষদ নতজানু হয়ে সম্রাটকে নিবেদন করলেন—ষড়যন্ত্রের খবর তো পাখিই প্রথম ফাঁস করে। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে রাজকুমারকে লিখিত ধিক্কারও জানায়। সেই লেখা আজও ঝুলছে। সম্রাট সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ‘তিন ধাপ প্রাোমোশন। রাজকুমার ঝুলে গেল, পাখি উঠে গেল তিন পদ ওপরে। ভারতের অবস্থার প্রেক্ষিতে গল্পটি মিলিয়ে দেখলে হয়!