প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

এই শহরে

এই শহরে

কলকাতা এক সময়ে ছিল সন্ধ্যার শ্যাম্পেনের মতো। বেশ একটা নেশা ধরে যেত। দু-চার দিনের জন্যও কোনও জায়গায় গেলে মন কেমন করত। হাওড়া স্টেশানে নেমে ব্রিজের মাথাটা দেখা মাত্রই মন নেচে উঠত—ফিরে এসেছি, ফিরে এসেছি। গঙ্গার ওপর দিয়ে শহরে ঢুকছি। পোস্তা আর বড়বাজারের ঘিঞ্জি এলাকা। বাড়ির গায়ে বাড়ি। সাবেক আমলের স্নান-ঘাট। পরিত্যক্ত ওয়্যার হাউস। কোম্পানির কলকাতার স্মৃতিচিহ্ন। প্রাচীন টাঁকশাল। বাঁদিকে ঘাড় ঘোরাই। একরকম দৃশ্য। ডানদিকের আকাশপটে বিধানরায়ের কলকাতার বহুতল। লোকজন, ঠ্যালা, লরি, লোহালক্কড়, বালতি, কড়াই। থিকথিকে মানুষজন। স্ট্রান্ডরোডের বিখ্যাত জ্যাম। পোস্তার গুদামে দিবারাত্র মাল-খালাস, নিমতলার শেষযাত্রা, কাঠগোলার টংঘর। একটু প্রাচীন, একটু নতুন, স্যাঁতস্যাঁতে ভাঙাচোরা। মশলার গন্ধে নর্দমা আর আবর্জনার গন্ধ মিশে আছে। তবু প্রবেশ মাত্রই মন নেচে উঠত। এই আমার কলকাতা। হ্যারিস্যান রোডের দু-পাশে জমজমাট সব দোকান। বাঁপাশে ঘুরে গেছে পথ সত্যনারায়ণ পার্কের দিকে। কলকাতার রাজস্থান। চলে গেছে আহিরিটোলার দিকে। উত্তর থেকে আরও উত্তরে। সেই কলকাতার স্মৃতিসরণী ধরে, যে কলকাতায় ছিল বড়-বড় থামওয়ালা বাড়ি, ঝাড়লণ্ঠন, বেলোয়ারি কাঁচের বাহার। শার্সির রঙিন কাছ, বিখ্যাত বাঙালি, জ্ঞানী বাঙালি, শিল্পী বাঙালি, ভোগী বাঙালি, বিলাসী বাঙালির পীঠস্থান, হ্যারিস্যান রোড যখন চিৎপুরে এসে মিশবে, ডানদিকে তাকিয়ে দেখে নোবো নাখোদার কারুকার্য করা চুড়া। চিকনের কাজ করা ওই গম্বুজ, আর সার-সার পাজামা, পাঞ্জাবি, আতর, বিদরি, আর জুতোর দোকান দেখলে মন চলে যায় বেনারসের দিকে। হায়দ্রাবাদের চারমিনার, লক্ষ্মৌ, বেনারসের কথা মনে পড়ে যায়।

বাঁ-দিকে পথ চলে গেছে হরেন শীলের বিশাল বাড়িকে বামদিকে রেখে জোড়াসাঁকোর দিকে। ডি. গুপ্তর বাড়িটাকে দেখলে মনে হয়, হ্যাঁ, এই তো আমার সেই নানা সমস্যা-সঙ্কুল প্রাণের কলকাতা। লন্ডনের ডকসাইড রোডের মতো চিৎপুরের কবলভ রোড সোজা চলে গেছে বাগবাজার, সেখানে সেই প্রাচীন খাল। নর্দমার চেয়েও অপরিষ্কার। তবু সেই খাল আমার কত প্রিয়। খালের ওপর বিশাল একটা হাতির মতো বাগবাজারের পোল। চিৎপুর সেই আদৌপথ। নাম ছিল তীর্থযাত্রীর পথ। শান্তিপুর নবদ্বীপ থেকে তীর্থযাত্রীরা এই পথ ধরে চৌরঙ্গীতে চৌরঙ্গীবাবার আশ্রম হয়ে চলে যেতেন কলিতীর্থ কালীঘাটে।

হ্যারিস্যান রোড চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনু ভেদ করে আমাকে ফেলে দেবে কলেজ স্ট্রিটে। আমার ডানপাশে বিদ্যার পীঠস্থান। প্রেসিডেন্সি, হিন্দুস্কুল। বিশ্ববিদ্যালয়। একটু দু:খ আমার এখনও হবে। কলিসিয়ামের মতো অমন সুন্দর সেনেট হলটা ভেঙে দিল। কলকাতার এমন সুন্দর এক ল্যান্ডমার্ক। সামনেই কলেজ স্ক্যোয়ার। কে যে পরিকল্পনা করে অমন সুন্দর এক দৃশ্যকে দোকান দিয়ে চাপা দিয়ে দিলেন! কলকাতার ব্যবস্থাপকরা আমার মনে অজস্র ক্ষত তৈরি করেছেন। বহুবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি—একটা সুন্দর শহরকে সুপরিকল্পিত ভাবে কেন তাঁরা ধ্বংস করছেন। ইচ্ছে করলেই তো কত সুন্দর করে তোলা যায়। তাঁরা তো বিদেশে যান। সুন্দর-সুন্দর শহর দেখেন। তাঁরা তো সব কর্তাব্যক্তি। যেমন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, আমাদের মেয়র। সেই শহরের রূপকার, ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে দেখা হয়, আলোচনা হয়, লাঞ্চ, ডিনার হয়। বক্তৃতাও করেন কত! তাঁদের কি মনে হয় না, এই শহরে ওঁরা যখন আসবেন, অব্যবস্থা, কল্পনাহীনতা, উদাসীনতা দেখে তাঁরা নাক সিটকোবেন। বিশ্রি একটা ধারণা হবে তাঁদের। মেয়র, মন্ত্রীকুল, বড় ব্যবসায়ী, এঁদের কোনও লজ্জা হয় না!

বই-পাড়া, কলেজ-পাড়া ছেড়ে অ্যামহার্সস্ট্রিটে পড়ব। ডান দিকে সেই বিখ্যাত শ্রদ্ধানন্দ পার্ক! রাজনীতির কারণে স্মরণীয়। স্বদেশি আন্দোলনের দিনে কত বড়-বড় সভা এখানে হয়ে গেছে। শ্রীঅরবিন্দ, রাসবিহারী বসু, সুভাষ বসু। এই ঐতিহাসিক পার্কটিও ছোট-ছোট স্টল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম লাইন ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানান হয়েছে কোণের দিকে দুর্গন্ধি এক আবর্জনা স্তূপ তৈরি করে। সেই রকের ভাষায় বলে না—গুরু তোমার কাজ আছে। তবু কেন জানি না এই শহরের জন্যে প্রাণ কাঁদে।

কলকাতার ৩০০ বছর বেশ ভালোই হচ্ছে। জোব চারনকের আমল বেশ সুপরিকল্পিত ভাবেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পথ-ঘাট নেই। ছিল একদা। একটানা বৃষ্টি। অন্ধকার। আলো তো থাকেই না। সে—এক বীভৎস নরক। সন্ধ্যার শ্যাম্পেন আর নেই, এখন মাঝরাতের চুল্লু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *