একটা দুটো বেড়াল
চুষিদের বাড়িতে কোনও বেড়াল ছিল না। তবে বেড়ালদের আনাগোনা ছিল। সেসব চোর আর ছোঁচা বেড়ালদের কথা আর বলবার নয়। যতবার মেরে তাড়াও লজ্জা নেই—আবার আসবে। দেওয়ালে বাইবে। জানালায় উঁকিঝুঁকি দেবে। মিহি সুরে ভারী বিনয়ী ডাক ডাকবে। এমনকী শীতের লেপকাঁথা রোদে দিলে তাতে গিয়ে গোল্লা পাকিয়ে শুয়ে রোদ পোয়াবে। খড়ম, ঝাঁটা, ঠাঙার বাড়ি কী খায়নি তারা? ফাঁক পেলে মাছ নিয়ে গেছে, দুধে মুখ দিয়েছে, নোংরা পায়ের ছাপ ফেলে গেছে বিছানার সাদা চাদরে।
বেড়ালের আরও ননাংরা কাণ্ডমাণ্ড আছে। সেসবের জন্য হয় রামু জমাদারকে ডাকতে হয়, নয়তো আলাদা পয়সা দিলে পান্তি ঝি পরিষ্কার করে দেয়।
একটা ভারী বদ হুলো বেড়াল আছে সে কারও তোয়াক্কা করে না। কুঁদো চেহারা, কপাল আর পিঠে খাবলা-খাবলা লোম উঠে গেছে অন্য সব বেড়ালদের সঙ্গে কামড়াকামড়ি করে। হুলোটার চলন খুব ধীর-স্থির, তাড়া করলে দৌড়ে পালায় না, ধীরেসুস্থে অনিচ্ছের সঙ্গে যেন দয়া করে সরে যায়।
চুষির কাকা বিয়ে করবার পর বাড়ির পিছনের বারান্দাটায় দেয়াল তুলে একধারে একটা ঘর হল, বাকিটা হয়ে গেল দরদালান। চুষিদের তাতে খুব আনন্দ। চুষি আর কুসি দুই বোন মিলে তাড়াতাড়ি দরদালানের একধারে পুতুলের ঘর সাজাল। কিন্তু সত্যি বলতে কী পুতুল খেলার বয়স এখন আর চুষির নেই। কুসি ছোট, সে-ই পুতুল খেলে। মাঝে-মাঝে চুষির যখন পড়তে ভালো লাগে না, কিংবা যখন ছুটির দুপুরটা খাঁখাঁ করে, কিংবা মেঘ-বাদলার দিনে ছোট হতে ইচ্ছে যায় তখন গিয়ে কুসির পুতুলঘরে ভাগ বসায়।
শীতের রাত সন্ধে পার করেই সেদিন নিশুত হয়েছে। মফসসল গঞ্জের রাস্তাঘাট নির্জন। কুয়াশা জড়ানো ঘুম-ভাবে চারদিক ঝিমোচ্ছে। বাড়ির দরজা জানালা সব শীতের ভয়ে আঁট করে বন্ধ! ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ দরদালানে হুড়ম-দুড়ুম শব্দ। রান্না সারা। পুরুষরা বাড়ি ফেরেনি বলে তখনও খাওয়া হয়নি। মা বসে ময়দার চষি পাকাচ্ছিল। পান্তি মেঝেয় পড়ে ঘুম।
মা পান্তিকে ডেকে বলল—দ্যাখ তো। ঘুমচোখে উঠে পান্তি দেখতে গেল। পড়া ফেলে চুষিও। চুষির পিঠোপিঠি ভাই কানু এক হাতে খেলনা পিস্তল, অন্য হাতে দরজার আলগা বাটামটা নিয়ে সবার আগে গিয়ে দরজা খুলে চেঁচাল—কোই হ্যায়?
সবাই জানে এই ভরসন্ধেয় চোর আসে না। তবু তা বলে ভয়টা তো থাকেই। পান্তি হারিকেন তুলে আলো ফেলতেই চুষি বলল—এঃ মাঃ দেখেছ!
কাণ্ড কাকে বলে! রাংতা এনে কত কষ্টে আজ পুতুলের বিয়ের বাসর সাজিয়েছে! রঙিন কাগজের শিকলি, পিচবোর্ড দিয়ে খাট, বর বউ সত্যিকারের ফুলছাড়ানো বিছানায় শুয়ে। সেই সাজানো বাসর ছয় ছত্রখান করে গুন্ডা হুলোটা দরদালানের বন্ধ জানালার তাকে উঠে বসে আছে।
কানু চেঁচিয়ে বলল—এ হচ্ছে কে এন সিংয়ের কাজ।
কে এন সিংটা যে কে তা আজও ভালো করে কেউ জানে না। তবু–কানু বলে—কে এন সিং হল ভিলেন।
কেউ কিছু গোলমেলে কাণ্ড করলেই কানু চেঁচাবে—এ হল কে এন সিং। একবার বাবাকেও কে এন সিং বলে ফেলেছিল কানু। কারণ, কপিখেত তৈরি করার সময় ভুল করে মায়ের লাগানো একটা দোলনচাঁপা গাছ উপড়ে ফেলে দেয়। মা রাগারাগি করাতে বাবা বলেছিল—ফুলগাছ টুলগাছ কোন কাজে লাগে! যত সব মেয়েলি ব্যাপার। বাগান হচ্ছে নরম মনের জন্য। খেত হল শক্ত মনের জিনিস। এই ব্যাখ্যাটা কেউ তেমন মানতে পারেনি। কানু বলে উঠেছিল—কে এন সিং।
বাবা জিগ্যেস করল—কে এন সিং কে?
একজন রাজস্থানী বীর।
–রাজস্থানী বীর? বাবা ভ্রূ কুঁচকে বলল–রাজস্থান না রাজপুতানা? রাজস্থানে আবার বীর হয়। নাকি, সব তো শুনি ব্যাবসা করে।
কানু মরিয়া হয়ে বলে রাজস্থানী।
বাবা আর কিছু বলেনি। ইতিহাস তো আর তেমন মনে নেই।
তা হুলোটা কানুর সেই কে এন সিংই বটে। দুধ নয় যে হাঁড়ি ওলটাবি, মাছ নয় যে খাবলা দিবি, পুতুলের ঘরটা তবে ভাঙতে গেলি কোন আক্কেলে? পুতুল খেলার তুই বুঝিস কী রে পাজি?
কানু বাটামটা ধরে একলাফে এগিয়ে গিয়ে চেঁচাতে লাগলকাম অন কে এন সিং, তুমহারা ইজ্জৎ আজ বহুৎ খতরে মে হ্যায়। আজ তুমহারা টেংরি টুটেগা বিল্লি কা বচ্চে।
চুষি দৌড়ে গিয়ে পুতুলের ঘরের সামনে বসে বড়-বড় চোখে চেয়ে দেখল সব। কান্না পায়! কত কষ্টে সাজিয়েছে। কুসিটা সাঁঝবেলায় ঘুমিয়েছে ভাগ্যিস। কাল সকালে অবস্থা দেখে কাঁদতে বসবে। কানুর হিন্দি শুনে চুষি ধমক দিয়ে বলল—তোমার হিন্দি ছবি দেখা বের করছি কানু। আজই বাবাকে বলব।
–কাম অন কে এন সিং। বলে কানু বাটামটা যেই জানলার তাকে হুলোটার দিকে বাড়িয়েছে অমনি শুরু হল হুলুস্থুল কাণ্ড। এমনিতে হুলোটা ভয় পায় না, কিন্তু এবারটায় যেন মরিয়া হয়ে এক লাফে নেমে কানুকে এক ধাক্কা দিয়েই দরদালানের দরজায় গিয়ে পড়ল। ‘ফু-অ অ’ করে একটা হতাশার শ্বাস ছাড়ল হুলো। দরজা বন্ধ। কানু লাঠি ঠুকতে-ঠুকতে তাকে তাড়া করল ফের, বলল—বিল্লি কা বচ্চে, তুম নে ইনসান নহি, স্রিফ বিল্লি কি এক নানহে মুন্নে বচ্চে হো। তুমহারা। জিন্দগি মে এক গহেরা দাগ দিখাই যাতি হ্যায়।
হুলোটা তাড়া খেয়ে ফের ছুটে আসে রান্নাঘরের বন্ধ দরজায় আছাড় খেতে। হারিকেন তুলে ধরে পান্তিও তাকে হুড়ো দিতে থাকে–যাঃ গ্যাদড়া মুখপোড়া দূর হ।
কিন্তু হুলোটা যাবেই বা কোথা দিয়ে! যাওয়ার কোনও পথ নেই! চুষিও তখন রাগে রি-রি করা গায়ে উঠে গিয়ে বাবার ছাতাটা হাতে করে নিয়ে এল।
মা ভিতর থেকে ডেকে বলল—দেখিস, ভয় পেয়ে যেন আঁচড়ে কামড়ে না দেয়। মায়েরা জানে অনেক। বাস্তবিক হুলোটাযা ভয় পেয়েছিল সে-রাতে।
তিনজন যখন তিন দিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে, তখন বারান্দার কোণে দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে বসেছে সেটা। দাঁত বার করে ঘ্যাও-ঘ্যাও করে আওয়াজ ছাড়ছে। ল্যাজটা আস্তে-আস্তে ঢেউ দিচ্ছে। কানু লাঠি বাড়াতেই সেটাকে একটা থাবা দিল জোর। চোখ জ্বলে উঠল হুলোটার।
চুষি বুঝতে পেরেছিল, কামড়াবে। কানু বোঝেনি। সে আর-এক দফা বীরত্ব দেখাতে যেই লাঠি উঠিয়েছে অমনি দেখা গেল হুলোটা বাঘের মতো লাফিয়ে উঠল কানুর গায়ে। একটা থাবা তো দিলই, পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁতও বসিয়ে দিল। কী আক্রোশ তার!
সেই নিয়ে ডাক্তার বদ্যি। মা শুধু এসে বলেছিল—দ্যাখো কাণ্ড, জানলার একটা পাল্লা খুলে দিবি তো! নইলে ও পালাবে কোথা দিয়ে? এই বলে মা জানালা খুলে দিতেই হুলো একলাফে পালাল। বাড়ির পারিবারিক ডাক্তার গুণেন ধরের সঙ্গে বাবার বনিবনা হয় না। কানুকে দেখতে এসে ডাক্তার ধর বললেন—অ্যান্টি টিটেনাস দিতে হবে।
বাবা বললেন,—বেড়াল কামড়ালে অ্যান্টি টিটেনাস কেন? আয়োডিন দাও।
—আয়োডিনও দাও। সঙ্গে এটিএস।
বাবা বললেন—ঘোড়া কামড়ালে এটিএস দেয়। বেড়াল কামড়ালে নয়।
ধর কটমট করে তাকিয়ে বললেন—তবে আমি যাচ্ছি–যা খুশি করো।
রাগ করে ডাক্তার ধর চলেই যাচ্ছিলেন, ঠাকুমা এসে তাঁর গায়ে মাথার হাত বুলিয়ে বাবা, বাছা বলে ঠান্ডা করে। বাবা শুধু বললেন—বেড়াল যে এত ডেঞ্জারাস হয় জানতাম না।
হুলোর জন্য এত সব কাণ্ড।
একদিন সকালের দিকে পুবের বারান্দায় রোদে বাবা দাড়ি কামাতে বসেছে। কামানোর জন্য গরম জল আনতে গেছে চুষি। কিন্তু রান্নাঘরের উনুনে তখন ভাত ফুটছে। এসময় হাঁড়ি নামালে ভাত প্যাঁচপ্যাচে হয়ে যায় বলে মা হাঁড়ি নামাতে রাজি নয়। গরমজলের তাই দেরি হচ্ছে। অধৈর্য হয়ে বাবা বলল—ধুত্তোর, আজ দাড়িই কামাবো না। এই বলে ক্ষুর সাবান আয়না নিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে কপিখেতের দিক থেকে ফোঁসফোঁস শব্দ এল।
তারপরই বাবার চিঙ্কার—দেখে যাও সব, দেখে যাও কী ডেঞ্জারাস কাণ্ড হচ্ছে এখানে।
সবাই ছুটে এসে দেখে একটা হাতদেড়েক লম্বা দাঁড়াস সাপের সঙ্গে নিরীহের মতো লালচে রঙের বেড়ালটার লড়াই লেগেছে কপিখেতে। ভারী মজার লড়াই। সাপটা এক একবার বেড়ালটার বুকে পেটে প্যাঁচ মেরে কান কামড়ে ঝুলে থাকে। বেড়ালটা তখন ভেজা বেড়ালের মতো বসে থাকে চুপচাপ। সাপটা অনেকক্ষণ ওরকম থেকে কাঁহাতক আর বেড়ালের কান। কামড়ে থাকা যায়—এই ভেবে প্যাঁচ খুলে নিজের কাজে রওনা হয়। তক্ষুনি বেড়ালটা ভেজাভাব ঝেড়ে ফেলে লাফিয়ে গিয়ে সামনের দুই থাবায় সাপটাকে ধরে টেনে আনে। তারপর সেটাকে ফেলে কাতুকুতু দেয়, গলার নলীতে কামড়ে ধরে আঁচড়ে দেয়। সাপটা মহা হাঙ্গামায় পড়ে ওলটপালট খায়, তারপর ফের প্যাঁচ মেরে ধরে। সেই খেলা দেখতে বাইরের লোকও জমে গেল বেড়ার ধারে।
বেড়ার বাইরের লোকজনের মধ্যে চুষি হঠাৎ বাবুদাকে দেখতে পেল। আজকাল কী যে হয়েছে তার! বাবুদাকে দেখলেই কেমন যেন বুকটা ঝাঁৎ করে ওঠে। সারা শরীরে একটা তানপুরার তার পিড়িং করে বাজে। বাবুদা বেশ দেখতে। তার দিকে তাকায় প্রায়ই। চুষি তাকাতে লজ্জা পায়। যদিও ইচ্ছে করে।
কিন্তু সেদিন বেড়াল-সাপের লড়াইয়ের সময় মজাই হল একটা। সবাই যখন লড়াই দেখছে তখন চুষির নজরে পড়ল, বাবুদা একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে। গায়ে কাঁটা দিল চুষির। শিহরণ যাকে বলে। ভারী লজ্জা-লজ্জা করতে লাগল। যতবার চোখ সরিয়ে নেয় ততবারই চোখটা গিয়ে বাবুদার চোখে আটকে যায়। এরকম কয়েকবার হতে-হতে চুষি আর চোখ সরানোর হাঙ্গামায় গেল না। চেয়েই রইল।
বাগানে তখন কপিখেতের ভেজা মাটিতে সাপটাকে নখে করে চিরে ফেলেছে বেড়ালটা।
এই ঘটনার পর বাবা পড়ল মহা সমস্যায়। বলতে লাগল—আমি জানতাম বেজি আর ময়ুরই সাপের সঙ্গে লড়াই করে। কিন্তু বেড়ালের ব্যাপারটাও বেশ ডেঞ্জারাস দেখছি।
বাবার বন্ধু সুভদ্র তার উত্তরে বলে—তুমি দুনিয়ার জানোটা কী হে? চিরকাল হম্বিতম্বি করে এলে, শিখলে না কিছুই। বেড়ালের ব্যাপারটা আমি আগে থেকেই জানতাম।
—চালাকি কোরো না সুভদ্র। জানলে এতদিন বলেনি কেন?
—বাঃ সব জানার কথাই এসে তোমাকে বলতে হবে নাকি?
এইভাবে ঝগড়া লাগল। তা বাবার সঙ্গে সকলেরই ঝগড়া লাগে। রোজ।
কিন্তু বাবা বলতে লাগল—বেড়াল তো বেশ উপকারী প্রাণী দেখছি।
শুনে কে যেন বলল—খুবই উপকারী। ইঁদুর মারে।
শুনে বাবা বলল—ইঁদুর? ইঁদুর কোনও প্রবলেমই নয়। প্রবলেম হল সাপ।
এই নিয়ে তার সঙ্গে বাবার একটা মনকষাকষি হয়ে গেল। বাবা কিছুতেই স্বীকার করল না যে, সাপ বিপজ্জনক প্রাণী হলেও গৃহস্থের ঘরে ঢুকে উৎপাত করে না, যতটা করে ইঁদুর।
শীতের দুপুরে যখন রোদে কাঁসাপেতলের রং ধরে তখন সেই রোদের ওম-এ বসে চারজন লুডো খেলে। ঠাকুমা, মা, চুষি আর পান্তি, কখনও কানু। কাকিমা ছেলে হতে বাপের বাড়ি গেছে, নইলে সেও খেলে। দাদু মারা যাওয়ার পরপরই ঠাকুমা আমিষ, পাড়ওলা শাড়ি আর পান-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর একরাতে স্বপ্ন দেখল, দাদু এসে ঠাকুমার বাঁ-হাতের ওপর ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে বলছে—তুমি যে পান খাও না তাতে আমার বড় কষ্ট হয়। আর কিছু না হোক পানটা অন্তত খেও। সেই থেকে ঠাকুমা আবার পান খাওয়া ধরল।
মুখে রসস্থ পান থাকলে লুডো খেলবার বড় অসুবিধে। মুখ নীচু করলেই কোন ফাঁকে পানের পিক ফুচুক করে বেরিয়ে যায়। ঠাকুমার আবার সামনের দিকে দুটো দাঁত না থাকায় পানের রসে বাঁধ দেওয়ারও উপায় নেই।
ছক্কা চেলে ঠাকুমা তাই উধ্বপানে মুখ তুলে জিগ্যেস করে–কটো?
কানু বা মা বা চুষি চাল দেখে দেয়। ঘর গুনে গুটিও চেলে দেয়। ঠাকুমা ঘাড় কাত করে দেখে। কানু ঠাকুমার গুটি চাললে ঘর চুরি করবেই। মহা চোট্টা।
সেদিন ছুটির দিনের দুপুরে যখন খেলা জমে উঠেছে তখন পান্তি এসে খবর দিল, কাকার ঘরে চৌকির তলায় এক বেড়ালনী মুখে করে-করে তার আঁতুড়েছানা এনে রাখছে।
—তাড়াও! তাড়াও! বলে চুষি লাফিয়ে উঠেছিল।
পাশের ঘর থেকে বাবা উঠে এসে প্লাস পাওয়ার চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে বলল—কোথায় বেড়ালছানা দেখি?
সবাই গিয়ে দেখে। বেড়ালের বাচ্চাগুলো দেখতে কিন্তু বেশ। একেবারে পাউডার পাফ-এর মতো। একটার পেটের তলা দিয়ে আর একটা মুখ বের করে আছে। একটা অন্যটার গা বাইছে। আর মিহি স্বরে ‘মিউমিউ’ করে যাচ্ছে অনবরত। ধাড়ি বেড়ালটা বাচ্চা রেখে পালিয়েছে কোথাও। লোকজন সরে গেলে আসবে।
বাবা ঘোষণা করল–বাচ্চাগুলোর খিদে পেয়েছে। ওদের একটু দুধ এনে দে তো চুষি।
মা বলল—দুধ কি ওরা চেটে খেতে পারে? খামোখা দেওয়া!
—আহা, দিয়েই দেখনা। খিদে পেলে বাঘে ধান খায় শুনেছি!
দেওয়া হল। কুসির খেলাঘরের একটা ছোট্ট বাটিতে করে। সে বাটির দিকে ফিরেও তাকাল বাচ্চাগুলো। বরং একটার গায়ে ধাক্কা লেগে বাটি উলটে দুধটুকু পড়ে গেল। পরে ধাড়িটা এসে সে দুধ চেটে খায়।
সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেখা গেল বাবার আর কুসির। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবা চা আর কুসি দুধ খেয়েই গিয়ে কাকার ঘরের চৌকির সামনে উবু হয়ে বসে বেড়ালছানা দেখে। রাতে শোওয়ার আগেও বাবা গিয়ে টর্চ ফেলে দেখে আসে। পান্তিকে বলে—একটা ন্যাকড়া ট্যাকড়া কয়েক ভাঁজ করে ঢেকে দিস ওগুলোকে। শীতে কষ্ট পায়।
মা বলে—হুঁঃ বেড়ালরা কত যেন কোট প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায় শীতকালে!
—আঃ হাঃ, তোমার কেবল সব বিষয়ে ফোড়ন কাটা।
মা-বাবার রোজই লেগে যায়। তাতে অবশ্য মা রোজই দুই-তিন গোলে জেতে। ঝগড়ার শেষে মা প্রমাণ করে ছাড়ল যে, জীবজন্তুদের শীত লাগার কথা নয়। বাবা স্বীকার করল না বটে, তবে বেড়ালছানা চাপা দেওয়ার জন্য আর চাপাচাপিও করল না। মা কিন্তু শোওয়ার আগে একটা ঝুড়িতে চট পেতে নিয়ে গিয়ে ধাড়িসুষ্ঠু ছানাগুলোর জন্য চমৎকার বাসা করে দিল।
শুখা বাতাস আর রোদের তাপ কমে চারদিককার শীতভাব শুষে নিতে লাগল। কুয়োর জল অনেক নীচে নেমে গেছে। শিমুলগাছে ফুল এল। বাবুদা ডাকঘরে কেরানির চাকরি পেয়ে বাইরে চলে যাওয়ার আগে একদিন এসে মা-বাবাকে প্রণাম করে গেল। আগে কখনও এরকম প্রণাম ট্রনাম করেনি।
বাবুদা চলে গেলে কী হয় এখন কিন্তু চুষি ঠিক টের পায় তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবার লোকের অভাব নেই। চুষির বুকের ভিতরে হৃৎপিণ্ড ঝলকে-ঝলকে ফোয়ারার মতো রক্তস্রোত বইয়ে দেয়। শরীর জুড়ে সেই রক্ত ঝরনার মতো ঝরে পড়ে। দিনরাত নিজের শরীরে এক অন্তর্গত ঝরনার শব্দ শোনে সে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গালের একটা ব্রণ টিপল চুষি। টিপতে নেই, তাহলে বাড়ে। তবু গালে একটা টুসটুসে ব্রণ দেখতে পেলে সেটার ভাত বের না করেই বা থাকে কী করে মানুষ?
ব্রণটা গেলে দিয়ে জায়গাটায় একটু ক্রিম ঘষে দিল সে। মুখখানা বারবার ঘুরিয়ে দেখল। একটু নাচের ভঙ্গি করল। আজকাল অনেক কিছু টের পায় চুষি। শরীর, মন মানুষের চোখ।
কখনও কলঘরে গিয়ে নিজেকে খুঁজে দেখে চুষি। দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। এ কী! এ মা! সে যে কচি মেয়েটা ছিল এতদিন! বড় হয়ে গেল?
মাঝে-মাঝে রোদে হাওয়ায় ভেসে যেতে-যেতে খুব হোঃ হোঃ হাসতে ইচ্ছে করে তার।
আবার এক একদিন এমন হয়, কুয়োতলা ছাড়িয়ে পিছনের লাউমাচার ছায়ায় বসে দুপুরবেলার নির্জনে বিভোর হয়ে কাঁদে। বেড়ালছানাগুলো আজকাল দরদালানে আসে, ঘরে আসে। ঠাকুমা প্রথম-প্রথম তাড়া দিত—যাঃ, যাঃ, এক্ষুনি সব ছুঁয়ে-ছেনে দেবে।
কিছুদিন বাদে ঠাকুমা আর তাড়া দেয় না। বেড়ালরা দালানে ঘোরে। ঘরে খেলা করে। ফুটফুটে ছানাগুলোকে এ ও সে কোলে নিয়ে খানিক আদর করে ছেড়ে দেয়, লুডোর ছক পেতে দিলে বেড়ালছানারা দিব্বি পা দিয়ে ছকটা উলটেপালটে খেলা করে।
কুসিও খেলে। সে আজকাল খুব বউ সাজতে ভালোবাসে। বাবা ছোট ডুরে শাড়ি কিনে দিয়েছে। চুষি তাকে শাড়ি পরিয়ে বউ সাজায়। কুসি পুতুল-ছেলে কোলে করে একদম মায়ের ভাষায় আদর করে শাসন করে। পাকা মেয়ে।
বাবা দেখে বলে—ওঃ বাবা, মেয়ের বিয়ের কথা ভাবলেই বুক কেমন করে।
মা বলে—তা বিয়ের খরচের কথা ভাবলে ওরকম অনেকের হয়! মেয়ের বিয়েতে খরচ তো করতেই হবে।
বাবা বিরক্ত হয়ে বলে—সবসময় টাকার কথা ভেবে কথা বলি নাকি। মেয়ের বিয়ে দিতে মনের কষ্টও তো আছে।
—তুমি কি সে ভেবে বলেছ!
আবার মাতে বাবাতে লেগে যায়। মা জেতে। বাবা হেরে গিয়ে রেগে কুয়ো থেকে দশ বিশ বালতি জল তুলে ফেলে।
তুলোর আঁশ বাতাসে উড়ে যায়। উঠোনের রোদে সাদা আর সাদা-কালো বেড়ালছানারা এখন গম্ভীরভাবে বসে থাকে থুপ হয়ে। তুলোর আঁশ দেখলে লাফিয়ে-লাফিয়ে ধরার চেষ্টা করে। ঘর দোরে আসে, বিছানায় ওঠে। ধাড়িটা আর বাচ্চাগুলোর কাছে তেমন ঘেঁষে না, পাড়াবেড়ায় চৌপর দিন।
কাকিমা বাচ্চা কোলে করে ফিরে এল একদিন। বাড়িময় ছুটোছুটি পড়ে গেল। আদর আর কাড়াকাড়িতে বাচ্চাটা ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠে। তার পর চুপ করে যায়। তারপর এর কোলে তার কোলে ঝাঁপ খেয়ে যেতে শিখে যায়।
বাবা বলে—মানুষের বাচ্চার চেয়ে বেড়ালের বাচ্চারা অনেক বেশি সাবালক। তারা খুব তাড়াতাড়ি সেলফ-ডিপেন্ডেন্ট হয়।
ধর ডাক্তার বলে—সাবালক হয়, কিন্তু বেড়াল বাচ্চারা কোনওদিনই মানুষ হয় না কথাটা মনে রেখো।
–বোকার মতো কথা বোলো না। বেড়াল মানুষ হতে যাবে কেন?
তা সে যাই হোক। কথাটা হল, চুষিদের বাড়িতে আগে কোনও বেড়াল ছিল না। এখন বেড়াল হয়েছে।