উড়ো মেঘ

উড়ো মেঘ

নিদাঘকান্তি তাহার পাটনানিবাসী বন্ধু সূর্যকে লিখিল, ‘প্রফেসার সাহেব, সাত দিনের ছুটি পাটনায় বসে বসে কি করবে? এখানে চলে এস, দু’জনে বায়স্কোপ-থিয়েটার দেখা যাবে। তাছাড়া আরও একটি জিনিস তোমাকে দেখাব। তুমি ব্রহ্মচারী মানুষ, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করেছ, অতএব তোমার কোনও ভয় নেই।’

নিদাঘরা চার পুরুষে টালার বাসিন্দা। নিদাঘের প্রপিতামহ পশ্চিমের কোনও এক শহরে তিসির আড়তে নায়েব-গোমস্তার কাজ করিতেন। তখনও এ দেশে রেল আসে নাই। ১৫ বৎসর গৃহত্যাগী থাকিবার পর হঠাৎ একদিন তিনি নৌকাপথে দেশে ফিরিয়া আসিলেন এবং টালায় জমি কিনিয়া মস্ত এক চক্‌মিলানো অট্টালিকা নির্মাণ করিয়া নানা প্রকার ব্যবসায় ফাঁদিয়া বসিলেন। নিজের পিতৃদত্ত বাসুদেব নামটা বোধ করি তেমন পছন্দসই মনে না হওয়ায় উহা বদলাইয়া গোবর্ধন মিত্র নামে পরিচিত হইলেন। ব্যবসায়ে অচিরাৎ উন্নতি দেখা গেল। তারপর মৃত্যুকালে মা কমলার পায়ে একটি সোনার শিকল পরাইয়া শিকলটি একমাত্র পুত্রের হস্তে দিয়া গেলেন। সেই অবধি চঞ্চলা লক্ষ্মী শিকল পায়ে দিয়া কাকাতুয়ার মতো মিত্র-পরিবারে বিরাজ করিতেছেন।

নিদাঘকান্তি এই বংশের একমাত্র সন্তান। দেখিতে বেশ সুশ্রী, বলবান্‌, দীর্ঘদেহ। প্রথম বিভাগে আই. এ. পাস করিয়া বি. এ. পড়িতে পড়িতে হঠাৎ একদিন পড়াশুনা ছাড়িয়া দিয়া নিদাঘ ঘরে আসিয়া বসিল। পিতা হরিধন মিত্র বুদ্ধিমান লোক। লেখাপড়া না শিখিয়াও পৈতৃক সম্পত্তি যথেষ্ট পরিমাণে বর্দ্ধিত করিয়াছিলেন। ছেলের মতিগতি দেখিয়া বোধ করি মনে মনে খুশি হইলেন, কিন্তু মুখে একটু বিরক্তির ভাব দেখাইয়া চুপ করিয়া গেলেন। নিদাঘের মা কিন্তু সত্যই অসুখী হইলেন। যে বংশে কেহ কখনও প্রবেশিকার সিংহদ্বার উত্তীর্ণ হয় নাই, সেই বংশে তাঁহার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত উপাধি অনায়াসে দখল করিয়া বসিবে, তাঁহার মনে এই উচ্চাশা অহরহ জাগিয়া থাকিত। তাই নিদাঘ যখন তাঁহার সমস্ত আশা নির্মূল করিয়া দিয়া আসিয়া বলিল, ‘মা, দেখলুম সব ফাঁকি। কলেজে পড়া আমার হল না। এখন থেকে বাড়িতে পড়ব’, তখন জননী বড়ই মর্মাহত হইলেন, কিন্তু কোনও কথা কহিলেন না। নিদাঘের স্বেচ্ছাচারে কেহ কখনও বাধা দেয় নাই, আজও সকলে তাহা নিঃশব্দে স্বীকার করিয়া লইল।

কিন্তু এই যে নিদাঘ নিজের ইচ্ছাটাকে নির্বিরোধে অব্যাহত রাখিতে সমর্থ হইত, তাহার প্রধান কারণ, তাহার সকল কার্য এবং চিন্তার মধ্যে এমন একটা নির্ভীক আত্মবিশ্বাস ছিল যে, সে যে ভুল করিয়াছে বা অন্যায় করিয়াছে, এ কথা কাহারও মনে উদয় হইত না, এবং তর্ক-যুক্তির দ্বারা তাহাকে পরাস্ত করিবার বাসনাও আজ পর্যন্ত কাহারও হয় নাই। কারণ, স্পষ্ট কথাটাকে এত রূঢ় করিয়া বলিবার ক্ষমতাও বোধ করি ভগবান আর কাহাকেও দেন নাই।

সূর্য কলিকাতায় আসিয়া পৌঁছিবার পর প্রথম চারি পাঁচ দিন দুই জনে বায়স্কোপ-থিয়েটার দেখিয়া পুরাতন বন্ধুবান্ধবের সহিত দেখাসাক্ষাৎ করিয়া প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে শেষ করিয়া ফেলিল। শেষে যখন সূর্যর ছুটি ফুরাইবার আর দুই দিন মাত্র বাকি আছে, তখন সে বলিল, ‘কৈ হে, কি দেখাবে বলে লিখেছিলে!’

নিদাঘের হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল যে আজ কয়দিন সতীকুমারবাবুর বাড়ির কোনও খোঁজই সে রাখে নাই—অথচ শুনিয়াছিল যে, কয়েক দিন যাবৎ সতীকুমারবাবুর স্ত্রী অসুখে ভুগিতেছেন। নিদাঘ তাঁহাকে মাসীমা বলিয়া ডাকিত। সে অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল; বলিল, ‘তাই তো, একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম। একটু বসো ভাই, আমি চট্‌ করে আসছি।’ বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল।

সতীকুমারবাবু শিক্ষা-বিভাগে খুব বড় চাকরি করিতেন। নিদাঘদের প্রকাণ্ড বাড়িখানার পাশেই তাঁহার ক্ষুদ্র অথচ পরিপাটী বাড়িখানি মনোয়ারী জাহাজের পাশে ক্ষুদ্র মোটরলঞ্চ-এর মতো শোভা পাইত। নিদাঘ চটি ফট্‌-ফট করিয়া তাঁহার অন্দরমহলে প্রবেশ করিয়া হাঁকিল, ‘মাসীমা, কেমন আছেন?’

সৌদামিনী রুগ্ন ছিলেন। প্রায় জ্বরে পড়িতেন—সারিয়া উঠিতেন, আবার পড়িতেন। এ জন্য তাঁহার মেজাজ সর্বদা খুব প্রফুল্ল থাকিত না। কাল রাত্রিতে জ্বর ছাড়ার পর আজ সকালে গুটিকত খৈ খাইয়া তিনি বিছানায় বসিয়া একখানা উপন্যাস পড়িতেছিলেন: নিদাঘকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এ ক’দিন কোথায় ছিলে?’

নিদাঘ বলিল, ‘ছিলুম এখানেই। একটি বন্ধু পাটনা থেকে এসেছেন, তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলুম।’

সৌদামিনী কৈফিয়তের কোনও জবাব দিলেন না। তখন নিদাঘ একটু হাসিয়া বলিল, ‘আপনার অসুখ আমাদের এতই গা-সওয়া হয়ে গেছে, মাসীমা, যে, সামান্য জ্বরটা-আসাটাতে আর আমাদের বেশী ভাবিত করতে পারে না।’

তাঁহার অসুখের ব্যাপারটাকে লঘু করিয়া দেখিলে সৌদামিনী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইতেন। তিনি সুদ্ধ ‘হ্যাঁ, তা তো বটেই’ বলিয়া মুখখানা টিপিয়া পুস্তকে মনোনিবেশ করিলেন।

এমন সময় উপর তলার রেলিঙের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া একটি দশ এগার বছরের মেয়ে ডাকিল, ‘নিদাঘদা, একবারটি ওপরে এস না, তোমাকে ভারী একটা মজার জিনিস দেখাব।’

নিদাঘ উঠান হইতে উপরদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, ‘কে, তনু?—

জগতের অশ্রুধারে ধৌত তব তনুর তনিমা

ত্রিলোকের হৃদি রক্তে আঁকা তব চরণ-শোণিমা—’

‘তবে যাও’ বলিয়া তনু রাগ করিয়া চলিয়া গেল।

কবিতা সে আদৌ সহ্য করিতে পারিত না এবং সেই জন্য নিদাঘ তাহাকে দেখিবামাত্র যাহা মুখে আসিত, একটা কবিতা আবৃত্তি করিয়া দিত। তাহার ফলে তনুর সঙ্গে তাহার ভাব রাখা অত্যন্ত দুঃসাধ্য হইয়া উঠিত। কিন্তু নিতান্ত জ্বালাতন হইয়াও তনু বেচারী তাহার সহিত শাশ্বতভাবে আড়ি করিতেও পারিত না। ভাব এবং আড়ির মধ্যবর্তী একটা স্থানে তাহাদের সম্বন্ধটা সর্বদা ত্রিশঙ্কুর মতো আন্দোলিত হইতে থাকিত।

উপস্থিত ক্ষেত্রে তনু ক্যারম-খেলায় কিরূপ অসাধারণ নৈপুণ্য লাভ করিয়াছে, তাহাই দেখাইবার জন্য নিদাঘকে অত উৎসাহের সহিত ডাকিয়াছিল। দিদিকে সে যে কিরূপ অবলীলাক্রমে হারাইয়া দিতে পারে, তাহা নিদাঘ না দেখিলে সমস্তই বৃথা!

ক্ষুণ্ণমনে তনু ফিরিয়া আসিয়া খেলিতে বসিল। তাহার দিদি অণু এতক্ষণ খেলিতেছিল, এবার মেঝের উপর শুইয়া পড়িয়া বলিল, ‘থাক ভাই, আর খেলব না।’

তনু অনুনয় করিয়া বলিল, ‘খেল না দিদি, এই তো আর একটু বাকি আছে।’ বলিয়া বোর্ডের উপর ঘুঁটি সাজাইতে লাগিল। তাহার মনে তখনও ক্ষীণ একটু আশা ছিল যে, হয়তো নিদাঘদা হঠাৎ আসিয়া পড়িতেও পারেন।

খেলা আবার আরম্ভ হইল। কিছুক্ষণ পরে নিদাঘ নিঃশব্দে আসিয়া অণুর পশ্চাতে দাঁড়াইল। খেলায় উন্মত্ত তনু সম্মুখে থাকিয়াও তাহাকে দেখিতে পাইল না।

নিদাঘ বলিল, ‘যে রকম খেলোয়াড় হয়ে উঠেছ, শিগগির তোমাদের হকি এবং ফুটবল ক্লাবে ভর্তি না করে দিলে চল্‌ছে না!’

তনু উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। কথাগুলার মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন শ্লেষটুকু ছিল যে, তাহা কিন্তু অণুকে গিয়া বিঁধিল। সে খেলা ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল।

নিদাঘ চেঁচাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘রাগ হল না কি?’

পাশের ঘরে সম্পূর্ণ নীরবতা ভিন্ন আর কিছুরই নিদর্শন পাওয়া গেল না। নিদাঘ তখন গম্ভীরকণ্ঠে ডাকিল, ‘অণু, আমি ডাকছি, শুনে যাও। কথা আছে।’

অণু দ্রুতপদে ঘরে ঢুকিয়া নিদাঘের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল, ‘কি?’ নিদাঘ বলিল, ‘আজ বিকালবেলা তোমার ফটো তোলা হবে—ভাল কাপড়—চোপড় পরে তৈরি হয়ে থেকো।’

‘বেশ’ বলিয়া অণু পূর্ববৎ দ্রুতপদে নীচে নামিয়া গেল।

নিদাঘ কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া তনুকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘হয়েছে কি?’

তনু বলিল, ‘বাঃ, মনে নেই? সেই সেদিন তুমি যে দুপুরবেলা ঘুমোনোর জন্য বকেছিলে—’

‘ওঃ,—’ মুখখানা খুব গম্ভীর করিয়া নিদাঘ সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গেল।

নীচে বাহিরের দ্বার পর্যন্ত গিয়া সে ফিরিয়া আসিল। সৌদামিনীর ঘরে গিয়া দেখিল, অণু মায়ের পায়ের কাছে মুখ গম্ভীর করিয়া আছে। নিদাঘ তাহার দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া সৌদামিনীকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘অণুর বয়স কত হল, মাসীমা?’

নিজের রোগের ভাবনার অবকাশে যতটুকু সময় পাইতেন, সে সময়টা সৌদামিনী মেয়ের বিবাহের কথা ভাবিতেন। তিনি বলিলেন, ‘এই তো গেল মাসে তের পেরিয়ে চোদ্দয় পড়েছে। তা ওঁর কি সে দিকে নজর আছে? মেয়ে থুবড়ো হয়ে থাক্‌ল তো ওঁর কি বল না! আমিই শুধু ভেবে মরি।’

নিদাঘ বিরক্তির স্বরে বলিল, ‘কি আশ্চর্য, মাসীমা; অণু তো আমার চেয়ে মোটে আট বছরের ছোট, আর আমার বয়স হল—চব্বিশ।’ বলিয়া উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়াই ঘর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

অণুর মুখখানা পলকের মধ্যে কর্ণমূল পর্যন্ত রাঙ্গা হইয়া উঠিল। সে তাহার মায়ের মুখের দিকে তাকাইতে পারিল না; দ্রুত উঠিয়া ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া নিদাঘ সূর্যকে বলিল, ‘ওহে, তোমাকে আজ একটা ফটো তুলতে হবে।’

সূর্য একটা আরাম-কেদারায় শুইয়া কাগজ পড়িতেছিল, কাগজখানি মুড়িয়া রাখিয়া বলিল, ‘সে কি রকম, কার ফটো তুলতে হবে?’

নিদাঘ বলিল, ‘কুমারী অণিমা বসুর, আমার একটি বাল্যকালের বন্ধু।’

স্ত্রীলোকের ফটো তুলিতে হইবে শুনিয়া সূর্য অত্যন্ত বিব্রত হইয়া উঠিল—‘আরে না না, আমি যে ফটো তুলতে জানিনে।’

নিদাঘ নিজের দামী ক্যামেরা আলমারি হইতে বাহির করিতে করিতে বলিল, ‘শিখে নেবে। আজ সমস্ত দিন তোমাকে তালিম দেব।’

করুণকণ্ঠে সূর্য বলিল, ‘কিন্তু আমি কেন? তুমি নিজে তুললেই তো পার।’

‘তা পারি, কিন্তু তুমি তুললেই বা ক্ষতি কি? তোমার ব্রহ্মচর্য-ব্রত ভঙ্গ হবার কোনও ভয় আছে কি?’

সূর্য লজ্জিতভাবে বলিল, ‘তা নয়। তবে আমি একেবারে অপরিচিত—’

‘সেই জন্যেই তো পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, পরে কোনও দিন হয়তো—’ বলিয়া নিদাঘ মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।

এই পরিচয় করাইয়া দিবার আবশ্যকতা যদিও সূর্য কিছুই বুঝিল না, তবু উপরোধে পড়িয়া শেষে কুণ্ঠিতভাবে রাজি হইল।

সমস্ত দিন ক্যামেরা নামক যন্ত্রটির কলকব্জার জটিল তত্ত্ব সূর্যকে বুঝাইয়া দিয়া বৈকালে যথাসময়ে উভয়ে সতীকুমারবাবুর বাড়ি উপস্থিত হইল। বৈঠকখানায় গিয়া সতীকুমারবাবুর সহিত সূর্যের পরিচয় করাইয়া দিয়া নিদাঘ বলিল, ‘আজ অণুর ফটো তোলানো হবে। ইনি তুলবেন।’

সতীকুমারবাবু লোকটি বড়ই ভালমানুষ এবং সংসার সম্বন্ধে ইঁহার অভিজ্ঞতা অতিশয় সঙ্কীর্ণ। তাঁহাকে কোনও বিষয়ে রাজি করাইতে কাহাকেও বেগ পাইতে হয় না। তিনি খুব খুশি হইয়া বলিলেন, ‘ঠিক ঠিক। আমিও ক’দিন ধরে এই কথাই ভাবছিলুম। ফটো তোলানো দরকার। আর কি, বয়স তত কম হল না, এবার বিয়ে-থা দিতে হবে তো।’

কয়দিন ধরিয়া ভাবা দূরে থাকুক, এক মুহুর্তে পূর্বে পর্যন্ত এ সম্ভাবনা তাঁহার কল্পনার ত্রিসীমায় আসে নাই। অন্য কেহ হইলে নিদাঘ তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করিত; কিন্তু সতীকুমারবাবুর সম্বন্ধে তাহার কেমন একটা দুর্বলতা ছিল। সে তাঁহার এই অমায়িক মিথ্যা কথাগুলার কিছুতেই প্রতিবাদ করিতে পারিত না। সে মনে মনে হাসিয়া বলিল, ‘হাঁ, সেই কথাই তো আজ মাসীমাকে বললুম। বিয়ে যখন দিতেই হবে, তখন উদ্যোগ করা চাই তো।’ বলিয়া সূর্যকে তাঁহার কাছে বসাইয়া বাড়ির ভিতর তত্ত্বাবধান করিতে গেল।

ফটো তোলা শেষ করিয়া বাড়ি ফিরিবার মুখে নিদাঘ বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কেমন দেখলে?’

সূর্য একটু অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল, চমকাইয়া উঠিল। একটু ইতস্তত করিয়া লজ্জিতমুখে বলিল, ‘বেশ, ভারি চমৎকার!’ শেষাংশটা সে এক রকম ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করিয়াই বলিয়া ফেলিল।

নিদাঘ জানিত, সূর্য অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের লোক। বিশেষত স্ত্রীলোক সম্বন্ধে সে কোনও কথাই বলিতে পারে না। তাই তাহাকে আর বেশী প্রশ্ন করিল না। কিন্তু এই ক্ষুদ্র প্রশংসাটুকু সে যে খুব অকপটভাবেই করিয়াছে, তাহা বুঝিয়া নিদাঘ হাসিতে লাগিল।

পরদিন সন্ধ্যার গাড়িতে সূর্য পাটনা ফিরিয়া গেল। তাহাকে হাওড়া পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া নিদাঘ ফিরিবার পথে সতীকুমারবাবু বাড়িতে গিয়া বসিল। এ দুই দিন যে কথাটা তাহার মনের মধ্যে ঘুরিতেছিল, তাহারই উপক্রমণিকাস্বরূপ বলিল, ‘সূর্যকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে এলুম।’

সৌদামিনী মাদুর পাতিয়া বসিয়া বালিশের ওয়াড় শেলাই করিতেছিলেন, মুখ না তুলিয়াই বলিলেন, ‘ছেলেটি চলে গেল বুঝি? দিব্বি দেখতে কিন্তু। এই তো ক’দিন ছিল। কি করে ও, নিদাঘ?’ তাঁহার মনটা এবেলা বেশ ভাল ছিল।

‘পাটনায় প্রফেসারী করে।’

‘কি জাত?’

‘কায়স্থ। দত্ত।’

সৌদামিনীর শেলাই বন্ধ হইল। মুখ তুলিয়া বলিলেন, ‘কায়েত? পড়াশুনোয় কেমন?’

‘এম. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল।

সৌদামিনী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, ‘ও মা, এত ভাল ছেলে! কিন্তু এদিকে তো খুব বিনয়ী নম্র—’ সৌদামিনী ভাবিতে লাগিলেন।

তনু ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল, ‘নিদাঘদা, দিদির ছবি কেমন হয়েছে, দেখাও না।’

নিদাঘ হাসিয়া বলিল, ‘ছাই হয়েছে। “চিত্রে নিবেশ্য পরিকল্পিতসত্বযোগা রূপোচ্চয়েন মনসা বিধিনা কৃতানু”—’

সৌদামিনী মাঝখান হইতে প্রশ্ন করিলেন, ‘বিয়ে হয়েছে?’

‘কার? ওঃ—না, সে বিয়ে করবে না।—যার ফটো, তাকে ডেকে আন, তারপর দেখাচ্ছি।’

কবিতা বলার জন্য মুখ ভার করিয়া তনু চলিয়া গেল এবং অল্পক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘দিদি পড়ছে, এখন আসতে পারবে না।’

‘আচ্ছা, চল তবে আমিই যাচ্ছি—’

নিদাঘ অণুর পড়িবার ঘরে উপস্থিত হইল।

অণু গম্ভীরভাবে পড়া মুখস্থ করিতেছিল। নিদাঘ ফটোখানা বুক-পকেট হইতে বাহির করিয়া টেবলের উপর ফেলিয়া দিয়া বলিল, ‘এই নাও।’

অণু ফটোর দিকে দৃষ্টিপাত করিল না, পড়া মুখস্থ করিতে লাগিল।

‘এখনও রাগ পড়েনি দেখছি’ বলিয়া নিদাঘ অণুর সম্মুখস্থ চেয়ারটায় বসিল। তনু উৎসুকভাবে দিদির অনাদৃত ছবিটার পানে হাত বাড়াইতেছিল। নিদাঘ তাহাকে প্রশ্ন করিল, ‘তোর দিদি আজকাল দুপুরবেলা ঘুমোয় রে, তনু?’

‘না, ঘুমোয় না। তুমি বকে অবধি—’ দিদির চোখে ভ্রূকুটি দেখিয়া তনু সহসা থামিয়া গেল।

নিদাঘ খুশি হইয়া বলিল, ‘কথাটা যখন শোনাই হয়েছে, তখন আর রাগ কেন? এস—ভাব।’ বলিয়া যেন শেকহ্যান্ড করিবার জন্য ডান হাতখানা বাড়াইয়া দিল।

অণু হাসিয়া ফেলিল। ভাব হইয়া গেল।

কিছুক্ষণ পরে নিদাঘ বলিল, ‘খুব তো লেখাপড়া হচ্ছে! কিন্তু এ রকমটা আর বেশী দিন চলবে না।’

‘কেন?’

নিদাঘ ফটোখানা তুলিয়া লইয়া নিবিষ্টমনে দেখিতে দেখিতে বলিল, ‘কেন?—অম্‌নি।’ বলিয়া একটু একটু হাসিতে লাগিল।

‘হাসছ কেন?’

‘অম্‌নি।’

‘যাও’ বলিয়া অণু আরক্তিম মুখখানা নীচু করিয়া ফেলিল। নিদাঘ তাহার মুখের উপর দৃষ্টি স্থির করিয়া কহিল, ‘বুঝতে পেরেছ তো? তবে ‘যাও’ কেন! ভাবতে দোষ নেই, বল্‌লেই বুঝি দোষ?’

মুখ নীচু করিয়াই অণু বলিল, ‘আমি বুঝি ভাবি?’

‘ভাবো না?’

‘যাও!’

তনু বলিল, ‘দিদি আজাকাল খুব ভাবে, নিদাঘদা। পড়তে পড়তে ভাবে, খেলতা খেলতে ভাবে—’

অণু তাহাকে ধমক দিয়া বলিল, ‘তুই থাম। ভারি গিন্নি হয়েছেন। নিদাঘদা, আমার তর্জমার খাতাটা দেখে দাও না।’ বলিয়া তাড়াতাড়ি একখানা খাতা আগাইয়া দিল।

হাস্যমুখে খাতাটা তুলিয়া লইয়া নিদাঘ দেখিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে তাহার সহজ কন্ঠস্বর উত্তরোত্তর এক এক পর্দা চড়িতে লাগিল—‘এর নাম ইংরিজী লেখা!—কি লিখেছ মাথামুন্ডু!—লেখবার সময় মন কোথায় ছিল—বাঃ, নিজের ব্যাকরণ তৈরি করা হয়েছে যে—এ কথাটি কি? কি চমৎকার হাতের লেখাই হচ্ছে দিন দিন—পীজন্‌ বানান এই—’ অপরাধী শব্দটাকে পেন্সিলের একটা নিষ্টুর খোঁচা দিয়া নিদাঘ ক্রুদ্ধ হস্ত-সঞ্চালনে খাতাটা টান মারিয়া দূরে ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

‘দরকার নেই তোমার পড়াশুনো করে। ফেলে দাও বইগুলো। যার পড়াশুনো করবার ইচ্ছে নেই, তাকে মিছিমিছি পড়িয়ে লাভ কি?’

বকিতে বকিতে নিদাঘ চলিয়া গেল।

অণু এতক্ষণ নীরবে তিরস্কার শুনিতেছিল। নিদাঘ চলিয়া গেলে সে হঠাৎ টেবলের উপর একখানা বইয়ের পাতার মধ্যে মুখ গুঁজিয়া শুইয়া পড়িল; তাহার শরীর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল।

তনু বেচারী এই দৃশ্যের সাক্ষিস্বরূপ দাঁড়াইয়া দিদির উপর এই তিরস্কার শুনিতেছিল। সে অণুর পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। ম্লানমুখে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, ‘দিদি, কাঁদছ?’

অণু মুখ তুলিল। তখন তনু অবাক হইয়া দেখিল, কান্না নয়, হাসির অদম্য উচ্ছ্বাস চাপিবার চেষ্টায় দিদির গৌরবর্ণ সুন্দর মুখখানি একেবারে রাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছে।

এই ঘটনার পর প্রায় দিন পাঁচেক পরে নিদাঘ অণুদের বাড়ি মাথা গলাইবামাত্র সৌদামিনী তাহাকে কাছে ডাকিয়া বসাইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আচ্ছা নিদাঘ, তোমার সঙ্গে তো তোমার ঐ বন্ধুটির অনেক দিনের জানাশোনা—’

‘হ্যাঁ, প্রায় দশ বছরের। স্কুল থেকেই একসঙ্গে পড়েছি।’

‘তাহলে ওর বিষয় তুমি সমস্তই জানো—’

‘সমস্তই। ওর স্বভাব-চরিত্র খুবই ভাল—তা না হলে আমার বন্ধু হতে পারত না। লেখাপড়ার কথা তো বলেইছি।’

‘বাপ-মা আছেন?’

‘না।’

‘তাহলে ও যা উপার্জন করে, তাতেই ওর বেশ চলে যায়?’

‘স্বচ্ছন্দে। প্রফেসারী করে ও সখের জন্যে। ওর বাপ যা রেখে গেছেন, তাতে ওর তিন পুরুষের আরামে কেটে যাবে।’

সৌদামিনী উত্তেজনা দমন করিয়া ধীরে ধীরে কহিলেন, ‘তাহলে অণুর জন্যে ওকে একবার চেষ্টা করে দেখলে হয় না? ছেলেটি সব বিষয়েই যখন সুপাত্র—তোমার বন্ধু—’

নিদাঘ শান্তস্বরে বলিল, ‘সূর্য বিয়ে করবে না, মাসীমা।’

সৌদামিনী ঈষৎ রুক্ষস্বরে কহিলেন, ‘ছেলেমানুষ, টাকার অভাব নেই, বিয়ে করবে না, এ কি আবার একটা কথা হল! চিরকাল আইবুড় থাকতে গেলই বা কোন্‌ দুঃখে? এমন নয় যে, স্ত্রীকে খেতে দিতে পারবে না। আর তোমরাও তো বন্ধুবান্ধব আছ, বুঝিয়ে বললে কি বোঝে না?’

তাঁহার ঝাঁজ দেখিয়া নিদাঘ একটু হাসিয়া বলিল, ‘বোঝাতে আমি ত্রুটি করিনি, মাসীমা। বন্ধু তো আমারই।’

সৌদামিনী নরম হইয়া বলিলেন, ‘তবু আর একবার চেষ্টা করে দেখ না, বাবা। এ তো তোমারই করা উচিত, নিদাঘ। এক দিকে অণু আর এক দিকে তোমার বন্ধু। দু’জনের বিয়ে হলে কি চমৎকারই হবে, একবার ভেবে দেখতো।’

কল্পনাটা কতদূর প্রীতিপ্রদ হইল, তাহা নিদাঘের মুখের দিকে ভাল করিয়া তাকাইলেই সৌদামিনী হয়তো দেখিতে পাইতেন; কিন্তু সে দিকে তাঁহার দৃষ্টি ছিল না। নিদাঘ উঠিয়া দাঁড়াইল; বলিল, ‘বেশ, আপনি যখন বল্‌ছেন, তখন আমি আর একবার চেষ্টা করে দেখব।’

বলিয়া ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

হরিধন মিত্রের পরিবারের সহিত সতীকুমারবাবুদের পরিচয় আজিকার নহে। পনের বৎসর পূর্বে সতীকুমার যখন হরিধনবাবুর বাটীর পাশে জমি ক্রয় করিয়া বাসস্থান প্রস্তুত করিতে নিযুক্ত হন, তখন ধনী প্রতিবেশীর নিকট অনেক সাহায্য পাইয়াছিলেন। এই সহায়তার ফলে সতীকুমার হরিধনবাবুর নিকট গভীরভাবে কৃতজ্ঞ হইয়াছিলেন। ক্রমে এই কৃতজ্ঞতা উভয় পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্বে পরিণত হইয়াছিল।

সৌদামিনীর সহিত নিদাঘের মাতার মনের মিল কিন্তু ততটা হইতে পায় নাই—যতটা উভয় পরিবারের কর্তাদিগের মধ্যে হইয়াছিল। বোধ হয়, সৌদামিনী অপরার অতুল ঐশ্বর্যের জন্য মনে মনে তাহাকে একটু ঈর্ষা করিতেন। তাছাড়া মিত্র-পরিবারের বংশানুগত মূর্খতার জন্য তিনি তাহাদিগকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে যে না দেখিতেন, এমন বলা যায় না। শিক্ষা-বিভাগের উচ্চ কর্মচারীর গৃহিণীর মনে শিক্ষার অভিমান একটু বেশী পরিমাণেই থাকিবার কথা।

অণুর সহিত নিদাঘের বিবাহ হইতে পারে, এ সম্ভাবনার কথা সৌদামিনী কখনও ভাবেন নাই, এমন নহে, কিন্তু এ বিষয়ে তাঁহার মনে দুই একটি ক্ষুদ্র বাধা ছিল। প্রথমত নিদাঘ তাঁহার মতে তেমন সুশিক্ষিত নহে। বাড়িতে বসিয়া পড়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ উপাধি অর্জন করা এক জিনিস নহে। অতএব বিশ্ববিদ্যালয় যাহাকে উচ্চ উপাধি দেয় নাই, এমন পাত্রের হাতে কন্যা সম্প্রদান করিতে তাঁহার মাতৃহৃদয় যে ব্যথিত হইয়া উঠিবে, ইহাতে আর বিচিত্র কি? দ্বিতীয়ত অণুকে নিদাঘের মা’র পুত্রবধূ হইতে হইবে, এটাও কি জানি কেন তাঁহার কাছে বিশেষ প্রীতিপ্নদ বোধ হইত না।

কিন্তু মেয়ের ষোল বছর বয়স পর্যন্ত কেন যে তিনি তাহার বিবাহ সম্বন্ধে বিশেষ কোনও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন নাই, তাহাও বলা কঠিন। বোধ করি, তিনি অণুর বিবাহের ভারটা ভগবানের হাতেই ছাড়িয়া দিয়াছিলেন; মনে মনে ভাবিয়াছিলেন যে, অণুর অদৃষ্টে যদি নিদাঘই থাকে, তবে কেহই তাহা খণ্ডন করিতে পারিবে না। এরূপ ভাবার একটি সূক্ষ্ম কারণ এই যে, নিদাঘের বার্ষিক আয় যে আশি হাজার টাকার এক পয়সা কম নহে, তাহাও সৌদামিনীর অবিদিত ছিল না।

এমন সময় সূর্য আসিয়া দেখা দিল। সূর্য দেখিতে শুনিতে খুবই সুন্দর, বিদ্বান, আর্থিক অবস্থাও ভাল। সৌদামিনী সেই দিকে ঝুঁকিয়া পড়িলেন। ভগবানের হাত ছাড়াইয়া নিজের হাতে হাল ধরিলেন। ইহাতে ভগবান স্বস্তি বোধ করিলেন কি বিমর্ষ হইলেন, মানুষের সসীম দৃষ্টিতে তাহা ধরা পড়িল না এবং পরিষ্কার আকাশের মাঝখানে কোথা হইতে যে একখণ্ড কালো মেঘ আসিয়া পড়িল, তাহাও এক অন্তর্যামী ছাড়া সকলের অগোচরে রহিয়া গেল।

বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া নিদাঘ অনেকক্ষণ নিজের ঘরে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। শেষে সূর্যকে এইরূপ পত্র লিখিল,—

‘বন্ধু,

তোমার ব্রহ্মচর্যরূপ কঠোর তপস্যায় স্বর্গে দেবতারা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উঠেছেন। শীঘ্রই তোমার বিরুদ্ধে এক ঝাঁক অপ্সরা স্বর্গ থেকে রওনা হবে। অতএব আমার উপদেশ, এখনই তোমার এ বিষয়ে একটু সতর্ক হওয়া দরকার। দেবতাদের বেশী চটানো ভাল নয়। মমার্থ:—শীঘ্র বিয়ে করে ফেল। তোমার জন্য একটি ভাল পাত্রী পাওয়া গেছে। আমার অনেক দিনের বন্ধু—নাম অণিমা। তুমি যার ফটো তুলেছিলে।

তোমার অভিমত অবিলম্বে জানাবে। ইতি।’

চিঠিখানা নিদাঘ হাজার চেষ্টা করিয়াও আর বড় করিতে পারিল না। যে সকল যুক্তিতর্কের দ্বারা পূর্বে সে অনেকবার সূর্যকে পরাস্ত করিয়াছে, তাহার একটাও চিঠির মধ্যে স্থান পাইল না।

আট দিন পরে সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধের নীরব ক্ষতচিহ্ন বক্ষে লইয়া চিঠির জবাব আসিল। চিঠিখানা আদ্যোপান্ত পড়িয়া নিদাঘ গুম হইয়া বসিয়া রহিল। অনেকখানি ভণিতা করিয়া শেষে সূর্য লিখিয়াছে—মানুষের জীবন বেশীর ভাগই দুঃখময়, তাহার মধ্যে যতটুকু সুখ পাওয়া যায়, মানুষের বরণ করিয়া লওয়া কর্তব্য,—অবিবাহিত জীবন এক হিসাবে ভাল, কিন্তু পরিপূর্ণ নয়,—সে এত দিন নিজের ভুল বুঝিতে পারে নাই, অতএব—।

পত্রের শেষে পুনশ্চ করিয়া লেখা ছিল যে, নিদাঘ কেন তাহাকে এক অপরিচিতা কুমারীর ফটো তুলিবার জন্য লইয়া গিয়াছিল, তাহা এখন সে বুঝিতে পারিয়াছে।

নিদাঘ ভাবিতে লাগিল,—ভণ্ড! মিথ্যেবাদী! আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করিব প্রতিজ্ঞা করিয়া—উঃ, এমন লোকের সহিত সে বন্ধুত্ব করিয়াছিল। এই দুর্বল স্ত্রীলুব্ধ লোকটাকে সে এত দিন। পরমাত্মীয় মনে করিতেছিল। ধিক্‌!

নিদাঘ অণুকে ভালবাসিত। ছেলেমানুষী ভালবাসা নহে, নিজের সহচরীর মতো—প্রেয়সীর মতো ভালবাসিত। কবে যে অণুর প্রতি এই ভাবটা প্রথম জাগিয়াছিল, তাহাও তাহার বেশ মনে আছে। বছর তিনেক আগে ঠাণ্ডা লাগাইয়া অণু একদিন অসুখ করিয়া বসে। সেই অসুখের খবর প্রথম শুনিয়া নিদাঘ বুঝিয়াছিল, অণু তাহার জীবনের কতখানি। সেইদিন হইতে সে স্থির জানিয়াছিল যে, অণু না হইলে তাহার চলিবে না এবং একান্ত আত্মবিশ্বাসে সে একবার ভাবিতেও পারে নাই যে, কোনও কারণেই অণু তাহার দুষ্প্রাপ্য হইতে পারে। এইভাবে তিন বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। নিদাঘ মনে ভাবিয়াছে—আর কিছু দিন যাক, আর একটু বড় হোক—লেখাপড়া শিখুক; —কিন্তু মনের কথা ইঙ্গিতেও কাহাকে জানিতে দেয় নাই।

কিন্তু শেষে কি সত্যই তাহাকে আশা ছাড়িতে হইবে? নিদাঘ কল্পনানেত্রে অণু-হীন ভবিষ্যৎ জীবনটা দেখিতে চেষ্টা করিল। ব্যর্থ! ব্যর্থ! কোথাও একটু রস নাই, স্বাদ নাই, গন্ধ নাই। আগাগোড়া একটা বজ্রাহত বিদীর্ণ-বক্ষ বৃক্ষের মতো নিষ্প্রাণ—অভিশপ্ত।

কতক্ষণ যে এইভাবে বন্ধুর চিঠি মুঠার মধ্যে লইয়া চেয়ারে বসিয়া কাটিয়া গিয়াছিল, তাহা নিদাঘ কিছুই জানিতে পারে নাই। সন্ধ্যার পর মা ঘরে ঢুকিয়া তাহাকে দেখিতে পাইয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ রে, ঘরে চুপটি করে বসে আছিস যে, বেড়াতে যাসনি?’

‘ওঃ,’ বলিয়া নিদাঘ চেয়ার ছাড়িয়া দাঁড়াইল। তাই তো! এ যে রাত্রি হইয়া গিয়াছে।

মা ইলেকট্রিক বাতি জ্বালিয়া ছেলের মুখ দেখিয়া শঙ্কিত কণ্ঠে কহিলেন, ‘অসুখ করেছে না কি, নিদাঘ! মুখ ভারি শুকনো দেখাচ্ছে।’

‘মনটা ভাল নেই’ বলিয়া নিদাঘ তাড়াতাড়ি অন্যত্র চলিয়া গেল।

রাত্রিতে বিছানায় শুইয়া সে কথাটা অপেক্ষাকৃত ধীরভাবে ভাবিতে চেষ্টা করিল। সে অণুকে ভালবাসে। সূর্যও বোধ হয় তাহাকে দেখিয়া—হ্যাঁ, বোধ হয় কেন—নিশ্চয়। তাহা ছাড়া আর কি হইতে পারে? সূর্য তাহার বাল্যকালের বন্ধু—তাহার আপনার বলিবার পৃথিবীতে কেহ নাই। নিদাঘের মা আছেন, বাপ আছেন। এক্ষেত্রে—কিন্তু তবু অন্যায়! অন্যায়! ছেলেবেলা হইতে অণু তাহারই—আর কাহারও অণুর উপর দাবি নাই। আবার সূর্য সকল বিষয়ে সুপাত্র—নিদাঘের তুলনায় সুপাত্র;—তাহার রূপ আছে, বিদ্যা আছে, অর্থ আছে; কন্যার এবং কন্যার পিতা-মাতার যাহা কিছু প্রার্থনীয়, সমস্তই তাহার আছে। অণু যদি তাহার হাতে পড়িয়া সুখী হয়, তাহা হইলে নিদাঘের কি কর্তব্য নহে—

স্বার্থত্যাগ? হ্যাঁ, যাহাকে ভালবাসে, তাহার জন্য এই স্বার্থত্যাগ সে করিতে পারিবে না? যদি না পারে, তবে তাহার ভালবাসার মূল্য কি? এবং কেই বা সে মূল্য দিবে?

সৌদামিনী ঠিকই বলিয়াছিলেন, এক দিকে অণু আর এক দিকে সূর্য—ইহাদের মিলনের অপেক্ষা সুখের আর কি হইতে পারে? কিন্তু—নিদাঘ চিন্তা করিতে লাগিল।

সে কি নিজে পায়ে নিজের কুঠারাঘাত করে নাই? কি দরকার ছিল অণুকে সূর্যের সম্মুখে বাহির করিবার? সূর্য যদি ইহাকে ঘটকালির চেষ্টা ভাবিয়া থাকে তো তাহাকেই বা দোষ দেওয়া যায় কিরূপে? দোষ তো সম্পূর্ণ তাহার নিজের। কেন সে নির্বোধের মতো নিজের দুর্ভাগ্যকে এমনভাবে টানিয়া আনিল? এখন নির্বুদ্ধিতার দণ্ডভোগ তাহাকে করিতেই হইবে।

বিছানার উপর সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়া নিদাঘ মনে মনে বলিল, ‘দণ্ডভোগ আমাকে করিতেই হইবে। সুতরাং আর ভাবনার কিছু নাই।’ বলিয়া শুইয়া পড়িয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিল; কিন্তু নিদ্রা সে রাত্রিতে তাহার চক্ষে আসিল না।

পরদিন প্রভাতে নিদ্রাহীন রজনীর সমস্ত গ্লানি মুখে চোখে বহন করিয়া নিদাঘ চিঠি হাতে সৌদামিনীর নিকট উপস্থিত হইল। হাসিয়া বলিল, ‘মাসীমা, আপনিই ঠিক বুঝেছিলেন। দশ বৎসরের বন্ধুত্বের ওপর নির্ভর করেও আজকাল আর কোনও কথা বলা চলে না। এই নিন।’ বলিয়া চিঠিখানা তাঁহার হাতে দিল।

চিঠি পড়িয়া সৌদামিনী সগর্বে একমুখ হাসিয়া বলিলেন, ‘বলেছিলুম কি না আমি? আমরা যেমন মানুষের মন বুঝতে পারি, তোমরা কি তা পার? হাজার হোক, আমরা মেয়েমানুষ আর তোমরা পুরুষমানুষ!’

এ কথা নিদাঘ অস্বীকার করিতে পারিল না। তাঁহার মন বুঝিবার শক্তি যে অসাধারণ, ইহা সে বারবার ঘাড় নাড়িয়া প্রকাশ করিতে করিতে গমনোদ্যত হইল।

তনু উপরতলা হইতে নিদাঘের গলা শুনিতে পাইয়াছিল, নীচে আসিয়া বলিল, ‘নিদাঘদা, একবার ওপরে এসো না, দিদি ডাকছে।’

‘দিদি ডাকছে!’ নিদাঘ স্তম্ভিত হইয়া গেল। বিদ্যুতের শিখার মতো তাহার পা হইতে মাথা পর্যন্ত রাগে জ্বলিয়া উঠিল। অণুর যে এই অসম্ভব স্পর্ধা হইতে পারে, তাহা যেন সে কল্পনা করিতেই পারিল না। অত্যন্ত রুক্ষস্বরে কহিল, ‘বল গিয়ে, আমি যেতে পারব না, আমার অন্য কাজ আছে।’ তারপর সৌদামিনীর দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘এখন থেকে বোধ হয়, আমার মধ্যস্থতা আর দরকার হবে না, ভালও দেখাবে না। সূর্যর ঠিকানা মেসোমশায়কে দিয়ে যাচ্ছি, বাকিটা আপনারাই করে নেবেন।’ বলিয়া সে চলিয়া গেল।

নিদাঘের এই অপ্রত্যাশিত রূঢ়তায় তনু প্রায় কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া, নিদাঘ যে পথে বাহির হইয়া গেল, সেই দিকে একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দুপ দুপ করিয়া সে উপরে চলিয়া গেল।

বিবাহের সম্বন্ধ যে এত শীঘ্ৰ স্থির হইয়া যাইতে পারে, তাহা নিদাঘের জানা ছিল না। উল্লিখিত ঘটনার দিনদশেক পরে নিদাঘ সূর্যের একখানা পত্র পাইল। চিঠিখানা আগাগোড়া কৃতজ্ঞতাপূর্ণ। সূর্য লিখিয়াছে যে, বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে। দিন এখনও ঠিক হয় নাই—শীঘ্রই হইবে। দাম্পত্যজীবনের অপরিসীম সুখ যাহা সে শীঘ্রই লাভ করিবে, তাহার জন্য সমস্ত প্রশংসা নিদাঘেরই প্রাপ্য। নিদাঘই যে তাহার একমাত্র প্রকৃত বন্ধু, তাহা সে চিরদিনই জানিত, সে বন্ধুত্ব যে এতখানি অমৃতময় হইয়া উঠিবে, তাহা সে কল্পনাও করে নাই। কিন্তু বন্ধুর চরম সুখের বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াই নিদাঘের ক্ষান্ত হওয়া উচিত নহে, সে নিজেও যাহাতে ঐ সুখ অচিরাৎ লাভ করে, তাহার উপায় করা কর্তব্য। সূর্য নিজেও এ বিষয়ে নিশ্চেষ্ট নাই। দানের পরিবর্তে প্রতিদান সে যেমন করিয়া হউক শীঘ্রই দিবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

কঠিন হাসিয়া নিদাঘ চিঠিখানা একপাশে সরাইয়া রাখিল।

হঠাৎ তাহার মনে হইল যে, এই বিবাহ উপলক্ষে অণুকে তাহার অভিনন্দন জানানো উচিত—বুকে আগুন জ্বালিয়া বসিয়া থাকিলে চলিবে না। এই ক্রূর আত্মপরিহাসের তিক্ত রসটা বিন্দু বিন্দু করিয়া পান করিয়া সে যেন উন্মত্ত হইয়া উঠিল। সে যে কত খুশি হইয়াছে, তাহা দেখাইবার জন্য কি কি রসিকতা করিবে, তাহারই একটা চিত্র মনে উদিত হওয়ায় সে আপনা আপনি হাসিয়া উঠিল। ভাবিল, মানুষ কি নির্বোধ, দুঃখকে উপভোগ করিতে জানে না।

কয়দিন যাবৎ শরীরের বিশেষ যত্ন লওয়া হয় নাই। আজ বেশ ভাল করিয়া স্নান করিয়া, চুল আঁচড়াইয়া, একটা চাদর লইয়া নিদাঘ সতীকুমারবাবুর বাড়ি গেল এবং নীচে অপেক্ষা না করিয়া একেবারে উপরে উঠিয়া গেল। উপরে উঠিয়া ‘তনু’ ‘তনু’ করিয়া দুইবার ডাকিল; কিন্তু তনুর সাড়া পাওয়া গেল না। তনু উপরে নাই মনে করিয়া সে প্রথমে একটু ইতস্তত করিয়া অণুর ঘরে প্রবেশ করিল।

অণু বিছানার উপর চোখ বুজিয়া শুইয়া ছিল। তাহার চুলগুলা রুক্ষ এবং মুখখানা অত্যন্ত নিষ্প্রভ। মাথার কাছে টুলের উপর একটি অডিকোলনের শিশি ও একটা কাচের পেয়ালা।

নিদাঘ দোরগোড়াতেই দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিল। এ কি! অণুর অসুখ করিয়াছে!

জুতার শব্দে চোখ মেলিয়া, নিদাঘকে দেখিয়া অণু বিছানার উপর উঠিয়া বসিল।

নিতান্ত কুণ্ঠিতভাবে নিদাঘ বলিল, ‘তোমার অসুখ করেছে, কৈ, আমি তো কিছু জানতুম না।’

ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাহার দিকে তাকাইয়া অণু বলিল, ‘সেদিন আমি তোমাকে ডেকে পাঠালুম, তুমি এলে না কেন?’

নিদাঘ আরক্তমুখে বলিল, ‘তোমার যে অসুখ, তা তো আমি—বড্ড জ্বর হয়েছে না কি?’ বলিয়া তাহার কপালের দিকে হাত বাড়াইয়াই সে আবার হাতখানা টানিয়া লইল।

অণু বলিল, ‘জ্বর হয়নি, বড্ড মাথা ধরেছে। ক’দিন থেকে সমানে যন্ত্রণা হচ্ছে—’

নিদাঘ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘যাক্‌, কিন্তু ওষুধ-বিষুধ খাওনি কেন? শুধু অডিকলোনে কি মাথা-ধরা যায়? মেসোমশায়কে একবার বল্লেই তো—’

অণু বিরক্ত হইয়া বলিল, ‘বাবা আবার কবে আমাদের ওষুধ দেন, নিদাঘদা? তুমিই তো চিরকাল দাও।’

অপরাধের ভারে নিদাঘ যেন ভাঙিয়া পড়িতেছিল। হোমিওপ্যাথিক বাক্সটার জন্য সে একবার ঘরময় ওলট-পালট করিয়া বেড়াইল, কিন্তু বাক্সটা কোথাও পাওয়া গেল না। অবশেষে হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিয়া হাসিবার একটা অসম্পূর্ণ চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘ওষুধের বাক্সটা খুঁজে পাচ্ছি না। যাক গে, ও ওষুধে আর কি হবে? শিগগির তোমার মাথাধরার একটা খুব ভাল ওষুধ আসছে।’

অণু কিছুই বুঝে নাই, এমনই ভাবে বলিল, ‘কোথা থেকে? কি ওষুধ?’

নিদাঘ গম্ভীরভাবে বলিল, ‘পাটনা থেকে, শ্রীমান সূর্যকান্ত।’

অণু চুপ করিয়া রহিল। নিদাঘ বলিল, ‘চুপ করলে কেন? ভাল ওষুধ নয়?’

শ্রান্তকণ্ঠে অণু বলিল, ‘তোমার কাছে কি অপরাধ করেছি, নিদাঘদা, যে, তুমি আমার সঙ্গে শত্রুতা করছ?’

নিদাঘ সহসা চমকিয়া উঠিল। এ কি কথা অণুর মুখে? সে তাহার প্রতি শত্রুতা করিতেছে!

কয়েক মুহূর্ত নিদাঘ বিস্ময়স্তম্ভিতভাবে যোড়শী তরুণীর ম্লান মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

বিবাহের প্রসঙ্গ লইয়া সকলেই অগ্রসর হইয়াছে; কিন্তু একপক্ষের যে প্রধান উপলক্ষ, সেই অণুর বিবাহ-বিষয়ে কোনও মতামত থাকিতে পারে, এ চিন্তা তো তাহাদের কাহারও মনে উদিত হয় নাই! অণু এখন জ্ঞানহীন বালিকা নহে। সে প্রাপ্তযৌবনা; শিক্ষাপ্রাপ্তা নারী। তাহার হৃদয় লইয়া—ভবিষ্যৎ লইয়া ছিনিমিনি খেলিবার অধিকার কাহারও আছে কি?

ক্ষুব্ধকণ্ঠে নিদাঘ বলিল, ‘আমি তোমার শত্রু, অণু? তোমার মঙ্গলের জন্য—’

তাহার সুগৌর বাহুলতা আন্দোলিত করিয়া মধ্যপথে বাধা দিয়া অণু বলিল, ‘তোমার পায় পড়ি, নিদাঘদা, ও কথা আর তুলো না।’

তারপর সহসা দীপ্তকণ্ঠে সে বলিয়া উঠিল, ‘হিন্দুর মেয়ের কখনো দু’বার বিয়ে হয়, দেখেছ?’

বজ্রাহতভাবে নিদাঘ দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার চটুল রসনা নির্বাক হইয়া গেল।

শয্যার উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া ঐ যে তরুণী উচ্ছ্বসিত হৃদয়াবেগকে সংবরণ করিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছে, উহার আন্দোলিত দেহের অন্তরালে—হৃদয়ের মধ্যে কি দুর্ভেদ্য রহস্য বিরাজিত, তাহা নির্ণয় করিবার মতো শক্তি মূঢ় নিদাঘের আছে কি?

স্খলিত-কণ্ঠে নিদাঘ বলিল, ‘কি বলছ, অণু? বিয়ে—দু’বার—’

অণু শয্যার উপর উঠিয়া বসিয়া মিনতিপূর্ণ কণ্ঠে বলিল, ‘আমার জন্য তোমাদের কিছু ভাবতে হবে না। আমি মাকেও বলেছি, তোমাকেও বললাম। আমাকে একাই থাকতে দাও।’

বিমূঢ় নিদাঘ কোনও কথাই খুঁজিয়া পাইল না। বিচিত্র এই নারী—বিধাতার সৃষ্ট জগতে নারীর হৃদয় বুঝিবার চেষ্টা করা পুরুষের পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার!

এ পর্যন্ত অণুর ব্যবহারে সে কোনও ইঙ্গিত পায় নাই। আজ যেন সমস্ত ব্যাপারটাই তাহার কাছে সুস্পষ্ট হইয়া গেল। বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা বিপুল আনন্দের শিহরণ তাহার সর্বদেহে লীলায়িত হইয়া উঠিল।

‘নিদাঘদা, মা তোমায় ডাকছেন।’ বলিয়া আনন্দ নির্ঝরের ন্যায় তনু কক্ষমধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িল। তারপর দিদির দিকে চাহিয়া দ্বাদশবর্ষীয়া বালিকা কি বুঝিল, সেই জানে। সে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাহার নিদাঘদার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।

নিদাঘ কম্পিতকণ্ঠে বলিল, ‘অণু, আজ একটা মস্ত ভুলের হাত থেকে আমরা দু’জনেই বেঁচে গেছি। এর জন্য তোমার কাছেই আমাকে চিরঋণী থাকতে হবে।’

তনু সহসা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। তারপর হাসির বিরামস্থলে বলিয়া উঠিল, ‘দিদি, তোমার মাথা-ধরা ছেড়ে গেছে? এই জন্যে বুঝি রোজ জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে আর বলতে, মাথার যন্ত্রণা—’

অণু নিদাঘের স্মিত-সস্নেহ দৃষ্টির সম্মুখে দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিল না, ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া গেল।

তনুর হাসি সহজে থামিল না। সে ছেলেমানুষ হইলেও বুদ্ধিতে ছোট নহে। তারপর নিদাঘের হাত ধরিয়া বলিল, ‘চল, মা তোমাকে এখুনি ডাকছে।’

নিদাঘ নীচে নামিয়া আসিয়া সৌদামিনীর ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘মাসীমা, ভেবে দেখলুম, অণুর এ সম্বন্ধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

মাসীমা বলিলেন, ‘সেই কথা বলব বলে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। তোমার বাবার কাছ থেকে উনি এইমাত্র অনুমতি নিয়ে ফিরে এসেছেন। তোমার মা’রও মত আছে। এখন বাবা, তুমি অণুকে গ্রহণ না করলে—’

নত হইয়া নিদাঘ তাড়াতাড়ি তাঁহার পদধূলি লইয়া বলিল, ‘আশীর্বাদ করুন, মাসীমা।’

২৫ জুলাই ১৯২০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *