একটি অখাদ্য গল্প
আমার এ পথে হাঁটা আবার বন্ধ করতে হবে। মনে মনে এই কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরছিলাম। আজ সকালবেলাতেই প্রথম লক্ষ করলাম বাণী শাড়ি ধরেছে। প্রথম বয়সের শাড়িতে মেয়েটাকে ভালই দেখাচ্ছিল, এর দিদিদের মতোই বলা যায় কিংবা তাদের চেয়েও রাণী, মণি দুজনের চেয়েই হয়তো একটু বেশিই সুন্দরী, কিন্তু আমাকে এ পথে হাঁটা বন্ধ করতে হবে।
আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সদরে ট্রামরাস্তার এইটাই সোজা পথ, কিন্তু আবার সেই বাড়ির পেছন ঘুরে সেই উলটোপথ, সেইটাই ধরতে হবে। না, বয়স হয়েছে আর ধাক্কা সামলাতে পারব না। মনে মনে প্রথম যৌবনের সেই দুঃসাহসী দিনগুলির কথা ভাবতে একটু বেদনা, একটু দুঃখও যেন হচ্ছিল। তখন কত কী করা যেত, ওর দিদিদের রাণী-মণিদের আমি থোড়াই তোয়াক্কা করেছি। কিন্তু বয়েস কিছু বাড়ল, একটু সমঝে চলতে হবে।
খোকনদা, এই খোকনদা…, কখন থেকে ডাকছি, মোটেই সাড়া দিচ্ছ না! বুকটা আঁতকে উঠল। পিছনে ফিরে দেখি যাকে এড়ানোর জন্যে এত পরিকল্পনা এত বুদ্ধির মারপ্যাঁচ, ঘোরালো সড়ক, সেই মেয়েই ছুটতে ছুটতে প্রায় পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে। গরমের দিনের সকাল বেলা। এইটুকু ছুটে এসে কপালে ঘামের ফোঁটা জ্বল জ্বল করে জ্বলছে, কঁপতে কাঁপতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। কয়েকটা স্বচ্ছ তরল স্বেদবিন্দু। শাড়ির বিব্রত বেসামাল ভঙ্গিটা, সব মিলিয়ে বাণীকে যেন অস্বীকার করা যায় না। আমার বুক কাঁপতে লাগল। আমি জানি, জানি এখনি অথবা আগামী কাল ও সেই মারাত্মক প্রস্তাব করবে, এই শাড়ি পরার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রস্তাব সেই আমন্ত্রণের অধিকার ওর জন্মেছে একদিন ওর দিদিদের মতোই।
রাণী-মণির হাত থেকে আমি পরিত্রাণ পাইনি, এবারেও হয়তো পাব না। কিন্তু আর কতকাল! আর বাণীই যদি শেষ হত তাহলে হয়তো চোখ বুজে ঝাঁপিয়ে পড়া যেত। কিন্তু আরও ছোট, আরও ছোট–অনেক, বাণীর বোনেদের সংখ্যা অর্থাৎ ভুবনবাবুর, আমার প্রতিবেশীর, মেয়েদের সংখ্যা আমি শুনে দেখিনি, হয়তো ভুবনবাবুও গুনে দেখেননি। এরা প্রত্যেকে বড় হবে, প্রত্যেকেই মণিরাণীবাণীর মতো একদিন পল্লবিনী হবে কিন্তু কতকাল, আর কতকাল আমি তাদের প্রথম অভিজ্ঞতার শিকার হব। মনের মধ্যে একটা বিদ্রোহের ভাব দেখা দিয়েছে কিন্তু এইটুকু মেয়ের সামনে সেটা দমন করতে হল।
খোকনদা, একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে? তুমি কতদিন আমাদের বাসায় আস না। মা বলছিল, ছোড়দি সেদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছিল, তোমার খোঁজ করলে। আমি তোমাকে ডাকতে গিয়েছিলাম। তুমি বাসায় ছিলে না। রাতদিন বাইরে বাইরে কোথায় এত টো-টো করে ঘোরো! বেশ পাকা গিন্নির মতো কথা বলতে লাগল বাণী। তারপর হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে বলল, দ্যাখো আমি শাড়ি পরেছি, বেশ ভাল দেখাচ্ছে না! বলেই একটু লজ্জিত হয়ে পড়ল, কথাটা একটু ঘুরিয়ে শাড়ির আঁচলটা বাঁ হাতের একটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল, বাবা কিনে দিয়েছে, শাড়িটা বেশ সুন্দর, তাই না!
এসব কথায় আমার কোনও আপত্তি নেই, আমি শুধু মূল প্রস্তাবটির আশঙ্কা করছিলাম, বললাম, শাড়িটা বেশ সুন্দর, আর তুমিও মন্দ না।
একটু মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলে বাণী বলল, কিন্তু তুমি কবে আসবে আমাদের বাড়িতে? মুখে বললাম, যেদিন আজ্ঞা করবে সেদিনই। মনে মনে অন্য কুমতলব ভাজতে লাগলাম। তখনকার মতো বাণী চলে গেলো।
যদিও ধরেই নিয়েছিলাম যে আজ-কালের মধ্যেই বাণী আসবে, আর আসবে সেই সাংঘাতিক মর্মান্তিক প্রস্তাব, কিন্তু সে যে এত তাড়াতাড়ি সেটা আশা করিনি। পরদিন সকালে ঘুম থেকে আমি উঠি সাড়ে নটায়, তখন ছটা–মানে আমার মধ্যরাত্রি, সেই সময়ে হাঁকাহাঁকি দরজায় কড়া নাড়া, প্রায় ভেঙে ফেলবার উপক্রম। উঠে দরজা খুলতে হল। খোকনদা, বড়দি এসেছে। আজ শেষ রাত্রিতেই ফিরেছে।
দেখি একটু পিছনে রাণী দাঁড়িয়ে। কাটিহার না কোথায় বিহারের দিকে এর বিয়ে হয়েছে। আরে এসো এসো, বাধ্য হয়েই আমাকে বলতে হয়। বলতে বলতে আমি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করি। ওরাও পিছে পিছে আসে। তা আজকেই ফিরছ রাণী, কেমন? শ্বশুরবাড়ির খবর কী? যে খবরগুলি না জেনেও অন্যান্য দিনের মতো আজকের দিনটাও কেটে যেতে পারত, সেইগুলিই জানবার জন্যে আমাকে এই মুহূর্তে ভদ্রতার খাতিরে বিশেষ উৎসাহ দেখাতে হয়। রাণী এতসব প্রশ্নের উত্তরে একটু মুচকি হাসে। আজ সকালেই ফিরলে? ফিরেই সাত তাড়াতাড়ি আমার এখানে ছুটলে, মন কেমন করছিল?
এইবার রাণী যেন একটু গম্ভীর হল, পাশের টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিয়ে আলগোছে পাতা ওলটাতে লাগল। বাণী কিন্তু এর মধ্যেই একটু ফিক করে হেসে ফেলল। রাণী ধমকে উঠল, থাম ফাজিল কোথাকার! আসলে ধমকটা আমার উদ্দেশেই। সুতরাং আমাকে নিরত হতে হল। এবং সেই মুহূর্তেই লক্ষ করলাম রাণী আর বাণী দুইজনে চোখে চোখে কী একটা কথা আলোচনা করে নিল। আমার অন্তরাত্মায় আমি অনুভব করলাম আমি অবিলম্বে সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনার মুখোমুখি হব।
এইবার বাণী কথা বলল, দিদি আজই ফিরে যাচ্ছে। ওর দেওরের বিয়ে, কিছু কেনাকাটি করতে হবে। তারপর রাত্রেই ফিরে যাবে।
সে কী, আজকেই ফিরে যাবে? আমাকে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হতে হয়।
এইবার রাণী বলল, , আর সেইজন্যেই তুমি অনেকদিন আমাদের বাসায় যাও না, আজ দুপুরে আসবে, ওখানেই খাবে। এবং বাণী যোগ করল, জানো খোকনদা, আমি রান্না করব। আমি কেমন সুন্দর রান্না করতে শিখেছি।
আমার মাথায় বজ্রাঘাত হয়। যা ভেবেছি ঠিক তাই হল। রাণী-মণির বেলায় যা হয়েছে, এবারও বাণীর বেলাতে তাই হল। বাণীর প্রথম রান্না, তার স্বাদ আমাকেই সর্বাগ্রে গ্রহণ করতে হবে। আমিই এদের এই প্রাণহরা অভিজ্ঞতার সবচেয়ে সুলভ শিকার। যা এড়াব বলে কালকেই মনে-প্রাণে প্রতিজ্ঞা করেছি, এই দুই তরুণী প্রতিবেশিনীর সামনে কিছুতেই সেটা করা যাবে না সেটা আমি এখনই বুঝলাম। না, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে আবার সেই একই দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে।
এই তো রাণী আমার সামনে বসে রয়েছে। সাধারণ সুন্দরী, নববিবাহিতা। চেহারায়, আচরণে একটা স্মিত কোমলতার ছাপ রয়েছে। কিন্তু একে দেখলে কে বুঝতে পারবে এর হাত দিয়েই বেরোতে পারে হাত-বোমার চেয়েও মারাত্মক সেই সব খাবার। সেই মানকচুর চপ। শরীর এখনও রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। যারা আমাকে সম্প্রতি চেনেন, তারা জানেন না, চিরকাল আমার কণ্ঠস্বর এমন ছিল না। এককালে আমি আপনাদের মতোই, সাধারণ মানুষদের মতোই, কোমল কণ্ঠস্বরে কথা বলতে পারতুম। কেউ কি বিশ্বাস করবে, করা কি সম্ভব যে আমার সেই অমায়িকতা এই একটি কোমল-দর্শনা যুবতীর হাতে নিহত হয়েছে!
তবে রাণীর চেয়ে মণি আরও সাংঘাতিক ছিল। এই পৃথিবীতে অনেক খাদ্যদ্রব্য নিশ্চয়ই আছে এবং আমরা সকলেই সেরকম খাবার লোভে পড়ে বা বিপদে পড়ে গ্রহণ করে থাকি যার জন্যে যকৃৎ, প্লীহা বা অন্ত্রাশয়ে নানা অসুবিধা দেখা দেয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন আর নাই করুণ মণির তৈরি এক ধরনের পরটা খেয়ে আমার হাঁটুতে, কাঁধের জোড়াতে এবং দাঁতের মাড়িতে ভয়ংকর ব্যথা হয়েছিল, দুহাতের শিরা এক সপ্তাহ ফুলে ছিল, একুশ দিন অফিস যেতে পারিনি। জোড়াসন হয়ে মেজেতে খেতে বসেছিলাম। এদের বোনেদের এবং মায়ের অনুরোধে উপরোধে, বলা উচিত বলপ্রয়োগে, হাঁটু গেড়ে মেজেতে কাঁধের ও হাতের শিরায় শিরায় এবং দাঁতের মাড়িতে শরীরের সমস্ত শক্তি নিবিষ্ট করে পর পর চারটে খণ্ড গলাধঃকরণ করতে হয়েছিল এবং খেয়ে আর উঠতে পারিনি, মেজেতেই শুয়ে পড়েছিলাম। এদের ধারণা সেটা ভোজনাধিক্যবশত, আমার ধারণা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য রোগশয্যায় মণি আমাকে বলেছিল, খাবারটা অবশ্য ভালই হয়েছিল, কিন্তু খোকনদার অতটা খাওয়ার কি দরকার ছিল?
এবং মণির কাছেই তার প্রস্তুত-প্রণালী শুনেছিলাম। এখন ঠিক স্পষ্ট মনে নেই তবে এই ঘটনার প্রতি সন্দেহশীল পাঠকদের (এবং পাঠিকাদের) একটু নমুনা দিচ্ছি। ধৈর্য সহকারে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। প্রথমেই বলা উচিত যে পরটাগুলি গম বা যব, এমনকী কোনও শস্যবীজ থেকেই তৈরি হয়নি, এগুলি ফলজাত। আরেকটু খোলসা করলে হয়তো ভাল হয়। আমের আঁটির ভেতরের সাদা সার গুঁড়ো করে কঁঠালের বিচির সঙ্গে সেটা সেদ্ধ করে রোদ্দুরে শুকনো হয়। তারপর জল দিয়ে চটকে মেখে আবার রোদ্দুরে শুকানো হয়। তারপর একে উপাদেয় করবার জন্য কিঞ্চিৎ মশলা এবং খাদ্যপ্রাণযুক্ত করবার জন্যে পুঁইশাক নিংড়ে তার রস দিয়ে আবার শুকানো হয়। বিজ্ঞানের শিক্ষা এবং মণির উদ্ভাবনী শক্তি দুই-এ মিলে এই মারাত্মক পরিণতি।
সেই রাণী-মণির বোন বাণী, তার হাতের রান্না খেতে হবে আমাকে আবার আজ দুপুরে এবং আমি আবার স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করলাম, ওদের সেই ছোট ছোট বোনেরা যারা প্রতিদিন বড় হচ্ছে এবং কাল হোক, পরশু হোক, শাড়ি পরা শুরু করবে আর আবার সেই সঙ্গে সেই রান্না আর আমি। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটা কিছু কোনও একটা প্রতিবিধান, একটা প্রতিকার করতেই হবে। বছরের পর বছর এই অত্যাচার আর নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে আমি নিজেকে ঠেলে দিতে পারি না। আজ আবার আমার সেই প্রভুভক্ত কুকুরটির কথা মনে পড়ল। রাস্তা থেকে এনেছিলাম বাচ্চা অবস্থায়, তারপরে শত অপমানে, প্রহারেও গৃহত্যাগ করেনি। মণি একবার এক ধরনের পোলাও তৈরি করেছিল। কী দিয়ে তৈরি করেছিল বলতে পারব না, কিন্তু তৈরি করে একটা ঠোঙায় করে রুমালে বেঁধে দিয়ে বলেছিল, খোকনদা, এটা নিয়ে যাও। আজ খেয়ো না। দু-একদিন পরে খাবে। যত বাসি হবে ততই মুখরোচক হবে। খাবারটি বাসায় এনে আমার টেবিলের উপর রেখেছিলাম, পরদিন সকালে সেই ঠোঙাটি মুখে করে আমার প্রিয় কুকুরটি হঠাৎ ঘরের বাইরে চলে গেল, সেই যে গেল, আর এল না, চিরদিনের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। পরে একবার পাড়ার বাইরে বহুদুরে একটা রাস্তায় হঠাৎ কুকুরটি দেখতে পেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে দেখেই এত ভীত, আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে গেল যে বলার নয়।
সুতরাং, আর অত্যাচার সহ্য করা যায় না। এর একটা বিহিত করতেই হবে। আমি মরিয়া হয়ে উঠি।
যথাসময়ে মধ্যাহ্নকাল এল, আমাকে উঠতে হল, বাণীর ছোট জনাচারেক দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাকে নিয়ে যেতে। ভাল করে স্নান করলাম, মাথাটি এই গুরুতর সংকটে কিঞ্চিৎ ঠান্ডা থাকা দরকার। তারপর পায়ে পায়ে গুটি গুটি এগুনো গেল ওদের বাড়ির দিকে।
গিয়ে দেখি ত্র্যহস্পর্শ যোগ। মণিও এসেছে, বলল, দিদি এসেছে খবর পেয়ে চলে এলাম।আমি বললাম, তা বেশ। তুমিও রান্না করলে নাকি? না সবই বাণী? মণি বললে, আমি একটা মাত্র তৈরি করেছি, শুধু মশল্লা দিয়ে, শুধুই মশল্লা আর কিছু নয়, একটা মশল্লা চচ্চড়ি।মশল্লার সঙ্গে জিনিসটা। কী দিলে, কী দিয়ে চচ্চড়িটা হল? আমি একটা ছোট প্রশ্ন করি। মণি জানায়, আরে বলছি তো, শুধু মশল্লা দিয়ে আর কিছু নেই, ধনে-মৌরি চচ্চড়ি। শুধু ধনে-মৌরি? তবুও আমার সংশয় দূর না হওয়ায় মণি অসম্ভব ধমকে ওঠে। আগে খাও, খেয়ে বলো। ইতিমধ্যে বাণী এসে উপস্থিত। কপালে কালি, হাতে হলুদের দাগ, শাড়ির আঁচলেও, বিশেষ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। এসেই প্রশ্ন করল, কাঁচকলার মধ্যে নুন থাকে, জানো খোকনদা? আমি কাতর-কণ্ঠে জানাই, থাকা স্বাভাবিক। সেই কঁচকলা গরম জলে কুচি কুচি করে সেদ্ধ করে তার থেকে নুন বের করে নিয়েছি। তারপর সেই জল দিয়ে আর সব রান্না করেছি, আলাদা করে নুন দেওয়ার দরকার করেনি। বাণীর কথা শুনে আমি অভিভূত এবং মণি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে, রাণীও এসে যোগ দেয়। ওরা এরকম কোনওদিন ভাবতেই পারেনি বাণী এই পনেরোতেই যেটা করে ফেলল। ওরা বোনের জন্যে বিশেষ গর্বিতও হতে থাকে। সবচেয়ে ছোট একটি বাচ্চা ঘরের কোণে বসে পুতুলের রান্না-বান্না করছিল খুব মন দিয়ে। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে মণি বলল, দেখছ, কেমন মনোযোগী। ও বাণীর চেয়েও সরেস হবে।
ইতিমধ্যে ওদের মা চলে আসেন। এসেই হাঁকডাক শুরু করে দেন। এখনি জায়গা করে দাও, আর দেরি করো না। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে সে আর খাবারই থাকে না।
সুতরাং খেতে বসতে হল। বিচিত্র বর্ণগন্ধসমন্বিত অপূর্ব খাদ্যদ্রব্য আমার চতুর্দিকে। তাকালেই চোখে জল আসে জিভ শুকিয়ে যায়। অনুমান করি, এত প্রয়োজন ছিল না, এর যেকোনও একটিই কালান্তক হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মুখেও তাই বলি, এত করার কী ছিল, অল্প দু-একটা রান্না করতে পারতে। তোমরা এত পরিশ্রম করলে। বলতে বলতে একসঙ্গে সবগুলি তরকারি ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে মেশাতে থাকি। এই নীল রঙের পটলের ডালনাটার সঙ্গে ওই সাদা ধবধবে দুধ দিয়ে রাঁধা মাংসের ঝোলটা, তার সঙ্গে লাল টকটকে মুগের ডাল মেশাতেই একটা আশ্চর্য নতুন রং দেখা দিল। যেমন খাবারটায় তেমনি বোনেদের ও মায়ের মুখে। এবার আমি এগুলো সব চটকে মাখি, ভাত মেশাই দলা পাকাই। এই দলাটা রাণী খাবে মণি খাবে, এই দলাটা। এইভাবে এক একজনের নামে এক-একটা দলা পাকিয়ে আলাদা করে রাখতে থাকি। ওরা এক-একজনের নাম হতেই আঁতকে আঁতকে উঠতে থাকে।
খোকনদা, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ নাকি! আমরা রান্না করেছি, আমরা তো খাবই। তুমি খাও।
এইবার আমি উঠে দাঁড়াই। আজ আর আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়।
কেন? কী হল? ওরা সবাই বড় হতাশ হয়ে পড়ে, কেমন ক্লান্ত করুণ দেখায় ওদের। আমি অনেকটা থিয়েটারের অভিনেতার মতো উদাত্ত কণ্ঠে বলে যাই, আজ তোমাদের বাণীর এই সব রান্না দেখতে দেখতে আবার আমার মণির রান্নার কথা, রাণীর রান্নার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল সব কতদিন আগের কথা, সেই কবে ছোটবেলায় পুরী গিয়েছিলাম।…
পুরীর সঙ্গে, তোমার পুরী যাওয়ার সঙ্গে আমাদের রান্নার সম্পর্ক কী?মণি প্রশ্ন করে। এতক্ষণে আমি আমার জুতোজোড়ার মধ্যে পা গলিয়ে দরজার কাছে গিয়ে ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়াই, তোমাদের রান্না, তোমাদের প্রত্যেক বোনের রান্না খেতে খেতে আমার আবার পুরীর সমুদ্রতীরের কথা বারবার মনে পড়ে। আহা, সেই শৈশব, নীল সমুদ্র, বনরাজিনীলা। বিয়োগান্ত নাটকের নায়কের মতো আমার কণ্ঠস্বর ওদের মুগ্ধ করে ফেলে, বুঝি আমার প্রাক্তন কণ্ঠের কোমলতা আবার ফিরে আসে আমার স্বরে, আমি বলে যাই তোমাদের প্রত্যেকটি খাবারে সেই পুরীর সমুদ্রতীরের স্বাদ আবার ফিরে পাই। ঠিক তেমনই লবণাক্ত, তেমনই বালুকাকীর্ণ তোমাদের প্রত্যেকটি রান্না যেমন লোনা তেমন বালি কিচকিচে। এর উপরে ভ্রমণ করা যায় কিন্তু গলাধঃকরণ করা যায় না। পুরীর সমুদ্রতীরের সেই ভ্রমণের এত সহজ আনন্দ থেকে কলকাতার লোকদের আমি বঞ্চিত করতে চাই না। এই বলতে বলতে সমস্ত খাবারগুলো আমি দ্রুতবেগে রাস্তার দিকে হাত বাড়িয়ে ছুঁড়ে দিই, নিজেকেও ছুঁড়ে দিই রাস্তায়। ছুটে যাই সেই খাবারগুলোর উপর দিয়ে লবণাক্ত বালুকাকীর্ণ রাস্তার উপর দিয়ে দৌড়ে যেতে যেতে পুরীর সমুদ্রতীরে ভ্রমণের আস্বাদ ফিরে পাই।